
অনুপ্রেরনার সেরা গল্প
আনিস ভাই আমার কাছে ব্যর্থ একজন মানুষ। যেই মানুষের বউ তাকে ছেড়ে তার বন্ধুর সঙ্গে চলে যায় তিনি ব্যর্থ না হওয়ার কোন কারণ নেই। উনার দুই সন্তানও তাদের মায়ের সঙ্গে আছে। জুয়েল ভাই সন্তানসহ ভাবীকে গ্রহণ করেছে এবং আমার জানামতে উনারা বেশ ভালো আছেন। জুয়েল ভাই ব্যবসায়ী হিসেবে বেশ প্রতিষ্ঠিত। অন্যদিকে আনিস ভাই আমার চোখে উড়নচণ্ডী মানুষ।
তিনি প্রায় মানুষের কাজে দৌড়াদৌড়ি করেন। একবার উনাকে দেখলাম মন খারাপ করে বসে আছেন। তখন ভাবী এবং বাচ্চারা উনার সঙ্গে থাকতেন। আমি উনাকে জিজ্ঞেস করলাম
কি ব্যাপার আনিস ভাই? আপনার মন খারাপ কেন?
ভাই জানেন আমার উপর তালায় একজনের ক্যান্সার। উনাকে দ্রুত উন্নত চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে নেয়া উচিত। দেশের ডাক্তাররা হাল ছেড়ে দিয়েছে। কিন্তু লোকটার বাঁচার বড় ইচ্ছে। আমার সঙ্গে দেখা হলেই বলে
আনিস আমার মনে হয় দেশের বাইরে গেলে আমি সুস্থ হয়ে যাবো।
টাকা পয়সা থাকলেতো পরিবারের সদস্যরা উনাকে দেশের বাইরে নিয়ে যেতেই পারে। আমি বললাম।
টাকা পয়সাতো আছে। দুই ছেলে কানাডাতে থাকে। আর মেয়ে থাকে দুবাইতে । কিন্তু সবচাইতে সমস্যা কি জানেন কারোই সময় নেই। সবাই বেশ ব্যস্ত। উনাকে দেখলে এত মন খারাপ হয়। মনে হয় আমি উনাকে দেশের বাইরে নিয়ে যাই। লোকটার মনের আশা পূরণ হউক।
আমি অবাক হয়ে দেখলাম আনিস ভাইয়ের চোখ ছলছল করছে। এর কিছুদিন পর দেখি উনি ইন্ডিয়া থেকে আমাকে ফোন দিয়েছেন।
ভাইজান চাচার জন্য খাস দিলে দোয়া করবেন। আজকে উনার একটা অপারেশন আছে।
আমি অবাক হয়ে বললাম
আনিস ভাই আপনার বাবাতো একমাত্র ছেলে জানতাম। চাচা আসলো কোথা থেকে?
আরে ভাই আমার উপর তালার সেই চাচা। উনাকে নিয়ে ইন্ডিয়াতে আসছি। অনেক কষ্টে অফিস থেকে ছুটি নিয়েছি। চাকরি থাকে কিনা সন্দেহ। তবুও চাচার আশা পূর্ণ হউক।
সেই আনিস ভাই কয়েকদিন ধরে আমাকে নক করছে।
ভাই আপনার বাসা চেক করে দেখবেন। কোন পুরাতন শীত বস্ত্র আছে কিনা? এই দেশের কত মানুষ যে শীতে কষ্ট পাচ্ছে তার হিসেব নেই। কত বাচ্চা শিশু এই শীত বস্ত্রের অভাবে রাতের বেলায় ঠাণ্ডায় কাপতে কাপতে ঘুমাতে পারছে না। অথচ আমাদের ঘরের আলমিরাতে কত শীত বস্ত্র অবহেলায় পরে আছে।
আমি আনিস ভাই কথার সঙ্গে একমত হই। কিন্তু সেগুলো আর বের করা হয় না। একদিন তিনি নিজে এসে হাজির।
আমি কিঞ্চিত বিরক্ত হই। মানুষ এতো নাছোড়বান্দা হলে মুশকিল। উনি আমার দিকে তাকিয়ে হেসে বললেন
ভাই আপনি যখন নিজের হাতে আপনার একটা সুয়েটার শীতের রাত্রিতে কাঁপতে থাকা কোন মানুষকে দিবেন। সে যখন আপনার দিকে তাকিয়ে স্বর্গীয় হাসি দিবে তখন আপনার কাছে মনে হবে আপনি বুঝি বেঁচে আছেন এই মুহূর্তটির জন্য।
আমি তবুও আমার বিরক্ত গোপন করে আলমিরা থেকে আমার পুরাতন শীতবস্ত্র তাকে বের করে দিলাম।
আমার মনে মনে হাসি পায়। এই লোকটার কাণ্ড কারখানা দেখে। উনার বউ উনাকে ছেড়ে চলে গিয়েছে। ছেলেমেয়েরা উনার সঙ্গে নেই। লোকটার তেমন টাকা পয়সা নেই। আমি শুনেছি উনি যেই ডিপার্ট্ম্যান্টে কাজ করে সেটাতে টাকা বানানোর অনেক সুযোগ রয়েছে। কিন্তু সততার কারণে উনার জীবনে প্রাচুর্যতা নেই। খুব সাধারণ জীবন উনার।
উনি আমাকে রীতিমত জোর করে শীতের রাত্রিতে বের করে নিয়ে এসেছেন। হয়তো বুঝতে পেরেছিলেন যে শীত বস্ত্র সংগ্রহে আমার বাসায় চলে আসাতে আমি বিরক্ত হয়েছিলাম। এখন কোনভাবে সেই ঘটনাকে ব্যালেন্স করার চেষ্টা করছেন। ঢাকায় বেশ শীত পড়েছে। আমি শার্ট, ভেতরে গঞ্জি, তার উপর জাম্পার, এবং একটা জ্যাকেট দিয়ে ঠাণ্ডা থেকে বাঁচার চেষ্টা করছি। কানে কান টুপি। আমরা মালিবাগের রাস্তা দিয়ে হাটছি। এদিক সেদিক অনেক মানুষ, অনেক বাচ্চা ছেলে, মেয়েকে দেখতে পাচ্ছি যে শীতে কাঁপছে। কেউ কেউ আগুন ধরানোর চেষ্টা করছে। তাদের পড়নের পোশাক দেখে আমার নিজের কাছেই লজ্জাই লাগছে। মনে হচ্ছে এতদিন এদের দেইনি কেন। আনিস ভাই একটা ভ্যান গাড়ি ভাড়া করেছে। ভ্যান গাড়ি ভর্তি শীত বস্ত্র। যাকেই পাচ্ছেন তাকেই সুয়েটার, জ্যাকেট, শার্ট দিচ্ছেন।
সেইসব মানুষের হাসি দেখে, তাদের চোখের জল দেখে আমার সত্যি বেশ ভালো লাগছে। মনে হচ্ছে ভালো খাওয়া, সুন্দর জায়গায় ঘুরা, এইসবের চাইতে বড় আত্মতৃপ্তি একজন মানুষকে যদি খুশী করা যায়। তার প্রয়োজনে যদি পাশে দাঁড়ানো যায়। কিছুক্ষণ পর দেখি একটা গাড়ি থেকে দুইজন ছেলেমেয়ে এবং একজন মহিলা নেমেছে। ছেলে মেয়ে গুলো অনেক শীতবস্ত্র নিয়ে এসে আনিস ভাইয়ের সঙ্গে যোগ দিয়েছে। তারা প্রবল উৎসাহ নিয়ে বিতরণ করছে।
মহিলাটি আমার সঙ্গে হাঁটছে।
আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম
আপনারা কি কোন এন জি ও থেকে এসেছেন?
জি না আমি ওর স্ত্রী ছিলাম। এবং এই দুইজন ছেলে মেয়ে হচ্ছে আমাদের ছেলে মেয়ে।
আমার সঙ্গে আনিস ভাই এর অনেক দিনের পরিচয় থাকলেও উনি আমাকে কখনো বউ বাচ্চার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন নি। তাই আমার চেনার কথাও না। কিন্তু উনাদেরকে এখানে দেখে আমার অবাক লাগছে। আনিস ভাই কিছুক্ষণ পর পর বাচ্চা দুটোকে জড়িয়ে ধরছেন।
ভাবি ভালো আছেন?
মহিলাটি হেসে ফেললেন। ভাই আমি একসময় ভাবী ছিলাম কিন্তু এখন নেই। কিন্তু এখনো ও যেখানে কোন চ্যারিটি করতে যায় আমাদের জানায় আমরা ওর সঙ্গে যুক্ত হই। আমাদের ছেলে মেয়েরা ওর জন্য পাগল বলতে পারেন।
আমি বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে আছি।
ভাই সত্যি কথা কি জানেন আমার সন্তানেরা আনিসকে ভীষণ ভালোবাসে। তারা তাকেই তাদের রোল মডেল হিসেবে চিন্তা করে। আমার ছেলে, মেয়েরা আমার মতো লোভী হয়নি। আমার কাছেও আনিস খুব ভালো একজন মানুষ। বলতে পারেন আমি তার জীবনে নেই কিন্তু সে আমাদের জীবনে প্রবলভাবে আছে। তবে আমার ও উপায় ছিল না। ভালো একজন মানুষ হওয়া এবং একজন ভালো স্বামী হওয়ার মধ্যে অনেক পার্থক্য আছে। সংসার জীবনের ভালো থাকা অনেক কিছুর উপর নির্ভর করে। সেখানে শুধু ভালোমানুষি দিয়ে চলে না।
আমি মাথা নাড়লাম।
আপনি কি উল্টা দিকে একজন মানুষকে দেখতে পাচ্ছেন। সিগারেট টানছে।
জি।
উনি আমার বর্তমান স্বামী জুয়েল। ও আমাকে সবকিছু দিয়েছে। প্রাচুর্যতা, আলিশান লাইফ, আমাদের বাচ্চাদের জন্য উন্নত পড়াশুনা, তাদের জন্য অভিজ্ঞ টিচার। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার কি জানেন। আমার বাচ্চারা সেসব সুবিধে প্রত্যাখ্যান করেছে। তারা খুব সাধারণ জীবন যাপন করে আনিসের মতো।
তাদের স্কুলে এইম ইন লাইফ রচনায় তারা লিখেছে যে তারা তাদের জন্মদাতা পিতার মতো পরোপকারী হতে চায়। তারা আনিসের মতো হতে চায়। মাঝে মাঝে খুব দুঃখ পাই, কষ্ট পাই কিন্তু আবার কখনো আমার সন্তানদের নিয়ে খুব গর্বও হয়। ওরা আমার মত হয়নি। ভালো মানুষ হয়েছে। জানেন আজ তাদের আপনি যেই আনন্দ দেখতে পাচ্ছেন কিন্তু বাসায় তারা সারাক্ষন মনমরা হয়ে থাকে। আমি তাদের সবকিছু দিতে চেষ্টা করার পরেও তাদের আনন্দ দিতে পারিনি। জানেন জুয়েলের কোনদিন সন্তান হবে না। ও কিন্তু এদের নিজ সন্তানের মতো ভালোবাসে। জুয়েল আনিসকে খুব ঈর্ষা করতো তার জীবনের সবসময়। সে আমাকে নিয়ে আনিসকে পরাজিত করতে চেয়েছে। সে আমাকে ঠিকই পেয়েছে। কিন্তু আনিসকে পরাজিত করতে যেয়ে আমি এবং জুয়েল দুইজনই পরাজিত হয়ে বসে আছি।
আমি দেখতে পাচ্ছি চাঁদের আলোয় এক বাবা, তার সন্তানদের মানবতা শিখাচ্ছে। ভালোবাসা, মায়া ছড়িয়ে দিতে হয় তা শিখাচ্ছে। বাচ্চাগুলোর চোখ উজ্জ্বল দেখাচ্ছে। তাদের মুখে আনন্দের, উচ্ছ্বাসের হাসি।
আমি ভাবছি মানব জীবন কত অদ্ভুত হয়। মানুষের কত ধরনের প্রাপ্তি হয়। এই আপাদমস্তক অতি সাধারন মানুষটা আমার কাছে ব্যর্থ একজন মানুষ কিন্তু আজকে তাকে আমার চাইতেও সফল মানুষ মনে হচ্ছে।
#আনন্দের_ফেরিওয়ালা
#আমিনুলের_গল্প_সমগ্র