- প্রথম প্রেমের গল্প
- প্রথম প্রেমের রোমান্টিক গল্প
- ভালোবাসার গল্প গুলো
- গভীর ভালোবাসার গল্প
- facebook. রিলেশনের গল্প
১.প্রথম প্রেমের গল্প
#গল্প
এক্স ফ্যাক্টর
নিজের হলুদ সন্ধ্যায় এক্স গার্লফ্রেন্ড ইরাকে নাচতে দেখে চমকে উঠল রায়ান। হাতে থাকা কোল্ড ড্রিঙ্কসের গ্লাস থেকে ছলকে কিছুটা পানীয় পড়ল পাঞ্জাবিতে। পাশে থাকা মামী শাশুড়ি ব্যস্ত হয়ে বললেন,
আহা কি হলো এটা! এই নাও টিসু দিয়ে মুছে ফেলো জলদি। নাহলে দাগ বসে যাবে।
রায়ানের তখন মাথাটা ঝিমঝিম করছে। পাঞ্জাবির দাগ নিয়ে চিন্তা করার মতো অবস্থা নেই।
মাথার মধ্যে ঘুরছে ইরা। ওর সাথেই এমনটা হতে হবে। এই ঢাকা শহরে এতো এতো মানুষ থাকতে ইরাকেই আসতে হবে এখানে।
ইরার সাথে রায়ানের পরিচয় হয়েছিল এক বন্ধুর জন্মদিনের পার্টিতে। ইরা ছিল ঐ বন্ধুর ছোট বোনের বান্ধবী। উচ্ছল সুন্দরী ইরাকে প্রথম দেখাতেই ভালো লেগে যায় রায়ানের। পুরোটা সময় ওর পিছে পিছে ঘুরে ফ্লার্ট করে রায়ান। হাতে থাকা ডিএস এলারে একের পর এক ইরার ছবি তোলে।
একসময় ইরা বলে,
শুনুন, জন্মদিন কিন্তু আমার না।
রায়ান বলে,
আপনাকে দেখার পর আর কারো ছবি তুলতে গেলেই ঝামেলা করছে ক্যামেরাটা!
এভাবেই ইরাকে বুঝিয়ে দেয় ওর ভালো লাগার কথা। অনুষ্ঠান শেষে দেখে ইরার ঠিকানাটাই নেয়া হয়নি। তারপর বন্ধুর ছোট বোনের কাছ থেকে ঠিকানা জোগাড় করে একদিন আচমকা গিয়ে হাজির হয় ওর মেসে। ছবিগুলো দিয়ে বলে,
এতো সুন্দর ছবি কাছে রাখতে সমস্যা হচ্ছে। তাই নিজেই ঠিকানা জোগাড় করে চলে এলাম দিতে।
কি সমস্যা হচ্ছে?
সারাদিন শুধু ছবিই দেখতে মনচায়।
ঘুম খাওয়া সব গেছে আমার।
ইরা ছবি নিয়ে মিষ্টি হেসে চলে যাবার জন্য ঘুরতেই রায়ান বলল,
সেল নাম্বার টা কি পেতে পারি? না মানে ছবি কেমন হয়েছে তার রিভিউ নিতাম আর কি।
ইরা যেতে যেতে বলে গেলো ওর নাম্বার।
সেদিন রাতেই কল করল রায়ান। আর তারপর প্রতিদিন।
রায়ানের কথার জালে অষ্টাদশী ইরা খুব সহজেই জড়িয়ে গেলো। মন দিয়ে ফেলল রায়ানকে।
তারপর রাতের পর রাত জেগে কথা, এখানে ওখানে দেখা করা, রায়ানের কেয়ারিং সব মিলিয়ে আরো বেশি রায়ানের সাথে জড়িয়ে গেলো ইরা।
একদিন রায়ান একটা কফিশপে ইরাকে নিয়ে হার্ডবোড ঘেরা একটা রুমে গিয়ে বসতে চাইল। ইরা বসতে না চাইলে বলল,
বাইরেতো টেবিল ফাঁকা নেই।
ইরা দেখল সত্যি সব টেবিলে মানুষ আছে।
তখন ইরা বসতে রাজি হলো।
ওয়েটার কফি দিয়ে গেলে রায়ান একহাতে ইরাকে জড়িয়ে চুমু খেলো।
ইরা একটু আড়স্ট হয়ে পড়লে ছেড়ে দিলো রায়ান। একটু পর আবার আচমকা ইরাকে জড়িয়ে ওর জামা টেনে বুকে হাত দিলো। ইরা নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে চেষ্টা করল,
রায়ান ছাড়ো,এসব কি!
তুমি তো আমারই ইরা,একটু কাছে আসলে কি এমন হবে?
বলেই রায়ান টেনে ইরাকে কোলে বসিয়ে দিলো।
আর দুহাতে ইরার পুরো শরীর চটকাতে লাগল।
ইরা সব শক্তি দিয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে বের হয়ে এলো।
রায়ান হতভম্ব হয়ে বসে থাকল। বিল মিটিয়ে বাইরে এসে দেখল ইরা নেই।
রায়ান কল দিলো কিন্তু ইরা ফোন রিসিভ করলো না।
রায়ান মেসেজ দিলো,
আমি তোমার মেসের বাইরে। তুমি যতক্ষণ ক্ষমা না করবে আমি এখান থেকে সরবো না।
ইরা ফোন অফ করে দিলো। রাত বারোটায় জানালা দিয়ে দেখল রায়ান রাস্তায় ল্যাম্পপোস্টে হেলান দিয়ে বসে আছে। জানালা বন্ধ করে ইরা ঘুমিয়ে পড়ল।
সকালে উঠে দেখল রায়ান ওখানেই আছে বসে। ওর বান্ধবী রুমা বলল,
এই ইরা,রায়ান ভাই নাকি সারারাত বাইরে ছিলো। সবাই কানাঘুষা করছে। যা হয়েছে মিটিয়ে ফেল। নাহলে বড় কোনো সিনক্রিয়েট হবে।
ইরা বাধ্য হয়ে রায়ানের কাছে গেল।
রায়ান বলল,
মাফ করে দাও ইরা। আর কখনো এমন হবে না।
আচ্ছা যাও।
আমাকে তুমি বিশ্বাস করো না। এটাই সবচেয়ে বেশি অপমানের। আর তাছাড়া তোমার সাথে যদি আবারও এমন করি,তুমি কাছে থাকলে আমার সব এলোমেলো হয়ে যায় ইরা। তোমাকে আমি বিয়ে করতে চাই।
রায়ানের অবস্থা দেখে ইরার মায়া হলো। ওর মনে হলো রায়ান সত্যি ওকে ভালোবাসে। নাহলে বিয়ে করতে চাইতো না। আর তাছাড়া ওতো পুরুষ মানুষ। ওকে কাছে চাইবে এটাই স্বাভাবিক। ইরা বলে,
বাড়িতে কি বলব?
আমার বাড়িতে সমস্যা নেই। তোমার পরীক্ষা হয়ে গেলে বাসায় জানিয়ে দিও।
পরদিন রায়ানের এক বন্ধুর বাসায় কাজী ডেকে বিয়ে করে নিলো দু’জনে।
আর কোনো বাঁধা থাকলো না কাছে আসতে।
আজ হোটেলে,তো কাল কোনো বন্ধুর বাসায়,দু’জনে দেখা করত।
এভাবে বছর ঘুরে এলো। রায়ানের অফিসে এক সুন্দরী মেয়ে কম্পিউটার অপারেটর হিসেবে জয়েন করল। রায়ান ঐ মেয়ের প্রতি দূর্বল হয়ে পড়ল। ইরাকে এখন আর ভালো লাগে না রায়ানের। ঐ কলিগের সাথে জড়িয়ে পড়ল রায়ান।
ইরা ঈদের বন্ধে বাড়িতে গেলো। ফিরে এসে খেয়াল করল রায়ান একটু কেমন বদলে গেছে। ঘনঘন ফোন দেয়া,দেখা করতে চাওয়া কমিয়ে দিয়েছে।
ইরা কল করলে কখনো একবারে রিসিভ করে না।
দেখা করতে চাইলে বলে আজ একটু ব্যস্ত আছি সোনা।
ইরার মনটা কেমন কু ডাকতে শুরু করল।
একদিন ওর রুমমেট তিফা বলল,
আজ রায়ান ভাইকে দেখলাম একটা মহিলার সাথে শপিং করছে। খুব ক্লোজ মনে হলো।
ইরার বুকের ভেতর ধক করে উঠল। ও সাথে সাথে রায়ানকে কল করল।
তুমি কোথায় ছিলে দুপুরে?
একটা মিটিং ছিলো।
আমিতো অফিসে গেলাম। তুমি নাকি ছুটি নিয়েছো।
বাড়াবাড়ি করার কি ছিলো? আমাকে কল দিতে।
কোথায় বাড়াবাড়ি করলাম। তোমার জন্য পুডিং করেছিলাম।
ভাবলাম সারপ্রাইজ দেই।
আমিতো বাইরে চলে এসেছি তখন।
মিথ্যা বলছো কেনো! আমিতো তোমাকে দেখেছি।বলো এক মেয়ের সাথে শপিং এ ছিলে তাইনা?
হুম, আমার কলিগ।
ও তাহলে এখন কলিগের সাথে শপিং করতেও হয়।
এতো মিন মাইন্ডেড কেনো তুমি?
এখনতো এটাই বলবে, আমার মন ছোট,আমি খারাপ। আচ্ছা আমি যদি কারো সাথে ঘুরতাম তোমাকে মিথ্যা বলে?
ঘোরোনা তুমি, চাইলে ডেটিং করো,শোও তাতে আমার কিছু আসে যায় না।
এভাবে বললে,আমি না তোমার বিয়ে করা বৌ!
কিসের বিয়ে! আমাকে তোমার এতোটা বোকা মনে হয়! ওসব ছিলো নাটক।
কি বলছো!
হুম,ঐ কাজী,মৌলভী সব নকল ছিলো।
এটা করতে পারলে তুমি!
না করলেতো তুমি ধরা দিচ্ছিলে না। সতির মূর্তি হয়ে ছিলে। আজকাল কে শুধু দেখা করে প্রেম করে।রুম ডেট না করলে এতো টাইম ওয়েস্ট কে করে বলো।
আচ্ছা তো সেটাও তো হয়েছে তবে এখন অন্য কারো সাথে কেনো তুমি?
তোমাকে আর ভালো লাগছে না ডার্লিং। বাসি ভাতের মতো ফ্যাসফ্যাসে হয়ে গেছো তুমি।
আমি সবাইকে তোমার আসল চেহারা প্রকাশ করে দেব। তোমার অফিসে, তোমার বন্ধুদের।
আর আমি কি শাড়ি চুড়ি পরে বসে থাকব ? তোমার যেসব ছবি আমার কাছে আছে সব নেটে ছেড়ে দেব।
কিসের ছবি?
পাঠিয়ে দিচ্ছি দেখো।
মেসেঞ্জারে পাঠানো ওর নগ্ন ছবি দেখে আঁতকে উঠল ইরা। রায়ান কখন এসব তুলেছে। ও এতোটা শয়তান কখনো একটুও টের পায়নি।
তুমি এতো জঘন্য!
কিসের জঘন্য, তোমার ভাগ্য ভালো যে আমি এসব দিয়ে তোমাকে ব্লাকমেইল করছিনা। যা হয়েছে সব ভুলে চুপ করে যাও। আমিও তোমাকে ঘাটাবো না আর।
ছবি দেয়ানেয়া নিয়ে সম্পর্কটা শুরু হয়েছিল,সেই ছবি দিয়েই সব শেষ করল রায়ান।
এতো কিছুর পরেও রায়ানকে ফোন দিয়েছে,ওকে বোঝাতে চেয়েছে ইরা। ওর জন্য কেঁদেছে। রাতের পর রাত জেগে থেকেছে। একসময় মানসিক রোগী হয়ে গেছে। শেষ পর্যন্ত সাইক্রিয়াটিস্টের কাছে যেতে হয়েছে।
কোনোরকমে ফাইনাল দিয়ে লন্ডনে পাড়ি জমায় ইরা।
আজ এতোদিন পর এভাবে নিজের বিয়েতে ইরার সাথে দেখা হবে ভাবতেও পারেনি।
ইরার ডাকে ভাবনায় ছেদ পড়ল রায়ানের।
ইরা বলছে,
হাই জিজু, আপনাকে এখন নাচতে হবে আমাদের সাথে।
আমি তো নাচতে পারি না।
তা বললে হবে? আজকাল কার ছেলেরা নাচতে না জানলেও নাচাতে তো জানে।
মা মা মানে।
মানে আপনি শুধু কিছু স্টেপ ফলো করবেন আমরাই নাচ চালিয়ে যাব।
যাক ইরা বিষয়টা চেপে গেছে ,এই ভেবে একটু স্বস্তি পেলো রায়ান।
ধনীর দুলালী শিমিকে বাগে আনতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে রায়ানকে। শিমি বড়লোক বাবার একমাত্র মেয়ে। সমস্ত সম্পত্তির উত্তরাধিকারী। এই বিয়েটা কিছুতেই ভেস্তে দিতে দেয়া যাবে না। এখনতো রায়ানের কাছে সেসব ছবিও নেই যে ইরাকে ভয় দেখাবে। পুরাতন মোবাইলের সাথে সাথে সব নষ্ট হয়ে গেছে।
একফাঁকে শিমির চাচাতো ভাইকে ডেকে রায়ান বলল,
ঐ যে নীল লেহেঙ্গা পরা মেয়েটা নাচছে ও কে ?
ওতো শিমি আপুর ছোট খালার মেয়ে।
রায়ানের গলা শুকিয়ে গেলো। ওর হবু বৌয়ের কাজিন ইরা। কপাল!
হলুদ ছোঁয়ানোর সময় ইরাও এলো রায়ানকে হলুদ ছোঁয়াতে।
মুখের কাছে মিষ্টি তুলে ধরে হেসে কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল,
সেঞ্চুরি করার ঠিক আগে বোল্ড আউট হতে কেমন লাগে জিজু?
রায়ানের গলায় মিষ্টি আটকে কাশি উঠে গেলো।
ইরা পানি দিয়ে বলল,
কুল জিজু,অমন হড়বড় করে খাচ্ছেন কেনো। একটু রয়ে সয়ে। ওহ্,আপনার তো আবার হামলে খাওয়ার অভ্যাস।
রায়ান বুঝতে পারছে না ইরা ঠিক কি চাইছে।
হলুদ শেষে বর কনের অনেক ছবি তোলা হলো।
ইরা বলে উঠল,
আমাদের জিজু কিন্তু দারুণ ছবি তোলে তাই না জিজু?
রায়ানের অস্বস্তি হচ্ছে। ও ওয়াশরুমে গেলো।
একটু পর ইরাও এলো পিছে পিছে।
পেছন থেকে ইরা রায়ানকে জড়িয়ে ধরল। তারপর জোর করে কিস করতে লাগল।
কি হচ্ছে এসব? ছাড়ো ইরা।
কেনো একসময়তো আমাকে কাছে পেলে পাগল হয়ে যেতে জানু।
আগের কথা তুলে কি লাভ,ছাড়ো কেউ এসে পড়বে।
লাভতো আছেই তবে সেটা আমার।
প্লিজ পুরোনো সব কথা ভুলে যাও।
ভুলেই তো গেছিলাম। কিন্তু তোমাকে এখানে দেখে আবার সব মনে পড়ল সোনাপাখি।
কি চাও তুমি?
টাকা।
কি?
হুম দশ লাখ টাকা চাই।
এক টাকাও পাবে না তুমি।
তাহলে আমার সাথে তুমি যা যা করেছো সব ফাঁস করে দেবো।
কেউ বিশ্বাস করলে তো। আমি বলব তুমি টাকার জন্য এসব করছো।
এইতো ভুল করলে। তোমার পাঠানো ছবিগুলো আমার কাছে আছে। আর এইযে এখনের সব কথা রেকর্ড হয়ে যাচ্ছে আমার ফোনে।
ইউ বিচ।
নো নো। গালাগালি চলবে না। কম্প্রোমাইজে আসো।
আচ্ছা পাঁচ দেব।
উহু দশ চাই। এক টাকাও কম চলবে না।
রায়ান ভেবে দেখল দশ দিলে ওর আর কিছু থাকে না। তবে শিমির সাথে বিয়েটা হলে কোটি টাকার মালিক হবে ও। তাই ইরার কথায় রাজি হয়ে গেলো।
আচ্ছা ডান। তবে তুমি যদি বিট্রে করো।
কি গ্যারান্টি যে তুমি এসব নিয়ে আর ঘাঁটাঘাঁটি করবে না।
এটুকুই মানবতা আমার আছে সোনাপাখি। তুমি তো আমাকে ব্লাকমেইল করতে পারতে কিন্তু করোনি। ধরে নাও সেটার প্রতিদান।
পরদিন রায়ান ইরার দেয়া একাউন্ট নাম্বারে দশ লাখ টাকা ট্রান্সফার করে দিলো।
ইরা আর কিছু বললো না বিয়ের দিনে। বরের হাত ধোয়া থেকে শুরু করে জুতা লুকানো সবটাতেই ভীষণ মজা করল ইরা।
রায়ান হাফ ছেড়ে ভাবল যাক বিয়েটা ঠিকমতো হয়ে গেলে আর চিন্তা নেই।
কাজী এসে বরের কাছে বসল প্রথমে তারপর বৌয়ের কাছে যেতেই একটা হৈচৈ শুরু হলো। শিমির মোবাইলে কে যেন রায়ানের সাথে একটা মেয়ের ঘনিষ্ঠ ছবি পাঠিয়েছে।
একমূহুর্তে বিয়েটা ভেঙ্গে গেলো। শুধু তাই না। শিমির প্রভাবশালী বাবা আইনগত ব্যবস্থা নিলেন রায়ানের বিরুদ্ধে।
ক্ষতিপূরণ গুনতে হলো রায়ানকে। সেইসাথে চাকরিটাও হারালো। কোনো ভালো কোম্পানিতে রায়ান যাতে চাকরি না পায় তেমনটাই ব্যবস্থা করলেন শিমির বাবা।
রায়ান ঠিক করল ইরাকে ছাড়বে না কিছুতেই।
কিন্তু সেদিনের পর থেকে ইরা যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে।
খোঁজ করতে গিয়ে রায়ান জানল
ইরা ঐ ঘটনার পরেরদিন লন্ডনে ফিরে গেছে।
(সমাপ্ত)
২.প্রথম প্রেমের রোমান্টিক গল্প
সহজ প্রেম
-আপনার ঐ পাশের সিটটা আমার।
-ওহ…সিওর। প্লিজ ঢুকে পড়ুন।
-থ্যাংকিউ।
-বাসে বমি হওয়ার সমস্যা আছে? না মানে মেয়েদের অনেকেরই থাকেতো। আর তাছাড়া এই ঠাণ্ডায়ও উইন্ডো সিট নিয়েছেন।
-না।
-যাক। বাঁচা গেলো। আমার আবার কারো বমি করা দেখলে প্রবলেম হয়।
…
-ল্যাগেজটা তো বক্সে দিতে পারতেন। কাছে রেখে বসতে প্রবলেম হচ্ছেনা?
…
-আচ্ছা, আমি একাই কথা বলছি। আপনি কিছু বলছেননা!
-আমি অপরিচিত কারো সাথে প্রয়োজন ছাড়া কথা বলিনা।
-ওকে, তাহলে আমরা পরিচিত হয়ে নেই। এতোটা পথ চুপচাপ বসে থাকা কঠিন। আমি সায়েম। পড়াশুনা করি। আপনি?
-সেতু। পড়াশুনা করি।
-কি পড়ছেন?
-অনার্স। ইডেনে।
-আমি ডিইউতে।
…
…
-আবার তো চুপ হয়ে গেলেন।
-কী বলবো?
-যে কোন কিছু।
-পূর্ব পরিচয় বা কোনো সম্পর্ক ছাড়া কি কথা এগোয়?
-সম্পর্ক আছে তো আপনার-আমার মধ্যে।
-কী সম্পর্ক?
-আমরা একে অন্যের সহযাত্রী।
-(হাসি)
-আপনার হাসিটা সুন্দর।
-আপনার চোখ দুটো।
-পটল চেরা? নাকি পাখির নীড়ের মতো?
-কোনটাই না। এগুলো মেয়েদের চোখের উপমা দিতে ব্যবহার করা হয়। আমি লিটারেচারের স্টুডেন্ট।
-ছেলেদের চোখের উপমা কী দিয়ে দেওয়া হয় আপনার সাহিত্যে?
-ছেলেদের সৌন্দর্য চোখে নয়। পেশিতে। তাই চোখের উপমা খুব একটা দেখা যায়না।
-আচ্ছা, চিরে ফেলা অর্ধেক পটল বা পাখির নীড় কি কোন ভাবে সুন্দর টানা টানা চোখের মতো? বিছ্রী দেখতে তো। চোখের উপমা কেনো এগুলো দিয়ে দেওয়া হয়?
-আমি সাহিত্যে নতুন। কেবল সেকেন্ড ইয়ারে। এতো কিছু জানিনা। আপনি কি পড়ছেন?
-বিবিএ।
…
…
-কয়টা বাজে? আমার ফোনটা পার্সের মধ্যে তো।
-দেড়টা, একটা তেত্রিশ।
-সবাই তো ঘুমাচ্ছে।
-আপনার ঘুম পাচ্ছে? আমার কাঁধটাকে বালিশ হিসাবে ব্যবহার করতে পারেন। আমি কিছু মনে করবোনা।
-নাহ। ঠিক আছে। আমার একটু শান্ত পরিবেশ ছাড়া ঘুম হয়না।
-ঘুম হয়না নাকি আমি পাশে বলে ভয় হচ্ছে?
-না, ভয় করবে কেনো? আপনি ছেলে হিসাবে ভালোই। বিশ্বাস করা যায়।
-এটুকু সময়ে কিভাবে বুঝলেন আমি ছেলে হিসাবে ভালো?
-আমি যখন আমার সিটে বসেছিলাম তখন আপনার ও আমার মাঝে পাঁচ ইঞ্চি গ্যাপ ছিলো। গত চার ঘণ্টায় ড্রাইভার সাহেবের এত গুলো কড়া ব্রেক, টার্নিং ও ঝাকির পরও মাঝের গ্যাপ পাঁচ ইঞ্চিই আছে। আমি কয়েক বার আপনার গায়ে পড়ছি। আপনি পড়েননি।
-আপনার তো বালিশের দরকার নাই। আমার দরকার।
-কেন? ঘুমাবেন?
-না। আপনার কাঁধে মাথা রাখতে ইচ্ছা হচ্ছে।
-ইশ্। সখ কতো। ভদ্র বলেছি বলে ঘাড়ে মাথা রাখতে দিব ভেবেছেন?
-ভাবিনি। আমি সিওর মাথা রাখলে আপনি কিছু মনে করবেননা।
-কিভাবে এতোটা সিওর হলেন?
-আমি অলরেডি মাথা রেখেছি।
-ওকে। তাহলে আমিও রাখবো।
-দুজন তো একই সাথে দুজনের ঘাড়ে মাথা রাখতে পারবোনা। আসুন আমরা দুজন দুজনের মাথায় মাথা রাখি।
-ওকে।
-বাড়িতে কে কে আছে আপনার?
-আব্বু, আম্মু আর এক ছোট ভাই। আপনার?
-আমার আব্বু আর আম্মু। একটা বড় বোন আছে। বিয়ে হয়ে গেছে।
-আর মনের বাড়িতে কে আছে?
-মনের বাড়িতে কেউ নেই। এক জন দরজায় দাড়িয়ে আছে। বাড়িতে ঢুকবে না বের হয়ে চলে যাবে বুঝতে পারছিনা। আপনার?
-আমারও আপনার মতোই আবস্থা।
-একি! পানি পুরাটা শেষ করে ফেললেন!
-আপনি খাবেন? একটু আগে বলতেন।
-কেন আপনি জানেননা? আমি আপনার পানি প্রার্থী?
-ও তাই? এখনো আমার ঠোঁটে দু-এক ফোটা পানি লেগে আছে। চলবে?
সাই সাই করে এগিয়ে চলেছে বাস রাজ পথ ধরে। লাইট বন্ধ। যাত্রীরা সব গভীর ঘুমে মগ্ন। আর দুজন মনের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষ দরজা খুলে ভিতরে প্রবেশ করায় ব্যাস্ত।
৩.ভালোবাসার গল্প গুলো
#japanKahini জাপানি নববর্ষ এবং প্রথম জাপানি প্রেম
বাংলাদেশে বাংলা একটা পঞ্জিকা আছে। আর জাপানের নিজস্ব কোন পঞ্জিকা নেই। অফিস আদালতে আমরা যে পঞ্জিকা ব্যবহার করি, এটাই। তাই জাপানিদের নববর্ষ হলো পহেলা জানুয়ারি। ধার করা নববর্ষ বলতে পারেন।
তারিখটা ধার করা হলে ও সালটা নিজস্ব।
যেমন, আজ হলো ২০১৭ সাল এপ্রিল ১৪ তারিখ। জাপানি ভাষায় লিখবে ২৯ সাল ৪ মাস ১৪ তারিখ। সালটা জাপানি। ২৯ মানে বর্তমান সম্রাট ২৯ বছর ধরে গদিতে আছেন। এই সম্রাট পরিবর্তন হয়ে আরেক সম্রাট এলে আবার ১ থেকে বছর গণনা শুরু হবে।
জাপানে আমার প্রথম জাপানি নববর্ষ কেটেছে টোকিও তে।
১৯৮৮ সাল শেষ হয়ে ১৯৮৯ আসছে। ডিসেম্বর ২৫ তারিখ এর পর থেকে কেমন ঈদ ঈদ ভাব। দোকান পাট রাস্তা ঘাট সব ছোট ছোট বাতি দিয়ে সাজানো। একটা পণ্য কিনলে সাথে সাথে দোকানদার কিছু একটা গিফট দিচ্ছে। এমনকি ১০০ টাকার পণ্য কিনলে ও। জাপানের অর্থনীতি তখন আকাশচুম্বী।
৩১শে ডিসেম্বর কাটলো ডরমিটরির বিদেশী ছাত্রদের সাথে। টোকিওর গরম এলাকা রপ্পঙ্গিতে। নাচে গানে ভরপুর এক জায়গা। বিরাট কাউন্ট ডাউন হয়।
এই নববর্ষ আসলে জাপানি কায়দার না।
জাপানি কায়দার নববর্ষ টের পেলাম দ্বিতীয় বছরে। শীতের ছুটি (ডিসেম্বর ২৫ থেকে জানুয়ারি ৭ পর্যন্ত) প্রায় পুরোটাই কাটিয়ে দিলাম এক জাপানির বাড়িতে। নববর্ষে এরা কী করে, কী খায়, কী পরে সব সব দেখার সৌভাগ্য হলো।
আমি যে পরিবারটির সাথে ছিলাম তাদের পারিবারিক নাম হিরানো। রূপক কর্মধারয় সমাসে আমি বলতাম হীরা রূপী হীরানো। ৬৬ বছরের বাবা, ৬০ বছরের মা, আর ৮২ বছর বয়সের দাদি আছেন। দুই মেয়ে বিয়ে করে গ্রাম ছেড়েছেন। ফাঁকা বাড়ি দিয়ে কী করবেন? বিদেশী ছাত্র ছাত্রীদের জন্য দরজা খুলে দিলেন। কাঠের এক দোতালা বাড়ি। আমার রুম দেয়া হলো দোতালায়। ওনারা থাকেন এক তলায়। প্রতিদিন সকালে সবাই মিলে কাঁচা বাজারে যাই। সবজি কিনি, মাছ কিনি। আমি কেটে কুটে দেই। মা-জান রান্না করেন। সবাই মিলে খাই। দুই বিকালে দাদিজান ওনার আলু ক্ষেতে নিয়ে গিয়েছিলেন। আগাছা পরিষ্কার করার জন্য। ৮২ বছরের মহিলা। কি যে স্ট্যামিনা।
তিন দিন পর ২৮ তারিখে ওনাদের বড় মেয়ে আসলেন। জামাই বউ কানাডা যাবেন, ৫ বছরের কন্যাকে রেখে গেলেন। নাম হারুকা। মানব কন্যা নয়। যেন কারিগরকে অর্ডার দিয়ে বানানো এক পুতুল। গ্রীষ্মের ছুটিতে ও তার সাথে দেখা হয়েছিল। তেমন খাতির হয়নি। এবারো প্রথম দিন আমার সাথে তেমন কথা বললনা। দ্বিতীয় দিনে আমরা দুজনে দুজনের প্রিয় হয়ে গেলাম। তৃতীয় দিন থেকেই সে আমাকে ছাড়া খাবে না। আমাকে ছাড়া ঘুমাবে না। আমি তাকে যত্তসব রাজকুমারীদের গল্প শোনাই।
৫ বছরের জাপানি মেয়ে। বললাম না, পুরোটাই পুতুল। ঘুমালেও পুতুল, জেগে থাকলে ও পুতুল। সকালে ঘুম থেকে উঠে সে টের পায় সে দোতালায় নেই, একতলায়। উঠেই চোখ ঘষতে ঘষতে দোতালায় আসে। নীচ তলা থেকে ডাক দিতে দিতে দৌড় দেয় – আশিরু অনি-ই-চান। বাড়ির ফ্লোর কাঠের। আমি তার পা এর থপ থপ শব্দ শুনতে পাই। উপুড় হয়ে ঘুমিয়ে থাকার ভান করে থাকি। সে কাঁধের উপর উঠে ধাক্কাতে থাকে। পুরাই একটা বিড়াল ছানা। পুরনো গল্পই বার বার শুনতে চায়। রাজকুমারীটা ডাইনি বুড়ি থেকে কিভাবে ছাড়া পেল শুধু সেই অংশটুকু।
নীচ থেকে ডাক পড়ে – আসাগোহান দা-য়ো, নাস্তা রেডি। হারুকা একই কথা রিপিট করে। আসাগোহান দা-য়ো। ঘরের মধ্যেই কি এক আজিব প্রতিধ্বনি।
আমার কাঁধ তার প্রিয় জায়গা। আমি তাকে কাঁধে নিয়ে আস্তে আস্তে নীচ তলায় যাই। সে নিজেকে মনে পরিবারের সবচেয়ে উঁচু আসনের সবচেয়ে লম্বা ব্যাক্তি। নাস্তা শুরু হয় ঠাণ্ডা দুধ খেয়ে। এই দেশের মানুষ শীতকালে ও ঠাণ্ডা দুধ খায়। হারুকা দুধ খায় চুক চুক করে। পুরাই বিড়াল ছানা।
সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে দাঁত মাজা আমাদের অভ্যাস। এই মেয়ে আমাকে ধমক দিল- দাঁত মাজবে ঘুমাবার আগে আর নাস্তার পরে, বুঝলে?
৩০ তারিখ। রাতে সবাই মিলে টিভি দেখছি। কী সুন্দর সুন্দর অনুষ্ঠান। সারা বছরে পৃথিবীতে কোথায় কী আচানক ঘটনা ঘটেছে তার সারমর্ম দেখাচ্ছে। রুমানিয়ার প্রেসিডেন্ট চসেস্কু কে সবার সামনে গুলি করে মারা হলো। বার্লিনের দেয়াল ভাঙ্গা হলো। এসব।
রাত নয়টার দিকে হঠাৎ লাইট অফ হয়ে গেল। হারুকার নানি মোমবাতি সহ কেক নিয়ে ঢুকলেন। হ্যাপি বার্থ ডে টু য়ু। দাদি সহ হাত তালি দিয়ে গান গেয়ে উঠেলন। জ্বি আজ আমার জন্মদিন। বাংলাদেশে কোনদিন জন্মদিন পালন করেছি বলে মনে পড়ছে না। আনন্দে আমার চোখের পানি আসার কথা ছিল। কিন্তু আমার কোন অনুভূতি নেই। এমন একটা ভাব, যেন এটা আমার পাওনা ছিল।
হারুকার নানা-নানি মিলে একটা সাদা সোয়েটার কিনে এনেছেন। জন্মদিনের উপহার। আমার একটা সোয়েটার দরকার ছিল। সেই সোয়েটার সবার সামনে পড়তে হলো। আমার কাছে ঈদ ঈদ লাগছে। বাংলাদেশে নতুন ঈদের পোশাক পরে প্রথমেই বাবা মা কে সালাম করতাম। ওনাদের সালাম করতে হবে কিনা বুঝতে পারছিলাম না। অপ্রস্তুত হওয়া দেখে নানিজান বললেন, তোমার কি সোয়েটার পছন্দ হয় নি? দাদি জান বললেন, হারুকা তোমার জন্য লাভ লেটার লিখেছে।
কিন্তু হারুকা তা এখন দিতে চাচ্ছে না। সে এক শর্ত দিয়ে বসলো। এই চিঠি যেন এখানে না খুলি। যেন শুধু আমিই দেখি।
ও মাই গস। ৫ বছরের মেয়ে।
চিঠি খুলে আমি অবাক। কোন জাপানি মেয়ে থেকে পাওয়া এটাই আমার প্রথম প্রেম পত্র। চিঠির কন্টেন্ট সে গোপন রাখতে চেয়েছিল। থাকনা সেটা গোপন। আপনাদের যতটুকু শেয়ার করতে পারি সেটা হলো – সে আসলে কিছু লেখেনি। কিছু এঁকে দিয়েছিল। কিন্তু যা বোঝাতে চেয়েছে তার ষোল আনাই বুঝেছি।
নববর্ষ ঘনিয়ে আসছে। আগে যেমন দিন গুনতাম, ঈদ আসতে আর কত দেরী, পাঞ্জেরি। তেমন। আমাদের উৎসব গুলোর সাথে অনেকাংশে মিল আছে। বেমিল ও আছে।
আমাদের ঈদের মতো ওরাও সবাই নিজ নিজ গ্রামের বাড়ি ফেরে। বাস ট্রেনে মানুষ বাদুর দোলা হয়ে না গেলে ও ভেতরে ঠাসাঠাসি অবস্থা। ৩১ তারিখ বিকালে আমরা বের হয়েছিলাম। এখানে পাড়া প্রতিবেশী সবাই সবাই কে চেনে। কোন ঘরের ছেলে ফিরেছে, কবে ফিরবে এসব নিয়েই কথা বিনিময় হলো। বিবাহিত মেয়েরা নববর্ষ পালন করে শ্বশুর বাড়িতে। আমাদের দেশের মতই।
রাত বারোটার সময় অনেকেই মন্দিরে যায়। অনেকটা কিশোর বয়সে আমাদের কুমিল্লায় শব-ই-বরাতের রাতের মত। এক মসজিদ থেকে আরেক মসজিদে শুধু রিক্সা দিয়ে ঘোরাঘুরি। এরা ও এক মন্দির থেকে আরেক মন্দিরে যায়। ঢং ঢং করে ঘণ্টা বাজায়। টোকিও তে প্রায় সারারাত ট্রেন চলে। বাইরে প্রচণ্ড ঠাণ্ডা। আমরা ঘরে বসে টিভি দেখছি। অনুষ্ঠানের নাম – কো-হাকু উতাগাসসেন। একগ্রুপ সেলিব্রিটি আছেন সাদা দলে, আরেক গ্রুপ লাল দলে। বিভিন্ন কুইজ, খেলাধুলা, গান বাজনা র আয়োজন। ফলাফল হবে সম্মিলিত ভাবে। আমি আর হারুকা লাল দলের ফ্যান। বাসায় আজ আর্জেন্টিনা – ব্রাজিল ভাব।
এক তারিখ সকালে ঘুম থেকে উঠেই দেখি বাপ-জান কয়েক শত পোস্ট কার্ড ঘাটছেন। আর মা-জান কে বলছেন- শুনছো অমুকের ঘরে ছেলে হয়েছে, অমুকের মেয়ের বিয়ে হয়েছে। এই পোস্ট কার্ড গুলো হচ্ছে জাপানিদের নববর্ষের কার্ড। নেন-গা-জো। উনি কার্ড লিখেছিলেন ২০০র মতো, পেয়েছেন ৩০০। চমৎকার এক কালচার। বিরাট এক ব্যবসা। একটা পরিবার গড়ে ৫০ খানা করে কার্ড লিখলে ১০০ কোটি কার্ড বিনিময় হয়। সবচেয়ে জনপ্রিয় কার্ড হলো এদের জাপান পোস্ট অফিসের কার্ড। একেক এলাকার জন্য একেক ধরণের ডিজাইন। আপনি নিজে ও ডিজাইন করতে পারেন। হাতে লিখতে পারেন, প্রিন্ট করতে পারেন। সাধারণত এক বছরে পরিবারে কি কি ঘটলো তার ছবি সহ বর্ণনা দেন। প্রত্যেক কার্ড এর নীচে থাকে একটা লটারি নাম্বার। লটারি ড্র হয় জানুয়ারির ১ তারিখে। নিউজ পেপারে। আর পোস্টম্যানদের দায়িত্ব হলো সব পোস্ট কার্ড মোটামুটি একই সময়ে বিলি করা। ভোর ৪ টা থেকে ৬ টার ভেতরে। সকালে ঘুম থেকে উঠেই প্রত্যেক পরিবার শুরু করে কার কাছ থেকে কি ধরণের কার্ড এলো। কার পরিবারে কি পরিবর্তন এলো। এই সব।
আমরা যেমন নববর্ষে পান্তা ইলিশ খাই বা ঈদে সেমাই খাই, এরা খায় অমোচি নামক এক চালের তৈরি স্বাদহীন আঠালো পিঠা। আগে জাপানি দাদি নানিরা এই পিঠা নিজেরা তৈরি করতেন। এখন রেডিমেইড পাওয়া যায়। ভয়ঙ্কর এক জিনিশ। আঠালো বিধায় মাঝে মাঝে গলায় ঠেকে যায়। এমন কোন বছর নেই যে বছর কোন বুড়ো বুড়ি মারা যায় নাই। এখন কমেছে কিন্তু শূন্যে যায় নি।
সকাল ৮ টার দিকে নাস্তা সেরেই মার্কেটে দৌড়। মা-জান শপিং করবেন। ডিপার্টমেন্ট স্টোর গুলো এক ধরণের গিফট-সেল এর আয়োজন করেন। লাল সাদা রঙের একটা বড় প্যাকেট। মুখ বন্ধ। ভেতরে কি আছে দেখার উপায় নেই। এক প্যাকেট ১০,০০০ ইয়েন। ২০০০ ইয়েন এর প্যাকেট ও আছে। লাইন ধরেন, টাকা দেন, প্যাকেট নেন। বাসায় এসে প্যাকেট খুলেন। ভাগ্য ভালো থাকলে ১০,০০০ ইয়েন এর প্যাকেটে ১০০,০০০ ইয়েন মূল্যের জিনিশ পাবেন। এই প্যাকেটের নাম ফুকু-বুকুরো। ফরচুন-প্যাকেট। এই কালচার বর্তমান জাপানের অর্থনৈতিক অবস্থায় আছে কিনা জানিনা।
মা-বাবা, নানা-নানি রা বাচ্চাদের টাকা দেন। অতোসি দামা। অধিকাংশ বাচ্চারা এই টাকা জমিয়ে রাখে। আমি বাচ্চাদের সরাসরি টাকা দেয়ার বিপক্ষে। কিন্তু কেন জানি আমাকে যারা টাকা দিল সেটা নিয়ে নিলাম। এমন ডাবল স্ট্যান্ডার্ডের আমার আমিকে প্রথম আবিষ্কার করলাম। আমি হারুকাকে কিনে দিলাম একটা ঝুনঝুনি। অনেকটা আমাদের ঘুঙ্গুরের মত। সে এটা তার ব্যাগে লাগিয়েছে। ইচ্ছা করেই একটু বেশি দুল দুল করে হাঁটে যেন ঝুন ঝুন আওয়াজ হয়। গিফট পেয়ে সে দারুণ খুশি। কোন অতিথি আসলেই নববধূর মত আহ্লাদ সহ বলে, এই ঝুনঝুনি আমাকে আশিরু অনি-চান দিয়েছে।
সকাল দশটায় বের হলাম। হারুকার নানি হারুকা কে কিমোনো পরিয়ে দিল। এই পুতুলকে আরো বেশি পুতুল পুতুল দেখাচ্ছে। যেন একটু আগেই রঙ মাখিয়ে আনা হয়েছে। আমরা যাবো একটা কমিউনিটি সেন্টারে। সব বয়সের লোক জন আছেন। বাচ্চাদের জন্য আছে ছড়া প্রতিযোগিতা। নাম কারুতা। একজন ছড়া পড়বেন। আর মেঝে বিভিন্ন ছড়া লেখা অনেকগুলো কার্ড র্যান্ডোমলি বিছানো আছে। ছড়ার লাইন শোনা মাত্র সেই ছড়া যে কার্ডে লেখা আছে সেটা স্পর্শ করতে হবে। যে সবচেয়ে আগে স্পর্শ করবে সেই কার্ড তার। আমার জাপানি ভাষার লেভেল দেখে আমাকে ও বাচ্চাদের দলে ঢোকানো হল।
৩ তারিখে আরো তিনজন বিদেশী এই বাড়িতে উঠলো। একজন এসেছে পালাও নামের এক দেশ থেকে। এই দেশের নাম আমি প্রথম শুনেছি। হারুকা সবার প্রিয় হয়ে উঠলো। বিশেষ করে পালাও দেশের মেয়েটা হারুকা কে আদর করলে আমার গা জ্বলে যায়। বলতে ইচ্ছা করে – হারুকা পালাও থেকে পালাও।
এই ঈর্ষা ঈর্ষা ভাব থেকে মুক্তি পাবার জন্য আমি একদিনের জন্য আমার ডরমিটরি তে ফিরলাম। ডরমিটরি কাছেই। দুই ঘণ্টার পথ। বললাম আমার লেখা পড়া আছে। বই আনতে হবে।
৬ তারিখে এসে দেখি হারুকার বাবা মা ফিরেছেন কানাডা থেকে। কাল হারুকা কে নিয়ে টোকিও চলে যাবেন।
পরদিন সকালে ঘুম থেকে নিজে নিজেই উঠলাম। প্রতিদিনকার মত হারুকা আজ আমার রুমে দোতালায় উঠে আসেনি। সকালে নাস্তার টেবিলে হারুকাকে দেখলাম। সেদিনকার প্রেমপত্র লেখা হারুকা আজ আমাকে না চেনার ভান করছে। নিজেকে কেমন পাত্তাহীন অকেজো বস্তুর মত লাগছে।
সে টোকিও যাবার জন্য মহাব্যস্ত। মাথায় টুপি পড়েছে। পেছনে ব্যাগ। গোলাপি কালার।
আমি পড়াশুনার অজুহাত দিয়ে দোতালায় চলে এলাম। নীচ তলা থেকে কিছু কথাবার্তা আর ঝুনঝুনির আওয়াজ পাচ্ছি। সে এদিক সেদিক ঘুরছে। ব্যাগের সাথে ঝুনঝুনিটা আছে। একটু অপ্রয়োজনীয় রকমের দৌড়াচ্ছে আর ঝুনঝুনিটাকে ইচ্ছা করে বাজাচ্ছে। তার অস্তিত্বকে জানান দিচ্ছে। আর আমার কাছে মনে হচ্ছে একটা অনস্তিত্বের আগাম বাণী। বিদায়ের ঘণ্টা।
জাপানে এসে প্রথমে বন্ধুহীনতায় ভুগেছি। নিজ বয়সের কাউকে বন্ধু বানাতে পারিনি। যাঁদের সান্নিধ্যে যেতে পেরেছি তারা হল শিশু আর দাদা- দাদি, নানা-নানি শ্রেণীর লোক।
নীচ তলা থেকে ঝুনঝুনির আওয়াজ টা স্পষ্ট হয়ে উঠছে। সে দোতালায় উঠে আসছে – বিদায় নেবে। ঝুনঝুনির আওয়াজটা অসহ্য লাগছে। এসব ঝুনঝুনি যে কেন কিনে দিয়েছিলাম। নিজের পায়ে কুঠার নিজে কেন মারতে গেলাম? কেমন কান্না কান্না পাচ্ছে। যেন জীবনে প্রথম ছ্যাকা খাওয়ার মুহুর্তটির জন্য অপেক্ষা।
৪.গভীর ভালোবাসার গল্প facebook
একটা বয়স পরে আমাদের একটা নামহীন সম্পর্ক হোক—;
সম্পর্ক মানেই প্রেম বা অন্যকিছু এমন নয়।
ধর, মাঝরাতে ঘুম আসছে না, কথা বলতে ইচ্ছে করছে খুব
কিন্তু কথা বলার কেউ নেই;
কাউকে ডাকতে পারছ না— সকালে উঠে আবার ব্যস্ততা
এমন সময় নিঃসংকোচে ফোন করা যায়
এমন একটা সম্পর্ক আমাদের হোক।
ধর, সবাই এখন দূরে— ছেলে লন্ডনে আর মেয়ে প্যারিসে
তুমি স্মৃতি আঁকড়ে ধরে দেশে পড়ে আছ;
সপ্তাহে নিয়ম করে ফোন আসে দু’চার দিন
মিনিট ত্রিশেক কথা
আবার সেই একাকীত্ব, শূন্য ঘর— টেবিলে রবীন্দ্রনাথ
কখনো শুধু শরৎ বাবু;
কিন্তু তুমি চাচ্ছ দুপুরবেলায় এক কাপ কফি আর গল্প—
এমন একটা সম্পর্ক আমাদের হোক
হাত না ছুঁয়েও আষাঢ়ে উষ্ণতা নামে খোলা বারান্দায়।
ধর, স্পন্ডিলাইটিসের ব্যথাটা বাড়ছেই, ডাক্তার বলেছে হাঁটতে
কিন্তু তুমি একা বের হতে এখন ভয় পাও
সবার ব্যস্ততা, তোমাকে সাথে করে হাঁটবে এমন সময় নেই
কিন্তু এমন একজন হোক—
ভোরে ডেকে নিয়ে হাঁটতে বের হবে
তোমাকে চোখে চোখে রাখবে
একটুখানি ক্লান্ত হলে পার্কের বেঞ্চে বসে কপাল ছোঁবে
হাত দুটি ধরে রাখবে
আবার খুব সাবধানে ঘর অবধি পৌঁছে দেবে;
এমন একটা নামহীন সম্পর্ক আমাদের হোক।
ধর, এখন আর কবিতা শোনা হয় না—
কিন্তু কবিতা খুব প্রিয় ছিল;
কিশোর বেলার সেই প্রেমের মত কেউ একজন
এই বয়সেও না হয় বাহানা করুক খুব—
তোমাকে সে মাঝরাতে সুনীলের কবিতা শোনাবে:
ভালোবাসি-ভালোবাসি।
সব ধূসর রঙের সাথে মিশে তুমিও যেন ধূসর হয়ে যাচ্ছ;
হলুদ পাতার মত জারুল গাছ থেকে খসে পড়ছে প্রিয় সবকিছু:
বন্ধু-বান্ধবী; পাড়াপড়শি, আত্মীয়স্বজন
এখন যেন আরো ফাঁকা লাগে—
মাঝরাতে হঠাৎই জানালার ধারে একটা কাক কেমন যেন ডাকে:
যেন ছেড়ে যেতে হবে এরই আহ্বান।
তুমি ভীষণ বিষণ্ণ;
কিন্তু তোমার একজন আছে যাকে দেখলে পালায় সকল অসুখ
আরো কিছু বছর বাঁচতে ইচ্ছে হয়;
একটা বয়স পরে আমাদের এমন একটা নামহীন সম্পর্ক হোক।
সকল নিঃসঙ্গ মানুষের নিঃসঙ্গতা জুড়ে
একটা বয়স পরে এমন একটা নামহীন সম্পর্ক হোক;
নিঃস্ব দীর্ঘশ্বাসে এমন সম্পর্ক থাকুক— এই সম্পর্কে মানুষ বাঁচুক।
:
‘নামহীন সম্পর্ক’
লেখক- তনয় চক্কোত্তি।
৫.রিলেশনের গল্প
বিবর্ণ প্রেম
‘আমি আজকে অফিসে আসতে পারবোনা, আমার গাড়ির ব্রেক কাজ করছে না’। সাত-সকালে সোনিয়ার এহেন মেসেজ পেয়ে ফুয়াদের চরম মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো। এই সদ্য তরুণী মেয়েদের নিয়ে কাজ করা খুব সমস্যার আর ইংলিশ হলে তো কথাই নেই। পাল্টা মেসেজ পাঠালো সে, ‘বাসে আসো’।
‘আমার কাছে টাকা নেই ফুয়াদ, আর তাছাড়া আমাকে তিনবার বাস চেঞ্জ করতে হবে’। তাৎক্ষণিক উত্তর এলো সোনিয়ার কাছ থেকে।
এদেশে ছুটি নেওয়ার যে কত ধরণ আছে তা ম্যানেজার না হলে জানতে পারতো না ফুয়াদ। যতজনের এইচআর ফাইল সে দেখেছে সবগুলোতেই সে দেখতে পেয়েছে সিক লিভ যতটুকু এলাওড ততো তো নিয়েছে আর সাথে আছে নানা ধরণের টাল -বাহানা যেমন এংজাইটি বা স্ট্রেস। লোক দেখানো একটি কম্পেটিশন চলে সবার মাঝে, কার বয়ফ্রেইন্ড কত হ্যান্ডসম, কে কোন ব্রান্ডের ঘড়ি, ব্যাগ কিনলো। পকেটে টাকা না থাকলেও লেটেস্ট মডেলের আইফোন থাকতে হবে, গাড়ি হতে হবে আউডি বা মিনি। তারপর বিয়ের আগে বাড়ি কিনতে হবে আরো কত কিছু ! এতো সব চাপ আর তারপর সোশ্যাল মিডিয়ায় সবার ঝকঝকে সুন্দর ছবি – স্ট্রেস বাড়িয়ে দেয় উইকেন্ডে পার্লারে যাওয়ার জন্য। তার কাছে মনে হয় এই সমাজ কাঠামো এর জন্য দায়ী। পুঁজিবাদী কাঠামোর সাথে যদি ওয়েলফেয়ার মিক্স করা হয় তার বিরূপ প্রোডাক্ট তো তৈরি হবেই। আর ফুয়াদের ধারণা, এরা ইচ্ছে করে কাজ করতে চায়না। তবে সবাই না, অনেকে আছে খুব ভালো কাজ করে। সোনিয়া দারুন কাজ করে, কিন্তু মাঝে মাঝে তিন-চার মাস পর পর হঠাৎ করে যে তার কি হয়। মনে মনে ভাবলো, বাংলাদেশ হলে যে কি হতো? এদেশে মানে ইউকেতে এমপ্লয়ীরদের অনেক অধিকার আছে এবং স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলি এই সব অধিকারের ব্যাপারে বেশ সরব।
কি হয়েছে? ঘুমকাতর কণ্ঠে জানতে চাইলো পুতুল।
না কিছু হয়নি – বলে জানালো ফুয়াদ।
আচ্ছা ঠিক আছে, বলে পাশ ফিরে আবার শুয়ে পড়লো পুতুল, ফুয়াদের স্ত্রী।
ওদের ভালোবাসার বিয়ে, একসাথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তো সোসিওলোজিতে। তারপর প্রেম, বিয়ে, প্রবাস জীবন এবং দুই সন্তান রজনী আর রাইসাকে নিয়ে থাকে অক্সফোর্ডে।
কি করবে চিন্তা করছে ফুয়াদ। মেসেজ পাঠালো, ‘তুমি কি হেলেনকে বলেছো- তোমার প্রিয় বান্ধবী’ ?
‘না, কারণ দশ মাইল ওকে ড্রাইভ করতে হবে, ওকে তেল খরচ দেবার মতো আমার কাছে টাকা নেই ফুয়াদ।
‘ঠিক আছে, তোমার ঠিকানা পাঠাও, আমি তোমাকে পিক করছি’।
তুমি সিউর, এতো কষ্ট করবার দরকার নেই ফুয়াদ, তুমি বরঞ্চ আমাকে অ্যানুয়াল লিভ দিয়ে দাও।
না, অসুবিধে নেই। আজকে আমার দরকার তোমাকে কারণ আমি সারাদিন ব্যস্ত থাকবো মিটিঙে, অফিস সামলানোর কাজ তোমাকে করতে হবে। তুমি ছাড়া আমি অন্যদের উপর ভরসা করতে পারিনা।
আমি কিন্তু তোমার তেলের পয়সা দিতে পারবো না।
ঠিক আছে, আর তোমার বাসায় যাওয়ার ব্যবস্থা আমি করবো ।
সোনিয়ার মেসেজ আসলো ঠিকানা সমেত, গুগলে চেক করলো সে তারমানে আরো সাত মাইল ড্রাইভ করতে হবে, এই শীতের সকালে। তার ড্রাইভ করতে সমস্যা নেই কিন্তু গ্রামের রাস্তায় সে এই শীতের সকালে গাড়ি চালাতে অস্বস্তি বোধ করে। রাতের বেলা শিশির পড়ে কিন্তু তাপমাত্রা মাইনাসের নীচে থাকায় রাস্তার উপরে হালকা বরফের আবরণ থাকে, সাবধানে গাড়ি না চালালে গাড়ি স্কিড্ করে দুর্ঘটনার মধ্যে পড়ার সম্ভবনা থাকে। আর এই দেশে মানে ইংল্যান্ডে গ্রামের রাস্তাগুলি আঁকাবাকা আর স্পীড লিমিট থাকে ন্যাশনাল মানে ঘন্টা প্রতি ষাট মাইল সিঙ্গেল ক্যারিজে। আর কেউ যদি সাবধানতাবশতঃ আস্তে গাড়ি চালায় তাহলে তো পিছন থেকে হর্ন আর গালি খাওয়া ছাড়া কোনো গতি থাকে না। ফুয়াদ বুঝতে পারেনা এই রাস্তায় কিভাবে সম্ভব পঞ্চাশের উপর গাড়ি চালানো।
মোটামুটি সাবধানে পৌঁছুলো সে – এই কনকনে ঠান্ডায়।
তুমি কষ্ট করে এলে কেন?
তোমার ম্যানেজার হিসাবে আমার একটি কর্তব্য আছে না?
ওহ, তোমাকে একটা নিউজ দেওয়া হয়নি?
কী!
আমার সাথে তো স্টিভের ছাড়াছড়ি হয়ে গেছে।
তাহলে তো ভালো হলো, আমি তোমার সাথে প্রেম করতে পারবো।
ধূর, তোমার না বৌ-বাচ্চা আছে?
তো- আচ্ছা দুষ্টামি করলাম, কি এমন হলো যে একেবারে ব্রেকআপ।
আরে- ও একটা লেজি ছেলে কিছুই করতে চায়না, আর তাছাড়া আমি খবর পেয়েছি ও আরেকটি মেয়ের সাথে চ্যাট করে। আমার টাকায় কেনা ওর ফোন – আর ওই ফোন দিয়ে আরেকজনের সাথে কথা বলা, আমি আমার পক্ষে কিছুতেই মেনে নেওয়া সম্ভব না।
আচ্ছা, আর কোনো কারণ আছে?
তুমি জানো আমার ফ্যামিলিতে আমার সৎ বাবা খুব এবিউস করে আমার মাকে আর আমার ছোট ভাইটা অটিস্টিক। আই নিড সাপোর্ট ফুয়াদ।
হুম, খুব সরি – আসলে বাইরে থেকে তোমাকে বোঝা যায় না।
চলে আসলো তারা অফিসে।
সবাইকে কাজ বুঝিয়ে দিয়ে সে মিটিংয়ের উদ্দেশে বেরিয়ে গেলো। মিটিং অক্সফোর্ড টাউন সেন্টারে। একটি প্রজেক্টের ব্যাপারে কথা চলছে। তার বাসার উপর দিয়ে গেলো সে। মিটিং শেষ হতে হতে দুপুর হয়ে গেলো। চিন্তা করলো এখন বাইরে না খেয়ে বাসায় গিয়ে কিছু খাওয়া যায় নাকি। পুতুল বের হবে তিনটার দিকে বাচ্চাদের আনতে। সারপ্রাইজ দেওয়া যাবে এই ভেবে নিজেই চমকিত হলো।
বাসায় পৌঁছে গেলো সে। পুতুল কোথায় গেলো? শাওয়ার থেকে আওয়াজ আসছে – মনে হয় শাওয়ারে গেছে। পুতুলের ফোন বেজে উঠলো। দেখলো রাহুগ্রস্ত নামে একটি নাম থেকে ফোন আসছে। এই নাম তো সে কোনোদিন শোনেনি পুতুলের কাছ থেকে। রিং বন্ধ হয়ে গেলো। সাথে সাথে মেসেজ আসলো, ‘জান তুমি কোথায়’?
আরেকটা- ‘আমি তোমাকে খুব মিস করছি’!
আবার আরেকটা – ‘আই লাভ ইউ জান’।
হকচকিয়ে গেলো সে – এগুলি কি দেখছে সে। মাথা কিছুতেই কাজ করছে না। বাসা থেকে বের হয়ে গেলো সে। পুতুলের মুখোমুখি হতে চাইছে না সে।
বিমর্ষ ভাবে সে ফেরত আসলো অফিসে। তার কেবলি মনে হচ্ছে সে যা দেখেছে ভুল দেখেছে। কোনো কাজেই মন বসাতে পারছে না সে। কি এমন হলো পুতুলের। কাল রাতেও তো সে আগের মতো সপ্রতিভ ছিলো, অন্য পুরুষের সাথে তার সম্পর্ক – এটা মন থেকে ভাবতেই পারছে না।
কি হয়েছে হ্যান্ডসাম – সোনিয়া জিজ্ঞাসা করলো।
কেন?
তোমাকে আমি ইমেইল করলাম, মাইক্রোসফট টিমসে মেসেজ করলাম – কোনোটাই তো উত্তর দিলে না। এরকম তো কখনো হয় না।
না, কিছু হয়নি। আচ্ছা আমি দেখছি।
তাই, তবে মনে হচ্ছে কিছু একটা হয়েছে।
আচ্ছা, আমি তোমার ইমেইল চেক করে দেখছি কি করতে হবে।
কোনোমতে ইমেইলের রেসপন্স করলো সে। একটু পরে আবার সোনিয়া আসলো – তুমি ঠিক আছো?
কেন?
আমি যে কোয়েরি তোমার কাছে পাঠিয়েছি – তুমি সেটার উত্তর দাওনি, তুমি হেলেনের ইমেইল আমাকে ফরওয়ার্ড করেছো। কি হয়েছে তোমার।
না, কিছু হয়নি।
আচ্ছা, আমার বাসায় যাওয়ার কি হলো?
দেখছি আমি, হেলেনকে বলে দিচ্ছি -উত্তর দিলো ফুয়াদ।
দরকার নেই, তুমি আমাকে নামিয়ে দিয়ে আসলে মাইন্ড করবো না বলে দুষ্ট হাসি দিয়ে চলে গেলো সোনিয়া।
আবার কাজে মনোনিবেশ করবার চেষ্টা করলো সে। কিন্তু মাথার মধ্যে কেবল ওই মেসেজগুলি ভেসে আসছে। আরো কয়েকটি মিটিং শেষ করলো সে, এখন সব মিটিংই অনলাইনে। এর একটি সুবিধা আছে, ক্যামেরা আর নিজের সাউন্ড মিউট করে বসে থাকলো মিটিংগুলিতে। বস কিছু জিনিস জানতে চেয়েছিলো – সে বলেছে ইনফরমেশন চেক করে জানাবে।
পাঁচটা বাজতেই সোনিয়া হাজির- চলো বলে ফুয়াদের ডেস্কের পিছনে জানালা বন্ধ করা শুরু করলো।
একসাথে বের হলো তারা। সোনিয়া থাকে ক্যাবলিংটন নামে একটি গ্রামে। ওর বাসার কাছে আসতেই বললো চলো এখানে একটি সুন্দর ড্রিংক করার জায়গা আছে, একটু বসি।
আমি ড্রাইভ করছি আর তুমি তো জানো আমি ড্রিংক করি না – উত্তর দিলো ফুয়াদ।
আমি জানি, তুমি তোমার ইউজাল ড্রিংক মানে লেমোনেড খাইও আর আমাকে একটি ককটেল কিনে দিও।
আচ্ছা, একটা কিন্তু।
ঠিক আছে।
পাবের নাম জর্জ ভি (মানে ফাইভ- পঞ্চম জর্জ)। বেশি ভিড় নেই, সোনিয়ার সাথে তাকে ঢুকতে দেখে কিছু লোকের অবাক দৃষ্টি চোখে পড়লো ফুয়াদের। দৃষ্টি টা রেসিস্ট নাকি সেক্সিস্ট সেটা বোঝবার চেষ্টা করছে সে।
ড্রিংক নিয়ে বসলো তারা।
কি হয়েছে ফুয়াদ – সামথিং রং উইথ ইউ।
না, কেন?
আমার মন বলছে।
তোমার মন তো সব সময় কিছু বলে তাই না।
কিন্তু এবার মনে হচ্ছে বেশ সিরিয়াস।
বিষয়টা বেশ পার্সোনাল। বললো ফুয়াদ।
তাইতো জানতে চাইছি।
আমি তোমাকে পরে বলবো সোনিয়া।
অন্য প্রসঙ্গে কথা উঠলো, সোনিয়া আবার আরেকটি ড্রিংক খেতে চাইলো – বললো বেতন পেলে সে টাকা দিয়ে দিবে। ফুয়াদেরও ভালো লাগছেনা বাসায় যেতে। সোনিয়ার সঙ্গ খুব একটা খারাপ লাগছে না।
সোনিয়া ওর সৎ বাবার কথা বলছে , ওর মার্ কথা বলছে। সোনিয়ার বয়স মাত্র বাইশ। দেখতে ভীষণ মিষ্টি। ও জানালো ওর মার কি একটি অসুখ হয়েছে, ডাক্তাররা ধারণা করছে ক্যান্সার কিন্তু কোনো স্ক্যানে এখনো কিছু ধরা পড়েনি। মা অসুস্থ হওয়ার পর ওর সৎ বাবা ওকে সেক্সসুয়ালি এক্সপ্লয়েট করবার চেষ্টা করেছে। কিন্তু মাকে সে বলতে পারছে না – মার এই অবস্থার জন্য। ছোট ভাইটার সাথে কাউকে না কাউকে থাকতে হয়। কি হবে তার?
আরো দুটি ড্রিংক করলো সোনিয়া। সোনিয়া ওর হাত ধরলো, একটু ধরা গলায় বললো,’ফুয়াদ তোমাকে আমার খুব ভালো লাগে, আমাকে একটু ভালোবাসা দিবে’?
সোনিয়ার আবেগ ফুয়াদকে আবেগতাড়িত করে ফেলেছে। ও কিছু বললো না। চুপ থাকলো।
সোনিয়া ফুয়াদের নীরবতাকে সম্মতি মনে করে ঠোঁট বাড়িয়ে দিলো।
ফুয়াদের চোখ বন্ধ হয়ে গেলো কিন্তু নিমিষেই দেখতে পেলো রাইসা আর রজনী বলছে, বাবা তুমি কোথায়?
ঝট করে বাস্তবতায় ফেরত আসলো সে, ঠোঁট সরিয়ে নিলো।
সোনিয়া, আমি এখন যাই, আমার বাচ্চারা আমার জন্য অপেক্ষা করছে। আমি তোমার সাথে পরে কথা বলবো।
লোকাল পাব, গ্রামের সবাই সবাইকে চেনে। ফুয়াদ ম্যানেজারকে ডেকে বললো – কেউ যেন একটু সোনিয়াকে বাসায় পৌঁছে দেয়।
গাড়িতে উঠে ফুয়াদ ঠিক করলো পুতুলের মুখোমুখী হবে সে, তার ভালোবাসা কিছুতেই মিথ্যে হতে পারেনা। তার ভালোবাসা, তার পরিবারকে ঠিক রাখার জন্য যা কিছু করবার দরকার সে করবে।