#পাপ পর্ব ৩ ও শেষ
সমাপ্তি
(#নোট: আমি দুই পর্বেই গল্পটি শেষ করে দিয়েছিলাম। কিন্তু পাঠকদের বিপুল সাড়া পেয়ে এবং রিফাতের বিষয় জানতে চেয়ে পরের পর্ব করার অসংখ্য অনুরোধে আমি এই পর্বটি করেছি। এটিই শেষ পর্ব। আশা করি সবার ভাল লাগবে। অনুরোধ রইল আগের দুইটি পর্ব না পড়ে এ পর্ব পড়বেন না। অগ্রিম ধন্যবাদ সবাইকে।)
“প্রায় ৫ বছর পরের দৃশ্য”
নিউইয়র্কের কুইন্স এ একটি সাজানো গোছানো সুন্দর নার্সিং হোমের প্লে গ্রাউন্ডে একদল ছেলেকে বাস্কেটবল খেলতে দেখা যাচ্ছে।
এরমধ্যে একজন ছেলেকে দেখলে যে কেওই বুঝবে সে স্থানীয় নয়। প্রায় ৬ ফুট উচ্চতা, উজ্জ্বল শ্যামলা বর্নের, মাথা ভর্তি ঘন কোকড়ানো চুল, আর জ্বলজ্বলে কালো দুটি চোখ।
একের পর এক বল বাস্কেটে ফেলছে আর হৈ হুল্লোড়ে মেতে উঠছে সবাই।
এর মধ্যে একজন ডাক দিয়ে বলে উঠল,
Hey Rifat, you are as good as always man. You should play for the city team after your release.”
(অনুবাদ: রিফাত তুমি বরাবরের মতোই চমৎকার খেল। রিলিজের পর তোমার শহরের দলের হয়ে খেলা উচিত হবে।)
রিফাত মুচকি হাসি দিয়ে সায় জানাল।
এর মধ্যে খেলায় একজন হসপিটাল কর্মী এসে বাঁধা দিল। রিফাত এর কাছে ভিজিটর এসেছে।
রিফাত দৌড়ে ভিজিটিং রুমে চলে যায়। হলরুমের মত বড় একটা রুমে বেশ কয়েকটা বেঞ্চ পাতা সামনে পেছনে করে। পেশেন্ট এর সাথে ভিজিটর দের কথোপকথন এর জন্য। একটু দূরে প্রহরী দাড়িয়ে থাকে। সশরীরে কোন বাউন্ডারি ছাড়া ভিজিটিং সবার জন্য প্রযোজ্য নয়। শুধুমাত্র যারা প্রায় সুস্থ ১-২ মাসের মধ্যে রিলিজ পাবে হসপিটাল থেকে তাদের জন্য এই ব্যবস্থা।
হলে ঢুকতেই রিফাত দেখে গাঢ় নেভি ব্লু রুং এর শাড়ি পড়ে অসম্ভব সুন্দর একজন মহিলা বসে আছেন। আর সামনে বিশাল বড় ফুলের তোরা সাজানো। আর একটা বার্থডে কেক।
– মা তুমি এসেছ। আমি ভেবেছিলাম তোমার কাজের চাপে এবার আসতে পড়বেনা।
হেসে জড়িয়ে ধরল নীলিমা রিফাত কে,
– আমার রিফাতের জন্মদিন আর আমি আসব না সেটা কি হয়!? কখনোই না।
রিফাত কেক কেটে তার দৈনন্দিন জীবনের গল্প বলতে থাকে এক মনে। নীলিমা রিফাতের গল্প শুনতে শুনতে আনমনা হয়ে পড়ে।
এই সেই রিফাত ৫ বছর আগে যে ভয়ানক অসুস্থ ছিল। আজকে সে তার সামনে বসে সাবলীল ভাবে কথা বলছে। মা বলে গ্রহণ করে নিয়েছে। মা মরা ছেলেটার জন্য সবসময়ই নিজের সর্বোচ্চ টুকু দিয়েছে নীলিমা।
ছেলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রিফাতের দায়িত্বে থাকা ডাক্তার এর সাথে কথা বলতে যায় নীলিমা।
(ইংরেজি কথোপকথন এর বঙ্গানুবাদ দিচ্ছি)
– ডক্টর, কি মনে করছেন? রিফাত আসলেই সভ্য সমাজে চলার মত সুস্থ হয়েছে তো?
নাকি আরেকটু সময় প্রয়োজন হবে।
– না মিস নীলিমা। আমরা অনেক অবজারভেশন করেছি। অনেক টেস্ট নিয়েছি। সবগুলোতেই সে অসম্ভব ভাল মার্ক পেয়েছে। অসম্ভব মেধাবীও সে। আইকিউ টেস্টে রিফাত রেকর্ড করা নাম্বার পেয়েছে। সে সুস্থ।
তাকে যদি আরও বেশি সময় এখানে রাখি বরং এটা তাকে মানসিক ভাবে কষ্ট দিতে পারে।
ধন্যবাদ জানিয়ে নীলিমা নার্সিং হোম থেকে বের হয়ে তার বাসার দিকে হাঁটছে। রিফাত এর কাছাকাছি থাকার জন্য ওর নার্সিং হোম এর কাছাকাছি ই একটা বাসা ভাড়া নিয়েছে। এই ৫ বছরে অনেক কিছু পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে।
সেই ৫ বছর আগে সেই ভয়াবহ ২৫ নভেম্বরের রাত কোনদিনই সে ভুলবে না। মৃত্যুর সাথে লড়াই করে সে ফিরে এসেছে। কিন্তু সেই বিষক্রিয়ার সাইড ইফেক্ট হিসেবে তার বা হাতে প্যারালাইজড এর মত হয়ে গিয়েছিল। দীর্ঘদিন থেরাপির পর এখন অনেকটা নড়াচড়া করতে পারে, দৈনন্দিন কাজ চলে যায় তার। কিন্তু সার্জন হিসেবে জীবন এর ইতি সেই ২৫ নভেম্বরেই হয়ে যায়।
এখন সে কুইন্সে একটি মেডিকেল ইউনিভার্সিটি তে লেকচারার হিসেবে আছে। এই জীবনটাও খারাপ না। নতুন নতুন তরুণদের শেখানো, তাদের গড়ে উঠতে দেখতে ভাল লাগে তার।
বাসায় ফিরে ফ্রেশ হয়ে স্বভাবমত কফি বানিয়ে রিডিং রুমে বসে। বইপত্র ওল্টাতে ওল্টাতে হঠাৎ একটা কাগজের দিকে চোখ আটকে যায় নীলিমার। তার আর রাশেদের ডিভোর্স পেপার।
খুব নীরবে একটি দীর্ঘশ্বাস নিল নীলিমা। কিন্তু সেটা হতাশা থেকে নাকি আফসোস থেকে নাকি সস্তি থেকে নীলিমা নিজেও জানেনা। এই মানুষটাকে অবলম্বন করে বাঁচতে চেয়েছিল। হয়নি। মানুষ চিনতে পারেনি। রাশেদ এর অতীতের ব্যাপারটা জানা জানি হওয়ার পর ওর ক্যারিয়ারে ধ্বস নামে। একাকীত্ব, ক্যারিয়ার সব মিলিয়ে প্রায় পাগল প্রায় হয়ে যায়। নীলিমা পড়ে জানতে পেরেছে যে জীবনের শেষ দিকটায় সে নাকি উন্মাদের মত রাস্তায় রাস্তায় ঘুরেছে।
গত মাসে তার মৃত্যুর খবরটা পায় নীলিমা। রোড এক্সিডেন্ট। ড্রাইভার পালিয়ে গিয়েছে চাপা দিয়ে। শনাক্ত করা যায়নি। খবরটা রিফাতকে জানায় সে। রিফাত কিছুই বলেনি চুপ করেছিল। শুধু বলেছিল,
“মা আজকের পর বাবার বিষয়ে আমার কাছে কোন কথা তুলবে না। এই একটি অনুরোধ রইল। আমি আর কিছু জানতেও চাইনা, শুনতেও চাইনা।”
নীলিমাও আর কখনো কোন কথা তুলেনি।
জীবনটা বড্ড অদ্ভুদ। কাঠগড়ায় সব আসামি দাঁড়াতে না পারলেও একজনের কাঠগড়ায় কোননা কোনভাবে দাড়াতেই হয়। সেই হিসাব ভিন্ন, আরও অনেক বেশি ভয়ংকর। এক রাশেদ অতীতের এক পাপের সাজা এভাবে দিল, তাকে মেরে পালিয়ে যাওয়া সেই আগন্তুক ও হয়তো কোনো না কোন ভেবে তার প্রাপ্য সাজাও পেয়ে যাবে।
আনমনে ভাবতে ভাবতে আবার কফির কাপে চুমুক দেয় নীলিমা। হাতে রিফাতের রিলিজের কিছু ফর্মালিটি পূরণের কাগজপত্র।
কেন জানি খুশি হবার সব কারণ থাকলেও খুশি হতে পারছেনা নীলিমা। অজানা একটা অস্বস্তির কাঁটা মনে খচ খচ করছে।
*******************************************************
আজকে অবশেষে সেই প্রতীক্ষিত দিন এল। রিফাত এর আজকে রিলিজ ডে। ফুল হাতে নীলিমা নার্সিং হোম এর বাইরে অপেক্ষা করছে।
সাদা রঙের একটা জ্যাকেট আর নীল রঙ্গা জিন্স এ রিফাত কে খুব সুন্দর লাগছে। ছেলেটা বাবার উচ্চতা, আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব পুরোটাই পেয়েছে। এই রিফাতকে দেখলে ভুলেও কেও তার অন্ধকার অতীতের কথা আঁচ করতে পারবেনা। বাংলাদেশে পড়ালেখা করলে সে ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারে থাকত। এখানে নার্সিং হোম এই তার পড়ালেখা হয়েছে। স্পেশাল কেয়ারে।
রিফাত এসেই নীলিমাকে জড়িয়ে ধরল।
– আমার জন্য অনেক কষ্ট করেছ মা। অনেক ভালবাসি তোমাকে।
নীলিমা কেঁদে ফেলল। আনন্দের কান্না। রাশেদ এর পর আর বিয়েও করেনি সে। সে ঠিক করেছে এই ছেলেটাকে সুখী দেখে সে মরবে এটাই তার এই ছোট্ট জীবনের চাওয়া আর কিছু নয়।
*
রিফাত এর রিলিজের প্রায় ৩ মাস হতে চলল। সবই স্বাভাবিক আছে। একটা কলেজে ভর্তি করে দেওয়া হয়েছে তাকে। রিফাত অসম্ভব মেধাবী হওয়ায় খুব একটা অসুবিধা হয়নি। নার্সিং হোম এর ডাক্তার এর রেকমেন্ডেশন এর জন্য আরও সহজ হয়েছে কাজটা।
একদিন ছুটির সকালে নাস্তা খেতে খেতে খবর দেখছিল রিফাত আর নীলিমা। একটি ১০-১২ বছরের ছেলে হারিয়ে গিয়েছে। এই দিকে এরকম ঘটনা খুব বিরল। তাই খবরটা বেশ চড়াও হয়ে ছড়িয়েছে।
– বুঝলাম না। এই বিদেশের মাটিতেও এখন নিরাপত্তা নেই দেখছি।
– আরে মা দুষ্টু লোক সব খানেই থাকে। বিদেশে ক্রাইম তো আরও সহজ। অনেক নীরব, পরিত্যক্ত জায়গা আছে। এরকম একটা কেন দশ বারোটা বডি গুম করে দেওয়া কোন ব্যাপারই না।
বাংলাদেশে তো জায়গাই নেই, চারদিকে মানুষ গুম গুম করে।
বলে অট্ট হাসিতে ভেঙ্গে পড়ছে রিফাত। যেন একটা খুব মজার কথা বলেছে। কথাটা একটু কেমন লাগলেও পাত্তা দেয়নি নীলিমা। যেখানে অভিজ্ঞ ডাক্তাররা কোন অসুবিধা বলেনি সেখানে তার এত ভাবা ঠিক না। তাকে সহজ ভাবে নিতে হবে সব কিছু।
এভাবে প্রায় বছর দুয়েক হতে চলল। কিন্তু ছেলে হারানো মেয়ে হারানোর বিষয়টা দিন দিন বেড়েই চলছে। প্রথম দিকে ছোট ছেলে মেয়েরা হারাতো। ইদানিং দুইজন প্রাপ্ত বয়স্ক মেয়ে নিখোঁজ হয়েছে।
এর মধ্যে রিফাত একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে পার্টটাইম জব নিয়েছে। রাতে রিফাতকে জব থেকে পিক করে নীলিমা। এমনই এক রাতে রিফাতকে নিয়ে বাসায় যাচ্ছে।
– রিফাত এলাকাটা আর আগের মত নেই। ক্রাইম বাড়ছে। পুলিশ ধরতে পারছেনা কিছুই।
তবে ধারণা করছে কাজটা একজনের ই করা।
কারণ প্রত্যেক নিখোঁজ ব্যক্তির সর্বশেষ দেখা পাওয়ার স্থানে একটা করে লাল রঙের মাশরুম এর ডিজাইন করা প্লাস্টিকের লোগো পাওয়া গিয়েছে।
তুই সাবধানে থাকিস বাবা।
– কি যে বল মা। তোমার ছেলের মেধার সাথে পেরে ওঠে এমন কেও এই কুইন্সে তো দূরে থাক সমগ্র নিউইয়র্ক এ নেই।
– রিফাত আত্মবিশ্বাস ভাল। কিন্তু অতিরিক্ত কোন কিছুই ভাল না।
– সরি মা।
এরপর কেন জানি আর কেওই কোন কথা বলল না। নীলিমার মন থেকে জোর করে দূরে সরিয়ে রাখা অস্বস্তির মেঘটা যেন আবার ছেয়ে যাচ্ছে।
পরদিন রিফাত কলেজে চলে যাবার পর রোজকারের মত রিফাতের রুম থেকে আধোয়া কাপড় নিতে গেল নীলিমা। কাপড় নিতে নিতে রিফাতের আলমারির নিচের ড্রয়ার টা হালকা ফাঁক হয়ে আছে দেখতে পেল। এটা রিফাত তালা দিয়েই যায়। আজকে খোলা দেখতে পাচ্ছে। ভিতর টা খুলে নীলিমা একটা চিৎকার দিয়ে উঠল,
চারটা বাক্স রাখা। একটায় অনেকগুলো মাছি মেরে জমা করে রাখা। কিন্তু একটারও পাখা নেই। পাখা আরেকটা বাক্সে রাখা। আরেকটা বাক্সে অনেক প্রজাপতি রাখা। এখানেও কোনটার পাখা নেই। পাখা আরেকটা বাক্সে রাখা।
এটা দেখে যা বোঝার বুঝে গেল নীলিমা। হাত থেকে সব কাপড় ফেলে দিয়ে বসে পড়ল মেঝেতে।
অস্বস্তি টা আজকে থেকে বাস্তব রূপ পেল।
মেঝেতে বসেই হিসেব কষতে লাগল নীলিমা। রিফাত নার্সিং হোম থেকে বের হবার পর যা যা ঘটতে শুরু করেছে তার সাথে অনেক কিছুই মিলে যাচ্ছে। পাত্তা না দেওয়া ছোট খাটো খটকা গুলো এখন যেন সব উত্তর পেয়ে যাচ্ছে।
হঠাৎ মেইন দরজা খোলার আওয়াজ পেল নীলিমা।
রিফাত এসেছে!
কাপড় জায়গা মত রেখেই নীলিমা নিজ রুমের ওয়াশরুমে দৌড়ে চলে গেল। রিফাত এসেই নিজ ঘরে ঢুকেছে শব্দ শুনে বুঝতে পারছে নীলিমা।
হাত মুখ ধোয়ার ভান করে রুম থেকে বেরোতেই মুখোমুখি হল রিফাতের।
– আরে রিফাত তুই! কলেজে যাস নি!
– একটা জরুরী এসাইনমেন্ট নিতে ভুলে গিয়েছিলাম তাই ফেরত আসলাম। তুমি ক্লাসে কখন যাবে?
– এইত বের হচ্ছি।
– ঠিকাছে মা সাবধানে থেকো। বলে জড়িয়ে ধরে নীলিমাকে বিদায় নিল রিফাত।
আবার রুমে ঢুকল নীলিমা, ড্রয়ার টা তালা দেওয়া। হুম এটাই তালা দিতে এসেছে সে।
এরপর পুরো রুম হন্যে হয়ে খুজেছে কোন একটা প্রমাণের আশায়। এভাবে প্রমাণ ছাড়া অনুমান করে পুলিশে গিয়ে কোন লাভ হবেনা। হিতে আরও বিপরীত হবে।
সেদিন আর ক্লাসে যায়নি নীলিমা। সেন্ট্রাল লাইব্রেরী তে গিয়ে সাইকোপ্যাথ দের ওপর স্টাডি করল সারাদিন।
রিফাত হচ্ছে সেইসব রেয়ার সাইকোপ্যাথ দের অন্তর্ভুক্ত যারা প্রচন্ড বুদ্ধিমত্তা, শার্প আইকিউ এর অধিকারী হওয়ায় তাদের সাইকোপ্যাথ বৈশিষ্ট্য গুলো খুব সহজেই লুকিয়ে রাখতে পারে। এরা সংসার করতে পারবে, এমনকি খুন করে এসে আদুরে ভঙ্গিতে বউ এর সাথে ডিনার করতে পারবে, দাদা/নানা হয়ে নাতি নাতনি দের গল্প শুনাতে পারবে কেও কিছু আইডিয়াও করতে পারবেনা। ইতিহাসে এধরনের বেশ কয়েকজন সাইকোপ্যাথ এর উদাহরণ আছে। নীলিমা শুধু ভাবেনি তার রিফাত ও সেরকমই হবে কিংবা হয়তো আরও ভয়াবহ।
এখন নীলিমার একটাই কাজ আর তা হচ্ছে প্রমাণ খুঁজে বের করা আর নিখোঁজ হওয়া অসহায় মানুষগুলোর হদিস বের করা।
*
নীলিমা এরপর প্রায় ১০-১৫ দিন সকাল থেকে সন্ধ্যা রিফাত কে ফলো করেছে। কোনো অস্বাভাবিকতা নজরে পড়েনি। কিছুই নজরে আসছে না।
রীতিমত হতাশ হয়ে পড়ছে সে। বাসায় প্রতি মুহুর্তে নিজেও আতংকে থাকে। নিজের নিরাপত্তার কথা ভেবে একটা পিস্তল নিয়েছে। নিজের ছেলের ভয়ে এখন পিস্তল নিয়ে ঘুমাতে হচ্ছে, এর চেয়ে কেন সে মরে গেল না ভাবতে ভাবতে হাউ মাউ করে কাঁদছে নীলিমা।
এমন সময় হঠাৎ রিফাতের পার্ট টাইম জব এর জায়গা থেকে ওর বয়সী একটা ছেলে বাসায় কড়া নাড়ল।
(ইংরেজি কথোপকথন এর অনুবাদ দেওয়া হল)
ম্যাম, রিফাত এই ফোনটা স্টোরে রেখে এসেছিল। তাই দিতে আসলাম।
– রিফাত কোথায়? ও স্টোরে নেই?
– না ম্যাম। ও আজকে হাফ টাইম করেছে। অসুস্থ বলে বেরিয়ে আসল। আমি ভেবেছি বাসায় আছে। তাই চলে এলাম।
– আচ্ছা ঠিকাছে। আমি দিয়ে দিব।
যে ফোন নীলিমার হাতে সেটা রিফাতের ফোন না। ফোনে চার্জ নেই। চার্জ দিয়ে অন করার পর ওয়াল পেপারে একটা মেয়ের ছবি। মেয়েটাকে চেনে নীলিমা। এলিটা মার্গারেট ওর নাম। শেষ যে মেয়েটা হারিয়েছে চারদিকে ওরই খবর ছড়িয়ে আছে।
হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে আসছে নীলিমার। ফোন লক করা নেই। কিছুই নেই রিফাতকে ধরার মত ভেতরে। কিন্তু এটা শক্ত ক্লু। পুলিশকে দেওয়া যাবে। কিন্তু এখনই নিয়ে গেলে আর রিফাত যদি আঁচ করতে পারে জীবনের জন্য গা ঢাকা দেবে।
কাঁপা কাঁপা হাতে গ্যালারির ছবি পাগলের মত ওলোট পালোট করছে। নাহ্ কিছু নেই। রিফাতের যে ট্রেইট তাতে করে সে টর্চার করে আনন্দ পায়। নিয়েই মেরে ফেলবে না। সুতরাং ভিকটিম দের টর্চার করার মত একটা জায়গা তার লাগবেই। ওদেরকে কোথায় রেখেছে সেই আস্তানা টা পেতেই হবে।
এভাবে ছবি ওল্টাতে ওল্টাতে একটা ছবির দিকে হঠাৎ নজর গেল। মেয়েটা জিন্সের একটা ক্যাপ পড়ে হাতে “ভি” সাইন দেখিয়ে একটি ছবি তুলেছে।
ছবিটি তুলেছে রকওয়ে বিচ বুলভারড রকওয়ে পার্কের পরিত্যক্ত একটি হসপিটালের সামনে। হসপিটাল টি প্রায় ৩০ বছরের উপর ধরে পরিত্যক্ত।
জায়গাটি দেখলে ভুতের বাড়ির মত লাগে দিনের বেলাতেই। হয়তো আজকাল ইয়াং জেনারেশন এর কোন এডভেঞ্চার হিসেবে বন্ধুদের কাছে বাহাদুরি দেখাতে এখানে ঘুরতে গিয়েছিল মেয়েটি।
এরপরে আর কোন ছবি নেই।
নীলিমা জানেনা এটাই সেই আস্তানা কিনা। কিংবা কি হতে যাচ্ছে। সে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। তার আরও সতর্ক হওয়া উচিত ছিল। সাথে নেওয়া পিস্তল টার দিকে তাকালো। আজ এস্পার না হয় অস্পার করতেই হবে।
তার আর হারাবার কিছুই নেই। মরবার ভয় ও আর কাজ করছে না। অনুভূতি শূন্য লাগছে নিজেকে।
পরিত্যক্ত হসপিটাল টিতে পৌঁছাতে পৌঁছাতে সন্ধ্যে হয়ে গিয়েছে। প্রচন্ড ভয় লাগছে। না মৃত্যুর ভয় না। কিসের ভয় কিসের আতঙ্ক বুঝতে পারছেনা। হসপিটাল টা পরিত্যক্ত। এটা ভেঙ্গে নতুন প্রকল্প করার কথা কিন্তু সেই কথা পর্যন্তই। কিছুই হয়নি। এক সময় ছোটদের ধনুষ্টংকার রোগের চিকিৎসা হত এখানে।
পায়ে পায়ে এগুচ্ছে নীলিমা। কিছু দেখা যাচ্ছে না। ফোনের আলো দিয়ে কোনমতে যাচ্ছে। যেতে যেতে একটা রুমের কাছে গোঙানোর মত শব্দ শুনতে পেল। পিলে চমকে উঠল। দরজা খুলে ঢুকতেই ছোট ঘুপচির মত একটা রুমে এক কোনায় ভাঙ্গা হসপিটালের বেডের সাথে এলিটাকে বাঁধা অবস্থায় দেখতে পেল। শরীরে অজস্র আঘাতের চিহ্ন।
এই দৃশ্য নীলিমা নিতে পারল না। চিৎকার করে উঠল। বমি করে দিল। এটা কোন মানুষের কাজ না। এটা পশুর কাজ। পশুও না এটা পিশাচের কাজ।
কোনমতে নিজেকে সামলে বাঁধন খুলতে গেল মেয়েটার। তখনই পেছন থেকে অট্ট হাসির আওয়াজ পেল।
রিফাত!
-বাহ্! মা এসে গেছে দেখছি সময়মত।
নীলিমার ভয়ে আতংকে চোখ থেকে মনি যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসছে। পুরো শরীর কাঁপছে। শুধু মনের জোরে দাঁড়িয়ে আছে। চুপ করে আছে। কোন উত্তর দিচ্ছে না রিফাতের কথার।
রিফাত আবার বলতে শুরু করল,
– উফ মা মা মা। এই ডাক টা বিগত ৭ টা বছরে যতবার দিতে হয়েছে ততো বেশি তোকে ঘৃনা করেছি।
ইশ হাপিয়ে উঠছিলাম আদর্শ ছেলের অভিনয় করতে করতে। ভালই হয়েছে তুই টের পেয়ে গিয়েছিলি আমার ব্যাপারে। নাহয় এই অভিনয় আরও কয় বছর যে করা লাগত!
– মানে? রিফাত!
আমার ভালোবাসার এই প্রতিদান?
কি দোষ ছিল আমার?
– দোষ ছিল মানে!? তোর জন্য আমার বাবা মারা গিয়েছে। আমার মা মারা গিয়েছে গিয়েছে। তার মৃত্যুর কারণ বের করে নায়িকা সাজতে কে বলেছিল তোকে। আমার একমাত্র আপন রহিমা খালাকেও তুই জেলে পাঠিয়েছিস। উনিই ছোটবেলায় আমাকে বুঝত শুধু।
তুই কি করেছিস!
তোকে সেই রাতে মারতে আমি সাহায্য করেছিলাম। আমি বলেছিলাম তোকে আমার সহ্য হয় না। সবই আমি জানতাম। কিন্তু তুই যে চালাকি করে আগেই প্রতিষেধক খাবি সেটা বুঝতে পারিনি। সেদিনই প্রতিজ্ঞা করেছিলাম তোর মত সেয়ানা মহিলাকে শায়েস্তা করতে আমাকে আরো দুই কদম আগে হাঁটতে হবে।
নীলিমা আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিল না। দম বন্ধ হয়ে আসছিল। তার পুরো জীবনটা অর্থহীন লাগছিল।
কাঁপা গলায় কোনমতে বলল,
– তুই জানলি কিভাবে আমি তোর ব্যাপারে জেনে গিয়েছিলাম?
এবার বিজয়ীর হাসি হাসছে রিফাত,
– খুব সহজ। আমার রুমে হিডেন সিসি ক্যামেরা লাগানো আছে। তুই আমার ড্রয়ার এ দেখেছিস সেটা আমি দেখেছিলাম ক্যামেরায়। না ড্রয়ার টা ইচ্ছে করে খুলে যাইনি। সেটা ভুলবশত হয়ে গিয়েছিল।
এরপর বাকিটুকু আমিই প্ল্যান করি। জানতাম তুই ফাঁদে পা দিবি।
একটু থামল রিফাত। চোখে তীব্র ঘৃনা।
তুই যদি এখানে পুলিশ নিয়েও আসিস আমার কিছুই যায় আসেনা।
ঠোঁটে আবার সেই বিজয়ের হাসি।
এই দুই বছরে আমি মোট ৪০ জনকে আমার শিকার বানিয়েছে। এর মধ্যে এলিটা সহ আরও ৬ জন এখনও জীবিত। যাদের হদিস আমি ছাড়া কেও জানেও না। কেও জানবেও না। আর তোকে যে এলিটার ফোন দিয়ে এসেছিল সে স্টোরের কেও না। সে জেসন, নার্সিং হোমের আমার সঙ্গী। আমার সাথেই রিলিজ পায়। আমার ক্রাইমের ডান হাত। এলিটা কে এখানে টোপ বানিয়ে নিয়ে এসেছি তোকে এখানে আনার জন্য। আর তুই ভেবেছিস এটাই আমার আস্তানা। হাহ্, রিফাত চৌধুরী এত কাঁচা কাজ করে না।
আবার হাসছে রিফাত।
তুই এক দিকে ভালই করেছিস এই সাইকোপ্যাথ পেশেন্ট দের নার্সিং হোম এ আমাকে এনে। আমি আমার মত আরও অনেক শিকারি পেয়েছি এখানে। এখানে না আসলে আমার কাজ এতটা সহজ হত না।
তুই যদি কোন চালাকি করিস আমার একটা ইশারায় বাকি আরও ৫ টা জীবন সাথে সাথে শেষ হয়ে যাবে। তোদের মত শিক্ষিত ডাক্তার দের গাধা টাইপ কিছু পরীক্ষা কে ধোকা দেয়া কোন ব্যাপারই না এটা তোরাই বুঝিস না।
আত্মবিশ্বাস এ পরিপূর্ন নীলিমার সামনে দাঁড়ানো মানুষরূপী একটা পশু কথাগুলো বলে অমানুষের মত গা দুলিয়ে হাসতে থাকে।
নীলিমা পাথরের মত দাঁড়িয়ে সব শুনছিল। নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছেনা। রিফাত শুধু যে পরিকল্পনা করে এসেছে তা না। নিখুঁত পরিকল্পনা করে এসেছে। এখনকার কথা পুলিশেরা সবই শুনছে।
কিন্তু সে আরও ৬ টা জীবন জিম্মি করে রেখেছে। এর মধ্যে একজন এই শহরের মেয়রের মেয়ে। তারা এই ঝুঁকি নিবে না। দুই কদম না একশো কদম ভেবে রিফাত কাজ করেছে।
নীলিমা দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে পড়ল। মাথা নিচু করে দিয়ে বসে আছে।
রিফাত এক পা দুই পা করে এগিয়ে আসছে নীলিমার দিকে। একদম এক আঙ্গুল দূরত্বে দাঁড়িয়ে এখন সে। নীলিমার চুলের মুঠি ধরে টান দিয়ে তার দিকে মুখ ফেরাল নীলিমার, জঘন্য একটা গালি দিয়ে।
নীলিমার মুখ দেখে এই প্রথম বারের মত রিফাত কেমন জানি হকচকিয়ে গেছে।
এই পরিস্থিতিতেও নীলিমার ঠোঁটে হাসি দেখবে তা রিফাত স্বপ্নেও কল্পনা করেনি। নীলিমা শূন্য দৃষ্টিতে রিফাতের দিকে তাকিয়ে হাসছে।
রিফাত খেঁকিয়ে উঠল। হাসছিস কেন বিচ!
রিফাতের হাত চুল থেকে হেচকা টেনে সরিয়ে দিল নীলিমা।
আর হাতে থাকা মোবাইলের একটা ভিডিও রিফাতের দিকে তাক করল,
রিফাত ভিডিও টা দেখে টলে উঠল।
নীলিমা উচ্চস্বরে হেসে উঠল এবার। সব হারানো এক নারীর অকুতোভয় হাসি।
– রিফাত জানিস, মানুষ হয়ে জন্মানোর খারাপ দিকটা কি?
আমাদের প্রত্যেকেরই কোন না কোন দুর্বলতা থাকে। প্রত্যেকের। এই পৃথিবীর কেও বলতে পারবেনা না তার কোন দুর্বলতা নেই।
তোর মত চতুর পশুও তার ব্যতিক্রম না। কারণ যতই পশু তুই হস্ আসলে তো তুই সৃষ্টিকর্তার সৃষ্ট মানুষ।
তোর বিষয়ে জানার পর দিনের পর দিন তোকে ফলো করেছি। অজস্র সাইকোপ্যাথ কেস স্টাডি করেছি। দিন শেষে একটা জিনিসই কমন পেয়েছি আর তা হল সবারই একটা না একটা দুর্বলতা ছিল। হোক সেটা কোন মানুষ, কোন অভ্যাস বা যে কোন কিছু সেটা থাকবেই।।
হন্যে হয়ে তোর দুর্বলতা খুঁজেছি। অবশেষে সেটা পেয়েছি আমি।
আর সেটা হল “রহিমা খালা”।
হ্যাঁ রহিমা খালাই তোর দুর্বলতা। তুই ওনার কাছে মানুষ হয়েছিস। তোর মতোই মানসিক রোগী ছিলেন উনি। তোর গল্পের সাথী, তোর ঐ বয়সের ক্রাইমের সঙ্গী। তোর সব ছিল উনি। তুই ওনাকেই মা ভাবতি। সবার আড়ালে ওনাকে যে মা ডাকতি সেটাও আমি জানি।
শুনেছি আমি। কিন্তু পাত্তা দেইনি সে সময়গুলোতে।
উন্মাদের মত চিৎকার করছে রিফাত। হাসছে নীলিমা।
ভিডিওতে রহিমা খালাকে পুলিশের টর্চার সেলে নিয়ে টর্চার এর ভিডিও দেখানো হয়েছে রিফাতকে।
– রিফাত সময় থাকতে নিষ্পাপ ৫ টা জীবন ছেড়ে দে। নাহলে বাকি জীবন এই টর্চার সহ্য করে যেতে হবে ওনাকে। মরতে দেওয়া হবেনা কিন্তু মৃতপায় করে ফেলা হবে। তুই তো অভ্যস্ত এসব করে আরও ভাল জানবি।
মুচকি হাসছে নীলিমা।
রিফাত রক্তচক্ষু করে তাকিয়ে আছে।
– রহিমা খালার কিছুই হবেনা। সব মরবে। সব। সব শেষ করে দিব। দরকার পড়লে আমি তোকে মেরে নিজে মরব।
সব শেষ করে দিব। এটা বলেই রিফাত নীলিমার দিকে পাশে থাকা একটা ছুরি উঠিয়ে দৌড়ে আসে।
এমন সময় নীলিমা হাতের আড়ালে থাকা সাময়িক প্যারালাইজ করা হাই ডোজের একটা ইনজেকশন রিফাতের পায়ে সজোরে চেপে ধরে।
অবিশ্বাসের ঘৃনা মিশ্রিত দৃষ্টি নিয়ে রিফাত নীলিমার দিকে তাকিয়ে থাকে।
আসতে আসতে পড়ে যায় মাটিতে।
আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না নীলিমা। মেঝেতে বসে চিৎকার করে কাঁদতে থাকল রিফাতকে জড়িয়ে ধরে। এই একটা ছেলেকে সে শেষ আশ্রয় করে বাঁচতে চেয়েছিল।
রাশেদের পর এখানেও নীলিমাকে হেরে যেতে হবে কোনোদিন স্বপ্নেও ভাবেনি নীলিমা।
নীলিমার সংকেতে চারদিকে ঘিরে থাকা পুলিশ এসে পড়ে। তখনও মেঝেতে বসে আছে নীলিমা। কিন্তু এখন আর কাঁদছে না সে। শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। কিছু ভাবছে না। কিছু অনুভব করছে না। বেঁচে আছে নাকি মারা গিয়েছে সেটাও অনুভব হচ্ছে না। আজকে এই ঘটনায় তার জীবনের এই ঘটনায় পৃথিবীর মানুষের দৃষ্টিতে সে হয়তো জিতে গেছে, কিন্তু আসলেই কি এটা নীলিমার জিত ছিল।
নীলিমা কি জিতে যাওয়ার খুশি অনুভব করতে পারছে!
এসময় স্ট্রেচারে এলিটা কে নীলিমার পাশ দিয়ে নিয়ে যাওয়ার সময় হঠাৎ এলিটা কাঁপা হাতে নীলিমার গাল স্পর্শ করল।
খুব ধীরে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
” From today you are my angel. Thank you for saving my life. I will never forget you. Don’t be sad.”
হঠাৎ কি যেন হল নীলিমার। এলিটার কথায় কিছু একটা ছিল। এলিটার হাত ধরে কেঁদে ফেলল সে।
এখন নীলিমা ভাবছে, না সে জিতেছে। সে হারেনি। সব হয়তো সে হারায়নি। অচেনা অজানা একজন মানুষ হলেও তাকে মনে রাখবে। তাকে ভালবাসবে। অনেকগুলো জীবন বাঁচাতে পেরেছে সে। সে স্বার্থক।
ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে, চাদর গায়ে বাইরে বেরিয়ে এল নীলিমা। চোখে মুখে এক অজানা অদ্ভুদ পরিতৃপ্তির হাসি, জীবন বাঁচানোর হাসি।।।।।।
সমাপ্তি
প্রতিশোধ গল্পের লিংক
https://kobitor.com/category/uponas/protisod/
বিশ্বাস অবিশ্বাস গল্পের লিংক
https://kobitor.com/category/uponas/bissas/
দ্যা ব্লাক বুক গল্পের লিংক