বৃষ্টিময় প্রেম পর্ব ৭৩
লেখনীতে- তাসফিয়া হাসান তুরফা
হৈহৈ কলরবে মুখোরিত বিয়েবাড়ি। অবশেষে আজ বিয়ের অনুষ্ঠান তথা রিসেপশন। এদিক ওদিক চেয়ে দ্রুতকদমে হেটে চলেছে প্রিয়া, লেহেঙ্গার ওড়না মাটি ঘেঁষে ছুটে চলছে তার সাথে। একহাতে লেহেনঙ্গার প্রান্ত উঁচু করে ধরেছে, অপরহাতে এক আত্মীয়ের দেওয়া গিফটের বক্স রাখতে যাচ্ছে সে। রাইসা অন্তঃসত্ত্বা হওয়ায় প্রান্ত ওর সাথেই ব্যস্ত, ওরা দুজন মিলে টুকটাক কাজ সামলাচ্ছে। এদিকে ব্যস্ত সময় কাটছে প্রিয়ারও! তাড়াহুড়োয় লেহেঙ্গার আচল পায়ের নিচে পড়তে ধরতেই হুড়মুড়িয়ে পড়তে ধরলো সে। টাল সামলাতে ব্যর্থ হতেই একপ্রকার দৌড়ে এসে হাত ধরে তাকে পড়ে যাওয়া থেকে বাচালো রায়হান। অতঃপর প্রিয়া সোজা হয়ে দাঁড়াতেই তাকে গভীর দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করে নিলো সে। পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে কপাল হতে সরে যাওয়া টিকলিটা ঠিকভাবে বসিয়ে দিলো সিথির মধ্যিখানে! এরপর প্রিয়ার হাত থেকে বড়সড় সেই গিফটের বক্সটা নিয়ে তার সাথে চলতে ইশারা করতেই বাধ্য মেয়ের ন্যায় মুগ্ধ চোখে তার সাথে চলতে লাগলো প্রিয়া। বলতে গেলে আজকাল রায়হানের এসব ছোটছোট কেয়ারের প্রেমে পড়ে সে! এখনো স্পষ্টভাবে মুখে “ভালোবাসি” না বলা হলেও সে হরহামেশাই কাজের মাধ্যমে প্রমাণ দিয়ে যাচ্ছে নিজের ভালোবাসার৷ এমন পুরুষদের বেশ পছন্দ করে প্রিয়া, ঠিক যেমন তার ভাই। ব্যাপারটা ভালো লাগলেও তার থেকে খোলাখুলি ভালোবাসার কথা শুনার অদম্য ইচ্ছা জাগে মনে৷ ওর এসব ভাবনার মাঝেই রায়হান বলে উঠলো,
—ওভাবে হাটছিলে কেন? দেখেশুনে থাকবেনা? আমি যদি তখন না দেখতাম তবে তো ঠিকি এতক্ষণে সবার সামনে ইজ্জতের ফালুদা হয়ে যেতো তোমার।
—আমি কি ইচ্ছে করে পড়েছি বলুন? একহাতে এই বড়সড় গিফট, আরেকহাতে লেহেঙ্গা ধরে রাখা! আপনি কি বুঝবেন সেটা?
—যেটা পড়ে হ্যান্ডেল করতে পারোনা সেটা পড়তে গেলেই বা কেন? আশেপাশে কত মেয়ে শাড়ি, লেহেঙ্গা পড়ে আছে৷ অন্য কাউকে তো পড়তে দেখলাম না?
খোচামার্কা কথাটা শুনে অন্যদিক তাকিয়ে মুখ ভেংচি দিলো প্রিয়া। আড়চোখে একবার সেদিকে তাকিয়ে হালকা হেসে ফেললো রায়হান। সে জ্বালাময়ী হাসি দেখে খানিকটা ক্ষিপ্ত হলো প্রিয়া৷ রায়হান হাত থেকে গিফট বক্স টেবিলে রাখতেই সে চোখ বাকিয়ে আশেপাশে তাকিয়ে কণ্ঠে মেকি উৎসাহ ঢেলে বললো,
—আশেপাশে বেশ সুন্দর সুন্দর ছেলে দেখছি! দেখি তো কারও সাথে কথাবার্তা বলা যায় নাকি? আর কতদিন সিংগেল থাকবো!
কথাটা বলতে দেরি ওর হাত ধরতে দেরি হলোনা রায়হানের। আশেপাশে একবার দেখে তীক্ষ্ম চোখে প্রিয়ার তাকিয়ে বললো,
—খুব শখ না কথা বলার? আমিও দেখছি তুমি কিভাবে যাও!
রায়হানকে জ্বা/লানোর উদ্দেশ্য সফল হওয়ায় অগোচরে ঠোঁট টিপে মৃদু হাসলো। এরপর স্বাভাবিক কণ্ঠে বললো,
—হাত ছাড়ুন! কেউ দেখলে ভাববে কি?
তৎক্ষণাত হাত ছাড়লোনা রায়হান। খানিকটা সময় নিয়ে আস্তেধীরে হাত ছেড়ে দিয়ে সরাসরি প্রিয়ার চোখের দিক চেয়ে নিচু স্বরে বললো,
—আমার হবু বউয়ের হাত আমি ধরবো না তো কে ধরবে? যার যা মনে করার করুক!
হঠাৎ করেই ঠোঁটের হাসি থেমে গেলো প্রিয়ার, চমকে উঠলো ভীষণভাবে! কস্মিনকালেও সে ভাবেনি রায়হান এ সময় আচমকা এমন কথা বলবে! বিস্ময় গিলে স্বাভাবিক হয়ে কিছুক্ষণ পর তাচ্ছিল্যের স্বরে বললো,
—কিসের হবু বউ? বাসায় কেউ জানে আমাদের কথা? কেউ যেখানে জানেই না, কেউ রাজি-ই না সেখানে আমাদের বিয়ের কথা আসছে কিভাবে?
ওর অভিমানি কথায় আরেকদফা হাসি পেলো রায়হানের। মেয়েটা এখনো জানেনা যে ইতোমধ্যেই বাসায় দুজনের বিয়ের ব্যাপারে কথা বলে রেখেছে রায়হান। সবাইকে রাজি করানোর কাজটা অবশ্য পূর্ণ-ই করেছে। কিন্তু প্রিয়ার এইচএসসি শেষ হওয়ার আগে ওকে জানানো হবেনা এ শর্ত দিয়েছিলো, যা নির্দ্বিধায় মেনে নিয়েছে রায়হান। তবুও আজ মুখ ফসকে বিষয়টা বলে দিয়েছে। তাই নিজেকে সামলে নিয়ে পুনরায় বললো,
—খুব তাড়াতাড়িই আমাদের বিয়েটাও হয়ে যাবে। সবাই রাজি হবে, তুমি এটার টেনশন করোনা! তুমি শুধু নিজের পরীক্ষার টেনশন করো। রেজাল্ট খারাপ হলে কিন্তু তোমার ভাই বিয়ে দিবেনা।
পূর্ণর কথা শুনে খানিকটা ভয় পেলো প্রিয়া। তার ভাই পড়ালেখা নিয়ে কেমন সিরিয়াস সেটা বিগত কয়দিনে বেশ ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছে সে। কথাটা ভাবতেই চোখমুখ কুচকে মাথা নেড়ে একটি দীর্ঘশ্বাস ফেললো সে। অতঃপর হেটে গেলো রায়হানের সাথে স্টেজে বসা বর-কনের দিকে। এতক্ষণ হাসিখুশি থাকলেও হঠাৎ স্টেজে বসে থাকা দম্পতির দিক তাকাতেই কিছুক্ষণের জন্য থমকে গেলো রায়হান। বুকের পাশে ইষৎ চিনচিনে ব্যাথা হচ্ছে। সবসময় ভালো থাকলেও মাঝেমধ্যেই হঠাৎ পুরনো অনুভূতি মনের মধ্যে নাড়া দিয়ে উঠে মনে। কিছু জিনিস জীবন থেকে চলে যেয়েও ফিরে আসে, হয়তো ভালোবাসাও তেমনি কিছু। নিজের অনুভুতি আড়াল করে, মুখের হাসি ফিরিয়ে এনে সকলের অগোচরে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো রায়হান। ভালো থাকুক ভালোবাসা অন্য কারও ভালোবাসায়।
_____________________
বর-বউ সাজে বসা আমি ও পূর্ণ। লাল ভারী লেহেঙ্গায় হালকা সাজে বসে থাকা আমি একটু পর পর আশেপাশে তাকাচ্ছি। পূর্ণ আজ বেশ চুপ, যদিও অন্যদিনেও চুপচাপ থাকেন তবুও আজকে তুলনামূলক একটু বেশিই চুপচাপ আছেন। একটু পর পর বাম হাতে ধরে রাখা টিস্যু দিয়ে কপালে জমে থাকা বিন্দু বিন্দু ঘাম মুচছেন, ছবি তুলতে আসা মানুষদের সাথে কথা বলছেন। আবার তার কলিগদের মধ্যে যাদের ইনভাইট করা হয়েছে তাদের সাথে আমার পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন। এছাড়া বেশ শান্তভাবেই বসে আছেন। আমার সাথে স্বাভাবিকভাবে তেমন একটা কথা বলেননি, শক্তকরে নিজহাতে আমার হাত ধরে আছেন শুধু। বারকয়েক হাত সরাতে চেয়েও তার হাত থেকে হাত সরাতে পারিনি আমি। তাই কিছুটা বিস্ময় নিয়েই আড়চোখে তাকালাম মেরুন রঙা শেরওয়ানি পড়া এই সুশ্রী মানবের দিকে! আমার চাহনি অনুভব করেই তিনি পাশ ফিরলেন, চোখজোড়া মিলিত হতেই কিছু বলার জন্য মুখ খুলবো এমন সময় ক্যামেরাম্যান এর আওয়াজ কানে এলো,
—স্যার, ম্যাম ওভাবেই তাকিয়ে থাকেন। একটা ছবি নিবো, নড়বেন না।
ফ্ল্যাশলাইট জ্বলে উঠলো, বেশ খানিকটা ছবি তুলা হলো। একে একে বড়াম্মু, বড়াব্বু সহ আমাদের ফুল ফ্যামিলি এলো। তাদের সাথে ছবি তুলার পর রাইসার মা-বাবাও এলো। এরপর আমাদের কাজিনদের সাথেও বেশ কিছু ছবি তোলা ও খুনসুটি হলো। সব মিলিয়ে বেশ কিছু স্মৃতি, খাওয়াদাওয়া এবং একরাশ ব্যস্ততার মধ্য দিয়ে আমাদের বিয়ের অনুষ্ঠান শেষ হলো।
বিদায়ের ঘণ্টা আরেকবার বাজলো। গতবার কাদলেও এবার হাসিমুখে বিদায় নিলাম আন্টির থেকে, আমার আসল পরিবারের কাছে, আমার আসল ঠিকানার কাছে। যাওয়ার আগে পূর্ণর গালে হাত রেখে আন্টি হাসিমুখে বললেন,
—গতবার তোমায় উপদেশ দিয়েছিলাম ওর যত্ন নেওয়ার কিন্তু এখন আমি জানি আমি না বললেও তুমি সারাজীবন আমার মেয়েটার খেয়াল রাখবে। তোমার হাতে ওকে তুলে দিয়ে আমি নিশ্চিত। আজীবন খুশি থেকো, বাবা। আল্লাহ তোমাদের দুজনকে একসাথে বহুযুগ বেঁচে থাকার তৌফিক দিক।
অতঃপর আমার দিক চেয়ে বললেন,
—সুখে-দুঃখে সবসময় একে-অপরের পাশে থাকবি। ওর ভালোবাসাকে মূল্য দিবি, নিজেও ভালোবাসবি। আমি জানি তোদের সংসার সুখের হবে।
আন্টির কথায় মাথা নেড়ে সকলের থেকে বিদায় নিয়ে উঠে পড়লাম ফুলে সাজানো গাড়িতে। গাড়িতে উঠে পূর্ণ একটা কথাই বললেন,
—চলো বউ, আমাদের বিবাহিত জীবনে আরও একবার তোমায় স্বাগতম।
____________________
ধুকপুক করতে থাকা হৃদয়ে ফুলসজ্জিত বাসরঘরে বসে আছি। বাইরে কাজিনদের চিল্লাচিল্লি শুনা যাচ্ছে, তার মানে পূর্ণ এসেছেন। উনাকে ভেতরে আসতে দেওয়া না দেওয়া নিয়েই দাম কষাকষি চলছে। শেষমেশ উনি বিরক্ত হয়ে প্রিয়ার হাতে কার্ড তুলে দিতেই শান্ত হয়ে গেলো সবাই। বিস্ময়ে, খুশিতে গদগদ হয়ে অভীভূত গলায় প্রিয়া বলে উঠলো,
—ওয়াও! তুমি সত্যিই নিজের কার্ড দিয়েছো? আই কান্ট বিলিভ দিস। তুমি বেস্ট, বড় ভাইয়া। সবাই জায়গা ছাড়, রুমে যেতে দে ভাইকে।
উনি রুমে ঢুকে দরজা লাগাতে লাগাতেই বলে উঠলেন,
—লিমিট সেট করা আছে, তোরা ততটুকুই খরচ করতে পারবি যতটুক আমি চাই।
কথাটি বলেই ঠাশ করে দরজা লাগিয়ে দিলেন উনি, দরজার পেছনে চাপা পড়ে গেলো সকলের আক্ষেপভরা চিৎকার!
দরজা লক করে পেছন ফিরে গলা ঝেড়ে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন। আমি তাকাতেই প্রগাঢ় চাহনি দিয়ে এগিয়ে আসতে লাগলেন খাটের দিকে। যদিও তিনি, এই রুম উভয়ই আমার খুব চেনা তবুও আজ সবকিছুই নতুনের মতো লাগছে। ঠিক বিয়ের সেই প্রথম রাতের মতোই শিহরণ জাগছে মনে! নিশ্চয়ই উনার মনেও তাই হয়েছে?
কাছে এসে দাঁড়াতেই দুহাতে বিছানা থেকে দাড় করিয়ে বুকে আগলে নিলেন আমায়। যেই বুকে মাথা রেখে স্পষ্ট শুনতে পেলাম তার ক্রমশ বর্ধমান হৃদপিণ্ডের ধ্বনি। কিছুক্ষণ পর দুই গালে হাত রেখে খানিকটা সরে গিয়ে মুখ তার দিক তুলে কপালে গভীরভাবে চুমু খেয়ে মসৃণ হেসে বললেন,
—আজকের দিনটা আমার কাছে স্বপ্নের মতো লাগলো, বউ। এতগুলো বছর আমি যেভাবে দিনটাকে কল্পনা করেছিলাম, নিজের বউ রুপে হাসিখুশি তোমায় আমার পাশে কল্পনা করেছিলাম, আজ তার চেয়েও অধিক সুন্দর লেগেছে সবকিছু। তুমি আমার জীবনের সবচেয়ে প্রিয় বাস্তব, তুর পাখি। তোমাকে আমি স্বপ্নে চাইনি, বাস্তবে চেয়েছিলাম। আমার সাথে, আমার পাশে প্রতিটা মুহুর্তে। আমি চেয়েছিলাম তুমিও একিভাবে আমাকে অনুভব করো, আমায় ভালোবাসো, আমায় নিজ ইচ্ছায় খুশিমনে কবুল করো। আর আজ সেসব সত্যি হয়েছে। আমি ঠিক বুঝতে পাচ্ছিনা এসময় কিভাবে নিজের অনুভুতি প্রকাশ করা উচিত। আচ্ছা তুমি সবকিছু বুঝতে পারছো তো, বউ? আমার অনুভূতিগুলো বুঝতে পারছো তো?
পূর্ণর প্রতিটি কথায় প্রতিফলিত হচ্ছে তার অনুভূতিগুলো তাদের কল্পনার শেষপ্রান্তে পৌঁছে গেছে। এজন্যই হয়তো উনি চুপচাপ ছিলেন বিয়েতে পুরোটা সময়, এজন্যই এতটা আবেগআল্পুত হয়েছেন উনি! এক মুহুর্তের জন্য আমার মনে হলো তার চোখ খানিকটা চিকচিক করছে৷ এখন আমার কাছে নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে সৌভাগ্যবান মেয়ে মনে হলো! যেন নিজের কাছেই সবকিছু স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে। আমি কি তার এতটা ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য? এই শান্ত গম্ভীর লোকটা কিভাবে পারেন এতটা গভীরভাবে ভালোবাসতে? আবেগে দু চোখ ভরে উঠলো অশ্রুজলে। তার দিক তাকিয়েই হালকা হেসে মাথা নাড়িয়ে সায় দিলাম, বিনিময়ে উনিও হাসলেন। দুজনের হাসির মাঝেই জানালার পর্দা বাতাসে দোল খেলো। সেটা ঠিক করতে যেতেই আচমকা এক পশলা বৃষ্টি এসে ভিজিয়ে দিলো দুজনকে!
সেই বৃষ্টি যেন পূর্ণ-র হাসিকে আরেকটু বাড়িয়ে দিলো। পেছন থেকে কোমড় জড়িয়ে ধরেই আকাশের দিক তাকিয়ে বলে উঠলেন,
—এই যে বৃষ্টিকন্যা, বাসর রাতে বৃষ্টিবিলাস করবে নাকি? চলো ছাদে যাই।
#চলবে
[লেখায় কোথাও ভুল-ত্রুটি থাকলে ক্ষমাসুলভ দৃষ্টিতে দেখবেন। সময়ের অভাবে অনেক জায়গায় রিচেক করা হয়নি]