
keya payel picture
ফুলসজ্জা পর্ব ১
লেখা- অনামিকা_ইসলাম “অন্তরা”
আমি আবির।
মাহমুদুল হাসান ‘আবির’। পেশায় একজন শিক্ষক। ঢাকার কোনো এক স্বনামধন্য ভার্সিটির বাংলার প্রভাষক। বাবার ইচ্ছে লেখােড়া শেষ করে ওনার ব্যবসায়ে যোগ দিতে, কিন্তু বরাবরের মতই মুক্তমনা আমি কিছুতেই যেন মনের বিরুদ্ধে গিয়ে বাবার ব্যবসায়ে জয়েন করতে পারি নি।ব্যবসায়ে ফাঁকি দিয়ে কাঁধে একটা গিটার নিয়ে বন্ধুদের অবাধে দেশের একপ্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে ঘুরে বেড়াতাম। বাবা বোধ হয় বুঝে গিয়েছিল স্বাধীন ও মুক্তমননের অধিকারী এই আমি’কে কিছুতেই ব্যবসায়ের কাজে লাগানো যাবে না। আর সে জন্যই বাবা আমায় ঢাকায় মামার বাসায় পাঠিয়ে দেয়। মামা যে ভার্সিটির সভাপতি সেই ভার্সিটিতেই বাংলার লেকচারার হিসেবে জয়েন করি। শুরু হয় আমার শিক্ষকতার জীবন। আজ ৫বছর অতিবাহিত হলো আমার শিক্ষকতার জীবনের।
সে বার পরিবারবর্গ সহ ২মামাকে নিয়ে যাচ্ছিলাম নরসিংদীর একটি ছোট্ট অজপাড়া গায়ে। যাকে নিয়ে কিংবা যার কথা শেয়ার করার জন্য এই লিখা সেই নীলিমার সাথে এই গ্রামেই প্রথম দেখা।
নীলিমা এ গল্পের কেন্দ্রিয় চরিত্র। নীলিমা এ গল্পের নায়িকা। নীলিমার পদচারণা গল্পের শুরু থেকে শেষ অবধি।
নীলিমা পল্লীগাঁ’য়ের এক সহজ-সরল ও অত্যন্ত শান্তশিষ্ট একটি মেয়ে। পড়াশুনা এসএসসি পর্যন্ত’ই। এস.এস.এসি পাসের পর মেধাবী নীলিমার আর কলেজে ভর্তি হওয়া হয়নি। যদিও অন্য ৮/১০টা মেয়ের মত তারও দু’চোখ ভরা স্বপ্ন ছিল….
স্বপ্ন ছিল লেখাপড়া করে অনেক বড় হওয়ার,
স্বপ্ন ছিল জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়ে বাবা মায়ের মুখ উজ্জ্বল করার,
স্বপ্ন ছিল অসহায় বাবা-মায়ের মুখে জয়ের হাসি অঙ্কন করার,
স্বপ্ন ছিল ছোট্ট বোন’টিকে ঈদে নতুন জামা-জুতো আর স্নেহের ভাইটিকে একটা ল্যাপটপ কিনে দেয়ার।
নীলিমার স্বপ্ন কিন্তু খুব বেশী বড় ছিল না,
ওর স্বপ্নগুলো ছিল ছোট ছোট। তবুও সেসব কিছু’ই যেন নীলিমার করা হয়ে উঠেনি।
পাড়া প্রতিবেশীর নিন্দার আগুনে দগ্ধ হতে হতে একটা সময় নীলিমার লেখাপড়ায় ইতি টেনে দেয় নীলিমার গরিব ও অসহায় বাবা। ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও কলেজ প্রাঙ্গনে যেতে পারে নি নীলিমা। নীলিমার ছোট্ট থেকে দেখে আসা স্বপ্নগুলো একটু একটু করে ভেঙ্গে তছনছ হয়ে যায় নিন্দুকের কথার আঘাতে। নীলিমাকে জর্জরিত হতে হতো প্রতিনিয়ত, নিন্দুকের কথার আঘাতে।
,
নীলিমার অপরাধ__
নীলিমা কালো। নীলিমার গায়ের রং কালো, ভিষন রকম কালো….
তরুন শিক্ষক আবির এবং তার পরিবার আজ সেই বাড়িতেই যাচ্ছে। আবিরের বাবার বাল্যকালের বন্ধু ‘ছমির’….আর তারই মেয়ে নীলিমা। আবিরের বাবার ইচ্ছে বাল্যবন্ধু ছমিরের মেয়েকে ওনার পুত্রবধূ হিসেবে বাড়িতে তুলে নেওয়ার। প্রসঙ্গ আবিরের বাবা ঠিক তখন’ই তুলে যখন আবিরসহ ওর মামারা সবাই ঐ বাড়িতে রাতের খাবার খেয়ে নেয়।
আবিরের মা’তো অন্ধকার রাত্রেই হনহনিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে পরে রাগে। আবিরের ছোট মামাও বোনের পক্ষ নিয়ে রাতের আঁধারে বেরিয়ে আসতে চায় বাড়ি থেকে। ওদের একটাই কথা আর সেটা হলো_
“এমন কালো মেয়েকে নিয়ে গেলে সোসাইটিতে মুখ দেখানো যাবে না।ওরা হাসাহাসি করবে।”
আবিরের বড় বোন আদিবার ভাষ্যমতে__
“মামা শুনো!
কালো’রাও মানুষ। ওরাও আমাদের মত এক’ই রক্ত মাংসে গড়া মানুষ। আর সবচেয়ে বড় সত্য হলো ওরাও আমাদের মতই এক আল্লাহর সৃষ্টি। তাই দয়া করে বন্ধ করেন বাজে কথা আর দেখেন আবির কি চাই? এ ব্যপারে ওর মতামত কি???
ঠিক তাই।
এই মুহূর্তে আবিরের মতামতটি নেওয়া সবচেয়ে জরুরী। তাই চলুন বন্ধুরা ঘুরে আসি আবিরের প্রোফাইল থেকে। দেখে আসি গল্পের নায়ক আবির কি বলে???
আবিরের ভাষ্য__
বাবা! মেয়ে আমার পছন্দ হয়েছে। আর আমি জানি, আমি এই মেয়েকে নিয়ে অনেক সুখী হবো যদি তোমার/তোমাদের সবার দোয়া থাকে। তাই আমি এই মেয়েকেই বিয়ে করতে চাই।
আমার কথা শুনে বাবা,মা আপু আর ডাক্তার দুলাভাই সবাই একসাথে আলহামদুলিল্লাহ বলে উঠে।
ডিসেম্বরের তেইশ তারিখ আমি আমার ঘরের লক্ষ্মীকে নিয়ে বাসায় ফিরি। এইদিনেই ওকে আমি বিয়ে করি। বিয়েটা খুব সাদাসিধে ভাবেই হয়েছে। তার একমাত্র কারন আমার মা এবং এক মামার বিরোধ।
বিয়েটা সাদাসিধে ভাবে হলেও বাসর ঘর’টা সাজানো হয় আমার ইচ্ছে মত’ই। বাসর ঘরে প্রবেশ করে দেখি বউ আমার গুটিসুটি মেরে বিছানায় বসে আছে। আমাকে দেখে’ই খাট থেকে উঠে সালাম করে আবার খাটে গিয়ে বসল ইয়া লম্বা ঘোমটা দিয়ে।
মাথা থেকে পাগড়ীটা খুলে ধীরপায়ে হেঁটে গিয়ে আমি আমার সদ্য বিয়ে করা বউয়ের পাশে গিয়ে বসলাম।বেশ কিছুক্ষণ কাশি দেওয়ার পরও বউয়ের কোনো সাড়া পাচ্ছিলাম না।বউ আমার পূর্বের ন্যায় মাথায় আধহাত লম্বা ঘোমটা দিয়ে বসে আছে। কি আর করার???
এভাবে বসে থাকলে যে পুরো রাত চলে যাবে। আর তাই কালবিলম্ব না করে আমি আমার বউয়ের একটা হাত আলতো করে ছুঁয়ে দিলাম।
মনে হচ্ছে নীলিমা আমার পরশে একটু কেঁপে উঠেছে কিন্তু তার বেশী কিছু নয়।আমার হাতের মুঠো থেকে হাত ছাড়ানোর কোনো চেষ্টা না করে ও বসে আছে। চুপটি করে আছে। ওর এই মৌনতা যেন আমায় জানান দিচ্ছিল ও সর্বপ্রকার পরাজয় স্বীকার করে নিতে প্রস্তুত। কিন্তু আমি তো এটা চাই না।
আমি চাই আমার বউ আমায় প্রথমে চিনুক, জানুক, ভালোবাসুক তারপর অন্যকিছু। কিন্তু ও কি না..???
– বিয়ের পর একজন স্বামী শুধু স্ত্রীর সাথে শারীরিক বন্ধনে নয়, ভালোবাসার বন্ধনেও আবদ্ধ হয়। কেবল শারীরিক সম্পর্ক নয়, বৈবাহিক সম্পর্কের আরেক নাম স্বামী-স্ত্রীর অপার প্রেমের এক বন্ধন। আর সেই বৈধ প্রেম’টা শুরু হয় ফুলশয্যার রাত থেকে’ই….
যায় হোক…
ফুলশয্যার রাত্রে আমি আমার বউকে প্রথম জিজ্ঞেস করেছিলাম__
” নীলিমা! ফুলশয্যার রাত তো প্রতিটি মানুষের জীবনের একটি সর্বশ্রেষ্ঠ রাত, তাই না?”
– নীলিমা ঘোম’টার ভেতর থেকে মাথা নাড়ে। হ্যাঁ কিংবা না কোনোটাই বুঝিনি আমি। তবুও ওর এই মাথা নাড়ানো হ্যাঁ বোধক মনে করে ওর দিকে আরো একটা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলাম। আর সেটা ছিল__
” তাহলে নিশ্চয় এ রাত সম্পর্কে তুমি জানো?”
নীলিমা এবারো মাথা নাড়লো। আমি নীলিমাকে উদ্দেশ্য করে বললাম__
“নীলিমা! আমি সাংকেতিক ভাষা বুঝিনা, তুমি যা বলার মুখে বলো। তুমি শুধু এটুকুই বলো এ রাত সম্পর্কে তুমি কিছু জানো কি না…???
নীলিমা এবার মুখ খুলল…
কাঁপা গলায় জবাব দিল_
” জি, জানি…”
আমি ওকে জিজ্ঞেস করলাম কি জানো???
ও লজ্জানত হয়ে নিচুগলায় বলল__
” ভাবিরা যা শিখিয়ে দিয়েছে।”
ওর দিকে পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলাম__
তা তোমার ভাবিরা কি শিখিয়ে দিয়েছে? আমায় কি বলা যাবে???
নীলিমা ক্ষাণিক’টা কেঁপে উঠল। তারপর নিচু স্বরে জবাব দিল_
” আপনি যা বলেন তাই করতে।”
___ আচ্ছা, তাই নাকি???
নীলিমা মাথা নেড়ে বলল হুম। আমি নীলিমাকে আবারো প্রশ্ন করলাম__
” আচ্ছা, আমি তোমাকে কি বলতে পারি???”
__ বউ আমার লজ্জায় বলল, জানিনা! **নতুন নতুন রোমান্টিক গল্প পেতে ভিজিট করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: “নিঃস্বার্থ ভালোবাসা”**
আমি দু’হাত দিয়ে বউয়ের ঘোমটা সরিয়ে বললাম-
“তোমার ভাবি এতকিছু শিখিয়ে দিল, তো এটা বলেনি আমি কি বলব/করব???”
লজ্জাবতী আমার লজ্জায় রাঙ্গা হয়ে চুপসে গেল লজ্জাবতী পাতার মত’ই…..
নীলিমার মাথা থেকে ঘোমটা’টা সরিয়ে দিলে নীলিমা লজ্জায় চোখ দুটো বন্ধ করে ফেলে। আমি মুগ্ধ নয়নে আমার পরি’টাকে দেখছি। ওর দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে অজান্তে’ই মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে মাশাআল্লাহ।
যেন এক স্বর্গের পরি আমার সামনে বসে আছে।
যত দেখি তৃষ্ণা মেটে না…
নীলিমা তখনও চোখ দুটো বন্ধ করে আছে। প্রশ্ন করলাম__
~নীলিমা, তুমি কি জানো একটি মেয়ে বিয়ের পর স্বামীর কাছে কিসের ভিত্তিতে মূল্যায়িত হয়?
নীলিমা চোখ খুলে বলল, আমি জানি না।
তখন আমি তাকে বললাম একটি মেয়ে যত সুন্দরীই হোক না কেন, বিয়ের পর তার সৌন্দর্যের দাম স্বামীর কাছে থাকে না। কারণ আমরা অনেক সময় অনেক পছন্দ করে মার্কেট থেকে কোনো পোশাক কিনলে প্রথমে সেটি খুবই যত্ন করি এবং বিশেষ বিশেষ অনুষ্ঠানে পরি। কিন্তু কিছুদিন পর ঐ পোষাকটি যখন পুরনো হয়ে যায় তখন সেটি আমরা সাধারণ ভাবে ব্যবহার করি। তেমনি একজন স্বামীর কাছে স্ত্রী এবং স্ত্রীর কাছে স্বামীর দেহের সৌন্দর্য প্রতিনিয়ত পাঠ করা হয়। তখন তাদের মধ্যে দেহের সৌন্দর্যের আর কোণো আকর্ষণ থাকে না। বরং তখন একে অপরের বিভিন্ন গুন দ্বারা প্রভাবিত হয়। তখন দেহের সৌন্দর্যকে ছাপিয়ে যায় একের প্রতি অপরের টান, ভালোবাসা, সহমর্মিতা প্রভৃতি গুনাবলি।
কথা বলা শেষ করে দেখলাম নীলিমা আমার দিকে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে আছে। রাত প্রায় শেষের দিকে। এর’ই মাঝে বার কয়েক লক্ষ্য করলাম নীলিমা চোখ কচলাচ্ছে। বোধ হয় ঘুম পাচ্ছে খুব।
আমি নীলিমাকে বললাম__
“নীলিমা! রাত অনেক হয়েছে। তুমি বরং ঘুমিয়ে পরো।”
নীলিমা বলল__
” না, না! আপনি বলেন। আমি শুনতেছি…”
আমি হেসে বললাম__
তোমার ভাবিরা কি শিখিয়ে দিয়েছে রাত জেগে আমার গল্প শুনতে? যদি শিখিয়ে দেয়, তাহলে শুনো। নাহলে ঘুমিয়ে পরো। নীলিমা চুপ করে রইল। ঘুমে ঢুলুঢুলু নীলিমা আমার সামনে শুইতে ইতস্তত বোধ করছিল। আমি বিছানা’টা ছেড়ে নীলিমা’কে বললাম__
” এই নাও তোমার বিছানা। এবার তুমি দরজা’টা লাগিয়ে শুয়ে পরো। কথা’টা বলে আমি অন্যরুমে ঘুমানোর জন্য বেরিয়ে আসছিলাম, ঠিক তখন’ই নীলিমা পিছন থেকে ডাক দেয় আমায়। বলে__
” আপনি ঘুমাবেন না?”
আমি নীলিমার দিকে তাকিয়ে বললাম__
” ঘুমাবো। পাশেই একটা রুম আছে, ঐখানে’ই ঘুমাবো। তুমি ঘুমিয়ে পরো।”
আমার কথা শুনে নীলিমার মুখ’টা ইষৎ অন্ধকার হয়ে যায়। কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে সে আবারো ডেকে বলে__
” আপনি এ রুমে বিছানায় ঘুমান, আমি না হয় ফ্লোরে ঘুমাবো।”
নীলিমার কথা শুনে আমি ওর দিকে অগ্নিদৃষ্টি নিয়ে তাকালাম। নীলিমা নিচের দিকের দিকে তাকিয়ে বলল__
” ঠিক আছে! আপনার যা ইচ্ছে।”
আমি গম্ভীর ভাব নিয়ে বললাম__
” কেন তোমার কি ইচ্ছে?”
আমি এ রুমে ঘুমাই, সেটা?”
নীলিমা কোনো কথা না বলে চুপটি করে দাঁড়িয়ে রইল। আমি ধমকের স্বরে বললাম__
” কি হলো? কথা’তো বলো?”
নীলিমা মাথা নেড়ে বলল হুম। আমি আবারো প্রশ্ন করলাম__
কিসের হুম???
নীলিমা ধীর গলায় বলল__
” আপনি এ রুমে ঘুমান। আমার অসুবিধা হবে না কোনো।”
কন্ঠে গাম্ভীয্যের ভাব এনে আমি নীলিমাকে জবাব দিলাম___
” তোমার অসুবিধা হবে না, কিন্তু আমার হবে। আমি আবার অচেনা কারো সাথে ঘুমোতে পারি না। আর সেই জায়গায় তুমি তো ঘোর অচেনা। তোমায় না জানি, না চিনি না মানি…
নীলিমা আমার দিকে তাকিয়ে বলল__
” মানেন না মানে?”
আমি সহাস্যে জবাব দিলাম_
” মানে অতি সহজ। তোমায় বিয়ে করেছি ঠিক কিন্তু আমি তোমায় আমার স্ত্রী হিসেবে মেনে নিতে পারিনি।”
নীলিমা মুখটা অমাবস্যার কালো অন্ধকারের মত করে বলল__
” আমি জানি…”
চোখ বড় বড় করে প্রশ্ন করলাম__
” কি জানো? “
নীলিমা স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলল__
” এই যে আপনি আমায় স্ত্রী হিসেবে মানতে পারেন নি আর পারবেন না কখনো।
আমি নীলিমাকে আবারো প্রশ্ন করলাম__
” তোমার এমন ধারনার কারন?”
নীলিমার জবাব_
” আমি কালো। ভীষণ কালো। কালো মেয়েকে কেউ বিয়ে করতে চায় না। আর সে জায়গায় আপনি অনেক সুন্দর। রাজপুত্রের মত যার চেহেরা, সে কি না বিয়ে করবে কালিতারাকে? আমি আগেই জানতাম__
আমি কারো স্ত্রী হবার যোগ্য না। আমি সাগরে ভাসা কচুরিপনার….(….)…..???
নীলিমার কথা শুনে কেমন যেন বুকের ভেতরটা মুচর দিয়ে উঠল। ভিষণ রাগ হলো ওর প্রতি। আর তাই ওর কথার মাঝখানে ধমক দিয়ে থামিয়ে দিলাম। তারপর__
” একটা কথাও হবে না।চুপচাপ ঘুমিয়ে পড়ো। আমি সোফায় ঘুমোচ্ছি। আর জীবনেও যাতে এমন কথা না শুনি।”
নীলিমা আর একটা কথাও বলে নি। আমি দরজা বন্ধ করে সোফায় শুয়ে পরলে কিছুক্ষণ পর দেখি লাইট’টাও অফ। তার মানে ও শুয়ে পরেছে।
সোফায় শুয়ে আছি মাথার নিচে একটা হাত দিয়ে। ঘুম যেন চিরতরে বিদায় নিয়েছিল আমার চোখের পাতা থেকে। মনের কোণে হাজারো ভাবনা এসে জড়ো হচ্ছে। আনমনে’ই বলে যাচ্ছি__
” নীলি! তুমি কালো হতে পারো কিন্তু তোমার মন’টা অনেক ভালো। আমি তোমার শরীর নয়, সেই ভালো মনটা পেতে চায়। সে মনের ভালোবাসা পেতে চায়। আমি চাই তুমি আমায় ভালো ভাবে চিনো, বুঝো, জানো। ব্যস, এটুকুই।
নীলি! তুমি জানো???
আমি তোমাকে দেখা অবধি কাউকে এতটা অনুভব করিনি, তোমাকে দেখার পর থেকে বুকের ভিতর কেমন যেন অচেনা অনুভূতি নাড়া দিয়ে যাচ্ছে। নীলি!
আমি তোমার শরীর নয়, তোমায় ভালোবাসতে চাই। তোমায় আমি স্ত্রী নয় আমার প্রেয়সী করতে চায় প্রথমে।
নীলি! আমি তোমার পাশে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত থাকতে চাই। আমি তোমার দুঃখ-সুখ দুটোরই সাথী হতে চাই। বলো নীলি!
এটুকু কি আমার খুব বেশী চাওয়া হবে???
নীলি! এটুকু কি আমি পেতে পারি না???”
অবচেতন মন নিজেকে নিজে’ই শান্তনা দিল___
” কেন নয় আবির?!!! তুই তো কোনো অন্যায় কিছু আবদার করিসনি! তবে কেন পাইবি না এটুকু। তুই অবশ্যই পাবি। তুই দেখে নিস, তুই জয়ী হইবি। তুই পারবি তোর নীলির মন উজাড় করা ভালোবাসা পেতে। সেটা শুধু সময়ের অপেক্ষা। সেই পর্যন্ত ধৈর্য ধর, ধৈর্যের ফল সবসময় সুমিষ্ট’ই হয়।”
পরদিন রাত্রিবেলা__
” নীলিমা! একটা কথা বলব?”
নীলিমা ধীর গলায় বলল, জি বলেন!
আমি নীলিমাকে প্রশ্ন করলাম__
” তোমার এত্ত বড় নাম’টা কে রেখেছে???”
নীলিমা আমার দিকে একবার তাকিয়ে চোখটা ফিরিয়ে নিল।অন্যদিকে তাকিয়ে বলল__
” দাদা…”
আমি দুষ্টুমি করে বললাম__
” ঐ শালা কি দুনিয়াতে আর কোনো নাম খুঁজে পাননি? শালা, এত্ত নাম থাকতে এত বড় নাম রাখছে…”
নীলি আমার দিকে চোখ বড় করে তাকিয়ে বলল__
” ওনার নাম শালা নয়। রমজান। রমজান আলী ওনার নাম…”
আমি হেসে বললাম এই হলো আর কি….
আচ্ছা, তুমি কি অন্য নামে ডাকতে পারি না???!!!
– কি নামে???
___ অন্য নামে। এই যেমন ধরো নীলিমার মা’টা কেঞ্চি দিয়ে কেটে খাটো করে দিলাম। নীলিমা আমার দিকে তাকিয়ে বলল__
” মানে নীলি?!!!”
আমি হেসে বললাম, জি! নীলি…..
কেন? পছন্দ হয়নি???
নীলিমা জোর গলায় বলল,
না, না! হয়েছে। আপনি আমায় নীলি বলে’ই ডাকবেন। এতে আমার কোনো আপত্তি নেই।
___ আমি হেসে বললাম, ওকে! এখন থেকে আমি তোমায় নীলি বলে’ই ডাকব। তুমি নীলি। শুধু আমার নীলি….
স্যরি, অন্য কিছু ভেব না। আমি আমার নীলি বলতে বোঝাতে চাচ্ছি যে-
” এই নামে অন্য কেউ তোমায় ডাকতে পারবে না।”
**নতুন নতুন রোমান্টিক গল্প পেতে ভিজিট করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: “নিঃস্বার্থ ভালোবাসা”**
নীলিমা চুপটি করে বসে রইল। আমি নীলিমার দিকে তাকিয়ে বললাম__
” নীলিমা! আমার মা যে তোমার সাথে এমন করল আজকে, তোমার কষ্ট হয়নি? সত্যি বলবা, মিথ্যে বলো না…”
নীলিমা হেসে বলল,
কি যে বলেন না! কষ্ট পাবো কেন? ওনি তো আমার গুরুজন। কতকিছু’ই তো বলতে পারে, তাই বলে আমরা সব কথা কি মনে রেখে দিব??? আমি কিচ্ছু মনে করিনি।”
__ নীলিমা তুমি কি জানো তোমার বয়স কত???
~নীলিমা আমার কথায় জবাব দিল__
হ্যাঁ, জানি….
— কত???
নীলিমা কাঁপা গলায় জবাব দিল,
খুব কম।
আমি নীলিমার দিকে তাকিয়ে বললাম__
” এই এত ছোট্ট হয়েও তুমি কিভাবে এত গুছিয়ে, সুন্দর করে কথা বলতে পারো???”
প্রশ্নোত্তরে নীলিমা কোনো জবাব দেয়নি….
দেখতে দেখতে ১৫টা দিন চলে যায়। দু’দিন পর পহেলা জানুযারি। আমার ভার্সিটির ছুটির দিন শেষ। আজকেই ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিতে হবে। ব্যাগপত্র সব গুছিয়ে রেখেছি আগে থেকেই। আমি চলে যাব, সেটা নীলিমা জানে।তারপরও যাইবার কালে আবার বলার জন্য রুমে এলাম। নীলিমা বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে আছে। আমার ডাক শুনে বিছানায় উঠে বসে। এই কয়দিনে অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে গেছে নীলিমা। দু’জন অনেকটা বন্ধুর মত হয়ে গেছি। নীলিমা বিছানায় উঠে বসতে’ই আমি নীলিমাকে বললাম__
” আসি….”
নীলিমা আমার দিকে তাকিয়ে জোর করে হাসি দেওয়ার চেষ্টা করল। তারপর বলল__
” আচ্ছা “
আমি নীলিমাকে বলে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়ে দিলাম। ট্রেনে বসে আছি। রাস্তা প্রায় অর্ধেক অতিক্রম করে ফেললাম। হঠাৎ মনে হলো ফোন’টা বেজে উঠল।ফোনটা হাতে নিয়ে দেখলাম ঢাকা থেকে স্যার কল দিয়েছে। কলটা রিসিভ করে হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে ভেসে আসলো জামাল স্যারের কন্ঠ।
– আবির স্যার! আপনার জন্য সুখবর আছে। কলেজ কর্তৃপক্ষ আপনার কাজে খুশি হয়ে আপনাকে একমাসের ছুটি দিয়েছে। আপনি বেতন পাবেন, কিন্তু এই একমাস আপনার ভার্সিটিতে আসতে হবে না। আপনি আরাম করে হানিমুন করেন…..
স্যারের কথা শুনে আমার খুশি আর দেখে কে?
তাড়াতাড়ি করে ট্রেন থেকে একটা স্টেশনে নেমে গেলাম। আমি কখনো বাস দিয়ে যাতায়াত করিনি, কিন্তু আজ করলাম। ট্রেন আসতে দেরী হবে শুনে আর বসে থাকিনি। নিকটস্থ বাস স্টপে গিয়ে বাসে উঠে পরলাম। চিটাগাংয়ের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম। এই কয়দিনে নীলিমার মায়ায় পরে গিয়েছিলাম। ওকে ছেড়ে আসার পর থেকে বুকের ভেতরটাই অদ্ভত এক শূন্যতা অনুভব করছি। ভাবতেই অবাক লাগছে ওকে আরো একটা মাস কাছে পাব। দেখতে পারব।
বাসায় পৌঁছলাম পরদিন দুপুরে। বাসায় প্রবেশ করে দেখি বাসায় কেমন যেন থমথমে ভাব।অদ্ভুত এক নিরবতা….
দৌঁড়ে উপরে উঠলাম।
মা ঘুমোচ্ছে জানতাম, তাই মায়ের কাছে না গিয়ে রুমে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালাম। দরজার সামনে যেতে’ই শিউরে উঠলাম।
– আমার প্রাণপাখি নীলি বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে কাঁদছে। গুমড়ে গুমড়ে কাঁদছে আর তার পাশে’ই বসে আছে বাসার কাজের মেয়ে’টি। মেয়েটি বার বার বলছে__
” ভাবি! কাঁদবেন না। কাঁদলে আপনার শাশুড়ি শুনতে পাবে যে, তখন ওনি আবার আপনাকে….
এটুকু বলে দরজার সামনে তাকিয়ে আমাকে দেখে থমকে গেল মেয়েটি। কোনো কথায় যেন ওর মুখ দিয়ে বের হচ্ছে না। ইশারায় আমি মেয়েটিকে ডাকলাম। রুম থেকে একটু দুরে নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম__
” ও হয়েছে তোর ভাবির?”
মেয়েটি চুপ হয়ে আছে।
আমি আবারো জিজ্ঞেস করলাম__
কি হলো বল? নীলি কাঁদছে কেন? কে কি বলছে ওকে???
এবারো কাজের মেয়েটি চুপ। আমি এবার ওকে ধমক দিয়ে বললে ও যা বলল তাতে আমার সারা শরীর শিহরণ দিয়ে উঠল।
– কি?!!!
আমার মা ওকে মেরেছে?
ওর পিঠে গরম হাতা দিয়ে মেরেছে???
আমি যেন নিজের কানকেও বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। দৌঁড়ে গেলাম আমার নীলির কাছে। ও আগের মতই উপুড় হয়ে আছে। আর ওর ঘাড়ের কাছে কিছুটা চামড়া উঠে গিয়ে লাল হয়ে আছে। মনে হচ্ছে কেউ গরম জাতীয় কিছু এ স্থানে ফেলেছে। নীলি তখনও উপুড় হয়ে শুয়ে বালিশে মুখ গুজে কাঁদছে। নীলির এ অবস্থা আমি যেন মেনে নিতে পারছিলাম না। ওকে আস্তে করে ডাক দিলাম।
– নীলি…..
ও হকচকিয়ে উঠে বসল। আমাকে দেখে আঁচল দিয়ে পিঠ’টা যথাসম্ভব ঢাকার চেষ্টা করল।
আমি নীলিকে প্রশ্ন করলাম__
” কি ঢাকতেছ?”
নীলিমা যেন আঁতকে উঠে আমার দিকে তাকালো….
আমি ভেঁজা কন্ঠে বললাম__
” বলো…
কি ঢাকতেছ আঁচল দিয়ে?”
নীলিমা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা কাজের মেয়েটির দিকে একবার তাকালো….
চলবে….
.
সকল পর্বের লিংক একসাথে