মধ্যবিত্ত পরিবারের বড় ছেলের কষ্ট মধ্যবিত্ত জীবন
লাকি রশীদ
পড়ছিলাম, সেহরির সময় হয়ে যাওয়ায় মা কে ডাকতে এসেছি আমি। ডাইনিং স্পেইসে যাবার আগেই শুনি মা বলছে,”৩ হাজার টাকা না দিলে
ভালো প্যান্ট, শার্ট,জামা হবে না তো। কাপড়ের যা দাম, তারপর আবার ঈদের সময়। আমি বলি কি, ৩ হাজার করে ৩ জনকে দিয়ে দাও”। বাবা বিষন্ন
স্বরে বলে,”তাহলে তুমি কি কিনবে”? মা খুশি খুশি
গলায় বলে,”আরে বুবু যে শাড়িটা এবার আমাকে পাঠিয়েছিল, এটা খুলেও দেখিনি। এটা ঈদে পরে ফেলবো”। বাবার সন্দেই তবু যাচ্ছে না,”শাড়ি টা
কি ভালো”? মা বলছে,”বুবু কক্ষণো খারাপ কিছু দেয় না। তোমাকে দেখাবো না হয়”।
রুমে ফিরে যেতে যেতে ভাবি, বাবার সন্দেহ ঠিক অমূলক নয়। ছোট চাচা মাকে ইংল্যান্ড থেকে দেশে বেড়াতে এসে যতবার শাড়ি দিয়েছে, একটা শাড়িও মা পরতে পারে নি। মা সুতি পরলেও সব সময় রুচিশীল কাপড় পরে। কিন্তু,বড়খালার কথা আলাদা। মা কে সবসময় ই সে ভালো জিনিষ পাঠায়।
সেহরিতে দীপু কে ডাকা অনেক কঠিন একটা কাজ। রাতের প্রথম দিকে ঘুমায় না, সেহরির একটু আগে ঘুমায় আর শেষে উঠতে কষ্ট হয়। এতো সুন্দর একটা ছেলে ও, ঘুমালে আরো মায়া
লাগে। মায়ের ডাকে দুই ভাই টেবিলে গিয়ে দেখি,
বাবা ও সুপ্তি টেবিল লাগিয়ে দিয়েছে। আমাকে দেখে ই মা বললো,”অপু যা তো, রুম থেকে তোর বাবার চশমা নিয়ে আয়। চশমা ছাড়া খেতে বসে আবার কাটা লাগাবে গলায়”।
লাইট জ্বালিয়ে বেড সাইড টেবিল থেকে চশমা আনতে গিয়ে দেখি,একটা লাল গোলাপ ছোট ফুলদানি তে রাখা। ঠোঁটের কোণে অজান্তেই হাসি ফুটে উঠে। নিশ্চয়ই বাবার কাজ। আমরা ঢট্রগ্ৰাম থাকতে যখন আমাদের আর্থিক অবস্থা অনেক ভালো ছিল, তখন বাবা বাসায় ফেরার সময়, প্রতিদিন মার জন্য অনেক গুলো গোলাপ ফুল নিয়ে আসতো। এরপর, কিছুদিন ভাত জোটানো ই কষ্টকর ছিল, আর ফুল !!!
দীপু পানি ঢালতে গিয়ে টেবিলে পানি ফেলে দিয়ে
ছে। সাথে সাথে মায়ের বকা,”অকর্মা আর কাকে বলে? যে ছেলে এবার এসএসসি দেবে, সে গ্লাসে পানি ঢালার সময় প্রতিদিন পানি ফেলে। আমি তো বুঝি না কেন”। সাথে সাথে দীপুর উত্তর,”আমি
কি ইচ্ছে করে ফেলেছি নাকি”? বাবা হাল ধরে,
“সেহরির সময় ছেলেটা কে বকো না তো। পানি আমি মুছে দিচ্ছি”। আসলে দীপুর ভীষণ রাগ।রাগ উঠলে হিতাহিত জ্ঞান থাকেনা। এ বাড়িতে মার হাতে ও ই একমাত্র মার খেয়েছে ও এখনো খায়।
শুরু হয়ে গেছে ওর ঘ্যানঘ্যান,”কি শুধু লতাপাতা রাধো মা। এ শাকগুলো বাসায় ফলিয়েছো। বাগান থেকে তুলে এনেই রেঁধে ফেলো। এসব খেয়ে রোজা রাখা যায়”? মা কঠিন স্বরে বলে,”কেন এই
ঢ্যাড়শ আর চিঙড়ির তরকারি, ছোট মাছের চচ্চড়ি তোর চোখে পড়ে না”? দীপুও সরব,”চোখে পড়বে না কেন? এটা তো একদম ই পিচ্ছিল
একটা সব্জি, তাও আবার তরকারি !!! এসব কি ভাবে মানুষ খায়”। মা বলে,”তাই? তাহলে অপু ও
সুপ্তি খায় কিভাবে”? দীপুর উত্তর,”ওরা তোমার ভালো ছেলে মেয়ে মা,তাই ওরা এসব খায়”।
বাবা এবার রেগে যায়,”কি ছেলেটার সাথে তর্ক করছো,ও এসব পছন্দ করে না জানোই তো। ডিম
ভাজি করে দিলেই তো হতো”। মা বাবার দিকে একবার তাকিয়ে রান্নঘরে গেল। সাথে সাথেই দীপু র হাসিমুখ। সুপ্তি মা কে সাহায্য করছে। মা রান্না
ঘর থেকে গলা বাড়িয়ে বললো,”অপু একটু অপেক্ষা কর।উঠিস না যেন”। দীপু ফিসফিস করে
বলছে,”বাবা ভাই এতোক্ষণ মার ভালো ছেলে হয়ে কোনো কথা বললো না। আমি বলে বকা খেলাম।
এখন ভাই কেন ডিমভাজা পাবে”? আমি হেসে বলি,”আমার লাগবে না, তুই আমার ভাগ খাস”। সে আবার হেসে বলল,”তাহলে ই হয়েছে, মা তখন বলবে,”তোর তো কারো জন্য ই ফিলিংস নেই”। আমি বাবা আর দীপু তখন একসাথে হেসে উঠি। কারণ, এটা দীপুর জন্য মায়ের খুব কমন একটা ডায়লগ। প্রায়ই সে দীপু কে বলে।
মা ৪টা ডিম ভেজে এনেছে। এতো তাড়াহুড়োর মাঝেও ডিমে টমেটো, মরিচ, ধনেপাতা দিয়েছে। হলুদ, সবুজ,লাল রঙের অপূর্ব সমাহার। মা ৩ ভাগ করবে, আমি প্লেট হাতে উঠে পড়লাম। মা অবাক হয়ে বলছে,”ডিম খেয়ে যা বাবা”। আমি বলি,”আমি ফুল মা। পেটে একটুও জায়গা নেই। তুমি ওদের দুজনকে দিয়ে দাও”। প্লেট সিঙ্কে রেখে
আসার সময় দেখি দীপু খুব খুশি হয়ে মোটা্ মোটা লোকমা দিয়ে খাচ্ছে। আমি এসব দেখলে,বুকের মধ্যে কিরকম একটা কষ্ট অনুভব করি।
মার দোষ নেই, আমি নিশ্চিত মা হয়তো এ ৪টা ডিম কালকের ইফতার বা সেহরির জন্য রেখে
ছিল।এ মাসে সুপ্তি কে মেডিকেল কোচিং এ ভর্তি
করাতে অনেক গুলো টাকা বাবার খরচ হয়েছে। তাও, আমার বন্ধুদের কোচিং সেন্টার বলে, দুই হাজার টাকা বলে কমিয়েছি। আমার টিউশনির টাকাও পাইনি। মাসের ১০ তারিখ চলছে, ছাত্রের
বাবারবিশাল বাড়ি, গাড়ি। কিন্তু, প্রতিমাসে আমার
টাকাদিতে ওরা ভুলে যায়। বন্ধুরা বলে,”বলিস্ না
কেন,৫ তারিখ পেরিয়ে গেলেই খুঁজবি”। কিন্তু, কেন যেন আমি পারি না। ভীষণ লজ্জা লাগে।
মায়ের কথা মতো বাবা পরদিন ই আমাদের ৩ হাজার টাকা করে ঈদের শপিং এর জন্য দিয়েছে।
দীপুর কাপড় কেনার নেশা আছে। হাতে টাকা পেলেই, কাপড় সে কিনবেই। আশা করা যায়, আজকে রাতের মধ্যে ই, তার পছন্দের যে কোনো কাপড়ের দোকানের ড্রয়ারে টাকা টা চলে যাবে। কিন্তু সুপ্তি বিকেলে এসে বাগড়া দিল। আমরা দুই ভাই কে বারান্দায় নিয়ে ফিসফিস করে বলল, “আমি সিওর বাবার কাছে আর কোনো টাকা নেই ,যে বাবা ও মা কিছু কিনবে। তাই, আমি ঠিক করেছি আমরা প্রত্যেকে ১ হাজার করে দিয়ে বাবা মায়ের কাপড়, জুতা কিনে দেবো”। দীপু সাথে সাথে ই বলছে,”মাত্র ৩ হাজার টাকা পেয়েছি। এর
মধ্যে ১ হাজার দিয়ে দিলে,থাকেই কতো”। আমি পারবো না, তোমরা দাও”। সুপ্তি রাগে গজগজ করতে করতে যাচ্ছে,”এতো স্বার্থপর আমি আমার
জীবনেও দেখিনি। যা লাগবে না তোর টাকা”।
পরদিন বিকেলে বেলা আমরা দুইজন গেলাম
মার্কেটে। বাবার পাঞ্জাবি ও মায়ের শাড়ি কালার ম্যাচ করে কিনলাম। দুটো ই আকাশি রঙের, ২২০০/ টাকা নিল। বাড়তি ২০০/ দিয়ে আমি দিয়ে ভাবলাম, এই মুহূর্তে হাতে টাকা থাকলে মা বাবার জন্য ২ জোড়া স্যান্ডেল কিনতাম। কিন্তু আমার বাকি টাকা দিয়ে আমার জন্য কাপড় না কিনলে,মা কাপড়ই পরবে না সেটা আমি নিশ্চিত।
নানা ঈদের শপিং এর জন্য,২০ হাজার টাকা দিয়ে
ছিল, মা নেয়নি। কারণ,এর সপ্তাহ দুয়েক আগে ছোট মামা আমাদের বাসায় এসে, অনেক ক্ষণ বসে যায়। ছোট মামী নাকি মামা বাসায় যেতে ই বলে,”বোন কে আজ কতো টাকা দিয়ে এলে”?
ছোটমামা এসব নিয়ে উঁচু গলায় কথা বলতেই,
পরিবারের অন্য সদস্যরা শুনে, কেউ একজন মার
কানে তুলে দিয়েছে। তাই এ টাকা নিতে মায়ের আপত্তি। আমি জানি,মা যতোদিন বেঁচে আছে,
হাজার সমস্যা হলেও আর কখনো টাকা নিবে না।
আমি এবার মেডিকেল কলেজের থার্ড ইয়ারে। আমাদের অবস্থা আগে অনেক ভালো ছিল। বাবা
সুপারি,আদা এসবের ব্যাবসা করতো। কি কারণে
পার্টনারের অসাধুতায় বাবা একেবারেই সর্বসান্ত হয়। অনেক সহজ,সরল আর বোকা আমার বাবা। আমি তখন এসএসসি দিয়েছি ওখান থেকে
বাড়িতে আসি আমরা। এখানে আরো বড় ধাক্কা অপেক্ষা করছিল। বাবা ভেবেছিল তার ভাগের ধানী জমি বের করে কিছু বিক্রি করে,ঔ টাকা দিয়ে কিছু করবে আর একটা বাসা ভাড়া নিবে। কিন্তু,দেখা যায় আমার চাচা ওগুলো বেশির ভাগ ই বিক্রি করে দিয়েছেন। সাথে আমার প্রবাসী ছোট চাচাও শামিল। রাগে, ক্ষোভে বাবা পাগলের
মতো হয়ে গিয়েছিল। অনেকে মামলা দায়ের করার বুদ্ধি দেয়। কিন্তু, আমার দূরদর্শি মা বুঝে
গিয়েছিল, এসব সময়সাপেক্ষ ব্যাপার।আর, অনেক টাকা খরচের ও একটা ব্যাপার আছে।
আমরা শহরে এসে নানা বাড়িতে উঠি। নানা তাদের এখানেই থাকতে বলেন। কিন্তু, মা ও বাবা
দুজনেই আপত্তি জানায়। কারণ,২ মামা তাদের পরিবার নিয়ে থাকেন। আমার মায়ের আত্মসম্মান
বোধ প্রখর। মা তার বিয়ের হার বিক্রি করেন। এ টাকা দিয়ে বাবা স্বল্প পরিসরে ব্যাবসা শুরু করেন। বাসা ভাড়া নেবো, এসময় নানা বললেন,
“আমার তো অনেক গুলো ফ্ল্যাট ভাড়া দিয়েছি,
এর একটাতে না হয় তোমরা থাকো”। কি ভেবে মা
রাজি হলো। নানার বাসা থেকে হাঁটার দূরত্ব এই বাসা। মাসের প্রথমদিকে বাবা আমাকে দিয়ে ভাড়া টা পৌঁছে দেয়।
আমার মায়ের হাতে আসলেই যাদু আছে। বাসার
পাশে একটুখানি জায়গায়,শাক, মরিচ,সীম,ধনে
পাতা, মরিচ লাগিয়েছে। টবে লাগানো ঢ্যাড়শ যেন উপছে পড়ছে। আমি আরেক টা টিউশনি পেলে, মা অনেক টা স্বাচ্ছন্দে সংসার চালাতে পারতো। ভাত খাবার সময় প্রতিদিন এক অবস্থা, মা একসাথে বসতে চায় না। আসছি,আসবো করতেই থাকে। বাবাও বুঝে গেছে,মা না এলে হাত গুটিয়ে বসে থাকবে।
নানু রা আগে প্রায়দিন ই এটা সেটা তরকারি রেঁধে
পাঠাতো। বাবা পছন্দ করে না বলে, মা মনে হয়
উনাদের কিছু বলেছে। এখন কিছুটা কমেছে।সুপ্তির মেডিকেল কলেজে এডমিশন হয়ে গেছে। বাবা, মা দুজনেই আনন্দে কাঁদছে। বাবার গলায়
আফসোসের সুর,”ভালো খাওয়া দাওয়া পেলে, বাচ্চা গুলো হয়তো আরো ভালো করতো”। বাবা কে কেউ নীচু দেখালে, সেটা বাবা নিজেই হোক না কেন,মা সেটা সহ্য করতে পারে না। তাই, ফোঁস করে উঠলো,” আর কি ভালো করবে? আর, খাবার কি ওরা খারাপ খায়? এ দেশে ডাষ্টবিন থেকেও খাবার তুলে মানুষ খাচ্ছে। এসবে ই আল্লাহ তাআলা নারাজ হন, সেটা জানো”? আমি বুঝি,বাবা আসলে এসব নিয়ে ভাবে আর শুধু শুধু অপরাধবোধে ভুগে।
সুপ্তি, দীপু দুজনেই চেষ্টা করছে টিউশনি পাবার। সুপ্তি আগে একজন কে পড়াতো। ছাত্রের বাবা অন্য জেলায় বদলি হয়ে যাওয়ায়, সেটা চলে গেছে। আমার বন্ধুর ক্লাশ থ্রিতে পড়া ছোট ভাই এর জন্য প্রাইভেট টিউটর খুঁজছেন শুনে, দীপু কে নিয়ে গিয়ে টিচার হিসেবে দিয়ে এলাম। পাঁচ দিনের দিন বন্ধু ফোন করে বলল,”তোর ভাইয়ের
এতো রাগ !!! আমার ভাই কি একটা বেয়াদবি করায় ও লাথি দিয়ে চলে আসছে। কি সাংঘাতিক ছেলে রে বাবা। আমার মা বলছেন, অপুর ভাই যে
সে…. তা তো বুঝাই যায় না”। আমি ওর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে,দীপুর কাছে যাই। বললাম,”কি
ব্যাপার? তোর ছাত্রকে না কি লাথি দিয়েছিস? কেন এটা করলি? এখন আন্টির সামনে আমি দাঁড়াই কি করে”?
উত্তেজনায় আমার গলা দিয়ে মনে হয় জোরে
কথা বের হতেই, বাবা মা পাশের রুম থেকে চলে এসেছেন। মা শুনে রেগে বলছেন,”ছিঃ ছিঃ,এ ছেলেটা এসব কোথা থেকে পেল, বলতে পারো? তুমি, আমি আর বাচ্চারা….. কেউ ই তো এরকম নই”। বাবা “দীপু আর কখনো এরকম করবে না” বলে ওকে সরিয়ে নিয়ে গেলেন। কিন্তু, মাথা গরম দীপু পরদিন সন্ধ্যায় আরেক কান্ড ঘটালো।পাড়ার
কোন ছেলে না কি ওকে বলেছে,” থাকো তো তুমি
নানার বাসায়,আর এতো গর্ব দেখাও কেন”? সাথে সাথে ই গোয়ার দীপু এতো জোরে ওর নাকে ঘুষি
মেরেছে, নাক দিয়ে নাকি রক্ত ঝরছে। আমি, বাবা,সুপ্তি কেউ ই বাসায় না থাকায়, মা ছেলেকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করিয়ে এনেছে।
এসে মা দীপু কে আচ্ছামতো ধোলাই দিয়েছে। মা
কখনো ই আমার বা সুপ্তির গায়ে হাত তুলেনি। যা
খেয়েছে, দীপু ই খেয়েছে। আমার কাছে অদ্ভুত লাগে, মা যখন তাকে হাতের কাছে যা পায় তা ই দিয়ে তাকে মারতে থাকে,এই ডাকাবুকো ছেলে তখন একদম ই ভয় পায় না। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে মার খেতে থাকে। আটকানোর চেষ্টাও করে না। আজকে আমরা কেউ ই ছিলাম না। সন্ধ্যায় তিনজন বাসায় এসে শুনেছি। বাবা একবার বলার চেষ্টা করছিল,”কিছু হলেই এতো বড় ছেলের গায়ে হাত তোলা ঠিক নয়”। মা রেগে বলেছে, “অপুর বাবা ছেলের হয়ে উকালতি করা বন্ধ করো
তুমি। এতো কষ্ট করছি, ছেলে গুন্ডা হবে বলে? ও
কি বাংলাদেশের সমাজ কে বদলাতে পারবে না কি? নানা বাড়িতে থাকলে এই সমাজ এসব তো বলবে ই, এসব সহ্য করতে ই হবে। এতো নরম চামড়া কেন, মানুষ কথা বললে ই ফোস্কা পড়ে যায়”?
বাবা আর কিছু না বলে, আমাদের রুমে যায়। আমি পেছন পেছন গিয়ে দেখি,বাবা ওকে জড়িয়ে
ধরে বলছে,”দেখি বাবা কোথায় তোর মা তোকে মেরেছে? বেশি ব্যাথা পেয়েছিস রে পুত”? দীপু খ্যাক করে উঠেছে,”ব্যাথা না আমি ভীষণ আরাম পেয়েছি। সরো তুমি, মাকে কিছু বলতে পারো না,
আর আমাকে আহ্লাদ দেখাতে এসেছো”। বাবা এবার বলে,”এই ভদ্রমহিলার সাথে আমি কি করে
পারবো বল্”? দীপু চেঁচিয়ে উঠলো,”তাহলে এখান থেকে যাও। আমি তো আর তোমাকে ডেকে আনি নি”। আমাদের সহজ,সরল বাবা ছেলের চিৎকারে
খুব হাসছে,যেন এরচেয়ে মজার কোনো ঘটনা এই
পৃথিবীতে আজ পর্যন্ত ঘটেনি।
ছোট সাইজের আপেল দীপুর খুব প্রিয়। আমি খেয়ে দেখেছি, ছোট বড় সব আপেলের স্বাদ ই আমার এক মনে হয়। বাবা ঘরে ঢুকার সময়, এক
টি কাগজের প্যাকেট হাতে দেখেছি। বাবা এবার
আমার দিকে তাকিয়ে বললো,”অপু যা না সোনা,
৮/১০ টা আপেল ধুয়ে নিয়ে আয়, আমরা খাবো। আসার সময় সুপ্তিকেও ডেকে নিয়ে আসিস প্লিজ”।
দীপু সামনাসামনি ই আমাকে বলে,”তুমি হলে মা এর ভালো ছেলে। আপ্পিও তাই, শুধু আমি ই এক
নম্বর খারাপ। ভালো তো, তোমরা বসে বসে ২ জন মায়ের আদর খাও,আর কি করবে”? সুপ্তি চুপচাপ ও ঝামেলা না করার পক্ষের এক মানুষ। আমি তো চুপচাপ ই। সুতরাং, আপাতদৃষ্টিতে বুঝা
যায়, মা শুধু আমাকে ও সুপ্তিকে ই মনে হয় আদর করে ও দীপু কে মোটেও দেখতে পারেন না। আমার বাবারও হয়তো তাই মনে হয়। সেজন্য
দীপু কে অনেক আগলে আগলে রাখেন। আপেল ধুয়ে এনে তাদের কাছে নিয়ে আসি। দেখি্, দীপু বিন্দাস হয়ে একবার আমার দিকে তাকিয়ে,সব
চেয়ে লাল আপেলটা মুখে তুলে নিল।
আমি বলে আসায়,সুপ্তিও চলে এসেছে। ও বাবা
কে দেখলে, সবসময় বাবার গলা জড়িয়ে ধরে থাকে। আজকেও এভাবে বসে বাবা কে বলছে,
“শোনো বাবা দুষ্টু প্রকৃতির বাচ্চাদের এতো আদর করতে নেই। তাতে বাচ্চারা মাথায় চড়ে যায়”। দীপু ওর দিকে তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,”তুমি
এতো জানো কিভাবে? তোমার কি অনেক গুলো
দুষ্টু প্রকৃতির বাচ্চা আছে নাকি”? সুপ্তি বলে,”বাচ্চা
থাকতে হবে কেন? তোর মতো একটা ভাই হলেই
তা হাড়ে হাড়ে বুঝা যায়”। সাথে সাথে ই দীপু আপেলের প্লেটটা সরিয়ে সুপ্তি কে বলে,”তুমি এতো হিংসুটে কেন আপ্পি? একা একা মায়ের আদর খেয়েও শান্তি নেই, এখন বাবা আমাকে যে
আদর করছে,তাও তোমার দেখতে ভালো লাগে না? তুমি একটা আপেলও পাবে না বললাম”।
সুপ্তি মুখে হাসি নিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,”কি আর করা যাবে, আপেল না হয় না ই খেলাম। তুই একা ই আপেলের সাথে বাবার আদর খা, তাহলে মায়ের মারের ব্যথাটা কিছু কমবে”। দীপু ২য় বার চেঁচামেচির আগে,”আমি এখন টিউশনি তে যাবো
বলে” বলে মায়ের কাছে বলার জন্য রান্নাঘরে পা
বাড়ালাম।
চলবে…………