#তুমি অন্য কারো সঙ্গে বেঁধো ঘর
পর্ব ৯
পরদিন সকালে নবনী হামিদুর রহমানকে কল দিলো। কিন্তু ফোন বন্ধ পেলো।কয়েকবার চেষ্টা করেও নবনী দেখলো হামিদুর রহমানের ফোনে কল যাচ্ছে না। নবনীর ভীষণ মন খারাপ হলো। যতোই সে নিজেকে হাসিখুশি প্রমাণ করার চেষ্টা করুক,বুকের ভেতর কোথাও একটা দুর্বলতা রয়েই গেছে।
হাশেম আলী পাঞ্জাবিতে আতর লাগিয়ে বের হলেন ঘর থেকে।গতরাতে ও বৃষ্টি হয়েছে।কাঁদায় সব ভরে আছে।বারান্দায় বসে মেয়েকে ডাক দিয়ে বললেন,”কই রে মা?আয় তাড়াতাড়ি। অনেক দূরের পথ তো। বৃষ্টি আসতে পারে।”
নবনীর দুই পা কিছুতেই নাড়াতে পারছে না।কেমন পাথরের মতো লাগছে।আজকে নবনী ডিভোর্সের নোটিশ দিতে যাবে তামিমকে।এজন্য হামিদুর রহমানকে কল দিয়েছিলো।কিন্তু কথা বলতে পারলো না নবনী।
রাবেয়া মেয়ের কাঁধে হাত রেখে বললো,”কার লাইগা কান্দো গো মা?চোক্ষের পানির ম্যালা দাম মা।যার তার লাইগ্যা এই পানি ফালাইতে নাই।কাইন্দা কি হইবো বল?ওরা যেই অমানুষ,ওরা কি তোর কান্দনের মায়া করছে?এই চোক্ষের পানির দাম কি ওরা দিতে জানে?মাইয়া মানুষ তো ফেলনা না রে মা।”
নবনী চোখ মুছে বললো,”একবার বাবার সাথে যদি কথা বলতে পারতাম মা।বুকের ভেতর যে ঝড় বয়ে যাচ্ছে আমার। “
রাবেয়া মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললো,”মাইয়া মাইনসের জীবন রে মা।যেইখানে একদিন থাকে,নিজের বইলা একবার জানে,সেইখানের মায়া ছাড়তে পারে না। সংসার এমন একটা জায়গা,যে জায়গায় শত জ্বালা যন্ত্রণা থাকার পরেও মাইয়া মানুষ তারা মায়া ছাড়তে পারে না। “
হাশেম আলী মেয়ের কান্না দেখে বললো,”আমরা না হয় আরো দুদিন পরে যাই?তুই নিজের মনরে শক্ত কর।”
নবনী চুপ করে রইলো। বারবার ট্রাই করতে লাগলো হামিদুর রহমানকে ফোনে পাবার জন্য।
১ সপ্তাহ পর বৃহস্পতিবার বিকেলে ডাকপিয়ন এলো নবনীদের বাড়িতে।নবনী সাইন করে খামটা নিলো।খাম খুলতেই ভেতর থেকে ডিভোর্সের নোটিশ বের হয়ে এলো। বিনা মেঘে বজ্রপাত হলো যেনো নবনীর মাথায়।বারান্দার চৌকিতে বসে পড়লো নবনী।রাবেয়া নারিকেল পাতা থেকে শলা বের করছেন বসে বসে।উঠান ঝাড় দেওয়ার ঝাড়ুটা ছোট হয়ে গেছে। নতুন ঝাড়ু বানাতে হবে।বাজারে এই একটা ঝাড়ুর যেই দাম।তারচেয়ে নিজের টা নিজেই করে নেয় রাবেয়া।মেয়েকে এভাবে তব্দা মেরে বসে থাকতে দেখে উঠে এলো।
মেয়ের পাশে বসে জিজ্ঞেস করলো,”কি হইছে তোর?কি নিয়া আইছে পিওন?”
নবনী শুকনো হাসি হেসে বললো,”আমার আর কষ্ট করতে হবে না মা।তামিম নিজেই ডিভোর্স নোটিশ পাঠাই দিছে।”
রাবেয়া বেগম কিছুটা অবাক হলেন।তারপর মেয়েরে জড়িয়ে ধরে বললেন,”আর তুই কি-না এই ইতরের জন্য মন উচাটন করস?আমি তো মা, আমি কি বুঝি না ঝুম বৃষ্টির মইধ্যে আমার মাইয়া দূর আকাশের দিকে তাকাইয়া কারে ভাবে?
রাইতে ঘুমের ভান ধইরা শুইয়া কার লাইগা গোপনে চোখ মোছে?সবই বুঝি মা।মায়া বড় খারাপ জিনিস। মন হতচ্ছাড়া অইলো গিয়া আর ঘাড়ত্যাড়া। যেইখানে আঘাত বেশি পায়,তার লাইগাই বেশি কান্দে।
এইবার তুই ভাইবা দেখ মা,তুই তো ওগো অত্যাচারে সংসার ছাড়নের কথা ভাবছস,হেরা কি করছে?হেরা ভাবছে যদি কোনো দিন তুই আবারও হেই বাসায় গিয়া উঠোস,তাই তাড়াতাড়ি কইরা নোটিশ দিয়া দিছে।কোনো রকমের ঝুঁকি নিতে চায় না তোরে নিয়া।আর মন খারাপ করনের দরকার আছে নি তুই নিজেই ভাইবা দ্যাখ!”
নবনী ভেবে দেখলো মা ভুল কিছুই বলে নি। তাহেরা বেগম হয়তো ভেবেছে নবনী ঝোঁকের মাথায় বাসা ছেড়ে চলে গেছে,আবার যদি ফিরে আসে।নবনী ফিরে আসার আগেই ওর আসার পথ বন্ধ করে দেওয়া দরকার। এজন্য তিনি আর দেরি করেন নি।
রাতে হাশেম আলী বাড়ি ফেরার পর নবনী বাবাকে জানালো বিকেলে পিয়ন আসার কথা। হাশেম আলী মুচকি হেসে বললো,”আমার সাত রাজার ধনরে ওরা চিনলো না।মন খারাপ করিস না মা।সবাই কি আর খাঁটি সোনা চিনে?আমাগো চাইতে ওগো বেশি তাড়া দেখছি।ভালো করছস মা তুই চইলা আইসা।তাও তো আমার মাইয়ারে চোখের সামনে দেখতাছি।যেই অমানুষ ওরা,কোন দিন মাইরা বুড়িগঙ্গায় ফালাইয়া দিতো আমরা খোঁজ ও পাইতাম না।”
————–
তাহেরার মন আজকে অত্যধিক ভালো। নিতুর সাথে তিনি ফোনে কথা বলেছেন।মেয়েটা দমে দমে তাকে মা বলে ডাকছে।শুনেই তার মনপ্রাণ জুড়িয়ে গেলো। এতো ভালো চাকরি করে মেয়েটা অথচ কতো সুন্দর করে ভদ্রভাবে কথা বলে।
নিতুকে বউ করে আনার জন্য তাহেরা বেগমের আর তর সইছে না।যতো শীঘ্রই সম্ভব নিতুকে ঘরে তুলতে চান তিনি।এজন্যই নবনীকে ডিভোর্স নোটিশ পাঠিয়ে দিয়েছেন।নবনীদের ইউনিয়ন পরিষদে ও ডিভোর্স নোটিশের এক কপি পাঠানো হয়েছে।এখন ভালোয় ভালোয় ৯০ দিন কেটে গেলেই ডিভোর্স হয়ে যাবে।
অফিসে ঢুকতেই তামিম দেখলো নিতু হাসিমুখে বসে আছে তার কেবিনে।পরনে একটা সবুজ শাড়ি,ম্যাচিং করে রেশমি চুড়ি ও পরেছে।
তামিম থমকে দাঁড়ালো। নবনীর কথা মনে পড়ে গেলো তামিমের।বুকের ভেতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে এলো নবনীর কথা ভাবতেই।বিয়ের পর প্রথম প্রথম তামিমের বেশ ভালো লাগতো নবনীর হাতের চুড়ির শব্দ। রাতে ঘনিষ্ঠ হতে গেলে মাঝেমাঝে নবনীর হাতে তামিমের বলিষ্ঠ হাতের চাপে ভেঙে যেতো চুড়ি,মাঝেমাঝে তো নবনীর হাত ও কেটে যেতো।
কিন্তু তাহেরা বেগম বিরক্ত হয়ে গেলেন নবনীর চুড়ির শব্দে।একদিন তামিমের সামনেই নবনীকে ধমকালেন বস্তির মেয়েদের মতো এসব চুড়ি পরে বলে। সেই সাথে নবনীর পরিবারকে আচ্ছামত ধোলাই করলেন।
তামিম মায়ের কথার উপর কথা বলে না।সেদিন তার খারাপ লাগলেও তাই কিছু বলে নি।উল্টো নবনীকে ধমকে বলেছে এই বাড়িতে এসব কেউ পছন্দ করে না।তামিম নিজেও বিরক্ত। আজ এতোদিন পর তামিমের মনে হলো,সে কি আসলেই বিরক্ত হতো!
মায়ের উপর কথা বলতে না পারার জন্য আজ জীবনে কতো পরিবর্তন এলো।তামিম নবনীকে ডিভোর্স নোটিশ ও পাঠিয়ে দিলো।অথচ তামিম কি কখনো নবনীকে ছেড়ে দিতে চেয়েছে?
নিজেকে সে শুদ্ধতম পুরুষ বলে দাবি করে না।নবনীর সাথে বিয়ে হবার আগেও দুজনের সাথে তামিমের শারীরিক সম্পর্ক ছিলো।কিছু পুরুষের মতো তামিমের ও প্রতিদিন একই খাবারে অরুচি। তাই বলে ছেড়ে দেওয়ার ইচ্ছে ও ছিলো না।
গাছের ও খাবে তলার ও কুড়াবার মতলব ছিলো তার। কি হলো অথচ!
তবে তামিম এটা অস্বীকার করবে না নবনীর প্রতি তামিমের অন্য রকম একটা মায়া রয়েছে।হয়তো ৩ বছর একই ছাদের নিচে থেকেছে বলে।
আজ স্বপ্নের মতো লাগছে সেসব দিন।নিতু তামিমকে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে হাত ধরে নাড়া দিয়ে বললো,”এভাবে দাঁড়িয়ে আছো কেনো?”
তামিম কিছুটা চমকে গেলো ভাবনায় ছেদ পড়ায়। একটু থেমে বললো,”তুমি আজ আমার কেবিনে?এভাবে সেজেগুজে কেনো?”
নিতু হেসে বললো,”বোকারাম,আমি জানতাম তুমি ভুলে যাবে।মনে নেই আজকে আমাদের অফিসে নতুন বস আসবে।বড় স্যার না গতকাল মিটিংয়ে বলে দিলেন ওনার একমাত্র ছেলে আজকে থেকে এই অফিসের দায়িত্ব নিবেন।আবার আজকে নতুন একটা প্রজেক্ট শুরু হতে যাচ্ছে,বাহিরের দেশ থেকে আমাদের ক্লায়েন্ট আসবে।সবাইকে অবশ্যই পরিপাটি হয়ে আসতে বলেছে।আমি তাই তোমার জন্য আমার সাথে ম্যাচিং করে শার্ট নিয়ে এলাম।আমি তো জানি তুমি আজও আয়রন না করে কুঁচকানো একটা শার্ট পরে চলে আসবে।”
তামিম মুচকি হাসলো। নবনী থাকতে তামিমের সব জামাকাপড় সে ধুয়ে ইস্ত্রি করে রাখতো। নবনী নেই আজ কয়েকদিন হলো,তার জামাকাপড় সব এলোমেলো হয়ে আছে।বাসায় খাবার ও হচ্ছে না। কে রান্না করবে?
হোটেল থেকে খাবার এনে খেতে হচ্ছে।
নিতু শপিং ব্যাগ রেখে চলে গেলো। তামিম শার্ট চেঞ্জ করে নিলো।পুরো অফিস জুড়ে আজকে কেমন সাজ সাজ রব। নতুন সোফা এসেছে,চেয়ার এসেছে।বসের কেবিনের দিকে একটা বুকসেল্ফ নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
নতুন বস নিশ্চয় বই পড়তে ভালোবাসেন।
তামিমের আবারও নবনীর কথা মনে পড়লো। কি ভীষণ পড়ার শখ ছিলো নবনীর।তামিম একবার তাকে দুটো বই ও কিনে দিয়েছে মায়ের আড়ালে।কি যেনো নাম ছিলো?
মনে করতে পারলো না তামিম।
কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না।তাহেরা বেগম একদিন দেখলেন নবনী কিচেনে দাঁড়িয়ে রান্না করছে আর পড়ছে আর মিটিমিটি হাসছে।
তিনি বই নিয়ে এলেন নিজে পড়বেন বলে। তারপর আর ফিরিয়ে দেন নি নবনীকে।
এসব ভাবতে ভাবতে তামিমের হঠাৎ করে মনে হলো,”নিতু কি নবনীর মতো হবে?তাহেরার এসব কি নিতু কখনো মেনে নিবে?”
উত্তর খুঁজে পায় না তামিম।
বাহিরে সবার হুটোপুটি শুনে তামিম বুঝতে পারলো নতুন বস এসেছে। সবাই সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নিতু,অরুণা,লিমার হাতে ফুলের মালা।স্যারকে পরানোর জন্য।
সবাই সেজেগুজে দাঁড়িয়ে আছে। তামিম তাকিয়ে দেখলো বড় স্যারের পেছনে ২৫-২৬ বছর বয়সী একটা ছেলে ঢুকেছে। পরনে একটা হালকা গোলাপি কালারের পাঞ্জাবি এবং সাদা পাজামা,মাথায় একটা কালো টুপি,তামিমের চাইতে দুই ইঞ্চি লম্বা হবে। চেহারায় কেমন একটা অদ্ভুত পবিত্রতা। স্নিগ্ধ,কোমল লাগছে দেখতে। তামিম জানতো গোলাপি মেয়েদের রঙ,ছেলেদের ও যে এতো ভালো লাগে তা আগে বুঝে নি।
ছেলে হয়ে ও তামিমের চোখ আটকে গেলো। তাকিয়ে থাকতে থাকতে কখন যে তামিমের সামনে এলো তামিম খেয়াল করলো না।
বড় স্যার তামিমের সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য বললো,”উনি হচ্ছে তামিম হোসেন,আমাদের উৎপাদন বিভাগ উনি দেখেন।আর তামিম সাহেব,এই হচ্ছে আমার ছেলে মেঘালয় আহমেদ মেঘ। “
মেঘ হাত বাড়িয়ে দিলো হ্যান্ডশেক করার জন্য কিন্তু তামিমের সেদিকে কোনো খেয়াল নেই।মুচকি হেসে মেঘ জড়িয়ে ধরলো তামিমকে। মেঘ জড়িয়ে ধরতেই ধ্যান ভাঙলো তামিমের।নিজের অমনোযোগিতার জন্য লজ্জা পেলো।
মেঘ কে সরি বলতেই মেঘ মুচকি হেসে বললো,”ইটস ওকে ব্রাদার। “
মেয়েদের সাথে মেঘ আর হাত মিলালো না।নিতু মালা পরাতে গেলে মেঘ মুচকি হেসে বললো,”প্লিজ,এসব ফরম্যালিটি আমার সাথে করবেন না।আমাকে মালা দিয়ে এভাবে বরণ করতে হবে না।কুরবানির হাটের গরুর মতো লাগে যেনো।”
নিতু পিছিয়ে গেলো। মেঘ বললো,”সবাই নিজের কেবিনে যান,কাজ করুন।বিকেলে মিটিং হবে।”
মেঘ নিজের কেবিনে চলে গেলো। নিতু তামিমের সাথে তামিমের কেবিনে গিয়ে বললো,”নতুন বস কি হ্যান্ডসাম তাই না তামিম!আমি তো অলরেডি ক্রাশ খেয়ে গেছি।”
তামিম বললো,”আসলেই অনেক হ্যান্ডসাম। আমি নিজেই মুগ্ধ হয়ে গেছি দেখে।”
নিতু হাসতে হাসতে বললো,”তোমার সাথে রিলেশন না থাকলে আমি নিশ্চিত ওনার সাথে লাইন মারার চেষ্টা করতাম।”
নিতুর কথা শুনে তামিম নিজেও হাসলো। এবং প্রথম বারের মতো খেয়াল করলো নিতু এরকম একটা কথা বলার পরেও তামিমের রাগ হচ্ছে না। অথচ নবনীর ফোনে একদিন একটা লোক রঙ নাম্বারে কল দিয়েছিলো বলে তামিমের মাথা গরম হয়ে গেছে।
তামিমের নিজেকে কেমন নড়বড়ে মনে হচ্ছে আজ।কেনো এমন লাগছে তার?
নবনীর কথা কেনো বারবার ভাবছে সে?
হিসেব মেলাতে পারছে না।সবার হিসেব কি মিলে এক জীবনে?
চলবে……
রাজিয়া রহমান