#পুকুর রহস্য
পর্ব ৩
হঠাৎ আমি আমার সর্বশক্তি দিয়ে মেজদাকে ধাক্কা দিলাম। মেজদা কিছুটা দূরে ছিটকে যেয়ে পড়লো। ধাক্কাটা আমি জোরেই দিয়েছিলাম তাছাড়াও ও নেশাগ্রস্ত অবস্থায় আছে। এটাই সুযোগ কোনোভাবে হাতছাড়া করা যাবে না। আমি এক লাফে দরজা খুলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলাম। কিন্তু মেজদাও ততক্ষণে আমার পিছু নিয়েছে। আমি বাঁচার জন্য দৌড়াচ্ছি, ও আমার পিছনে। আমার দাদীর আর রাজের ঘর ওপরতলায়। ওপরতলার সিঁড়িতে যেতে হলে আমাকে পিছনে ঘুরে মেজদাকে অতিক্রম করে যেতে হবে।
যেটা আমার জন্য একেবারেই নিরাপদ নয়। আমার শ্বাসকষ্ট হতে লাগলো। দিশাহারা লাগছে আমার। কি করবো এখন আমি? আমি প্রাণপণে ছুটতে থাকলাম। দোতলা থেকে আমাদের একটা লোহার গোপন সিঁড়ি আছে নিচে নামার। শোনা যায়, দাদাজানের আব্বা নাকি ওখানে বসেই অদৃশ্য কারো সাথে আরবী ভাষায় কথা বলতেন মাঝরাতে। কিন্তু আমাদের ওই সিঁড়ি ব্যবহার করা নিষেধ ছিলো। দাদী বা আব্বা চাচারাও কোনোদিন এই সিঁড়ি ব্যবহার করেনি।
কিন্তু এখন আমার সামনে মাত্র দুইটাই রাস্তা,হয় মেজদাকে অতিক্রম করে আমাদের মূল সিঁড়ি ব্যবহার করতে হবে নাহয় এই গোপন লোহার সিঁড়ি থেকে নিচে নেমে যেতে হবে। মেজদা হিংস্র হয়ে ক্ষিপ্র গতিতে আমার দিকে এগিয়ে আসছে। ভাবার সময় নেই। আমি কালবিলম্ব না করে লোহার সিঁড়িটাকেই বেছে নিলাম। আমি কখনো এদিকে আসিনি, মেজদাও ততক্ষণে আমার পথেই ছুটছে। আমি ধুপধাপ পা ফেলে নিচে নামতে থাকলাম, পিছনে মেজদার পায়ের শব্দও শুনছি।
ভয়ে আমার বুক কাঁপছে। এই ভরদুপুরেও এই সিঁড়িঘরটা কি অন্ধকারাচ্ছন্ন। অন্যসময় হলে এই অন্ধকার আমার ভীষণ ভয় লাগতো, কিন্তু এমন সময় আমার পিছনে আসা জানোয়ারটার চেয়ে আর কিছুই ভয়ের লাগছে না আমার। আমি সিঁড়ি বেয়ে নেমেই যাচ্ছি, কিন্তু অবাক কাণ্ড! দোতলা থেকে নামতে কখনো এতোগুলা সিঁড়ি ভাঙা লাগে? আমি হাঁপিয়ে যাচ্ছি কিন্তু কোনোভাবেই আলোর দেখা পাচ্ছি না। এ কোন গোলকধাঁধার মধ্যে পড়ে গেলাম আমি। যন্ত্রণায় মাথা ফেটে যাচ্ছে আমার।
শরীর ভেঙে আসছে ক্লান্তিতে। কিন্তু কোনোভাবেই থেমে যাওয়া যাবে না। আমি হাঁপাচ্ছি আর চিৎকার করে আল্লাহকে ডাকছি। হঠাৎ একটা সময়ে আমার মনে হলো দূরে বুঝি একটা ছোট্ট আলোর বিন্দু। আমার জানে পানি এলো কিছুটা। আমি আমার সর্বশক্তি দিয়ে ছুটছি, আর শয়তানটাও আমার পিছনে আসছে এখনো।কিন্তু যতোই ছুটছি বিন্দুটা যেনো ততই দূরে সরে যাচ্ছে। যেটুকু আশা ছিলো তাও নিভে যাচ্ছে।তবে কি আজকেই আমার জীবনের শেষদিন? একফোঁটা পানি খাওয়ার জন্য তৃষ্ণায় আমার বুকটা ছটফট করছে। আমি আর পারলাম না। সিঁড়ির রেলিং ধরে বসে পড়লাম।
হাউমাউ করে কাঁদছি আর চিৎকার করছি,”মেজদা আমাকে ছেড়ে দে। আমি কাউকে কিচ্ছু বলবো না। আমাকে ছেড়ে দে। আমার কোনো ক্ষতি করিস না।” কিন্তু বেশ কিছুক্ষণ হয়ে গেলো মেজদার কোনো শব্দ পাচ্ছি না। আমি আস্তে আস্তে রেলিং ধরে উঠে দাঁড়ালাম। মোটামুটি ভালোই অন্ধকার। আমি ভয়ে ভয়ে পেছন ঘুরে তাকালাম। কি আশ্চর্য! কেউ নেই পিছনে। তবে কোথায় গেলো মেজদা? হঠাৎ করে আমার মনে হলো আরে কোথায় সিঁড়ি? আমি একটা ফাঁকা নিস্তব্ধ জায়গায় দাঁড়িয়ে আছি। আশেপাশে কোনো সিঁড়ি দূরে থাক একটা আলোর উৎস পর্যন্ত নেই। এবার আমার ভয়টা যেনো আরো কয়েকগুণ বেড়ে গেলো। আমি আস্তে আস্তে ডাকলাম,”মেজদা? মেজদা কোথায় তুই? আমার খুব ভয় করছে রে,তুই কোথায়?”
আমি জানি ও আমার ক্ষতি করতে চেয়েছিলো, কিন্তু এই অবস্থায় নিজেকে খুব একা লাগছে। উপরে ওঠার কোনো জায়গা পেলাম না। তবে কি সারাজীবন এখানে আটকে থাকবো আমি? আমার আম্মা আব্বা কোনোদিন কি খুঁজে পাবে আমাকে এখান থেকে? আমি চিৎকার করে ডাকতে লাগলাম দাদী দাদী গো। আপনি কোথায়? আমাকে বাঁচান দাদী।” কিন্তু আমার কথা প্রতিধ্বনি হয়ে আবার আমার কাছে ফিরে আসতে থাকে। অন্ধকারের মধ্যেও আমি স্পষ্ট বুঝলাম আমি একটা ফাঁকা বিশাল ঘরসদৃশ কোনো স্থানে এসে পৌঁছিয়েছি। কিন্তু আমার জানামতে এটি তো নিচে যাবার সিঁড়ি ছিলো। কোনোদিন ব্যবহার না করলেও আমি জানি এটা দিয়ে সোজা উঠোনে যাওয়া যেতো। হঠাৎ আমার কেমন অস্থির লাগা শুরু হলো। তবে কি এটা আরো নিচে নামার সিঁড়ি ছিলো? আমি কি মাটির নিচে কোথাও এসে পৌঁছিয়েছি? কিন্তু যদি তাই হবে, সিঁড়ি কোথায় গেলো? আমি কীভাবে এই নিস্তব্ধ পুরী থেকে বের হবো?
আমি ভয়ে ভয়ে হাঁটছি আর এখান থেকে বের হওয়ার পথ খুঁজছি। হঠাৎ আমার মনে কেমন যেনো একটা কড়া আগরবাতির গন্ধ। গন্ধটা খুব পরিচিত লাগছে আমার। হ্যা মনে পড়েছে, সেই ঝড়বৃষ্টির রাতে যেদিন বড়চাচাকে পুকুরপাড়ে ডাকা হয় ঠিক এমন একটা গন্ধ ভরে গিয়েছিলো আমাদের হলঘরটায়। কিন্তু এই গন্ধটা আরো বেশি কড়া। আমার মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করে উঠলো। আগরবাতি আর কর্পূর মিশানো একটা গন্ধ। আমি ওড়না দিয়ে নাক চেপে ধরলাম। আস্তে আস্তে গন্ধটা আরো তীব্র হতে থাকলো। আমার বারবার মনে হচ্ছে এটা হয়তো কোনো দুঃস্বপ্ন। ঘুম থেকে উঠেই দেখবো সব ঠিকঠাক আছে। আমার শরীর ঘামে ভিজে জবজব করছে। কেনো অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছি না আমি? মাথা চেপে ধরে বসে পড়লাম আমি।
ঝনঝন শব্দে কিছু একটা ভাঙার আওয়াজে আমি কেঁপে উঠলাম। তবে কি এই নিস্তব্ধ পুরীতে আমি বাদেও আর কেউ আছে? কে আছে? মেজদা? কিন্তু ও থাকলে অনেক আগেই আমার ক্ষতি করতে এগিয়ে আসতো। এমনকি ওর কোনো আওয়াজও পাচ্ছি না আমি। অন্ধকারে কিচ্ছু দেখতে পাচ্ছি না। হঠাৎ কিছুটা আলোর ঝমকানিতে ভয়ে ভয়ে আমার ডান পাশে তাকালাম আমি। কি আশ্চর্য! এই রূপালী পেয়ালাটা এলো কোথা থেকে? রূপার ঝকঝকে আলোতে আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি একটা পেয়ালায় কিছুটা পানি আর পাশে একটা রূপার বাটিতে দুই টুকরা মিষ্টি। তৃষ্ণায় বুকের ছাতি ফেটে যাচ্ছে আমার। আর কিছু ভাবার মতো অবস্থায় নেই আমি। চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে পেয়ালাটা হাতে নিয়ে ঢকঢক করে পানিটা খেয়ে নিলাম আমি। প্রশান্তিতে বুকটা ভরে গেলো আমার। এটি পানি ছিলো না, ঠান্ডা মিষ্টি শরবত। এতো সুন্দর শরবত আমি আমার জীবনে খাইনি। পাশের দুইটা মিষ্টি দেখতেই ভারী সুন্দর লাগছে। এতো সুন্দর বাহারী কাজকরা মিষ্টিও আমি আগে দেখিনি। কিন্তু না! মিষ্টি নিলাম না আমি। দুইপা একত্রে এনে বুকের সাথে বেঁধে বসে থাকলাম। আমার মন বলছে, আমার ক্ষতি হবে না। হঠাৎ বড়চাচার সেই কথাটা মনে পড়লো আমার। সেদিন পুকুরপাড়ের সেই অদৃশ্য কণ্ঠটি তাকে বলেছিলো,”এই বাড়ির কোনো ক্ষতি আমি হতে দেবো না ইনশাআল্লাহ।” আমার মনে আস্তে আস্তে সাহস আসতে থাকে। আশার বুক বেঁধে বসে থাকি আমি।
কতোক্ষণ এভাবে ছিলাম আমি জানিনা। কারো মোটা ভারী গলার আওয়াজ শুনে আমার বুকে হাতুড়ি পেটার মতো শব্দ হতে থাকে। কে আছে এখানে?
“আসসালামু আলাইকুম।”
কে সালাম দিলো আমাকে? কার হতে পারে এমন গলা? আমি ভয়ে কেঁদে দিলাম। চোখ বন্ধ করে ফেললাম, কারণ কোনোভাবেই কোনো ভয়ংকর দৃশ্য আমার সামনে আসুক তা আমি চাইনা।
আমি চিৎকার করে বললাম,”আমাকে যেতে দিন, আমাকে যেতে দিন। আমি আমার আম্মার কাছে যাবো। আমি কারো কোনো ক্ষতি করিনি।”
মনে হলো কেউ হাসলো। আমি তখনো চোখ বন্ধ করে আছি।
“ক্ষতি তো তুই করেছিস পালকি। এই জায়গায় আসা তোদের পরিবারের সবার জন্য নিষিদ্ধ। এই জায়গা শুধু সরদার মুত্তালিব খাঁ এর জন্য বরাদ্দ ছিলো। তুই চলে এসেছিস।”
আমি হাত জোর করে কাঁদতে কাঁদতে বললাম,”আমাকে ক্ষমা করুন। আমি জানি আপনি যে-ই হন আপনি আমাদের ক্ষতি চান না। আমি নিজের জীবন বাঁচাতে ছুটতে ছুটতে এখানে চলে এসেছি। আর কোনোদিন এই ভুল আমি করবো না। দয়া করে আমাকে আমার আম্মার কাছে যেতে দিন।”
“ভুল যখন করেছিস শাস্তি তো তোকে পেতে হবে পালকি।”
ভয় আমার হাত পা কাঁপতে থাকলো। আর কি শাস্তি দিবেন উনি আমাকে?
“তোর শাস্তি আমার অতিথি হয়ে যখন এসেছিস, এই মিষ্টি তোকে খেতে হবে।”
অদ্ভুত ভালো লাগায় আমার মন ছেয়ে গেলো। সত্যিই নিজেকে বড় ভাগ্যবতী মনে হতে থাকলো এই পরিবারে জন্ম নিতে পেরে। আমি ভয়ে ভয়ে আস্তে করে চোখ মেলে তাকালাম। কিন্তু কোথায় কি? কিছুটা ঝকঝকে আলো ছাড়া কাউকে দেখতে পেলাম না আমি।
“আমাকে তুই দেখতে পাবি না পালকি। তোর পরদাদা সরদার মুত্তালিব খাঁ ব্যতীত তোদের পরিবারের কেউ আমাকে দেখতে পায়নি কখনো। তবে আজ একজন দেখবে।”
“কে দেখবে?”
“সে সময় হলেই দেখতে পাবি। মিষ্টি খেয়ে এখান থেকে চলে যা তুই। আর কোনোদিন আসিস না এখানে। সবার জন্য জায়গাটা ভালো না। তোদের রক্ষা করতে আমি সবসময় থাকবো না।”
আমি জানিনা আমি কীভাবে যাবো এখান থেকে। সেই সিঁড়িই বা কোথায় উধাও হয়ে গেলো? তবে আমার মনে বিশ্বাস তিনি যে-ই হোক আমাকে রক্ষা করবেন। আমি ভয় ভয়ে রূপার বাটিটা হাতে তুলে নিলাম। এক টুকরা মিষ্টি মুখে দিতেই প্রাণটা ভরে গেলো। কোনো পার্থিব স্বাদ হতেই পারে না। এতো সুন্দর আমার ইচ্ছা হলো এই মিষ্টির হাঁড়ির মধ্যে বসে থাকতে। একটু আগেই আমার জীবনে উপর দিয়ে কি ঝড় বয়ে গেলো আমি ভুলেই গেলাম। মাথা যন্ত্রণা, শরীরের ক্লান্তি, ভীতি সব এক নিমিষেই দূর হয়ে গেলো। আমি আরেক টুকরো মিষ্টিও খেয়ে ফেললাম। হঠাৎ করে মনে হলো আগরবাতির সেই কড়া ঘ্রাণটা আস্তে আস্তে কমে যাচ্ছে আর আমার মাথাটাও ভীষণ ভার হয়ে আসছে। চোখ দুটো বুজে আসছে ঘুমে। আমি শত চেষ্টা করেও আর জেগে থাকতে পারলাম না। মাটিতেই ধপ করে শুয়ে পড়লাম, মনে হচ্ছে আমি গভীর শান্তির নিদ্রায় তলিয়ে যেতে থাকলাম।
কতোক্ষণ ঘুমিয়ে ছিলাম আমি জানিনা। হঠাৎ পুকুরপাড়ের চিৎকার চেচামেচিতে আমার ঘুম ভেঙ্গে গেলো। ঘুম থেকে উঠেই আমার বুকটা ধকধক করতে থাকলো একটু আগের কথা মনে করে। আমি জানি এটা সত্যিই আমার জীবনে ঘটেছিলো, এটা দুঃস্বপ্ন হতেই পারে না। তবে কাকে বলবো আমি এই কথা? কেউ কি বিশ্বাস করবে আমার এই কথা? একজন বিশ্বাস করতে পারে, আমার দাদী। কিন্তু দাদী? তাকে তো এখনো মেজদা ঘরবন্দী করে রেখেছে। রাজকেও তো তাই। আমি তড়াক করে উঠে গেলাম। উঠতে যেয়ে আমার মনে হলো আমার শরীর ভীষণ দূর্বল। তাও শুয়ে থাকা যাবে না। আমি খাটের রেলিং ধরে আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ালাম। ক্লান্তিতে শরীর ভার হয়ে আছে। তবুও আমি আস্তে আস্তে পা ফেলে হাঁটতে লাগলাম। চিৎকার চেচামেচি ভেসে আসছে পুকুরপাড় থেকে। মানে নিশ্চিত সবাই দাওয়াত খেয়ে চলে এসেছে। আনন্দে আমার চোখে পানি চলে এলো। তার মানে এখন আমি নিরাপদ। আমি আগে তিনতলায় যেয়ে দাদী আর রাজের ঘর খুলে দিবো এরপর নিচে যাবো। এসব ভাবতে ভাবতে ঘর ছেড়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম আমি। কৌতুহলবশত পুকুরপাড়ের দিকে উঁকি দিতেই আমি ভয়াবহভাবে চমকে উঠলাম। সেখানে আমাদের বাড়ির লোকের জটলা। তারচেয়েও অবাক করা ব্যাপার সেখানে আমার দাদী আর রাজও আছে। ওদের কে ঘর থেকে বের করলো? সন্ধ্যা তখন প্রায় ছুঁই ছুঁই। আমি পিছন ঘুরে সেই লোহার সিঁড়ির দিকে তাকালাম। আরো একপ্রস্থ অবাক হলাম আমি। এখানে আসা আমাদের সবার জন্য নিষেধ তাই আমার দাদাজান তো মোটা তালার সাহায্যে সিঁড়ির সামনের গ্রিলটা আটকে রেখেছিলেন, এখনো তালা ঝুলছে। বহুবছরের পুরনো তালা বোঝাই যাচ্ছে অনেক বছর এটা খোলা হয়নি।আর এই তালার চাবিও তো আমাদের কারো কাছে নেই। আমি কীভাবে নামলাম এখান থেকে? আমি হা করে তাকিয়ে ছিলাম সেদিকে হঠাৎ মেজো চাচীর আহাজারিতে আমার চিন্তায় ছেদ পড়ে।
“কি সর্বনাশ হলো গো আমার। ওগো সোনালীর বাবা কি হয়ে গেলো আমার। এখন কি করবো আমরা?”
বাকি সবাই তাকে স্বান্তনা দেওয়ার চেষ্টা করছে। কি সর্বনাশ হয়েছে মেজো চাচীর? তালার রহস্য নিয়ে পরে ভাবলেও হবে, আমি আপাতত নিচে যাই। কোনোরকমে সিঁড়ির রেলিং ধরে ধরে নিচে নেমে এলাম আমি। পুকুরপাড়ে আমাদের পরিবারের সবাই আছে জটলা বেঁধে, তার মাঝখান থেকে আমার চাচীর বিলাপ ভেসে আসছে।
আমি ছুটে গেলাম সেদিকে। সবাই কাঁদছে। দাদীর কোলঘেঁষে দাঁড়ালাম। কিন্তু সামনের দিকে তাকিয়ে যে দৃশ্য আমি দেখলাম তা দেখার জন্য আমি কোনোদিন প্রস্তুত ছিলাম না।
মেজদা পড়ে আছে ঠিক পুকুরের ঘাটলাটার পাশে। তার মুখ দিয়ে ফেনা বের হচ্ছে। আর শরীরে অসংখ্য কাঁটাছেড়ার দাগ, যেনো কোনো হিংস্র কিছু নখ আর দাঁত দিয়ে ফালাফালা করে দিয়েছে একদম। সারাগায়ে জমাট বাঁধা রক্ত। আমি আর সহ্য করতে পারলাম না। চোখ বন্ধ করে দাদীকে জড়িয়ে ধরলাম। না তার জন্য কোনো মায়া আমার কাজ করছে না, শুধু দৃশ্যটা আমার সহ্য হয়নি।
আব্বা যেয়ে মেজদার নাকের কাছে আঙুল দিলেন। এরপর বড় চাচা আর মেজো চাচার দিকে তাকিয়ে বললেন,”বড় ভাইজান, মেজো ভাইজান। ওর নিঃশ্বাস এখনো চলছে। ওকে ঘরে নিয়ে চলেন। আপাতত গরম পানির ছেঁক দিতে থাকেন।এক্ষুনি হাসপাতালে নিতে হবে ওকে। আমি গাড়ি বের করি।”
বড় চাচা, আব্বা আর বড়দা মিলে মেজদাকে ধরে ঘরে নিয়ে আসলেন, শুধু মেজো চাচা পাথরের মতো শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেন।
সবাই আমরা গোল হয়ে ঘিরে বিছানার চারপাশে দাঁড়িয়ে আছি। মেজো আপা আমাকে জড়িয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। আমার শুধু একটা কথাই মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে,” আজ একজন আমাকে দেখবে।”
তবে কি মেজদা উনাকে দেখেছেন? কি হয়েছিলো তখন?
দাদী মেজদার মাথার কাছে বসে কুরআন শরীফ পাঠ করছেন। আম্মা মেজদার ক্ষত স্থানে এন্টিসেপ্টিক লাগিয়ে দিচ্ছেন তুলা দিয়ে, সমস্ত শরীরে বিশ্রী দাগ। অজ্ঞান হয়ে নিথর অবস্থায় পড়ে আছে মেজদা। মেজো চাচী হাউমাউ করে কাঁদছেন। বড় চাচা আর মেজো চাচা দাঁড়িয়ে আছেন পাশে। আব্বা আর বড়দা গেছেন গাড়ি বের করতে।
ছুটতে ছুটতে আব্বা এসে বললেন,”গাড়ি রেডি। সেজানকে হাসপাতালে নিতে হবে, দ্রুত করেন মেজো ভাইজান।”
হঠাৎ দুইহাত মুঠ করে মেজো চাচা শক্ত গলার বললেন,”এই অভিশপ্ত পুকুর আমি ভরাট করে ফেলবো। এই পুকুর আমাদের শান্তিতে থাকতে দেবে না। আমি নিশ্চিত এই পুকুরের কাছে এসেই আমার ছেলের এই অবস্থা হয়েছে। আজ যদি আমার ছেলের কিছু হয়ে যায় আমি সবকিছু তছনছ করে দিবো।যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই পুকুর ভরাট করবো এই আমি, সরদার হারুন খাঁ।”
উপস্থিত সবাই ভয়াবহভাবে আঁৎকে উঠে মেজোচাচার দিকে তাকায়। আমি তো মুখে ওড়না চাপা দিয়ে চাপাগলায় চিৎকার করে উঠি। তবে কি সত্যিই এই সর্বনাশ মেজো চাচা করেই ছাড়বেন?
(চলবে)
[পাঠকের উৎসাহ পেয়ে লেখিকা সাহসী হয়ে উঠেছে! আরো পর্ব বাড়ানোর কথা ভেবে ফেলেছে সে। প্রিয় পাঠকেরা কি খুশি হয়েছেন নাকি লেখিকার উপর রাগ হয়েছেন? গল্পটি কেমন লাগছে জানাবেন। অনেক অনেক ধন্যবাদ সবাইকে আমার গল্পটা এতো পছন্দ করার জন্য।]