কাজি অফিসে অনেকক্ষণ যাবৎ পলাশ আর ফারিয়া বসে আছে। তাদের সামনে বসা কাজি সাহেব বেশ বিরক্তবোধ করলেও প্রকাশ করছেন না। তিনি এটা সেটা করে সময় পার করছেন। তার চোখে মুখে অসম্ভব বিরক্তি প্রকাশ পাচ্ছে।
অনেকক্ষণ পর আবার বিরক্তি চেপে কাজি সাহেব বললেন, স্বাক্ষী কই? তারা কি আসবে? আপনারা বরং আজকে বাড়ি চলে যান। স্বাক্ষী বোধহয় আসবে না।
পলাশ সে কথার উত্তর না দিয়ে শুকনো মুখে বলল,পানি খাবো।
কাজি সাহেব ইশারা দিলেন তার সহকারীকে। পানি চলে এলো। সে ঢকঢক করে পুরো গ্লাস শেষ করে মুখ মুছতে মুছতে মিনমিনে গলায় বলল, একটু অপেক্ষা করেন, এক্ষুনি এসে যাবে। বলেই সে পকেট থেকে মোবাইল বের করে এ নিয়ে তৃতীয়বার ফোন দিল।
স্বাক্ষী বলল, ভাই, রিকসায় দুই ঘন্টা যাবৎ বসে আছি। হেভি জ্যাম। রিকশা নট নড়নচড়ন! জ্যাম ছুটলেই পক্ষীরাজের মতো উড়ে আসবো ভাই।
ফারিয়া একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। পলাশ কোন কাজই গুছিয়ে করতে পারে না। পরিচিত দুই জনকে পাঁচশো টাকা দিয়ে এসেছে স্বাক্ষী হওয়ার জন্য। আসবে কিনা কে জানে। দুই ঘন্টা যাবৎ কেবলই বলে যাচ্ছে জ্যামে আঁটকা আছে। হয়তো বাসায় বসে আছে। কিংবা চায়ের দোকানে বসে আড্ডা দিচ্ছে।
পলাশ অতিরিক্ত ভালো মানুষ বলেই কেউ তাকে পাত্তা দিতে চায় না। অনেকে আড়ালে আবডালে তাকে নিয়ে হাসাহাসি করে। ফারিয়া জানে, পলাশ কতোটা বুদ্ধিমান। এজন্যই সে একতরফা প্রেমে পড়েছে। এই অগোছালো ছেলেটাকে কেন যে এতো ভালো লাগে কে জানে!
হয়তো প্রেম এমনই।
পলাশ মন খারাপ করে বসে আছে। বারবার রুমাল বের করে মুখ মোছার ব্যর্থ চেষ্টা করছে। ফারিয়ার দিকে তাকিয়ে একটা শুকনো হাসিও দিল। প্রতিত্তোরে ফারিয়াও হাসলো।
পলাশ মন খারাপ করে বসে আছে দেখে ফারিয়ার মনটাও ভীষণ খারাপ হয়ে গেল। ব্যাগ থেকে মোবাইল বের করে তার দূরসম্পর্কের এক দুলাভাইকে ফোন দিল। সে দশ মিনিটের মাথায় কাজি অফিসে এসে হাজির হল। ফারিয়া তাকে সবকিছু বুঝিয়ে বলতেই সে স্বাক্ষী হতে রাজি হয়ে গেল এবং বিয়ের আয়োজন করে ফেললো। এক লোকের মাধ্যমে মিষ্টির ব্যবস্থাও করে ফেললো ।
সেই স্বাক্ষী দু’জন আর আসে নাই।
পলাশের বেজায় মন খারাপ । সে কখনোই ভাবে নাই, এভাবে কাউকে না জানিয়ে ফারিয়াকে আজ বিয়ে করতে হবে।
গতকাল ফারিয়া যখন বলল, হয় আমাকে বিয়ে করবে, না হয় সারাজীবনের জন্য আমাকে হারাবে,তখন পলাশের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়েছিল। ফারিয়া আগেও বলেছিল, বাড়ি থেকে আমার বিয়ে কনফার্ম করে ফেলেছে। ছেলে আমেরিকা প্রবাসী। আগামী মাসে দেশে আসছে। একটা কিছু কর।
পলাশ অবাক হয়ে বলেছিল, কী করবো?
তার পক্ষে কিছু করা হয়ে উঠে নাই। বেকার মানুষদের কিছু করার ক্ষমতা আসলে থাকে না।
ফারিয়া সুন্দরী এবং বুদ্ধিমতী। একই এলাকার মেয়ে। পলাশ জানে, ফারিয়ার ব্যবসায়ী পরিবার কখনোই তার মতো একটা বেকার ছেলেকে জামাই হিসেবে মেনে নিবে না। তার লেখাপড়া শেষ হয়েছে দুই বছর আগে, এখনোও চাকরি জোগাড় করতে পারে নাই। আশা ছিল একটা চাকরি জোগাড় করতে পারলেই ফারিয়াকে ঘরে তোলা হবে। তিন বছরের গোপন প্রেমের ইতি টানা হবে। তা আর হল কই?
বলাবাহুল্য, তাদের গোপন প্রেমের খবর দুই পরিবার কেউ জানে না। তারা বাইরে খুব একটা দেখা সাক্ষাৎও করে না। কথা যা হয় ফোনে।
পলাশ ফারিয়ার আশা প্রায় ছেড়েই দিয়েছিল। অসম সম্পর্ক রেখে লাভ কী?
আজ হঠাৎ করে কোট ম্যারেজ করে কাজি অফিসের বাইরে এসে পলাশ ম্যান্দামারা অবস্থায় দাঁড়িয়ে রইল। ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তা তাকে পেয়ে বসলো। তাকে দেখে মনে হল,যেন তার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়েছে। নীল রংয়ের একটা পাঞ্জাবি পরেছে সে। চোখে চশমা। পাঞ্জাবিটা তাকে কী যে সুন্দর মানিয়েছে!
ফারিয়া মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল।
পলাশ এদিকওদিক উদ্ভ্রান্তের মতো তাকাচ্ছে। পরবর্তী করনীয় কী বুঝতে পারছে না। ফারিয়া হঠাৎ পলাশের হাত ধরে বলল,চল, আমরা কক্সবাজার পালিয়ে যাই। কিছুদিন ওখানে থাকলে মা বাবা একদিন ঠিকই মেনে নিবে।
পলাশকে এলাকায় সবাই মেধাবী এবং ভালো ছেলে হিসেবে চিনে। ফারিয়ার কথায় তার মন সায় দিল না। পালিয়ে গেলে যে তার পরিবার সমাজে ছোট হয়ে যাবে।
দাঁড়িয়ে আছে দেখে ফারিয়া পলাশের হাত ধরে বলল, কী হলো? এতো টেনশন করছো কেন? আমি আছি না! সব ম্যানেজ করে ফেলবো। কোন টেনশন করো না তো। চল কক্সবাজার থেকে ঘুরে আসি।
পলাশ ইতস্তত করে বলল,ফারিয়া আমার কাছে তো বেশি টাকা নাই। তাছাড়া কাজটা কী ঠিক হবে?
ফারিয়া বলল, ও নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। আমার কাছে টাকা আছে। চল গাড়ি স্টেশনে যাই।
পলাশ তারপরও দাঁড়িয়ে রইল।
ফারিয়া জানে, পলাশ কম কথা বলা ছেলে,যা করার তাকেই করতে হবে। সে পলাশকে টেনে হিঁচড়ে গাড়ি স্টেশনের দিকে নিয়ে যেতে চাইলো। কিছুক্ষণ চুপচাপ হেঁটে হঠাৎ দাঁড়িয়ে গিয়ে বলল,ফারিয়া, আমি তো জামাকাপড় আনি নাই।
ফারিয়া বলল, টেনশন করে লাভ নাই। আমি তোমাকে নতুন জামাকাপড় কিনে দিবো। এখন চল।
পলাশ তবুও এদিকওদিক উদ্ভ্রান্তের মতো থাকিয়ে থেকে স্বগতোক্তির মতো করে বলল, আমাদের বাসা আজকে খালি, বাবা মা চারদিন আগে খালার বাসায় বেড়াতে সিলেট গেছে। আজকে রাতের ট্রেনে ফিরবে। পিচ্চি ছোটবোনকেও সাথে নিয়ে গেছে। চল আমরা বাসায় গিয়ে ডিসিশন নেই কী করা যায়। বাসায় গিয়ে জামাকাপড়ও আনা যাবে।
ফারিয়া বিরক্ত গলায় বলল, এই কথা আগে বল নাই কেন?
পলাশ জবাব দিল না।
ফারিয়া একটা দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে রিকশা ডাকলো,পলাশ সুবোধ বালকের মতো ফারিয়ার সাথে রিকশায় উঠলো। ফারিয়া পলাশের একটা হাত নিজের হাতে টেনে নিল। মনে মনে বলল, আই লাভ ইউ পলাশ,আই লাভ ইউ। তুমি এতো ভালো কেন?
তার এতো ভালো লাগছে! ইচ্ছে করছে গান গাইতে। সে সত্যি সত্যি গুনগুন করে গান গাইতে লাগল,’আহা, আজি কী বসন্তে,,’
গান শুনে পলাশ মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল। বাতাসে ফারিয়ার মাথার চুল উড়ে এসে তার নাকেমুখে লাগছে। তার মনে হল, রিকসায় বসে আছে একটা ডানাকাটা পরী। যে পরীটা একটা সাদা সালোয়ার কামিজ পরে তার পাশে বসা। সে চোখ বন্ধ করে ফেললো।
পলাশের মুগ্ধতা দেখে ফারিয়ার মনে হল,আহা, জীবন কত সুন্দর! সে মনে মনে আবারও বলল, আই লাভ ইউ পলাশ,আই লাভ ইউ।
রিকশায় ফারিয়ার সাথে বসে পলাশ কোন উল্লাস দেখালো না। নতুন বউকে কাছে পেয়ে কোন অধিকার ফলাবারও চেষ্টা করলো না। সে শুধু মুগ্ধ হয়ে বউয়ের দিকে তাকিয়ে রইল আর বারবার চোখ থেকে চশমা খুলে পাঞ্জাবির হাতায় মুছতে লাগলো।
বাড়ির কাছাকাছি এসে ফারিয়া ওড়না দিয়ে মুখ ঢেকে ফেললো। রিকশা থেকে নেমে পলাশ বউকে নিয়ে বাসায় ঢুকলো। আশেপাশের দুই একজন দেখেও কোন প্রশ্ন করলো না। হয়তো ভেবেছে কোন আত্মীয় হবে। তাছাড়া তাদেরকে বাড়িটা নির্জনে। আশেপাশে তেমন লোকজন নাই।
খালি বাসায় এসে ফ্যান ছেড়ে দিয়ে বিছানার উপর বসে পড়লো। ফারিয়া কাছে এসে পলাশের কাঁধে মাথা রাখলো। মনে মনে বলল,আই লাভ ইউ। আই লাভ ইউ।
এভাবে অনেকক্ষণ চুপচাপ থাকার পর ফারিয়া বলল, পানি খাবো।
পলাশ ফ্রিজ খুলে ঠান্ডা পানি এনে দিল। ফারিয়া লক্ষ করলো, একা পেয়েও পলাশ তাকে জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করছে না। সে পলাশের গালে একটা চকাস করে চুমু মেরে বসলো। পলাশ তার দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে দিয়ে কাপড় গোছাতে শুরু করলো। ফারিয়া বলল, আজকে তোমার বাবা মা তো আসবে না,আসতে অনেক রাত হবে। তাহলে এতো তাড়াহুড়ো করছো কেন? বাড়িতে নতুন মেহমান এসেছে। তাকে কিছু খাওয়াতে হবে না?
পলাশ আবারও ফিক করে হেসে দিয়ে ফ্রিজ খুলে মিষ্টি নিয়ে এলো। সাথে বিস্কুট। ফারিয়ার মনে হল, দূনিয়ায় খুব কম ছেলেই পারে এমন মিষ্টি করে হাসতে। সে মুগ্ধ হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল,তারপর খাওয়ায় মন দিল।
পলাশ একটা লজ্জিত হাসি দিয়ে বলল,খাবার আর কিছু নাই। আমাকে হোটেল থেকে কিনে এনে খাবার খেতে হয়।
ফারিয়া বিস্কুট খেতে খেতে বলল, তোমাদের রান্নাঘরটা কোন দিকে?
পলাশ অবাক হয়ে বলল, রান্নাঘর দিয়ে কী হবে?
রান্না করবো। শ্বশুর বাড়িতে এসে রান্নাবান্না তো করতেই হবে। আজকে থেকেই শুরু করি। বলেই সে ওড়না কোমড়ে প্যাঁচিয়ে হাঁটা দিল। পলাশ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল।
কিছুক্ষণ পর রান্নাঘরে গিয়ে দেখে ফারিয়া সব আয়োজন করে চুলা ধরিয়ে ফেলেছে। ফ্রিজ থেকে মাংস নামিয়ে পানিতে ভিজিয়ে রেখেছে। তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম।
এই প্রথম সে বউকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো। ফারিয়া চোখ বুঝে তা উপভোগ করতে করতে মনে মনে বলল,আই লাভ ইউ।
পলাশ জড়িয়ে ধরে রেখেই বলল, আমার বউটাকে আজকে হেভি লাগছে।
থ্যাংক ইউ।
বাসায় যাবে না?
ফারিয়া অবাক হয়ে বলল,বাসায় যাব কেন? আমি কি বাসায় ফেরত যাবার জন্য এসেছি? আজকে আমি আমার জামাই বাড়িতে বেড়াবো। এখানেই বাসর করবো।
তোমার মা বাবা টেনশন করবে তো।
ফারিয়া আগুনের আচ কমাতে কমাতে বলল, করুক। ও নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। বাসায় বলে এসেছি, কলেজ থেকে বান্ধবীর বাসায় যাবো। ফিরতে দেরি হবে।
পলাশ আরও জোরে বউকে জড়িয়ে ধরে এই প্রথম চুমু খেল।
রান্না শেষ করে দুজনেই খেতে বসলো। ফারিয়ার রান্নার হাত অসাধারণ। পলাশ মনে মনে বউয়ের রান্নার প্রসংশা করলো।
খাওয়াদাওয়া শেষ করে দু’জন টিভিতে একটা মুভি দেখতে বসলো। ফারিয়া পলাশের কোলে মাথা রেখে অনেকক্ষণ শুয়ে রইল।
সন্ধ্যা হয়ে গেছে। হঠাৎ উঠে পলাশ ব্যাগ গোছাতে শুরু করলো। ফারিয়া নিজেও প্রস্তুতি নিতে লাগল। যে করেই হউক রাতের গাড়ি ধরতে হবে। রাতে মা বাবা ফিরবেন। তার বাড়িতে নিশ্চয় বেশি দেরি হলে টেনশন শুরু হবে। খোঁজাখুঁজি শুরু হবে। এজন্যই সে মোবাইল বন্ধ করে রেখেছে।
হঠাৎ কলিং বেল বেজে উঠল। পলাশ এবং ফারিয়া দু’জনেই চমকে উঠলো, এই সময় তো কারও আসার কথা নয়। তাহলে কে এলো?
ফারিয়া পাশের রুমে লুকালো। পলাশ দরজা খুলে দিল। সামনে দাঁড়িয়ে আছে বন্ধু জিসান। জিসানকে দেখে পলাশ খুবই অবাক হলো। সে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল,যেন সে পাথরের মূর্তি। কিছুক্ষণ পর সম্বিত ফিরে বলল,তুই?
ভিতরে আসতে দিবি না?
আয়।
জিসান এই বাসায় আগেও এসেছে। সে জানে,পলাশ কম কথার মানুষ, তাই অবাক হলো না। কোন এক বিচিত্র কারণে সে পলাশকে বেশ পছন্দ করে। বন্ধুদের মধ্যে ও বেশ মেধাবী, তারপরও সবাই ওকে নিয়ে মজা করে।
জিসান বসতে বসতে বলল, এদিক দিয়ে যাচ্ছিলাম, ভাবলাম তোর সাথে দেখা করে যাই। ভালো করি নাই?
পলাশ উদভ্রান্ত গলায় বলল, ভালো করেছিস।
আড্ডায় যাস না কেন? বন্ধুরা তোর কথা বলে,,,
পলাশ চোখের চশমা নাড়াচাড়া করতে করতে বলল, আমার এসব আড্ডা ফাড্ডা আসলে ভালো লাগে না।
পলাশ বসা থেকে সামনে ঝুঁকে এসে বসলো, তা তো লাগবেই না। তুই যে গুড বয়। আংকেল আন্টি কই রে! বাসায় কেউ নাই?
না। সিলেট বেড়াতে গেছে। আজকে রাতেই ফিরবে।
ও। তোকে এমন দেখাচ্ছে কেন? শরীর টরীর খারাপ না কী রে!
আরে না, শরীর ভালো আছে।
পানি দে তো খাই।
পলাশ ফ্রিজ খুলে ঠান্ডা পানির বোতল বের করে দিল। পানি খেতে খেতে দেখলো, অগোছালো কিছু জামা কাপড় খাটের ওপর পড়ে আছে। সে খুবই অবাক হলো। সে জানে, এগুলো পলাশের বোনের জামা কাপড় নয়। তার বোন ছোট।
সে সেদিকে ইঙ্গিত করে একটা টিপ্পনী কেটে বলল, মামা, ঘটনা কী? এসব জামা কাপড় কার? আমাদের না জানিয়ে বিয়ে করে ফেললা নাকি? নাকি ফাঁকা বাসা পেয়ে,,,
পলাশ মুখ ফসকে বলে ফেললো, জ্বি। বিয়ে করেছি। বলেই মনে হল, কথাটা বলা ঠিক হয় নাই।
জিসান লাফিয়ে উঠে বন্ধুকে জড়িয়ে ধরে বলল, কংগ্রাচুলেশনস মামা! আমাদের মধ্যে সবার আগে তুমি কাজটা করে ফেললা? আমাদের কাউকে না জানিয়ে? ভেড়ি ব্যাড মামা!
পলাশ কোন কথা বলল না। দাঁড়িয়েই রইল।
কবে করলা মামা?
আজকেই।
আমাদের কিন্তু পার্টি দিতে হবে। আর কিছু কর আর না কর,সব বন্ধুকে খাওয়াতে হবে। আগে তোমাকে নিয়ে একা মজা করতাম। এখন বউকে নিয়ে মজা করবো, ঠিকাছে?
পলাশ শুকনো গলায় বলল, ঠিক আছে।
কীভাবে এসব করলা, মামা? প্রেম করে?
হা
তলে তলে এতদূর! আমরা কিছুই জানলাম না! ভেড়ি ব্যাড মামা। আজকে তোমার ফুর্তি করার দিন। বাসর করবা না? ফুল কই?
পলাশ চুপ করে রইল।
হঠাৎ জিসান বলল,এই শালা মারবো একটা লাথি। আজকে একটা খুশির দিন। তুই এমন হ্যাবলাকান্ত হয়ে আছিস কেন? বউ ভাগায়ে বিয়ে করেছিস? মেয়ের বাসায় জানে?
পলাশ মিনমিনে গলায় বলল, মেয়ের বাসায় জানে না।
জিসান হাত তুবড়ি মেরে বলল, কুচ পরোয়া নাই। আমি আছি কী করতে! মেয়ের বাসার ঠিকানা দে। আমি সব ম্যানেজ করে দিচ্ছি। দেখি, কোন শালা তোকে কী বলে। সব ম্যানেজ হয়ে গেলে তোর বউকে একদিন আমি বাইকে নিয়ে সারা শহর ঘুরবো। তুই কিন্তু না করতে পারবি না শালা।
বলেই জিসান হাসতে লাগল। পলাশ তবুও মুখ কালো করে দাঁড়িয়ে রইল। সে জানে জিসান ডেয়ারিং, ফুর্তিবাজ ছেলে। সে যা বলে তাই করে। ওকে সবাই ভয় পায়, এমনকি বন্ধুরাও।
সোফা ছেড়ে উঠে হঠাৎ পলাশের মাথায় একটা চাটি মারলো জিসান, তারপর বিরক্ত গলায় বলল, এই শালা, তারখাম্বা হয়ে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? নতুন বউ দেখাবি না? শালা বেকুব কোথাকার!
আর কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে সে ভাবি ভাবি বলতে বলতে অন্য রুমে প্রবেশ করল, তারপর ফারিয়াকে দেখে সে সেখানেই নিস্তব্ধ দাঁড়িয়ে রইল। কেউ যেন হঠাৎ করে তার মুখের জবান বন্ধ করে দিয়েছে! সে শুধু অস্ফুট স্বরে একটা কথাই উচ্চারণ করতে পারলো, ফারিয়া তুই!
ফারিয়া কিছুক্ষণ জিসানের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর ভাইয়া বলে তার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়লো!
চলবে,,,,
#আই_লাভ_ইউ পর্ব ১
#আই_লাভ_ইউ
পর্ব ২
মধ্যরাতে পলাশের মা বাবা বাড়ি ফিরে এসে দেখেন, দরজা হাট করে খোলা, ছেলে অজ্ঞান হয়ে মেঝেতে পড়ে আছে। তার শরীর রক্তাক্ত। এই অবস্থা দেখে পলাশের মা মাথা ঘুরে পড়ে যান। মাথায় পানি ঢেলে জ্ঞান ফিরিয়ে আনা হয়।
এলাকাটা নির্জন, লোকজন কম। তারা ধরে নেন, বাসায় হয়তো ডাকাত পড়েছিল। তাদের কান্নাকাটি শুনে বাসায় লোকজন এসে জড়ো হয়। এম্বুলেন্স ফোন করে তৎক্ষনাৎ হাসপাতালের দিকে ছুটতে থাকেন তারা।
সবচেয়ে বেশি কান্না করে পলাশের ছোট বোন। তার এমন ভালো মানুষ ভাইকে কেউ মারতে পারে,বিশ্বাস হতে চায় না। হাসপাতালে গিয়েও সে আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে কাঁদতে থাকে।
ডাক্তার পরীক্ষা নিরীক্ষা করে জানান, মাথায় আঘাত পেয়েছে। মাথার পিছনে রক্ত জমাট হয়ে আছে। কখন জ্ঞান ফিরবে কিছুই বলা যায় না।
ডাক্তারের কথা শুনে পলাশের মা রাজিয়া বেগম নিজেও অসুস্থ হয়ে যান। পলাশের বাবা একমাত্র ছেলের করুন দশা দেখে নির্বাক হয়ে বসে থাকেন। বোন হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে।
এদিকে জিসান বোনকে নিয়ে বাড়ি এসে মা বাবাকে কিছুই বলে নাই।
জিসানের কন্ঠ শুনেই ফারিয়া বুঝেছিল, কিছু একটা হতে চলেছে। জিসান যখন পলাশকে মারছিল, ফারিয়া আপ্রাণ চেষ্টা করে ভাইকে থামাতে। কোন লাভ হয় নাই। জিসান যখন কিল ঘুষি মারতে থাকে, পলাশ কোন প্রতিবাদ করে নাই, ঠায় দাঁড়িয়েছিল। হঠাৎ জোরে ধাক্কা খেয়ে পলাশ পড়ে গিয়ে সোফার হাতায় আঘাত পায়। সোফাতে মাথা গিয়ে লাগে। এতে পলাশ অজ্ঞান হয়ে যায় এবং মাথা কেটে রক্ত বের হতে থাকে। রক্ত দেখে ফারিয়া নিজেও অজ্ঞান হয়ে যায়। জিসান নাকেমুখে পানি দিয়ে বোনের জ্ঞান ফিরিয়ে আনে।
অসুস্থ বোনকে কোলে নিয়ে জিসান রিকশায় উঠে। কিছুক্ষণ রিকশা চলার পরই ফারিয়া স্বাভাবিক হয়ে আসে। সে একবার তাকিয়ে ভাইকে দেখে,তারপর চোখ বুঝে ফেলে। সারা রাস্তা সে একটা কথাও বলে নাই। শুধু ভাইয়ের কাঁধে মাথা রেখে সময় পার করে।
বাড়ির সামনে এসে ফারিয়া স্বাভাবিক ভাবেই রিকশা থেকে নামে। যেন কিছুই হয় নাই এমন ভাব করে সে নিজের রুমে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দেয়। তারপর হু হু করে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে।
রাতে মা বাবা এসে দরজা ধাক্কাধাক্কি করে খাবার খাওয়ার জন্য। ফারিয়া স্বাভাবিক ভাবেই জানিয়ে দেয়, তার খুব মাথা ধরেছে এবং সে রাতে কিছুই খাবে না। তাকে যেন বিরক্ত করা না হয়।
রাতে কয়েকবার পলাশের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করে। মোবাইল বন্ধ পাওয়া যায়।
পরদিন সকালে অনেক বেলা করে ঘুম থেকে উঠে ফারিয়া। এরমধ্যে মা বাবা কয়েকবার দরজা ধাক্কাধাক্কি করে গেছেন। সে দরজা খুলে নাই।
খুব স্বাভাবিক ভাবেই নাস্তার টেবিলে বসে সে। জিসানও নাস্তা খাচ্ছে আর আড়চোখে বোনের দিকে তাকাচ্ছে। একবার বোনের সাথে চোখাচোখি হতেই চোখ সরিয়ে নিল সে। তারপর যেন কিছুই হয় নাই এমন ভাব নিয়ে খানা খেতে লাগল।
মা মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, কী রে! তোর চোখমুখ এতো ফোলা ফোলা লাগছে কেন? রাতে ঘুম হয় নাই?
ফারিয়া জবাব দিল না।
বাবা বললেন, কী হয়েছে, মা? তোমার কী শরীর খারাপ? তোমাকে এমন লাগছে কেন?
ফারিয়া বলল, আমি ঠিক আছি, বাবা। টেনশন করার কিছু নাই।
অবশ্যই তুমি ঠিক নাই। তোমাকে বেশ অসুস্থ দেখাচ্ছে। আমি কি একজন ডক্টরকে কল করবো?
আমার কিছু হয় নাই, বাবা। টেনশন নিও না। তুমি খাওয়াদাওয়া করে অফিসে যাও তো।
ঠিক আছে মা। তবে এই শরীর নিয়ে আজকে তুমি কলেজে যেও না। ঠিক আছে?
ওকে বাবা। কলেজে যাব না। বলেই সে নাস্তা খেতে শুরু করলো। জিসান আড়চোখে বোনের দিকে তাকিয়ে উঠে গেল। ফারিয়ার মা নাস্তা খাওয়া ফেলে মেয়ের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। তিনি বুঝতে পারছেন মেয়ের কিছু একটা হয়েছে। তবে এই মেয়ের মুখ থেকে সহজে কথা বের করতে পারবেন বলে মনে হয় না।
তিনি একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে খাওয়ায় মন দিলেন। তার মনে কু ডাকতে লাগল।
নাস্তা শেষ করে ফারিয়া নিজের রুমে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিল। তার অনেক কথা মনে হতে লাগল। তারা একবার উত্তরা দিয়াবাড়ি বেড়াতে গিয়েছিল। পলাশ তার হাত ধরতে লজ্জা পাচ্ছিল। ফারিয়া নিজে পলাশের হাত মুঠোয় নিয়ে পাশাপাশি হাঁটতে লাগল। পলাশ একটা কাশ ফুল ছিড়ে ফারিয়ার খোঁপায় পরিয়ে দিয়েছিল। ফারিয়া মনে মনে বলেছিল, আই লাভ ইউ, পলাশ!
সম্বিত ফিরে মোবাইল বের করে পলাশের নাম্বারে ফোন দিল। ফোন ধরলেন রাজিয়া বেগম ।
ফারিয়া বলল, হ্যালো, হ্যালো। পলাশ আছে? ওকে একটু দেওয়া যায়?
রাজিয়া বেগম কাঁদতে কাঁদতে বললেন, তুমি কে গো মা?
আন্টি, আমি পলাশের বন্ধু। ওকে একটু দিন না,প্লিজ।
পলাশের মা ডুকরে কেঁদে উঠে বললেন, মা গো,গতকাল রাতে ডাকাত এসে আমার নিরীহ ছেলেটাকে খুব মেরেছে। কাল থেকে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে, এখনো জ্ঞান ফিরে আসে নাই। আমার এতো ভালো একটা ছেলে। ওর জন্য একটু দোয়া কইরো মা।
ফারিয়া কান্না চেপে রেখে বলল, আন্টি কোন হাসপাতালে আছে, ঠিকানাটা দিবেন, প্লিজ।
পলাশের মা কাঁদতে কাঁদতে ঠিকানা জানিয়ে দিল।
মোবাইল রেখে দিয়ে দুই হাতে মুখ চেপে ধরল ফারিয়া। বুক ফেটে কান্না আসতে চাইলো। সে কান্না আটকে রাখার ব্যর্থ চেষ্টা করল। না পেরে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল।
কিছুক্ষণ কেঁদে হঠাৎ উঠে দাঁড়ালো সে। বাথরুমে গিয়ে মুখ ধুয়ে এসে জামা পাল্টালো,তারপর হ্যান্ডব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে রুম থেকে বের হয়ে এলো। ড্রয়িংরুমে মা বসা ছিলেন। তিনি বললেন, কোথায় যাচ্ছো? তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেন?
ফারিয়া চোখ মুছে বলল, আমার একটু কাজ আছে মা। ফিরতে দেরি হবে। বলেই হনহন করে বেরিয়ে গেল।
মা বুঝলেন মেয়ের একটা কিছু হয়েছে। তিনি দৌড়ে গিয়ে জিসানের রুমে ডুকে তাকে ঘটনা বললেন।
বাইরে বের হয়ে ফারিয়া যখন সিএনজিতে উঠেছে, জিসান দৌড়ে এসে সিএনজি আটকালো। পিছনে দৌড়ে এল তার মা।
জিসান বলল,কোথায় যাচ্ছো ফারিয়া?
ফারিয়া কঠিন গলায় বলল, হাসপাতালে।
হাসপাতালে যাচ্ছো কেন?
কেন যাচ্ছি সেটা তুমি ভালো করেই জানো,ভাইয়া। এই সিএনজি চল।
জিসান দুই হাতে সিএনজি ধরে রেখে বলল,না, তুমি এখন কোথাও যাবে না।
তুমি আমাকে আজ আর আঁটকে রাখতে পারবে না, ভাইয়া। অনেক করেছো,আর নয়। তুমি আমার কলিজা টুকরো টুকরো করে ফেলেছো। আমাকে তুমি জিন্দা লাশ বানাতে চাও? যদি বোনের সুখ চাও,সামনে থেকে সরে দাঁড়াও।
তুমি ভুল করছো, ফারিয়া। মহা ভুল। তুমি কে আর পলাশ কে? ও একটা রাস্তার ছেলে,,,,
ফারিয়া চিৎকার করে বলল,জাস্ট শাটআপ ভাইয়া। শাটআপ। তুমি আর একটা কথাও বলবে না। যদি আর একটা কথাও বল, আমি পুলিশ ডেকে তোমাকে ধরিয়ে দেবো। তুমি আমার শান্ত রুপ দেখেছো, কঠিন রুপ দেখো নাই।
জিসান স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
পিছনে মা ছেলেমেয়ের আচরণ দেখে হতবিহ্বল হয়ে কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলেন, তারপর ডুকরে কেঁদে উঠলেন।
ফারিয়া চলে যাওয়ার পর জিসান মায়ের কাছে চলে এলো। মা কাঁদতে কাঁদতে বললেন, জিসান বাবা, সত্যি করে বল তো , ফারিয়ার কী হয়েছে? ও এমন করে কথা বলছে কেন? তোকে কেন পুলিশের ভয় দেখাচ্ছে?
জিসান কাটানোর উদ্দেশ্যে বলল, মা, তেমন কিছু হয় নাই। দেখ সব ঠিক হয়ে যাবে। ফারিয়ার শরীরটা বোধহয় ভালো নাই, মা।
আমাকে সত্যি কথা বল জিসান, ফারিয়ার কী হয়েছে? ও এমন করছে কেন?
জিসান বাধ্য হয়ে মাকে সব কথা বলতে লাগলো। জিসানের বাবা অফিসে যাওয়ার জন্য বের হচ্ছিলেন,তিনি পিছনে দাঁড়িয়ে সবকিছুই শুনলেন।
কথা শেষ হতেই জিসান দেখলো, মা আঁচল চাপা দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বসে পড়লেন। বাবা পকেট থেকে মোবাইল বের করে কাকে কাকে যেন ফোন করতে লাগলেন!
চলবে,,,,,,
#আই_লাভ_ইউ
শেষ পর্ব।
জিসান রুমে ঢুকে পায়চারী করতে লাগলো। কী থেকে কী হয়ে গেল। পলাশকে তো সে নিজেও পছন্দ করে। চমৎকার ভালো একটা ছেলে। কিন্তু ফারিয়াকে ওর বাসায় দেখে মাথায় রক্ত উঠে গিয়েছিল। কোথায় পলাশ আর কোথায় ফারিয়া। আকাশ পাতাল পার্থক্য। আকাশ কি কখনো পাতালের সাথে মিশতে পারে? ধনী এবং গরীবের ব্যবধান চিরদিনই থাকবে। এই ব্যবধান ভেঙে ফেলা সহজ নয়।
ফারিয়া মাসে মাসে যে টাকা খরচ করে, পলাশের সামর্থ্য নাই তা বহন করা। জিসান ভালো করে জানে, টাকা ছাড়া জীবন অচল। যে ঘরে টাকা থাকে না, সে ঘরে সুখ, ভালবাসা কিছুই থাকে না। টাকা সুখ টাকা-ই শান্তি।
সে বুঝতে পারে, পলাশকে এভাবে মারা তার উচিত হয় নাই। শত হলেও সে তার বন্ধু। ভালবেসে পলাশ ভুল করেছে,তার বোনও কি একই ভুল করে নাই? কই, বোনের গায়ে তো হাত তুলতে পারে নাই।
জিসান ঝিম মেরে কিছুক্ষণ বসে রইল। তারমধ্যে অপরাধবোধ কাজ করতে লাগলো। ফারিয়ার আচরণ দেখেই বুঝা যায়, পলাশকে অসম্ভব ভালোবাসে সে। বিয়ে যদি করে থাকে, ফারিয়ার আগ্রহের কারনেই হয়েছে। পলাশের এতো সাহস হবে না। যা ভীতু ছেলে! কিন্তু এই সম্পর্ক কি মেনে নেওয়া সম্ভব? কখনোই না।
সে মোবাইল বের করে তার বন্ধুদের ফোন করতে লাগলো। পলাশ কোন হাসপাতালে আছে জানা দরকার।
সারা রাতেও জ্ঞান ফিরে নাই পলাশের। সকালে বড় ডাক্তার পরীক্ষা নিরীক্ষা করে বলেছেন, মাথায় আঘাত পেয়েছে। সামান্য কেটেছে, তবে এক জায়গায় রক্ত জমাট হয়ে আছে। ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে । দুই তিন ঘন্টা পরই জ্ঞান ফিরে পাবে।
ফারিয়া ফোন করার কিছুক্ষণ পরই পলাশের জ্ঞান ফিরে আসে। রাজিয়া বেগম চিৎকার করে আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া আদায় করে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। পলাশের বাবা ফরিদ সাহেব দৌড়ে গিয়ে ডাক্তার ডেকে নিয়ে আসেন। ডাক্তার কতগুলো টেস্ট দেন, সেগুলো তক্ষুনি করে নিয়ে আসতে হবে। ফরিদ সাহেব ছুটে যান টেস্ট করানোর জন্য । রাজিয়া বেগম ছেলের মাথায় হাত বুলাতে থাকেন। পলাশের ছোট বোনটা বাইরে চেয়ারে বসেই ঘুমিয়ে পড়ে। সারারাত ভাইয়ের চিন্তায় অস্থির ছিল সে।
সিএনজি থেকে নেমে রিসেপশনিস্ট মেয়েটার সাথে কথা বলে ফারিয়া। রোগীর তালিকা দেখে পলাশের রুম নাম্বার শনাক্ত করে। তিনতলা। রুম নং ৭৬। লিফটে না গিয়ে সিঁড়ি বেয়ে দৌড়ে সে তিনতলায় উঠে যায়।
৭৬ নং রুমের দরজার সামনে ছোট একটা মেয়ে চেয়ারে মাথা হেলান দিয়ে আছে। মাথার চুল, কাপড়চোপড় এলোমেলো। ফারিয়া সেখানে গিয়ে দাঁড়াতেই মেয়েটা চোখ মেলে চাইলো। ফারিয়া বলল, তুমি কি পলাশের বোন?
মেয়েটা হা সূচক মাথা নাড়লো।
ফারিয়া বলল, পলাশ কোথায়?
মেয়েটা ভিতরে ইঙ্গিত করলো।
ফারিয়া রুমে প্রবেশ করল।
ছেলের মাথায় হাত বুলাচ্ছেন রাজিয়া বেগম। দরজায় খুট করে একটা আওয়াজ হয়। তিনি ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে দেখেন, অপরুপ সুন্দর একটা মেয়ে দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছে। তিনি জিগ্যেসু দৃষ্টিতে তাকাতেই মেয়েটা বলল, আন্টি, আমার নাম ফারিয়া। পলাশকে দেখতে এসেছি। কেমন আছে ও?
রাজিয়া বেগম কোন কথা না বলে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে ফারিয়াকে জায়গা করে দেন। ফারিয়া সামনে উঁকি দিয়ে দেখে,পলাশ চোখ বুঝে আছে। চোখদুটো পানিতে চিকচিক করছে। এই অবস্থায়ও ওকে কী যে সুন্দর লাগছে! ফারিয়া মনে মনে বলল, আই লাভ ইউ, পলাশ। আউ লাভ ইউ।
রাজিয়া বেগম ছেলেকে ডাক দিলেন, পলাশ, এই পলাশ, দেখ তোকে কে দেখতে এসেছে।
মায়ের ডাক শুনে পলাশ চোখ মেলে চাইলো। অবাক হয়ে ফারিয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। তার চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়তে লাগলো। এভাবে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে চোখ বন্ধ করে ফেললো। কান্না চলে আসছিল, অনেক কষ্টে ঠোঁট দিয়ে কান্না আটকালো ফারিয়া। রাজিয়া বেগমের দিকে তাকিয়ে বলল, আন্টি,আমি কি ওর সাথে একটু আলাদা কথা বলতে পারি?
রাজিয়া বেগম চোখ মুছতে মুছতে চলে যাওয়ার আগে বললেন, মা গো, আমার এতো ভালো ছেলেটাকে যারা মেরেছে, আল্লাহ যেন তার বিচার করেন।
রাজিয়া বেগম চলে যেতেই ফারিয়া চেয়ার টেনে বসলো, তারপর পলাশের একটা হাত নিজের মুঠোয় নিয়ে নিল। তাদের প্রেমের সম্পর্ক তিন বছর। এই তিন বছরে সে বেশি পলাশের হাত ধরতে পারে নাই। তাদের মধ্যে মাত্র হাতে গোনা কয়েকবার দেখা হয়েছে, কিছু সময়ের জন্য। মনে পড়লো তারা একবার নৌকায় করে বুড়িগঙ্গা বেড়াতে গিয়েছিল। ফারিয়ার আগ্রহেই যাওয়া হয়েছিল। পানি দেখে পলাশ খুব ভয় পাচ্ছিল। ফারিয়া পলাশের হাত নিজের মুঠোয় ধরে রেখেছিল, তবুও তার ভয় কাটছিল না। সেদিন পলাশ ধবধবে একটা সাদা পাঞ্জাবি পরেছে। তাকে কী যে সুন্দর লাগছিলো! ছেলেটা যা পরে তাতেই মানিয়ে যায়।
সেসব দিনের কথা মনে হতেই তার চোখ বেয়ে টপটপ করে পানি পড়তে লাগলো। সে স্বগতোক্তির মতো করে বলল, আই লাভ ইউ পলাশ, আই লাভ ইউ!
সে হাত ধরে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইল,তারপর আবারও কান্নাজড়িত কন্ঠে স্বগতোক্তির মতো করে বলল, আমি এসেছি পলাশ। আমি তোমার পাশে আছি। আর কোন ভয় নাই। তোমাকে ছেড়ে আমি আর কোথাও যাবো না। কক্ষনো না! কেউ আমাকে আর আটকাতে পারবে না। কেউ না!
ফারিয়ার কথা কানে যেতেই পলাশ চোখ মেলে চাইলো। কিছুক্ষণ অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল, জোর করে হাসার চেষ্টা করলো। তারপর ফারিয়ার হাত নিয়ে তার বুকের উপর রাখলো।
ফারিয়া এই অবস্থায় হু হু করে কাঁদলো, তারপর চিৎকার করে বলল, আমি তোমাকে খুব ভালবাসি। আই লাভ ইউ।
ফারিয়ার চিৎকারে যেন পুরো হাসপাতাল কেঁপে উঠলো।
রাজিয়া বেগম চিৎকার শুনে দৌড়ে রুমে প্রবেশ করলেন। তারপর দু’জনকে হাত ধরাধরি অবস্থায় দেখে স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। ফরিদ সাহেবও রুমে প্রবেশ করলেন। তিনিও স্ত্রীর মতো ঠায় দাঁড়িয়ে রইলেন।
কই? আমার মেয়ে কই? বলতে বলতে ফারিয়ার বাবা রুমে ঢুকলেন। পিছনে ফারিয়ার মা।
মা বাবাকে দেখে ফারিয়া অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল।
ফারিয়ার মা বাবাকে দেখে পলাশ মাথা তুলে উঠতে চাইলো। ফারিয়া ইশারায় উঠতে মানা করলো।
সে সময় প্রবেশ করলো ডাক্তার। ফারিয়ার বাবাকে দেখে বলল, আর দোস্ত! তুমি এখানে?
ফারিয়ার বাবা ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে বললেন, দোস্ত , এই ছেলেটা আমার একমাত্র মেয়ের জামাই। ওকে তুমি তাড়াতাড়ি সুস্থ করে তোল। যত টাকা লাগে আমি দিবো। যদি তাড়াতাড়ি সুস্থ করতে না পারো, তোমাকে আমি গুলি করে মারবো। বলেই হা হা করতে হাসতে লাগলেন। সে হাসিতে ডাক্তারও যোগ দিলেন।
ফারিয়া ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে প্রথমে অবাক, তারপর হতবিহ্বল হয়ে বাবার দিকে চেয়ে রইল। এরপর অশ্রু সজল চোখে দৌড়ে গিয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো।।
#হানিফ_ওয়াহিদ