অন্তর্হিত কালকূট পর্ব ৪৯
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
৪৯.
জ্যোতির কথা শুনে কয়েক মুহূর্তের জন্যে হতভম্ব হয়ে গেল তুহিন। জ্যোতির নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। ঠোঁটে রহস্যময়ী হাসি। তুহিনের অস্বস্তি হলো। ও টেবিলে দু হাত রেখে খানিকটা ঝুঁকে বলল, ‘হেয়ালি করবেন না জ্যোতি। যা বলার সরাসরি বলুন।’
জ্যোতি কিছু বলছেনা। নিচের দিকে তাকিয়ে সেভাবেই হেসে যাচ্ছে। তুহিন ঠান্ডা কিন্তু রাগী গলায় বলল, ‘আমি আপনার সঙ্গে চা বিস্কিটের আড্ডা দিতে আসিনি, জ্যোতি। আপনাকে ইন্ট্রোগেট করছি আমি। আর সহজে মুখ না খুললে আমাদের অনেক উপায় অবলম্বন করতে হয়। যদিও মেয়েদের গায়ে আমি হাত দেইনা। কিন্তু আপনার পেছনে যে দুজন দাঁড়িয়ে আছে, ওরা কাজটা করতে খুব বেশি আপত্তি করবেনা।’
জ্যোতি ঘাড় ঘুরিয়ে একবার দেখল দুজন মহিলা কন্সটেবলকে। তারপর আবার তুহিনের দিকে তাকাল। তুহিন বলল, ‘আমি চাইনা সেসব কিছু হোক। যা প্রশ্ন করা হবে সোজাসুজি উত্তর দেবেন। আর যতক্ষণ না আমরা উত্তর পাচ্ছি, আপনাকে ছাড়া হবেনা জ্যোতি। দরকারে অ্যারেস্ট করা হবে আপনাকে।’
জ্যোতি পলকহীন চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল তুহিনের দিকে। চাপা এক দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো ওর ভেতর থেকে। নিচু গলায় বলল, ‘বলুন কী জানতে চান?’
তুহিন আবার সোজা হয়ে বসল। ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ‘আপনি এ কথা কেন বললেন যে, রুদ্রই ন’টা খুন করেছে সে বিষয়ে আমি নিশ্চিত কি-না?’
‘ নটা খু’নের স্পটেই ওর বিরুদ্ধে প্রমাণ পাওয়া গেছে?’
তুহিন থমকালো। ন’টা খুনের ক্ষেত্রেই রুদ্রর বিরুদ্ধে প্রমাণ পায়নি ও। ও কেইসটা হাতে নেওয়ার পর যে কয়েকটা খু’ন হয়েছে শুধু সেগুলোরই প্রমাণ আছে ওর আছে ওর কাছে। মনে মনে কথাগুলো ভাবলেও তুহিন মুখে বলল, ‘সেটা বড় কোন ব্যপার না। ওটা আমাদের হাতেই ছেড়ে দিন। আপনি বলুন, রুদ্র কোথায় আপনি জানেন না। মেনে নিলাম। প্রিয়তা কোথায় তাও জানেনা না। সেটাও মেনে নিলাম। কিন্তু এটাতো জানে আমের ভিলায় কী হয়েছিল? কেন এখন সেখানে কেউ থাকেনা? কেন পালিয়ে বেড়াচ্ছে তারা? কী ঘটেছিল জ্যোতি?’
জ্যোতি আবার হাসল। কিন্তু তুহিনের এই হাসিটাকে তীব্র যন্ত্রণার মনে হল। জ্যোতি কেমন অন্যমনস্ক হয়ে তাকিয়ে রইল বাইরের দিকে। কপাল কুঁচকে গেছে। ঠোঁট কাঁপছে। যেন বিষাদময় কিছু স্মৃতি হাতরে বেড়াচ্ছে মন মস্তিষ্ক জুড়ে। ও অন্যমনস্ক গলাতেই বলল, ‘সব ঠিকঠাক ছিল। প্রিয়তা আসায় রুদ্র বদলে গিয়েছিল অনেকটা। ভালোবেসে ও নিজের কোন বৈশিষ্ট্যকে বিসর্জন দেয়নি সেটা ঠিক। কিন্তু নতুন অনেক বৈশিষ্ট্য যোগ হয়েছিল ওর ব্যক্তিত্বে। ভালোবাসতে শিখেছিল ও। প্রিয়তার খুশির জন্যে ও সব করতে পারতো। যে ছেলে অন্যের মৃত্যু চিৎকার শুনে আনন্দ পেতো তার প্রিয়তার ফুঁপিয়ে ওঠাও সহ্য হতোনা। কিছু চাওয়ায় আগেই প্রিয়তার পায়ের কাছে এনে রাখতো সবকিছু। যে রুদ্র আমের কারো সামনে মাথা নত করেনি সে প্রিয়তার সামনে হাজারবার মাথা নত করতেও দ্বিধাবোধ করতো না। প্রচন্ড ভালোবাসা কাকে বলে ওকে দেখে বুঝেছিলাম আমি।’
শেষের লাইন দুটো শুনে একটু নড়েচড়ে বসল তুহিন। মাথা নত করার ব্যপারটা কিছুটা ধাক্কা দিয়েছে ওকে। জ্যোতি বলে চলেছে, ‘ প্রিয়তা আসার পর আমের ভিলার খুশি কয়েকগুন বেড়ে গিয়েছিল। শুধু রুদ্র নয়। বদল ঘটেছিল সবার মধ্যেই। যে রাশেদ বাবার মুখের ওপর কেউ কথা বলতাম না তাকে কড়া শাসনে রাখত প্রিয়তা। খাবার, ঔষধ এদিক থেকে ওদিক হতে পারতো না। বাড়ির ছন্দটাই বদলে দিয়েছিল মেয়েটা। হাসি, আনন্দ, ভালোবাসায় ঝকঝক করছিল আমের ভিলা। প্রায় দুটো বছর সবকিছু যেন স্বপ্নের মতোই কাটছিল। কিন্তু..’
‘ কিন্তু?’ চেষ্টা করেও নিজের মধ্যে জেগে ওঠা কৌতূহল দমাতে পারল না তুহিন।
জ্যোতি বাইরে থেকে চোখ ফিরিয়ে তুহিনের দিকে বলল, ‘বিষে নীল হয়ে গেল সবকিছু।’
*
অতীত~
সেপ্টেম্বর মাসের শেষ সময়। গতকাল সারারাত টিপটিপ বৃষ্টি পড়েছে। বিরতিহীন বৃষ্টি থেমেছে ভোররাতের। সকালটা তাই অন্যরকম সুন্দর আজ। ভেজা গাছপালা, রাস্তা। তারসাথে বৃষ্টি ভেজা ঠান্ডা শীতল হাওয়া। ঘরের থাইগ্লাস খোলাই ছিল। সেখান থেকে ঠান্ডা বাতাস ভেতরে আসতেই শরীর কেঁপে উঠল রুদ্রর। অর্ধেক ভাঙা ঘুমটা পুরোপুরি ভেঙে গেল। লম্বা এক হাই তুলল। গতরাতে সন্ধ্যা সন্ধ্যাই ঘুমিয়ে পড়েছিল ও। রাতে খাওয়াও হয়নি। প্রিয়তাও ডাকেনি ওকে। হয়তো ক্লান্ত আছে ভেবে। এখনো ঘুম ভাব কাটেনি চোখ থেকে। ঘাড় কাঁত করে তাকাল নিজের মেলে রাখা বাঁ হাতের দিকে। ওর বাঁ হাতের ওপর পরম নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে আছে প্রিয়তা। রুদ্র মৃদু হাসল। আধশোয়া হলো প্রিয়তার ওপর। মুখের ওপর এসে পড়া চুলগুলো ফুঁ দিয়ে সরিয়ে দিল। প্রিয়তার ভ্রু মৃদু কুঁচকে উঠল কিন্তু আবার গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে গেলো। রুদ্র মৃদু স্বরে ডাকল, ‘প্রিয়?’
কিন্তু প্রিয়তার কোন সাড়া পাওয়া গেলোনা। রুদ্র ঠোঁটে হাসি রেখেই ভ্রু কোঁচকালো। কিছু একটা ভেবে প্রিয়তার ডান কানের লতিতে আলতো করে কামড় দিল। প্রিয়তা ভ্রু কুঁচকে মৃদু গলায় ‘উম’ শব্দ করল। রুদ্র আবার ডাকল, ‘প্রিয়?’
‘হুম?’ ঘুমঘুম কন্ঠে বলল প্রিয়তা।
‘ ওঠো।’
প্রিয়তা মৃদু আওয়াজ করে আবার ঘুমিয়ে পড়তে যাচ্ছিল। রুদ্র বাঁধা দিয়ে বলল, ‘ অ্যাই মেয়ে? আজ কী হয়েছে? এতো ঘুমোচ্ছো কেন? ওঠো। দেরী হচ্ছে।’
প্রিয়তা চোখ পিটপিট করে তাকাল রুদ্রর দিকে। ঘুমঘুম কন্ঠে বলল, ‘ক’টা বাজে?’
‘ আটটা।’
কথাটা শুনে চোখ বড়বড় করে তাকাল প্রিয়তা। ঘাড় ঘুরিয়ে দেয়াল ঘড়ি দেখে বলল, ‘আজতো আপনাদের ন’টায় বের হওয়ার কথা ছিল তাইনা? আর আমি এখনো ঘুমোচ্ছি?’
‘ আচ্ছা কুল! রান্নার কাজ নিচে কেউ না কেউ ঠিক করে ফেলছে। ওসব নিয়ে ভেবো না। তুমি শুধু সার্ভ করে দিলেই হবে।’
‘ তাহলে ডেকে তুললেন কেন?’
‘ শাওয়ার নেব, রেডি হবো। হেল্প কে করবে ম্যাম?’
রুদ্র প্রিয়তাকে সরিয়ে দিয়ে উঠে বসে একটা হাই তুলে বলল, ‘আপনি কী বাচ্চা হ্যাঁ? নিজের কাজ নিজে করতে পারেন না? সব কিছু হাতে হাতে করে দিতে হবে কেন শুনি? এবার নিজে নিজে করার অভ্যেস করুন।’
রুদ্রও উঠে বসে বলল, ‘কেনো? তুমি থাকতে নিজে করার অভ্যেস করব কেন?’
‘ আমাদের বিয়ের তো দু বছর হতে চলল। এরপর যখন নতুন কেউ আসবে তখন আমি কী করব? এই বড় বাচ্চা সামলাবো না-কি ছোট বাচ্চা?’
বলতে বলতে প্রিয়তা ওয়াশরুমে চলে গেল। বেরিয়ে এসে দেখল রুদ্র বিছানায় বসে আছে। স্যান্ডো গেঞ্জি পরে নিয়েছে এরমধ্যেই। প্রিয়তা ওড়না নিয়ে বলল, ‘আপনি গোসল করে বের হন। আমি নিচ থেকে একবার ঘুরে আসি।’
রুদ্র কিছু বলল না। প্রিয়তাও অপেক্ষা করেনি। বলতে বলতে বেরিয়ে গেছে রুম থেকে। নিচে গিয়ে দেখল উচ্ছ্বাস সিঙ্গেল সোফায় হেলান দিয়ে বসে আছে। এইমাত্রই ঘুম থেকে উঠেছে হয়তো। হাফ প্যান্ট, স্যান্ডো গেঞ্জি পরা। কাকের বাসার মতো এলমেলো চুল, ফোলা চোখ। বছরখানেক আগে হলেও প্রিয়তা ফিক করে হেসে ফেলতো উচ্ছ্বাসের এই অবস্থা দেখে। কিন্তু আজ ওর হাসি পেলোনা। ভেতর থেকে এক দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো কেবল। প্রিয়তাকে দেখে উচ্ছ্বাস চমৎকার হাসি দিল। ফোনটা রেখে বলল, ‘ বউমনি। তোমার হাতের কফি না হলে হজম হবেনা। দাওনা প্লিজ।’
প্রিয়তা কোমরে হাত দিয়ে বলল, ‘ বাজে কত খেয়াল করেছো, ভাই? নটায় বের হবে। গোসল করোনি কেন এখনো?’
‘সারারাত বৃষ্টি হয়েছে। প্রচন্ড ঠান্ডা। পানিতো বরফ হয়ে আছে। এখন না রাতে এসে করবো।’
‘ কফিটাও তাহলে রাতেই খেও। সারারাত ছাইপাশ গিলে এখন শাওয়ার না নিয়েই বের হবে। বাজে ছেলে একটা। নিজের অবস্থা দেখেছো। এই চুল নিয়ে বের হলে কাক চলে আসবে নিজের বাসা মনে করে।’
বলে চলে যেতেই নিলেই উচ্ছ্বাস বলল, ‘ যাচ্ছিতো। রেগে যাচ্ছো কেন?’
বলে গাল ফুলিয়ে অসহায় মুখ করে নিজের ঘরে চলে গেল উচ্ছ্বাস। প্রিয়তা হেসে ফেলল। রান্নাঘরে গিয়ে দেখল নার্গিস রান্না করছেন। জ্যোতিও হাত লাগিয়েছে। প্রিয়তা রান্নাঘরে ঢুকে বলল, ‘সরি সরি। আমার উঠতে দেরী হয়ে গেলো আজ।’
জ্যোতি প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে হেসে বলল, ‘একটা সরি কম পড়েছে।’
প্রিয়তাও হেসে ফেলল। কফি বানানোর পাত্রটা নিয়ে বলল, ‘বাবাকে ভোরে চা দেওয়া হয়েছিল?’
‘ হ্যাঁ, আমি দিয়ে দিয়েছি।’
‘ কুহুর তো পরীক্ষা আছে আজ। নিশ্চয়ই সকাল সকাল উঠে পড়তে বসেছে। কিছু খেতে দিয়েছিলে? দেখেছো? আজকেই আমার এমন মরা ঘুমে ধরল।’
‘ আরে সমস্যা কী? আমরা সবাই ছিলাম তো। সবদিন কী সবার একরকম যায়? তোমার সাহেব উঠেছে?’
‘ উনিই তো আমাকে জাগালেন। আজ কী হয়েছিল কে জানে? না ডাকলে হয়তো আরও দু তিন ঘন্টা আরামে ঘুমিয়ে কাটাতাম।’
প্রিয়তা আর জ্যোতি দুজনেই সমানতালে হাসল। নার্গিস মুখ বাঁকালেন এদের হাসি দেখে। প্রিয়তা কফি করে ট্রেতে মগগুলো নিয়ে বলল, ‘আমি এখন ঘরে যাচ্ছি হ্যাঁ? ওনাকে সবকিছু গুছিয়ে দিয়ে চলে আসব।’
জ্যোতি বলল, ‘ তুমি ধীরেসুস্হে করো। এতো তাড়াহুড়োর কিছু নেই। আমরা আছিতো এখানে।’
প্রিয়তা মুচকি হেসে চলে গেল। জ্যোতিও আবার কাজে মন দিল। নার্গিস মুখ ঝামটা দিয়ে বলল, ‘দেখলেতো কেমন হুকুম জারি করে চলে গেল। বাড়ির বউ কি-না। তোমাকে কিছু মনেই করেনা। চাকরবাকর ভেবে বসে আছে।’
জ্যোতি ভ্রু কোঁচকালো। নার্গিসের দিকে না তাকিয়েই বলল, ‘সবসময় আগুন লাগানো কথাবার্তা না বললে যা খাও তা হজম হয়না?’
নার্গিস ইতস্তত কলে বলল, ‘ আমিতো_’
জ্যোতি ধমকে বলল, ‘চুপ করবে? তোমার প্যানপ্যানানি সহ্য হচ্ছেনা আমার এখন।’
প্রিয়তা ঘরে ঢুকে দেখল রুদ্র গোসল করে বেরিয়ে গেছে। আয়নায় নিজের প্রতিবিম্ব দেখতে দেখতে চুল মুছছে। প্রিয়তা কফির মগটা রেখে ওয়াশরুম গেল। রুদ্রর ভিজিয়ে রাখা গেঞ্জি আর ট্রাউজার ধুয়ে মেলে দিল ব্যালকনিতে। ততক্ষণে রুদ্রর কফি খাওয়া শেষ। প্রিয়তা নিজেই রুদ্রকে সুট পড়িয়ে দিলো। হাতের ব্রেসলেটটাও পরিয়ে দিল। প্রিয়তা বিয়ের আগের জমানো টাকা দিয়ে ওটা উপহার দিয়েছিল রুদ্রকে। কাজ শেষ করে প্রিয়তা যেতে নিলেই রুদ্র ওকে নিজের দিকে টেনে নিয়ে বলল, ‘তখন কী বলছিলে?’
প্রিয়তা মনে করার চেষ্টা করে বলল, ‘ কই? কী বলছিলাম?’
রুদ্র প্রিয়তার কোমরে হাত রেখে মোলায়েম গলায় বলল, ‘নতুন কারো আসার কথা বলছিলে মনে হয়?’
কথাটা মনে পড়তেই প্রিয়তা মনে মনে লজ্জা পেল। কিন্তু বাইরে সেটা প্রকাশ না করে বলল, ‘ হ্যাঁ তো? ভুলটা কী বলেছি। সারাজীবন কী এরকম এংরি ইয়াং ম্যান হয়ে থাকার ইচ্ছা নাকি? বাবা হওয়ার ইচ্ছে নেই। নাকি বুড়ো হওয়ার ভয় পাচ্ছেন?’
বলে ঠোঁট চেপে হাসল প্রিয়তা। রুদ্র এক হাতে প্রিয়তার নাক টিপে দিয়ে বলল, ‘দুষ্টুমি আজকাল বেশি করছো তুমি। বুড়ো হওয়া অবধি বেঁচে থাকি আগে।’
প্রিয়তা রুদ্রর দু কাঁধে হাত রেখে বলল, ‘আপনিতো কথা দিয়েছিলেন আমার সব স্বপ্ন পূরণ করবেন। আমার সব স্বপ্ন পূরণ না করে পালিয়ে যাওয়ার কথা ভাববেনও না।’
রুদ্র খানিকটা ভাবুক হয়ে বলল, ‘এখনো কোন স্বপ্ন পূরণ হওয়া বাকি আছে?’
‘ ভুলে গেলেন?’
‘ ধুমকেতু?’
‘ হ্যাঁ, ওটা না দেখে আমি মরতে চাইনা। আর আপনাকে ছাড়া আমি বাঁচতেও পারব না।’
‘ আচ্ছা সে দেখা যাবে।’
‘ এবার ছাড়ুন। দেরী হয়ে গেছে এমনিই। কাল রাতেও কিছু খাননি। খিদে পায়নি? চলুন।’
রুদ্র সময় দেখল। সত্যিই দেরী হয়ে যাচ্ছে। প্রিয়তার কপালে একটা চুমু খেলো রুদ্র। এরপর দুজনে একসঙ্গেই নিচে নামল।
ডাইনিং টেবিলে একসঙ্গেই খেতে বসেছে সবাই। নিয়মমতো প্রিয়তা আর জ্যোতি দুজনকে প্রাথমিক সার্ভ করে তারপর বসবে। যারযার পাতে খাবার দিয়ে ওরাও বসে পড়ল। না হয় একটু পরেই রুদ্র চোখ রাঙিয়ে তাকাবে প্রিয়তার দিকে। খাওয়ার মাঝে রাশেদ আমের কুহুকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কুহু মা? পরীক্ষা আছেতো আজ?’
কুহু মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল। রাশেদ জিজ্ঞেস করলেন, ‘প্রিয়তা মা? তোমার ক্লাস কখন?’
প্রিয়তা মাথা তুলে বলল, ‘এগারোটায় বাবা। কুহু আর আমি একসঙ্গেই বের হবো। ওর পরীক্ষা সাড়ে এগারোটায়।’
‘ আচ্ছা।’ এরপর জ্যোতির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আজ অফিস যাবেনা?’
জ্যোতি মুচকি হেসে বলল, ‘আজ বন্ধ আছে।’
রাশেদ মাথা ঝাকালেন। কিছু বললেন না আর। খাওয়া শেষে রাশেদ উঠে বেরিয়ে যেতে প্রিয়তা বলে উঠল, ‘দাড়ান, বাবা।’
রাশেদ দাঁড়িয়ে পেছন ফিরে তাকাল। প্রিয়তা জিজ্ঞেস করল, ‘ঔষধ কে খাবে?’
কেমন একটা মৃদু কাচুমাচু ভাব ফুটে উঠল রাশেদের চেহারায়। উনি খানিকটা ইতস্তত করে এদিক ওদিক তাকিয়ে বললেন, ‘রুমেই যাচ্ছিলাম খাওয়ার জন্যে।’
‘ আপনার রুমটা বুঝি সদর দরজার দিকে?’
রাশেদ কিছু বললেন না। ওনার মুখ দেখে মনে হল যেন চোর ধরা পরে গেছে। রুদ্র ভীষণ মজা পাচ্ছে। সারাজীবন যা ঘটেনি সেটাই ঘটেছে প্রিয়তা আসার পর। রাশেদের এইরকম মুখ দেখা গেছে। বাকি সবার একই অবস্থা। প্রিয়তা নিজেই গিয়ে রাশেদের ঔষধের বক্স নিয়ে এলো। দাঁড়িয়ে থেকে সব ঔষধ খাইয়ে তবেই ছাড়ল। রাশেদ, রুদ্র, উচ্ছ্বাস, জাফর একসঙ্গেই বের হলো ঘর থেকে। গাড়িতে উঠে বসে জাফর রাশেদকে বলল, ‘ ভাইজান, আপনার বউমা না মা ফিরে এসেছে।’
রাশেদ প্রসঙ্গ পাল্টে বললেন, ‘ইকবাল কোথায়?’
‘ কী জানি গতকাল থেকে ফোনে পাচ্ছিনা ওকে। আজকাল হঠাৎ হঠাৎ উধাও হয়ে যায়।’
উচ্ছ্বাস বলল, ‘ আমি কাল বিকেলে দেখেছিলাম ওনাকে। চিন্তিত লাগছিল।’
রাশেদ কিছু বললেন না। অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে একটা সিগারেট ধরালেন। এদিকে রুদ্রও চুপচাপ বাইরে তাকিয়ে আছে। গভীরভাবে ভাবছে কিছু একটা।
*
ভার্সিটি যাওয়ার জন্যে রেডি হচ্ছে কুহু। সবকিছু গোছগাছ করে আয়নায় নিজেকে দেখে নিলো একবার। ওড়নায় সেফটিপিন লাগানো শেষ হতেই ফোনের মেসেজ টোন বেজে উঠল। কুহু চমকালো। প্রায় দৌড়ে গিয়ে ফোনটা হাতে নিল। কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তির মেসেজ দেখে মুখ আনন্দে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। নীরব মেসেজ পাঠিয়েছে, ‘বেরিয়ে গেছো?’
কুহু রিপ্লে লিখল, ‘রেডী হয়েছি। এখনই বের হবো।’
‘ সাথে ঐ দুটো কালো হাতি ছাড়া আর কেউ যাবে?’
কুহু হেসে ফেলল। লিখল, ‘ ভাবি যাচ্ছে সাথে। ওনারও ক্লাস আছে।’
‘ আচ্ছা। অল দ্য বেস্ট। সাবধানে যাও। ভালোভাবে পরীক্ষা দাও। রাতে কথা হবে। বাই।’
‘ বাই। আর আপনিও সাবধানে থাকবেন।’
ফোন নামিয়ে রেখে মৃদু হাসল কুহু। এতক্ষণে মনটা শান্ত হলো। তখনই পেছন থেকে একসঙ্গে ‘ভাউ’ করে উঠল দুজন। কুহু ভয়ে প্রায় লাফিয়ে উঠল। পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখল জ্যোতি আর প্রিয়তা একসঙ্গে হাসছে। কুহু ঠোঁট ফুলিয়ে তাকিয়ে রইল দুজনের দিকে। প্রিয়তা এগিয়ে এসে কুহুর গাল টেনে দিয়ে বলল, ‘হবু বরের সঙ্গে প্রেম করা হচ্ছিলো বুঝি?’
কহুর গাল লাল হয়ে উঠল। লাজুক হেসে প্রিয়তাকে ছাড়িয়ে বসে পড়ল বিছানায়। জ্যোতি ওর পাশে বসে বলল, ‘এইযে মেয়ে এতো লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই। প্রায় দেড় বছর ধরেই দেখছি এসব। নতুন কিছু না।’
কুহু ঠোঁট চেপে হেসে ব্যাগের জিপার লাগালো। প্রিয়তা বলল, ‘তা নীরব আসবে কবে?’
কুহু ইশারা করে বলল, ‘ মাস দুই এর মধ্যে চলে আসবে।’
প্রিয়তা এখন বোঝে সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ। রুদ্র আর কুহু দুজনেই শিখিয়েছে ওকে। প্রিয়তা আমোদিত গলায় বলল, ‘তারপরেই বাড়িতে ধুমধাম করে আরেকটা বিয়ে হবে। ভাবতেই ভালো লাগছে। এখন খালি জ্যোতি আপু_’
বলতে গিয়েই থেমে গেল প্রিয়তা। ওর নিজের মুখে জ্যোতির বিয়ের কথা বলা ঠিক হবেনা বলেই মনে হলো ওর। খানিকটা অস্বস্তিতে পড়ে গেল। অস্বস্তি কাটিয়ে উঠতে জ্যোতিই সাহায্য করল ওকে। প্রসঙ্গ পাল্টে বলল, ‘এইযে, বসে আড্ডা জুড়ে দিয়েছে। দেরী হচ্ছেনা তোমাদের? চলো বের হও।’
প্রিয়তা আর কুহু ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল সত্যিই দেরী হয়ে যাচ্ছে। দুজনেই ব্যাগ কাঁধে নিয়ে জ্যোতির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে গেল। ওদের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল জ্যোতি। রুদ্রর সহধর্মিনী হওয়া ওর এমন এক স্বপ্ন ছিল যা কোনদিন পূরণ হওয়ার নয়। প্রথম প্রথম খুব কষ্ট হতো। প্রতি রাতে চোখের জলে বালিশ ভেজাতো। আওয়াজ যাতে না হয় মুখে শাড়ির আঁচল গুজেও কেঁদেছে বহুবার। কিন্তু এখন আর কান্না আসেনা। অস্বস্তি হয়না। সব জ্বালিয়ে দিতে ইচ্ছে করেনা। সময়ের সাথেসাথে পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে নিয়েছে ও। তবে রুদ্রকে মন থেকে মুছতে পারেনি। ওর প্রতি ভালোবাসার অনুভূতি ত্যাগ করতে পারেনি। আর না রুদ্রর জায়গা অন্যকাউকে দেওয়ার কথা এখনো ভাবতে পেরেছে।
ওর ভাবতেই অবাক লাগে মুখে ভালোভাবে কথা বললেও প্রিয়তাকে একসময় সহ্য হতোনা ওর। মনে হতো রুদ্রকে জোর করে ওর কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছে প্রিয়তা। ওর সব পাওনা নিজে আত্মসাত করে বসে আছে। কিন্তু মেয়েটার মধ্যে অদ্ভুত মায়া আছে। সব জেনেও কখনও জ্যোতির সাথে খারাপ ব্যবহার করেনি। কষ্টে দুঃখে জ্যোতি অনেক খোঁচা মেরে কথা বলেছে, কিন্তু প্রিয়তা কখনও পাল্টা জবাব দেয়নি। আস্তে আস্তে জ্যোতিও প্রিয়তার মায়ায় পড়ে গেল। আর এটাও বুঝল, জগতের সবার কাছে কঠোর রুদ্র আমের কেন এই মেয়েটার কাছেই এতোটা দুর্বল।
#চলবে…