অন্তর্হিত কালকূট পর্ব ২১
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
২১.
দুপুর প্রায় তিনটে বাজে। সবাই ক্লাসরুম থেকে বের হওয়ার প্রায় বিশ মিনিট পর বের হলো কুহু। নিরবে বসে একটা বিল্ডিং এর ডিসাইন আঁকছিল। কখন এতো দেরী হয়ে গেছে বুঝতে পারেনি। কুহুর অন্যতম একটা অভ্যাস হলো, যখন যা-ই করে গভীর মনোযোগ দিয়ে করে। তখন আশেপাশের কোনকিছুর প্রতি বিশেষ কোন খেয়াল থাকেনা ওর। ভার্সিটি বিল্ডিং এর করিডর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ ওর মনে পড়ল গেইটের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা দুইজন প্রহরীর কথা। গোঁফওয়ালা হাতিদুটোর কথাতো মাথাতেই ছিলোনা। হ্যাঁ কুহু সেই দুজনকে গোঁফওয়ালা হাতিই বলে। ওরকম প্রকান্ড গোঁফ আর বলিষ্ঠ মোটা শরীর দেখে এর চেয়ে ভালো বিশেষণ মাথায় আসেনি ওর। ওর দেরী হচ্ছে দেখে না জানি ওরা আবার ভেতরে চলে আসে। পাহারার এই ব্যপারটা মোটেও পছন্দ করেনা কুহু। ও কী এখনো বাচ্চা? কুড়ি বছর বয়সী একটা মেয়ের সঙ্গে নিয়মিত দুজন পাহারাদার পাঠানোর কোন মানে হয়! ও কী রাস্তা হারিয়ে ফেলবে বলে ধারণা করে রাশেদ আর রুদ্র? কিন্ত ব্যপারটা অপছন্দ করলেও মেনে নিতে হয় কুহুকে। রাশেদ বা রুদ্র দুজনেই এ ব্যপারে ভীষণ কঠোর। কুহুর মিষ্টি আবদার বাকিসব ব্যপারে ওদের মন গলাতে পারলেও এ ব্যাপারে পারেনা। হাতঘড়িতে চোখ পড়তেই দ্রুত পা চালালো কুহু। লোক দুটো ভেতরে আসার আগেই ওকে বের হতে হবে। ও চায়না ভার্সিটির সবাই ওকে অন্যচোখে দেখুক, অস্বাভাবিক কেউ মনে করুক। ও সহজ সাধারণ জীবনযাপন করতেই বেশি পছন্দ করে। লিফটের বোতাম চাপার একটু পরেই পেছন থেকে ‘কুহু’ বলে কেউ ডেকে উঠল। আওয়াজ অনুসরণ করে পেছন দিকে তাকাতেই কুহু হকচকিয়ে গেল। সঙ্গেসঙ্গে উল্টো ঘুরে গিয়ে লিফটের দরজা খোলার অপেক্ষা করল অস্থিরভাবে। ছেলেটা প্রায় দৌড়ে আসছে। লিফটের দরজা খুলে গেল। কুহু এক মুহূর্ত অপেক্ষা না করে ভেতরে ঢুকে দ্রুত বোতাম চাপল। কিন্তু ততক্ষণে দেরী হয়ে গেছে। ছেলেটা ভেতরে ঢুকে পেরেছে। লিফটে এখন শুধু কুহু আর ঐ ছেলেটা। কুহু এককোণে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ছেলেটা হতাশ দৃষ্টিতে কুহুর দিকে তাকিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, ‘এমন কেন তুমি? কতবার তোমার সাথে কথা বলতে চেয়েছি। অথচ তুমি পালিয়ে বেরাচ্ছো। আমি বাঘ না ভাল্লুক? খেয়ে ফেলবো তোমাকে?’
কুহু একবার ছেলেটার দিকে তাকিয়ে সঙ্গেসঙ্গে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল। এই ছেলেটাকে ওর পছন্দ নয় একদমই। বারবার ফ্লোর নাম্বার দেখছে তাই। বের হতে পারলেই বাঁচে। ছেলেটা কিছু একটা ভেবে চমকে উঠল। বলল, ‘এই! তুমি কানে শুনতে পাও তো? না মানে অনেকের তো হয় এরকম। বলতে না পারার সাথেসাথে শুনতেও পায়না। আমি আবার আরেকটা ভুল করতে চাইছি না। তুমি শুনতে পাচ্ছো আমার কথা? হ্যালো?’
কুহুর চোখের সামনে হাত নাড়িয়ে বলল ছেলেটা। কুহু খানিকটা পিছিয়ে গেল। অস্বস্তি হচ্ছে ওর। তাড়াতাড়ি গ্রাউন্ড ফ্লোরে নামছেনা কেন লিফট টা? এতো ঢিলা! ছেলেটা কোন উত্তর না পেয়ে নিজেনিজেই কিছু ভেবে আবার বলল, ‘আমিও একটা বলদ। তুমিতো বলতে পারোনা। উত্তর দেবে কীকরে! আর শুনতে না পেলে তো আর ডাক শুনে তাকাতে না আমার দিকে। ডাক যেহুতু শুনেছো আমার কথাও নিশ্চয়ই শুনতে পাচ্ছো। দেখো_’
ছেলেটা কথা শেষ করার আগেই খুলে গেল লিফটের দরজা। কুহু এক সেকেন্ডও অপেক্ষা না করে প্রায় দৌড়ে বেরিয়ে গেল। ‘আরে আমার কথাটা_’ এটুকুই শুনতে পেল কুহু পেছন থেকে। এরপর মিলিয়ে গেল ছেলেটার গলার স্বর। কুহুর মনে পড়ে গেল এক সপ্তাহ আগের সেই ঘটনা-
ব্রেকের সময় ক্যান্টিনের উদ্দেশ্যে বেরিয়েছিল কুহু। নিচে ওর বান্ধবী অপেক্ষা করছিল তাই দ্রুতই হাঁটছিল। করিডর পেরিয়ে সিঁড়ির দিকে ঘুরতে গেলেই এই ছেলেটার সাথে ধাক্কা লাগে কুহুর। একই সময় সিঁড়ি দিয়ে ছেলেটা উঠে আসছিল। দুর্ভাগ্যবশত দুজনে একই সময় টার্ন নিচ্ছিল। কুহু যাচ্ছিল সিঁড়ির দিকে আর ছেলেটা আসছিল করিডরের দিকে। ফলসরূপ এই ধাক্কা। ধাক্কাটা আহামরি জোরে না লাগায় দুজনের কেউই পড়ে যায়নি। কিন্তু ছেলেটার হাতে থাকা জিনিসটা নিচে পড়ে গেল। পুরো ব্যাপারটা ঘটলো দুই থেকে তিন সেকেন্ডের মধ্যে। কুহু হতভম্ব হয়ে তাকাল ছেলেটার দিকে। পরনে নীল জিন্স, কালো টিশার্ট, কোমরে ধুসর রঙের জ্যাকেট বেঁধে রেখেছে। ব্লাক-ব্রাউন চুলগুলো লং লেন্থে কাটা। কাঁধে কলেজ ব্যাগ। চেহারায় বিদেশি বিদেশি একটা ভাব আছে। ছেলেটা কুহুর দিকে নজর দিলোনা। ধাক্কা খাওয়া নিয়েও তেমন কোন মাথাব্যথা আছে বলে মনে হলোনা ওকে দেখে। নিজেকে সামলেই সবার আগে তাকাল নিচে পরে থাকা জিনিসটার দিকে। কুহুও সেই দৃষ্টি অনুসরণ করে নিচে তাকিয়ে দেখে একটা ছোট বিল্ডিং টাইপ কিছু ভেঙ্গে পড়ে আছে। বুঝতে আর বাকি থাকেনা এটা একটা প্রজেক্ট। মডেল তৈরী করেছিল নিশ্চয়ই। বিষয়টার গভীরতা বুঝতে পেরে কুহু জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে চোখে ভয় নিয়ে তাকাল ছেলেটার দিকে। ছেলেটা কোমরে হাত দিয়ে দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরল। হতাশ আর বিরক্তি মিশ্রিত দৃষ্টিতে তাকাল কুহুর দিকে।
‘ ড্যাম! কী করলে এটা?’ ছেলেটা কন্ঠে চাপা রাগ প্ররিশ্রমের জিনিসটা নষ্ট হয়ে যাওয়ার দুঃখ আড়াল করতে পারল না। দুটো মিলিয়ে অদ্ভুত শোনাল তার গলার স্বর।
কুহু কী করবে বুঝতে পারছেনা। ও চাইলেও ছেলেটার কাছে দুঃখ প্রকাশ করতে পারছেনা। বলতে পারছেনা ওর ভুল হয়েছে, ও দেখতে পায়নি। ও তো কথাই বলতে পারেনা। ভয়ে ইশারা করার ব্যপারটাও মাথা থেকে বেরিয়ে গেছে ওর। কিছু বলতে না পেরে অবুঝ দৃষ্টি মেলে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে রইল শুধু। ছেলেটা নিচে বসে পড়ল। উঠিয়ে নিল ভাঙা মডেলটা। উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘ অদ্ভুত মেয়েতো তুমি! মিনামাম সরি বলার মতো ম্যানার্সটুকুও নেই? দেখেতো জুনিয়র মনে হচ্ছে। কোন ইয়ার?’
কুহু কানে হাত দিয়ে ‘সরি’ বোঝাতেই নিচ্ছিল কিন্তু তারআগেই করিডরের অপর প্রান্ত থেকে ‘নীরব’ বলে ডেকে উঠলো একজন ছেলে। কুহু তখন জেনেছিল ছেলেটার নাম নীরব। কুহুর দিকে ভয়ানক রাগী একটা দৃষ্টি নিক্ষেপ করে চলে গিয়েছিল সেদিন নীরব। কুহু হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছিল। ভেবেছিল মিটে গেছে ব্যপারটা। কিন্তু পরেরদিন যে নীরব এমন কান্ড করবে সেটা ভাবতে পারেনি ও। আর এখন ভাবলেই নীরবের প্রতি রাগ আর ভয় দুটোর মিশ্র অনুভূতি হয় ওর।
এসব কথা ভাবতে ভাবতেই গেইটের কাছে চলে এলো কুহু। উচ্ছ্বাসকে ওখানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অবাক হল। অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। উচ্ছ্বাস হাতঘড়ি দেখতে দেখতে এগিয়ে এসে বলল, ‘এতো দেরীতে নামলি কেন? আমিতো আরেকটু হলে ভেতরে আসছিলাম।’
কুহু হাত তুলে কিছু ইশারা করতে যাচ্ছিল তার আগেই উচ্ছ্বাস স্যারেন্ডার করার স্টাইলে দুই হাত উঁচু করে বলল, ‘দেখ তোর ঐ ডান্সিং ল্যাঙ্গুয়েজ তোর ব্যাগে রেখে দে। আমি ওসব বুঝিনা। সহজভাবে বোঝাতে পারলে বোঝা নয়তো চল।’
কুহু হাসল। তারপর শুধু আঁকার ইশারা করল। উচ্ছ্বাস বুঝতে পারল। হেসে কুহুর মাথায় হাত রেখে বলল, ‘আচ্ছা, বাড়ি চল।’
কুহুর ইচ্ছে করল জিজ্ঞেস করতে যে আজ ঐ দুজন গোঁফওয়ালা হাতি কোথায়? কিন্তু উচ্ছ্বাস বুঝবে না ওর কথা। তাই গাড়িতে বসে লিখে জিজ্ঞেস করাই ভালো হবে বলে মনে করল। কিন্তু উচ্ছ্বাস বোধ হয় কুহুর মনের প্রশ্নটা বুঝতে পারল। বলল, ‘আজ আমার কোনো কাজ নেই। বাড়িতে একাই বসেছিলাম। ভাবলাম তোর ড্রাইভারের ডিউটিটা আজ আমি করে দেই।’
কুহু মিষ্টি করে হাসল। দুজন গাড়িতে উঠে বসে পড়ল। কুহুকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে উচ্ছ্বাস গেল ইউনাইটেড হসপিটালের সামনে। অবসর যখন বসে আছে ওখানে বসে থাকাই ভালো। যদি একপলক নাজিফার দেখা পায়! গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে একটা সিগারেট ধরাল উচ্ছ্বাস। হঠাৎ প্যান্টের পকেটে রাখা ফোনটা বেজে উঠল। ফোন বের করে স্ক্রিনে ‘রুদ্র’ নামটা দেখেই একটু অবাক হল ও। ঘন্টা দুই আগেতো ফোন করে বলল ফিরে আসছে। তাহলে এখন আবার কেন? কোন বিপদে পড়ল নাতো? দ্রুত ফোনটা রিসিভ করল উচ্ছ্বাস। ওপাশ থেকে রুদ্রর কথা শুনে একবার ঘড়ি দেখে নিল। ফোনটা রেখে আর অপেক্ষা না করে গাড়িতেই উঠতে যাচ্ছিল কিন্তু তখনই সামনে তাকিয়ে চমকে উঠল ও। নাজিফা আসছে! হ্যাঁ, ওর কোন ভুল হচ্ছেনা। নাজিফা ওর দিকেই আসছে। হয়তো কিছু বলতে চায়। কিন্তু সময় সল্পতা আর রুদ্রর কথা মাথায় আসতেই আর দাঁড়াল না উচ্ছ্বাস। ওকে যেতে হবে।
*
প্রিয়তা উত্তর সলিমপুরের একটা গলির বিল্ডিং এর সামনেই নেমেছিল। স্পষ্ট মনে আছে রুদ্রর। সে গলিতেই জিপটা ঢুকিয়েছে ও। রাস্তাটা তেমন চওড়া না। তারওপর দু-পাশেই দালান আর গাছপালা। তবে গাড়ি ঢোকানোর যোগ্য। হ্যাঁ গাড়ি ঘুরিয়েছিল রুদ্র। কিছুক্ষণ ভাবার পর ওর মনে হল সবটা জেনেও মেয়েটাকে ম’রার জন্য ফেলে যাওয়া ঠিক হবেনা। ও অমানুষ, কিন্তু এতোটাও অমানুষ নয় যে একটা নির্দোষ মেয়েকে ইচ্ছাকৃতভাবে মৃ’ত্যু’র মুখে রেখে যাবে। তবে পেনড্রাইভটা নিয়ে কোনরকম রিস্ক নিতে রাজি ছিলোনা রুদ্র। কারণ এই পেনড্রাইভটা কোন সাধারণ পেনড্রাইভ না। এর মূল্য ওর জীবনের চেয়েও অনেক বেশি। তাই সঙ্গেসঙ্গে উচ্ছ্বাসকে কল করে বলেছিল চট্টগ্রাম চলে আসতে। পেনড্রাইভটা নিরাপদে আমের ভিলায় পাঠিয়ে দেওয়া প্রয়োজন। উচ্ছ্বাসের চট্টগ্রাম এসে পৌঁছাতে পৌঁছতে রাত সাড়ে ন’টার বেশি বেজে গেল। সঙ্গে দলের আরও পাঁচজন নিয়ে এসেছে নিরাপত্তার জন্যে। উপদেশটা রুদ্রই দিয়েছে। পেনড্রাইভটা নিতে নিতে মনে মনে রুদ্রর মু’ন্ড’পা’ত করতে ভুলল না উচ্ছ্বাস। যাওয়ার আগে বলে গেল, ‘শালা, আজ নাজিফা নিজে কথা বলতে এসছিল। তোর জন্যে, শুধুমাত্র তোর জন্যে কিছুই হলোনা। আমার লাভ লাইফের ভিলেন তুই। তোর লাভ লাইফের ভিলেন গোটা দুনিয়া হবে। মিলিয়ে নিস। সরল মনে দ্বিতীয়বার অভিশাপ দিলাম।’
রুদ্র শুধু হালকা হেসে বলেছিল, ‘তুই তোর সরল অভিশাপ নিয়ে জাহান্নামে যা।’
বিল্ডিংটার সামনে গাড়ি থামিয়ে ভ্রু জোড়া কুঁচকে গেল রুদ্রর। বিল্ডিংটার সামনে কিছুটা ভীড় রয়েছে। পরিচিত আশংকায় হঠাৎ কেঁপে উঠল ওর বুক। ও আসতে দেরী করে ফেলল? প্রিয়তার কিছু হয়নিতো? জেনেশুনে এক নিরপরাধ মেয়ের মৃত্যুর কারণ হওয়ার দ্বায় থেকে কোনদিন মুক্ত হতে পারবে ও? কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই জিপ থেকে নামল। স্বাভাবিক পায়ে গেইট ঠেলে ভেতরে ঢুকলো। চিৎকার চেঁচামেচির আওয়াজ শুনে কিছুটা নিশ্চিন্ত হলো রুদ্র। কেউ মা’রা গেলে এরকম চিৎকার চেঁচামেচির আওয়াজ হয়না। কিন্তু হয়েছেটা কী? রুদ্র হাত দিয়ে লোকজন ঠেলে ভেতরে গিয়ে দেখে প্রিয়তার হাত ধরে রেখেছে একটা ছেলে। ওকে টেনে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে কোথাও একটা। প্রিয়তা নিজের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে আটকানোর চেষ্টা করছে। কাঁদতে কাঁদতে হলদে ফর্সা মুখটাতেও লালচে ভাব এসছে। পাশেই কোকড়া চুলের চশমা পড়া একটা মেয়ে বাঁধা দেওয়ার চেষ্টা করছে কিন্তু পারছেনা। সে বেচারিও প্রায় কেঁদে ফেলেছে। গোটা বিল্ডিং থাকা সব মানুষজন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে ব্যপারটা। যেন দেখে যাওয়াই তাদের একমাত্র এবং প্রধান কাজ। কোন সাহায্য করার ইচ্ছে, প্রয়োজন বা সাহস তাদের নেই। রুদ্রর গোটা ব্যপারটা বুঝতে পাঁচ সেকেন্ডের বেশি লাগল না। বুঝতে পেরেই এগিয়ে গেল সেদিকে। কোনরকম কোন কথা না বলে সোজা ছেলেটার নাক বরাবর একটা ঘুষি বসিয়ে দিল। ঘুষিটা এতোই জোরে ছিল যে ছেলেটা প্রিয়তার হাত ছেড়ে নিচে বসে পড়ল। সকলের কথাবার্তা চেঁচামেচি থেমে গেল মুহূর্তের মধ্যে। সবার দৃষ্টি এখন এই সুদর্শন আগন্তুকের দিকে। রুদ্রকে দেখে প্রিয়তা কান্না ভুলে বিস্মিত নয়নে তাকিয়ে আছে। ছেলেটা নাক চেপে ধরে ক্ষিপ্ত দৃষ্টিয়ে তাকাল তাকে আঘাত করা ব্যক্তির দিকে। রুদ্র নির্বিকারছন্দে পকেটে হাত গুঁজে দাঁড়াল। ছেলেটা উঠে তেড়ে এসে বলল, ‘মারলি কেন?’
বলে রুদ্রকে পাল্টা ঘুষি মারতে গেলেই রুদ্র সোজা হাঁটু দিয়ে ওর পেটে মারল। ব্যথায় মুখ বিকৃত হয়ে গেল লোকটার। পেট চেপে ধরে উবু হয়ে রইল। রুদ্র বলল, ‘আমি জানতাম আমি শান্ত গলায় বললে তুই ওর হাত ছাড়বি না। তাই আর ফিল্মি স্টাইলে হাত ছাড়ার ওয়ার্নিং দেই নি। আমি বাস্তববাদি মানুষ। তাই বাস্তব কাজটাই করেছি।’
ছেলেটার চোখের হিংস্রতা বৃদ্ধি পেল। পেটে হাত রেখেই চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, ‘এখানে আমি তোকে কু/পি/য়ে মা/র/লেও কেউ আটকাবেনা জানিস?’
রুদ্র এক অদ্ভুত হাসি হাসল। তারপর আশেপাশের সবার দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিল। এটা ওর চেয়ে ভালো আর কে জানে? খানিকটা জোরে বলল, ‘যে যার যার ঘরে চলে যান, সার্কাস শেষ। যান!’
শেষের শব্দটা ধমকেই বলল রুদ্র। সবাই যে যার যার ঘরে চলে গেল। শুধু একটা মহিলা বাদে। সে এগিয়ে এসে প্রিয়তাকে উদ্দেশ্য করে কর্কশ কন্ঠে বলল, ‘এইযে মাইয়া! এইহানে থাকতে হইলে রোজরোজকার এইসব নাটক চলবো না। এতিম মাইয়া তাই দয়া করছি। তাই বইলা ভদ্রবাইত্তে দুইদিন পরপরই এই তামাশা নেওন যাইতাছে না। হয় এইগুলান বন্ধ করো নাইলে বাড়িহান খালি করো দেহি বাপু।’
কথাগুলো শুনে রুদ্র বুঝলো এই মহিলা হয়তো বাড়িওয়ালি। কিন্তু বাড়তি ঝামেলা এড়াতে চুপ করে রইল। মহিলা যেতে যেতে বিড়বিড় করে বলল, ‘কাইল আবার কইত্তে রাইত কাটাইয়া আইছে। আইজকাইলকার মাইয়াগো আর কী কমু! বিচ্ছিরি সব কান্ড!’
সব যেতেই রুদ্র তাকাল সেই ছেলেটার দিকে। ছেলেটা ততক্ষণে ব্যথা সামলে নিয়েছে। সামলে উঠতেই পি\স্ত\ল বের করে ফেলল। রুদ্রর মাথা বরাবর তাক করে বলল, ‘বেশি হিরোগিরি তাইনা? এবার কীকরে বাঁচবি? তোকে এখানে মেরে রেখে গেলেও কেউ কিচ্ছু করতে পারবেনা। আন্ডারওয়ার্ল্ডে আমার কত চেনাজানা জানিস?’
রুদ্র হালকা আওয়াজ করেই হাসল এবার। সেরা কৌতুক মনে হল কথাটা ওর কাছে। কৌতুকই বটে! প্রিয়তা তাকাচ্ছে আর ভাবছে যে ছেলে চোখের নিমেষে আট-আটজন অস্ত্রধারী লোককে ধরাসাই করে দিতে পারে শুধুমাত্র বুদ্ধির জোরে তাকে এই ছোকরা একটা পি/স্ত’/ল দিয়ে ভয় দেখাচ্ছে! কোন কম্পানির ছাগল এটা! রুদ্র হাসি থামিয়ে খানিকটা এগিয়ে গিয়ে ছেলেটার কাঁধে হাত রেখে অনেকটা কানে কানে বলল, ‘খোকা! তুমি যেটা হাতে ধরে আছো না, ওটা নিয়ে আমি ছোটবেলায় খেলাধুলা করতাম। আর আমার নামখানা শুনলে তোমার প্যান্ট ভিজে যাওয়ার প্রবল সম্ভাবনা আছে।’
ছেলেটা ভ্রু উঁচু করে বলল, ‘তাই নাকি? কী নাম শুনি?’
‘রুদ্র! রুদ্র আমের। রাশেদ আমেরের একমাত্র ছেলে।’ ঠান্ডা গলায় বলল রুদ্র।
হাত আপনাআপনি নিচে চলে এলো ছেলেটার। ভুল বলেনি রুদ্র। সত্যিই এবার প্যান্ট ভিজে যাওয়ার উপক্রম হলো বেচারার। সঙ্গে সঙ্গে রুদ্রর পায়ে পরে গেল। প্রায় কেঁদে ফেলার মতো করে বলল, ‘ভাই ভুল হয়ে গেছে। আমি আ_’
কথা শেষ করার আগেই রুদ্র শক্ত কন্ঠে বলল, ‘বিদায় হ। আর যাতে মেয়েটার আশেপাশে না দেখি।’
চশমা পড়া কোকরা চুলের সেই মেয়েটা প্রিয়তাকে ফিসফিসিয়ে বলল, ‘ছেলেটা ঐ বদমাইশকে কী বলল বলতো? হায়না থেকে সোজা নেংটি ইঁদুর হয়ে গেল!’
প্রিয়তা কিছু বলল না কেবল বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল রুদ্রর দিকে। গত দুদিনে ভয়ংকর সব পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হতে স্তব্ধ হয়ে গেছে মেয়েটা। ওদিকে ছেলেটা কোনমতে জান হাতে নিয়ে পালালো।
–
বিছানায় গুটিশুটি মেরে বসে আছে প্রিয়তা। এখন আবার কাঁদছে। সেই কোকড়া চুলের চশমা পড়া মেয়েটা একহাতে জড়িয়ে ধরে বসে আছে ওকে। মেয়েটার নাম মীরা। রুদ্র দেয়ালে হেলান দিয়ে হাত ভাঁজ করে দেখছে ওদের। নিরবতা কাটিয়ে রুদ্র খানিকটা গম্ভীর কন্ঠে বলল, ‘ছেলেটা এমন প্রায়ই করতো?’
প্রিয়তা চুপ থাকল। তাই মীরাই বলল, ‘ হ্যাঁ,তবে আজকের মতো বাড়াবাড়ি করেনি কখনও। কিন্তু কাল সারারাত ও বাইরে কাটিয়ে এসছে বলেই আজ বেশি পেয়ে বসেছিল। প্রিয়ুকে বিয়ে করার কথাই বলতো সবসময়। আর আজতো_’
রুদ্র তাকাল প্রিয়তার দিকে। কান্নাভেজা চোখদুটো আরও বেশি অপরূপ লাগছে দেখতে। রুদ্র খানিকটা কৌতুক করেই বলল, ‘ভালো তো! বিয়ে করে নিলেই তো পারতো। ছেলেটাতো দেখতে ভালোই ছিল।’
প্রিয়তা ঠোঁট ভেঙ্গে কেঁদে ফেলল এবার। যেন রুদ্রর রসিকতা ওর পছন্দ হয়নি। মীরা অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, ‘মজা করবেন না ভাইয়া। ছেলেটা ভালো না। অনেকগুলো বিয়ে করেছে। আর সবগুলো বউ-ই কদিন পরে পাচার করে দেয়। অনেক মেয়েকে তো ক্ষমতার জোরে জোর করে তুলে নিয়ে গেছে। আন্ডারওয়ার্ল্ডের সাথে যোগাযোগ আছে বলে কেউ কিছু করার বা বলার সাহস পায়না।’
রুদ্র ভ্রু কুঁচকে ফেলে বলল, ‘ এই কথাগুলো আগে বলোনি কেন?’
‘আগে বললে কী হতো?’ বুঝতে না পেরে বলল মীরা।
‘ জীবিত ছাড়ার প্রশ্নই ছিলোনা। সমস্যা নেই, খুঁজে বের করতে একদিন লাগবে না।’
কথাটা শুনে প্রিয়তা মাথা তুলে খানিকটা তেজ দেখিয়ে বলল, ‘খু’নে লোক একটা।’
রুদ্র বরাবরের মতোই বিরক্তি নিয়ে বলল, ‘ হ্যাঁ খু’নেই। ওকে বাঁচিয়ে রাখব কী আরও কয়েকটা মেয়ের সর্বনাশ করতে? নাকি তোমার ওর কাছে যাওয়ার শখ হয়েছে। হলে বলো আমি নিজ দায়িত্বে দিয়ে আসছি।’
প্রিয়তা কিছু বলল না। মুখ ঘুরিয়ে বসে রইল। মীরার ভীষণ হাসি পেল গোটা ব্যপারটায়। কিন্তু ঘরে উপস্থিত বাকি দুজনকে গম্ভীর দেখে ও আর হাসতে পারল না। প্রিয়তা চোখ মুছে নাক টেনে বলল, ‘আপনি এখানে কেন এসছেন এখনো বললেন না কিন্তু। কিছু রয়ে গিয়েছিল? আমিতো আপনাকে বলেছিলাম আপনি আমার প্রাণ বাঁচিয়েছিলেন তাই পুলিশ জেরা করতে এলেও আমি তাদের কিছু বলব না। তাহলে?’
রুদ্র ভনিতা না করে সোজা কথায় আসল। বলল, ‘আমার ওপর যারা আক্রমণ করেছিল তারা সবাই তোমাকে দেখে নিয়েছে। হয়তো ইনফরমেশনও পাঠিয়েছে। ওরা নিশ্চিত তোমাকে খুঁজছে। এমনো হতে পারে আজ রাতেই চলে আসবে তোমাকে নিতে কিংবা খু’ন করতে। আমার মনে হলো কিছুদিনের জন্যে আমার তোমাকে নিরাপদ কোথাও নিয়ে রাখা উচিত। আমার সাথে তোমাকে আসতে হবে। অন্তত তোমার সেফটি নিশ্চিত করার আগ পর্যন্ত।’
প্রিয়তা চেহারায় ভয়ের ছাপ পড়ল রুদ্রর কথা শুনে। মীরা খামচে ধরেছে প্রিয়তার হাত। এমন ভয়ংকর কথা ও শোনেনি এর আগে।কিছুক্ষণ ইতস্তত করে ভাবনা-চিন্তার পর একটা শুকনো ঢোক গিলে প্রিয়তা বলল, ‘আমি আপনাকে বিশ্বাস করিনা। আপনি একটা খু’নি লোক। আর যে খু’ন করতে পারে সে সব পারে। নিশ্চয়ই আপনার কোন খারাপ মতলব আছে।’
রুদ্র এক ভ্রু উঁচু করে বলল, ‘খারাপ মতলব? তোমার কী মনে হয় খারাপ কিছু করার হলে আমি এখানে করতে পারবো না?’
প্রিয়তা ভেতরে ভেতরে ভয় পেলেও সেই ভয় প্রকাশ করল না। যথাসম্ভব কঠোর গলায় বলল, ‘ হয়তো এমন কিছু করতে চাইছেন যা এখানে করা সম্ভব নয়। কালকে আমি আপনার ওপর নির্ভরশীল ছিলাম, তারওপর আকস্মিক এতো ঘটনায় ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম সেইজন্যই চুপচাপ আপনার কথা মতো চলেছি। বলতে পারেন বাধ্য হয়েছি। কিন্তু আজ পরিস্থিতি ভিন্ন। আমাকে বাঁচানোর জন্যে আপনার কাছে চির কৃতজ্ঞ থাকব আমি। আর আমার কথা ভাবার জন্যেও অসংখ্য ধন্যবাদ। কিন্তু আমি কোথাও যাবোনা। আর না আপনি এখন এখানে থাকবেন।’
মীরা প্রিয়তার হাত চেপে ধরে বলল, ‘কী বলছিস? এতো রাতে লোকটা যাবে কোথায়?’
প্রিয়তা এবার খানিকটা রাগ দেখিয়ে বলল, ‘আমি কী জানি? এখানে থাকতে দেওয়া অসম্ভব। এমনিতেই বাড়িওয়ালি আন্টি ক্ষেপে আছে। যদি শোনে কোন পরপুরুষকে রাতে ঘরে ঢুকিয়েছি কী হবে ভাবতে পারছিস? ওনাকে আমি বলেছিলাম এখানে আসতে?’
রুদ্র এতক্ষণ শুনছিল ওদের দুজনের কথা। বিরক্তি আর রাগে কিছু বলার ইচ্ছেই নষ্ট হয়ে গেছে ওর। প্রিয়তা বলল, ‘আপনি প্লিজ চলে যান। আমার আপনার সাহায্যের প্রয়োজন নেই।’
রুদ্রর মতো মানুষের এরপর আর দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব হলোনা। আত্মসম্মানের প্রশ্ন। হনহনে পায়ে বেরিয়ে গেলো প্রিয়তাদের রুমটা ছেড়ে। মীরা সেদিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে প্রিয়তার দিকে তাকাল। করুণ গলায় বলল, ‘কাজটা বোধ হয় ঠিক হলোনা।’
‘ এটাই ঠিক ছিল।’ ভাঙা গলায় বলল প্রিয়তা।
#চলবে…
[ রি-চেইক করতে পারিনি। আর দেরী হওয়ার জন্যে সকলের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী ]