অন্তর্হিত কালকূট পর্ব ৫০
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
৫০.
আমের ফাউন্ডেশনে রাশেদ আমেরের কেবিনে অদ্ভুত নীরবতা। দলের মুখ্য চারজন উপস্থিত। অনুপস্থিত কেবল ইকবাল। তার বদলে ঘরের এক কোণে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে রঞ্জু। পরবর্তী অস্ত্র ডেলিভারি কবে, কখন, কোথায় হবে সে বিষয়ে আলোচনা হলো। চেকপোস্টগুলো কীভাবে সামাল দেবে সে বিষয়েও বিস্তর পরিকল্পনা করা হলো। গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা শেষেই ঘরে নেমে এলো নিস্তব্ধতা। কারণ এরপরের আলোচনার বিষয়বস্তু মোটেও সুখকর নয়। রাশেদের লাইটার দিয়ে সিগারেট ধরানোর আওয়াজে সবার ধ্যান ভাঙল। কিন্তু কী দিয়ে কথা শুরু করবে কেউ বুঝতে পারল না। পরিবেশটা স্বাভাবিক করতে জাফরই মুখ খুলল সবার আগে। হালকা গলা ঝেড়ে বলল, ‘দুটো বড় বড় দল আমাদের কাছ থেকে অ’স্ত্র নিতে চাইছেনা, ভাইজান। ওনাদের মতে আমরা আগের মতো বেস্ট কোয়ালিটি তাদের দিতে পারছিনা। মাঝেমাঝেই গন্ডগোল হচ্ছে। আরও বেশ কয়েকজনের কাছ থেকে ইদানিং এমন টুকটাক অভিযোগ পাচ্ছি। এভাবে চললে কীকরে হবে? আমরা বাইরের দলগুলোর কাছে চুক্তিবদ্ধ। বিক্রি হোক বা না হোক ওদের কাছ থেকে নিয়মমাফিক অস্ত্র আমাদের আনতে হবে। ভয়ানক লস হয়ে যাবে, ভাইজান।’
উচ্ছ্বাস গাল হালকা চুলকে নিয়ে চিন্তিত গলায় বলল, ‘ কিন্তু আমরাতো একইরকম মাল ডেলিভারী দিচ্ছি। আর যা মাল আসছে আমরা সেটাই দিচ্ছি। প্রতিটা প্যাকেট করার আগে বারবার চেক করা হচ্ছে। সমস্যাটা কোথায় হচ্ছে বুঝতে পারছিনা।’
রুদ্র একবার তাকাল রাশেদের দিকে। উনি চেয়ারে হেলান দিয়ে একমনে সিগারেট টেনে যাচ্ছেন। কিন্তু সবার সব কথাই তার কানে পৌঁছেছে। সেটা জানে রুদ্র। ও বলল, ‘ বাইরে থেকে গন্ডগোল হওয়ার চান্স নেই। এমনিতেও সবসময় চেক করা হতো। কিন্তু যখন ক্রেতারা অভিযোগ করা শুরু করেছে তখন থেকেই মাল দেশে পৌঁছনো থেকে শুরু করে ডেলিভারী পাঠানোর আগ পর্যন্ত সবকিছু খুব খুটিয়ে খুটিয়ে চেক করে দেখেছি আমি। কোনরকম কোন গন্ডগোল পাইনি।’
উচ্ছ্বাস বিস্মিত হয়ে বলল, ‘তারমানে..’
‘ তারমানে একটাই। ডেলিভারী পাঠানোর পর রাস্তাতেই কোন গন্ডগোল হচ্ছে।’
জাফর হতবাক হলো। রাশেদকে একবার দেখে আবার রুদ্রর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘কিন্তু কীভাবে? আমাদের মাল কতটুকু যাচ্ছে, কোন রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে, কোথায় কত প্যাকেট এক্সচেঞ্জ করা হচ্ছে এগুলোতো আমরা পাঁচজন ছাড়া কেউ জানেনা। গন্ডগোল করবে কীকরে?’
রাশেদ ঠোঁট থেকে সিগারেট নামিয়ে ধোঁয়া ছাড়লেন। অ্যাশট্রেতে ছাই ঝাড়তে ঝাড়তে বললেন, ‘সেটা নিয়েই আলোচনায় বসতে হবে আমাদের। বৈঠকঘরে। আজ রাতে। ইকবাল কোথায়?’
জাফর বলল, ‘ কী জানি? ওর তো কোন খোঁজখবর-ই নেই। জানিনা কো_’
উচ্ছ্বাস কথাটা শেষ করার আগেই ইকবাল ঘরে প্রবেশ করল। কেমন বিচলিত দেখালো তাকে। চোখ মুখ দেখে মনে হচ্ছে গতরাত নির্ঘুম কাটাতে হয়েছে তাকে। রাশেদের কেবিনেও অনুমতি না নিয়ে ঢুকে পড়ল। বোঝাই যাচ্ছে ভীষণ অন্যমনস্ক সে। প্রথম প্রশ্ন জাফরই করল, ‘কাল থেকে কোন খোঁজ নেই তোর। কোথায় ছিলি?’
কথাটায় যেন ধ্যান ভাঙল ইকবালের। কেমন চমকে উঠল। ইতস্তত করে সারাঘরে চোখ বুলালো একবার। জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বলল, ‘অসুস্হ ছিলাম। গ্রামের বাড়ি গিয়ে বিশ্রাম নিচ্ছিলাম একটু।’
উচ্ছ্বাস বলল, ‘ ফোনেও পেলাম না আপনাকে। ফোন করেতো বলতে পারতেন?’
ইকবাল কিছুক্ষণ জবাব দিলোনা। ভেতরে ভেতর ছটফট করল। নিজের অস্বস্তি ভাবটা লুকোনোর পূর্ণ চেষ্টা করেও সেটা করতে পারল না। কোনমতে বলল, ‘সুইচড অফ হয়ে গিয়েছিল। খেয়াল করিনি। ওখানে চার্জার নিতেও মনে নেই তাই_’
রাশেদ এতক্ষণ গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছিলেন ইকবালকে। এবার বেশ থমথমে গম্ভীর কন্ঠে বললেন, ‘এখন শরীর কেমন আছে?’
‘ ভালো, রাশেদ বাবা।’ রাশেদের দিকে তাকালোনা ইকবাল।
‘ আর কোথাও বের হওয়ার আছে আজ তোর।’
‘ না, এখানেই আছি।’
‘ রাতে বৈঠকঘরে মিটিং আছে। আজ ডিনার আমার বাড়িতে। চলে আসিস।’
‘ জ্বি, আসব।’
আলোচনা ওখানেই শেষ হলো। রাশেদ, জাফর আর ইকবাল কেবিনেই রয়ে গেলেন। ফাউন্ডেশনের কাজে ব্যস্ত রাখলেন নিজেদের। রুদ্র উচ্ছ্বাস আর রঞ্জু বেরিয়ে গেল।
নিচে নেমে রুদ্র রুঞ্জুকে প্রশ্ন করল, ‘দুপুরে কোথায় খাবি?’
রঞ্জু বলল, ‘ এখানেই একটা হোটেলে খেয়ে নেব।’
‘ এখন কোথায় যাস?’
‘ টাকা আনতে হবে, ভাই। আজকে দেওয়ার কথা ছিল বেপারীর।’
রুদ্র পকেট থেকে কিছু টাকা বের করে রঞ্জুর শার্টের পকেটে গুজে দিয়ে বলল, ‘ টাকা না থাকলে বলবি। টাকা চাইলে তোকে শু’ট করবে না কেউ। আমি খেয়াল না করলে তো না খেয়ে থাকতি দুপুরে।’
মাথা নিচু করে ফেলল রঞ্জু। ধরা পড়ায় লজ্জা পেয়েছে। রুদ্র কৃত্রিম ধমক দিয়ে বলল, ‘ দাঁড়িয়ে না থেকে কাজে যা।’
রঞ্জু মাথা নিচু করে চলে গেল। ঠোঁটে মুচকি হাসি ঝুলে আছে। সে হাসি রুদ্রর প্রতি সম্মানের, শ্রদ্ধার, ভালোবাসার।
দুজনেই জিপে চড়ে বসল। আকাশটা মেঘলা। তবে এখনই বৃষ্টি হবে বলে মনে হচ্ছেনা। জিপ স্টার্ট দিতে দিতে রুদ্র বলল, ‘কোথায় যাবি?’
উচ্ছ্বাস সকৌতুকে বলল, ‘চল ভাই আমাজন ভ্রমণ করে আসি। বহুদিন অ্যাডভেঞ্চার কপালে জোটেনা। শত্রুগুলো সব কেমন নেতিয়ে গেছে। মজা পাচ্ছিনা। সব পানসে। জন্তু জানোয়ারের সাথেই একটু খেলাধুলা করে আসি।’
‘ আমি হাত চালালে ভয়ানক অ্যাডভেঞ্চার ফিল হবে। চালাবো?’
রুদ্রর হুমকিকে থেমে গেল উচ্ছ্বাস। হালকা হেসে বলল, ‘আরে এতো সিরিয়াস হচ্ছিস কেন? সিগারেট কিনতে হবে। ভাবছি সাথে চাও খেয়ে নেব। রেস্টুরেন্ট ভালো লাগেনা। কোন এক রোড সাইডে চল। কিন্তু..’
‘ ইউনাইটেড হসপিটালের সামনের দোকানটা বাদে, তাইতো?’
উচ্ছ্বাস কিছু বলল না। চোখ ফিরিয়ে তাকিয়ে রইল বাইরের দিকে। রুদ্রও তখন কিছু না বলে কাছেপিঠে একটা চায়ের দোকানে গিয়ে জিপ থামালো। দু প্যাকেট সিগারেট কিনে বসল চায়ের দোকানে। দু কাপ চা দিতে বলে সিগারেট মুখে গুজলো রুদ্র। নিজেরটা ধরিয়ে উচ্ছ্বাসের সিগারেটটাও ধরিয়ে দিল। লাইটার পকেটে রাখতে রাখতে বলল, ‘মাঝেতো খাওয়া ছেড়ে দিয়েছিলি। আবার শুরু না করলে হতোনা?’
উচ্ছ্বাস হাসল। ঠোঁট থেকে সিগারেট নামিয়ে মুখভর্তি ধোঁয়া ছেড়ে বলল, ‘ ছাড়ার কারণটাই যখন নেই, তখন ছেড়ে দিয়ে লাভ কী? কিছু একটাতো আঁকড়ে ধরে বাঁচতে হবে।’
‘ এখনতো আর ও সেই হসপিটালে জব করেনা। তাহলে ওখানে যেতে এতো সমস্যা কীসের?’
‘ কিছু জিনিস মনে করতে চাইনা তাই।’
‘ ভুলতে পেরেছিস?’
প্রশ্নটা শুনে রুদ্রর দিকে তাকাল উচ্ছ্বাস। রুদ্র সিগারেট টানতে টানতে চারপাশে চোখ বুলাচ্ছে। উচ্ছ্বাস কিছু বলল না। ছোট্ট একটা ঢোক গিলল। কান্না পায়না এখন ওর। গত এক বছরে কান্নাকে জিতে নিতে পেরেছে ও। তবে নতুন রোগ বাসা বেঁধেছে। কান্না না আসলেও বুক ভার হয়ে আসে। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয়। কষ্টগুলো সব যেন গলাতেই দলা পাকিয়ে বসে থাকে। সিগারেটে পরপর তিনটে টান দিয়ে আকাশের দিকে তাকাল উচ্ছ্বাস। রুদ্র ওর দিকে না তাকিয়ে এক হাত ওর কাঁধে রাখল। নিজের অজান্তেই চাপা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো ভেতর থেকে।
জীবনে সবসময় সবকিছু পরিকল্পনা করে হয়না। না চাইতেও জীবনে অনাকাঙ্ক্ষিত অনেক ঘটনা ঘটে। উচ্ছ্বাসের জীবনের এমন এক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ছিল নাজিফার সঙ্গে ওর সম্পর্ক। নাজিফার জেদ আর নিজের দুর্বলতার কাছে হার মেনে নিয়েছিল উচ্ছ্বাস। না চাইতেও নাজিফার সঙ্গে গভীর প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পরেছিল। ভীষণ মিষ্টি সম্পর্ক ছিল ওদের। নাজিফার প্রতি উচ্ছ্বাসের আশ্চর্য সমর্পন। নাজিফার কড়া শাসনের আড়ালে থাকা প্রচন্ড ভালোবাসা। উচ্ছ্বাসের ছোটখাটো ভুল, নাজিফার রেগে যাওয়া। নাজিফার রাগ ভাঙাতের উচ্ছ্বাসের অদ্ভুত কর্মকান্ড। সেসব দেখে ওপর ওপর চোখ রাঙালেও আড়ালে নাজিফার হাসিতে ফেটে পড়া। নাজিফার যখন রাতে ডিউটি থাকতো। উচ্ছ্বাস দাঁড়িয়ে থাকতো হসপিটালের সামনে। ডিউটি শেষে দুজনে একসঙ্গে চায়ের দোকানে চা খেতো। ফাঁকা রাস্তায় হাত ধরে হাঁটতো। কথায় কথায় নাজিফা রেগে উঠতো আর উচ্ছ্বাস নিজের সরল হাসিতে পরিস্থিতি সামলে নিতো। নাজিফার ব্যবহার যতটা ম্যাচুউরড ছিল ততটাই বাচ্চাসুলভ ছিল উচ্ছ্বাসের ব্যবহার। নাজিফার কথায় মদ, সিগারেট ছেড়ে দিয়েছিল উচ্ছ্বাস। টানা নয় মাসের গভীর প্রণয়ে একে অপরের অস্তিত্বে মিশে গিয়েছিল দুজন। এরমধ্যে ওদের প্রেম সম্পর্কে রুদ্র, প্রিয়তা, কুহু, জ্যোতি সবাই জানতো। এ নিয়ে মাঝেমাঝে হাসি-মজা করা, ওদের ঝগড়ার সময় উচ্ছ্বাসকে খোঁচা মেরে কথা বলা চলতেই থাকতো। ভীষণ সুখময় ছিল সেই সময়গুলো। কিন্তু এরপর এলো সেই বিভিষিকাময় দিন। নাজিফার ডিউটি শেষ হয়েছিল লাঞ্চ টাইমে। একসঙ্গে লাঞ্চ সেড়ে নিয়মমতো পার্কে গিয়ে বসেছিল দুজন। তবে সেদিন নাজিফাকে কেমন অন্যমনস্ক লাগছিল। মনে হচ্ছিল কিছু একটা নিয়ে গভীরভাবে ভাবছে সে। ব্যপারটা বুঝতে পেরে উচ্ছ্বাস প্রশ্ন করল, ‘ কী হয়েছে?’
উচ্ছ্বাসের ডাকে হালকা চমকাল নাজিফা। চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে বলল, ‘হু? হ্যাঁ, কথা ছিল তোমার সাথে?’
‘ তো বলো। কথা বলতেই তো বসেছি আমরা একসঙ্গে।’
বলে একহাতে জড়িয়ে ধরল নাজিফাকে। নাজিফা আস্তে করে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, ‘বাবা আর ভাইয়ারা আমার বিয়ের কথা ভাবছে, উচ্ছ্বাস।’
‘ ভালোতো! বিয়ে করে ফেলো।’
‘ মজা করছিনা আমি।’
উচ্ছ্বাস এবার খানিকটা গম্ভীর হলো। কিছু একটা ভেবে বলল, ‘ওদের বলেছো আমার কথা?’
‘ এখনো না। তবে বললে আমার মনে হয়না আপত্তি করবে। হ্যাঁ তুমি অনাথ এটা শুনে হয়তো ভাইয়ারা একটু বেঁকে বসবে। কিন্তু যখন জানবে তুমি রাশেদ বাবার কাছে বড় হয়েছো। আর রাশেদ বাবা যদি নিজে একবার এসে কথা বলে তাহলে আর কোন সমস্যাই থাকবেনা। বাড়ির সবাই রাজি হয়ে যাবে।’
কথাগুলো নাজিফা একবুক আশা নিয়ে বললেও উচ্ছ্বাসের চেহারায় একফোঁটা আশার আলোও দেখা গেলোনা। ও এখানো গম্ভীরভাবে বসে আছে। সদা প্রাণোচ্ছল উচ্ছ্বাসকে অমন গম্ভীর রূপে দেখে নাজিফা ভ্রু কুঁচকে ফেলল। কপট রাগ দেখিয়ে বলল, ‘ থম মেরে বসে আছো কেন? তুমি যত তাড়াতাড়ি পারো রাশেদ বাবার সাথে কথা বলো। উনি যাতে বাবার সঙ্গে কথা বলেন। আর আমিও বাবাকে বলে রাখব। চিন্তা করোনা।’
উচ্ছ্বাস এবারেও নিরুত্তর। নাজিফা এবার অবাকই হলো। উচ্ছ্বাসকে হালকা ধাক্কা দিয়ে বলল, ‘ কী ভাবছো? আমি কী বলেছি শুনেছো?’
দীর্ঘ সময় পর উচ্ছ্বাস নাজিফার দিকে তাকাল। চোখে-মুখে একরাজ্যের অসহায়ত্ব। নাফিজা কিছুক্ষণ চুপচাপ দেখল উচ্ছ্বাসকে। তারপর ঠান্ডা গলায় বলল, ‘তুমি কী আমাকে বিয়ে করতে চাও না উচ্ছ্বাস? নাকি শুধু প্রেম করে আনন্দ করার জন্যেই_’
উচ্ছ্বাস সঙ্গে সঙ্গে শক্ত করে চেপে ধরল নাজিফার হাত। অস্হির গলায় বলল, ‘ছিহ্ নাজিফা! এতোবড় অপবাদ দিওনা।’
‘ তাহলে চুপ করে আছো কেন?’
উচ্ছ্বাস আবার চুপ থাকল। নাজিফা জোর করল না। ধৈর্য্য ধরে উচ্ছ্বাসের কিছু বলার অপেক্ষা করল। দীর্ঘ নীরবতার পর দীর্ঘশ্বাস ফেলল উচ্ছ্বাস। তারপর বলল, ‘ আমার সম্পর্কে অনেক কথা তোমার অজানা নাজিফা। অনেক কঠিন সত্যি তোমার এখনো অজানা।’
নাজিফা বুঝতে না পেরে বলল, ‘ কী এমন সত্যি যা আমি জানিনা।’
উচ্ছ্বাস ছোট ছোট দুটো শ্বাস নিল। মনের সঙ্গে যুদ্ধ করে নিজেকে প্রস্তুত করে বলল, ‘তার আগে আমাকে কথা দাও, এখন আমি তোমাকে যা যা বলব, সব শুনে তুমি আমার সঙ্গে সম্পর্ক রাখো বা না রাখো, এই কথাগুলো কাউকে কখনও বলবেনা। কোনদিন না। যদি সত্যি একমুহূর্তের জন্যেও আমাকে ভালোবেসে থাকো, আমার কথা তুমি রাখবে। কথা দিচ্ছো তো?’
নাজিফা কিছুক্ষণ ভাবল। তারপর মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি দিলো। উচ্ছ্বাস বলতে শুরু করল, ‘তুমি জানো আমি অনাথ। রাশেদ বাবার কাছেই বড় হয়েছি। আমের ফাউন্ডেশনের সদস্য আমি। রাশেদ বাবার সকল ব্যবসায় সহযোগিতা করি। এলাকায় ছোটখাট মাস্তানিও করি। কিন্তু এসব ছাড়াও আরেকটা সত্যি আছে। যেটা তুমি জানোনা। আর সেটা হচ্ছে আমি একজন বড় ক্রিমিনাল।’
নাজিফা চমকে তাকাল উচ্ছ্বাসের দিকে। নাজিফার হতভম্ব দৃষ্টি দেখে চোখ নামিয়ে নিল উচ্ছ্বাস। এরপর অকপট স্বীকারোক্তি করল নিজের প্রিয়তমার কাছে। অবৈধ ব্যবসা, খু’ন, চাঁদাবাজি নিজের সব অপরাধ সম্পর্কে খুলে বলল। সব শুনে স্তব্ধ হয়ে গেল নাজিফা। পাথরের মতো স্হির চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে দেখল উচ্ছ্বাসকে। তারপর আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াল। উচ্ছ্বাসও উঠে দাঁড়াল। নিজেকে নিজেকে নিকৃষ্ট অপরাধী মনে হচ্ছে এখন ওর। ও নাজিফার হাত ধরতে গেলে নাজিফা আস্তে করে হাত ছাড়িয়ে নিল। উচ্ছ্বাসের বুক ভারি হয়ে এলো। অসহায় কন্ঠে বলল, ‘ বিশ্বাস করো এই কারণেই তোমাকে এড়িয়ে চলতাম আমি। কোনদিন চাইনি তুমি আমার কাছাকাছি আসো। কিন্তু তুমিই এমন জেদ ধরেছিলে যে_। নিজেও যথেষ্ট দুর্বল ছিলাম তোমার প্রতি। তাই বেশিদিন দূরে রাখতে পারিনি। কিন্তু তখনই আমি তোমাকে সত্যিটা বলতে চেয়েছিলাম। কিন্তু পারিনি। চেষ্টা করেও বারবার আটকে যাচ্ছিলাম। আমি জানি আমি ঠিক করিনি। এটাকে ঠকানো বলে। কিন্তু আমি_’
আর কিছু বলতে পারল না। বাক্য শেষ করার মতো আর কোন শব্দ খুঁজেই পেলোনা উচ্ছ্বাস। অস্হির চোখজোড়া চারপাশে দৌড়ে বেড়াল একবার। হঠাৎই ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল নাজিফা। অগ্নিদৃষ্টি বর্ষণ করল উচ্ছ্বাসের ওপর। ঠাটিয়ে পরপর দুটো চড় মারল উচ্ছ্বাসের গালে। উচ্ছ্বাস কোন প্রতিবাদ করল না। চুপচাপ চড় দুটো হজম করে নিল। গালে একবার হাত বুলিয়ে অসহায় চোখে তাকালো নাজিফার দিকে। নাজিফা চিৎকার করে বলল, ‘ঠক! প্রতারক! কীকরে পারলে এরকম কাজ করতে? এতো জঘন্য সত্যিটা আমার কাছ থেকে লুকিয়ে রাখতে? একটা খু’নি, সন্ত্রাসীকে এতোদিন ভালোবেসে এসেছি আমি? আমি একজন নার্স। মানুষের সেবা করি, তাদের সুস্থ হতে সাহায্য করি। সেখানে একজন খু’নিকে_! ছিহ!’
ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নিল নাজিফা। উচ্ছ্বাসের বুকে যেন ধারালো তীরের মতো বিঁধল নাজিফার এই ঘৃণা। ও নাজিফাকে ধরতে এলে নাজিফা সঙ্গে সঙ্গে দু পা পিছিয়ে গিয়ে বলল, ‘ছোঁবে না আমাকে তুমি। ঐ হাতে না জানি কত মানুষের র’ক্ত লেগে আছে। আমি জাস্ট ভাবতে পারছিনা।’
দু হাতে নিজের মাথা চেপে ধরে শব্দ করে কেঁদে ফেলল নাজিফা। উচ্ছ্বাসের সবকিছু এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। দম বন্ধ হয়ে আসছে কষ্টে। ও জানতো একদিন এমন মুহূর্ত আসবে। কিন্তু সেই মুহূর্ত এতোটা যন্ত্রণার হবে সেটা বুঝে উঠতে পারেনি। নিজের চেয়েও বেশি নাজিফার জন্যে কষ্ট হচ্ছে ওর। কতোটা কষ্ট পেলে একটা মেয়ে এভাবে কাঁদে! উচ্ছ্বাস বহু কষ্টে কিছু বলতে গেলে এক হাতে থামিয়ে দিল নাজিফা। নিজের চোখ মুছে লম্বা শ্বাস ফেলে শান্ত হল। তারপর উচ্ছ্বাসের চোখে চোখ রেখে বলল, ‘ ভয় পেওনা। আমি এসব কথা কাউকে বলব না। শুধুমাত্র তোমাকে কথা দিয়েছি বলে নয়। রাশেদ বাবার কাছে ঋণী আমরা। ওনার জন্যেই আজ আমরা এখানো বেঁচে আছি। তাই সেই কৃতজ্ঞতা থেকেই চুপ থাকব। কিন্তু অপরাধ অপরাধই হয়। কোনদিন ক্ষমা করব না আমি। না ওনাকে, আর না_’ একটু থেমে। ‘তোমাকে। তোমার মুখটাও দেখতে চাইনা আমি।’
কথাটা বলে দৌড়ে ওখান থেকে চলে গেল নাজিফা। উচ্ছ্বাস আটকাতে গিয়েও থেমে গেল। কেমন চারপাশটা শূণ্য মনে হল ওর। মনে হলো অনন্ত, উত্তপ্ত মরুভূমিতে কেউ ওকে ফেলে রেখে গেছে। একা, নিঃসঙ্গ। ও এদিক ওদিক ছুটে বেড়াচ্ছে কিন্তু বের হওয়ার পথ পাচ্ছেনা। মরিচীকা ওর সব শক্তি শুষে নিচ্ছে। ও ওখানেই পড়ে আছে তৃষ্ণার্ত, অসহায় অবস্থায়। বহুদিন পর সেদিন আবার সিগারেট জ্বালালো উচ্ছ্বাস। চেষ্টা করল চোখ দিয়ে খানিকটা জল বের করার। কিন্তু চোখের জলও বিশ্বাসঘাতকতা করল ওর সাথে। কিছুতেই বের হলোনা।
রুদ্র হালকা ধাক্কা দিতেই বর্তমানে ফিরল উচ্ছ্বাস। কোনরকম হাসার চেষ্টা করে বলল, ‘শালা! এতো ঠ্যালাঠেলি করিস কেন? মুখ কেউ টেপ লাগিয়ে রেখেছে?’
রুদ্রর হাসি পেলোনা। ও গম্ভীর হয়েই বলল, ‘ ইচ্ছে করে নিজের ভাগ্যে এমন দুঃখ না আনলে হতোনা? আর এখন না নিজে ওর কোন খোঁজ নিস, আর না আমাদের নিতে দিস।’
উচ্ছ্বাসের ঠোঁট থেকে এখনো হাসি। হেসেই বলল, ‘ ও এখন ভালোই আছে। খারাপ থাকারতো কথা না। আর এখন এসব বলে কী লাভ? খোঁজ নিয়েই কী লাভ? যা হওয়ার তো হয়েই গেছে। চাইলেও কিছু ঠিক হওয়া সম্ভব না।’
রুদ্র কিছু বলল না। কথা সত্যি। চাইলেও এখন আর কিছু ঠিক হওয়ার নেই। অনেক দেরী হয়ে গেছে।
*
রাতে খাওয়া-দাওয়ার পর আমের ভিলার বৈঠকঘরে মিটিং বসল। তবে ইকবালকে মিটিংয়ে পাওয়া গেলোনা। জাফর, উচ্ছ্বাস দুজনেই বারবার ফোন করেছে। কিন্তু ইকবালকে পাওয়া যায়নি। রঞ্জুকে পাঠানো হয়েছিল ইকবালের খোঁজে। কিন্তু ইকবালের ফ্ল্যাট কিংবা রাস্তায় কোথাও ইকবালের খোঁজ পাওয়া যায়নি। শেষে ইকবালকে ছাড়াই মিটিং করতে হলো। এবং ঠিক করা হল কাল সকালে ওর দেশের বাড়ি লোক পাঠিয়ে খোঁজ নেওয়া হবে। মিটিং করার পর পরিবেশটা মোটেও স্বাভাবিক ছিলোনা। কারণ সবাই বুঝতে পেরেছিল খুব শীঘ্রই বড় বিপদ আসতে চলেছে।
প্রিয়তা শুয়ে পড়েছে। রুদ্র ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে সোজা ব্যালকনিতে চলে গেল। সিগারেট জ্বালিয়ে ডুব দিল গভীর ভাবনায়। হঠাৎ এমন কেন হচ্ছে? এতো টাকার অ’স্ত্র। সবগুলোই বেস্ট কোয়ালিটির। কোয়ালিটি সব ওর নিজের চেক করা। কিন্তু ক্রেতাদের হাতে মাঝেমাঝেই ডিফেক্টযুক্ত কিংবা ঠিকভাবে কাজ না করা মাল যাচ্ছে। কেন? গন্ডগোলটা ঠিক কোথায়? অনেক ভেবে তিনটা সম্ভাবনা দেখতে পেলো রুদ্র। এক, হয় বাইরে থেকে ওদের হাতে খারাপ মাল আসছে। দুই, মাল আসার পর থেকে ডেলিভারীর মধ্যকার সময়টাতে কেউ খারাপ করে দিচ্ছে। তিন, ডেলিভারীর পথে কেউ কোন ঝামেলা করছে। প্রথম সম্ভাবনাটা বাদ দিল রুদ্র। সেটা সম্ভব নয়। দ্বিতীয় সম্ভাবনাটাও প্রায় অসম্ভব। তবুও আর একবার চেক করবে ও। বাকি রইল তৃতীয় সম্ভাবনা। আর হওয়ার চান্সই বেশি। মাল পাঠানোর পর থেকে পৌঁছনোর মধ্যকার সময়টাতেই কিছু একটা ঘটছে। কিন্তু কী? আর কিছু ঘটাতে হলেও ওদের গোপন খবর, তথ্য, কার্যক্রম সম্পর্কে অপর পক্ষের সুস্পষ্ট ধারণা থাকতে হবে। সেই ধারণা সে পাচ্ছে কোথায়? কে আড়ালে থেকে ধ্বংস করে দিতে চাইছে সবকিছু? এদিকে ইকবালে সন্দেহজনক ব্যবহার। হঠাৎ হঠাৎ উধাও হয়ে যাওয়াটাও ভাবাচ্ছে ওকে।
তখনই পেছন থেকে রুদ্রকে জড়িয়ে ধরল প্রিয়তা। রুদ্র অর্ধেক খাওয়া সিগারেটা দেখে নিছে ফেলে দিল। তারপর ওকে আঁকড়ে ধরা প্রিয়তার দুই হাতে হাত রেখে বলল, ‘ঘুমোও নি?’
‘কী হয়েছে আপনার? কিছু নিয়ে চিন্তিত?’
‘তেমন কিছু না?’
‘ আমি জানি আমি আপনাদের ওসব ঝামেলা বুঝবো না। তবে শেয়ার করলে মন হালকা হয়। শর্টকাটে বলে দিন।’
রুদ্র হাসল। প্রিয়তার হাত সরিয়ে ওর দিকে ঘুরল। তারপর প্রিয়তার কোমর জড়িয়ে ডান গালে চুমু খেল। চাঁদের আলোয় মুগ্ধ চোখে কিছুক্ষণ দেখল নিজের প্রিয়কে। প্রিয়র অপূর্ব সুন্দর চোখ দুটোকে। প্রিয়তাও তাকিয়ে আছে রুদ্রর মুখের দিকে। তারপর ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে বলল, ‘ব্যবসায় একটু ঝামেলা হচ্ছে প্রিয়। কেউ কিছু একটা গন্ডগোল করছে। হয়তো সেটা আমাদের দলেরই কেউ। এভাবে চলতে থাকলে বিশাল বিশাল লসের ধাক্কা সামলাতে হবে আমাদের। আর যে বিষয়টা আমাকে ভাবাচ্ছে তা হলো এবারের ইনফরমেশটি খুব সিক্রেট। দলের খুব কাছের লোকেরাই জানে। ওদের মধ্যে কেউ আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করলে_’
এটুকু বলে একটু থামল রুদ্র। তারপর ঠান্ডা গলায় বলল, ‘ইকবাল ভাইকেও অদ্ভুত লাগছে ইদানিং।’
প্রিয়তা ভ্রু কুঁচকে বলল, ‘ইকবাল ভাই?’
রুদ্র ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ‘ছাড়ো এসব।’
প্রিয়তা মুচকি হেসে রুদ্রর দু গালে হাত রেখে বলল, ‘ সেই ভালো। অনেক রাত হয়েছে। এসব নিয়ে পরেও ভাবা যাবে।টেনশনে ঘুম আসছেনা নিশ্চয়ই? চলুন আমি মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি। ঘুম চলে আসবে।’
বলে রুদ্রর হাত ধরে টেনে ভেতরে নিয়ে গেল প্রিয়তা। রুদ্র বালিশে শুয়ে পড়ল। প্রিয়তাও রুদ্রর পাশে আধশোয়া হলো। তারপর রুদ্রর চুলে আঙুল চালিয়ে বলল, ‘ঘুমিয়ে পড়ুন।’
প্রিয়তার নরম হাতের ছোঁয়ায় অদ্ভুত আরাম পেল রুদ্র। শান্তিতে চোখ আপনাআপনি বুজে গেল। মনে পড়ল ওর মাও ছোটবেলায় এভাবেই যত্ন করে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতো। চট্টগ্রামের সেই গ্যারেজে জ্বরের সময়ও প্রিয়তা এভাবেই ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছিল। আর সেদিনই প্রথম রুদ্রর মনে হয়েছিল এই মেয়েটা ওর জন্যে বিশেষ। খুব বিশেষ।
পরেরদিন সকালটা শুরু হলো নতুন সমস্যা দিয়ে। ইকবালের দেশের বাড়ি খোঁজ করেও তাকে পাওয়া যায়নি। এমনকি সম্ভাব্য সব জায়গায় খোঁজ করেও ইকবালের হদিশ পাওয়া যায়নি। সারাদিন খোঁজার পর একটা ব্যাপার বোঝা গেল। ইকবাল নিখোঁজ।
#চলবে…
[ রি-চেইক করিনি।]