তোমার কোন প্রিয় মুখ।জুলাইয়ের এক খরতপ্ত সন্ধ্যা। আগুনের মতো তেতে উঠেছে ঢাকা শহর। কপালের উপর থেকে ধূসর চুলের গোছা সরালেন মিসেস খন্দকার।তারপর প্রথম আলো পত্রিকায় চোখ বোলালেন।বরাবরের মতোই উত্তেজক সংবাদ পরিবেশনে ব্যার্থ পত্রিকাটি।বিবাহ বিচ্ছেদ বিষয়ক একগাদা খবর দেখে বিরক্ত হলেন তিনি। শেষে প্রথম আলো নামিয়ে বিনোদন ডেক্স তুলে নিলেন।
একটু পরেই কামড়ায় ঢুকলেন তাঁর স্বামি খন্দকার শামিম। এই ভদ্রলোক সাধারণত এতো দ্রুত বাসায় ফেরেন না।
“শুভ সন্ধ্যা, প্রিয় ” আড়চোখে স্বামীর দিকে তাকিয়ে বললেন তিনি।দুর্বধ্য একটা আওয়াজ করলেন খন্দকার সাহেব।এরপর এক কাপ কফি ঢাললো নিজের জন্য।সেই সঙ্গে গোটা দুই টোষ্ট নিয়ে টেবিলে এসে বসলো।
কফির কাপে চুমুক দিয়ে বলল;
বিয়ের পূর্বে তোমার বয়ফ্রেন্ড ছিল আগে বলোনি তো। তাও আবার তিন বছরের কঠিন প্রেম।আচ্ছা তুমি তাকে রেখে আমাকে বিয়ে করলে কেন?
মিসেস খন্দকার কি বলবো ভেবে পাচ্ছে না। চুপচাপ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলেন।মাথা উঁচু করে দেখলেন তিনি পত্রিকায় মনোনিবেশ করেছেন।
সম্প্রতি এই দম্পতি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে। তাই মিসেস খন্দকার চায়নি এ বিষয়ে তার স্বামি জানুক। এর প্রধান কারণ, যে তাকে ফেলে চলে গেছে তাকে নিয়ে কথা বলার ইচ্ছে ছিল না।
মিসেস ক্ষিণ কণ্ঠে বললেন,
আপনি বাসর রাতে বলেছিলেন,নতুন জীবন শুরু করছি।তাই পুরাতন কিছু মনে রাখিনি।যেন জীবনকে নতুন করে সাজাতে পারি।
– আচ্ছা নো প্রব্লেম। হঠাৎ জানতে পারলাম বিষয়টা।তাই জিজ্ঞেস করলাম। এসব নিয়ে আর কথা বাড়াতে চাইনা।
-আচ্ছা, ঠিক আছে।
– তোমার হাতের কাজ শেষ হয়েছে?
– হ্যাঁ।
– তাহলে ফ্রেশ হয়ে আসো। আমার ঘুম পাচ্ছে। আগামীকাল ভোর সাতটার দিকে ডেকে দিও। জরুরি কিছু কাজ আছে হাসপাতালে।
– আপনি তো ফজরের নামাজ পড়ে হাঁটতে বের হন। কালকে হয়তো হাঁটতে হাঁটতেই সাতটা বেজে যাবে।
– হ্যাঁ হ্যাঁ তাই তো।
বিছানায় গা এলিয়ে দিলেন খন্দকার সাহেব।
মিসেস খন্দকার ওয়াশরুমে গিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে রইলেন।ভাবছেন আতিক তার সঙ্গে এমনটা না করলেও পারতো। সে তো শুধু আতিককে নিয়ে স্বপ্ন দেখেছিল। তাহলে সে কেন শেষ মুহূর্তে একা ফেলে পালিয়ে গেল?
– কি করছ এতক্ষণ …
স্বামীর ডাক শুনে দ্রুত মুখ ধুয়ে বিছানায় গেলেন মিসেস খন্দকার। লাইট অফ করে স্বামীকে জড়িয়ে ধরে ঘু্মানোর চেষ্টা করলেন।কিন্তু চোখে ঘুম নেই।অবচেতন মনে বার ফিরে আসছে আতিকের স্মৃতি।পুরনো সেই প্রিয় মানুষটা। চুপচাপ চোখ মেলে অন্ধকারে তাকিয়ে রইলেন।
মিসেস খন্দকার, বারবার নিজের সঙ্গে শপথ করেছেন। স্বামী সংসার নিয়ে নিজেকে ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করছি্ন। তবুও দিনশেষে জীবন্ত হয়ে ওঠে পুরোনি স্মৃতি।
একজনের বুকে মাথা রেখে অন্য জনের স্মৃতিচারণ। মনের মধ্যে বারবার ডুকরে কেঁদে ওঠা।এসব অভিজ্ঞতা বলে বোঝান যায়না।তবে যাদের এ অনুভূতি হয়, তারা কখনো ভালো থাকতে পারে না। যদি কেউ পারেন তাবে তার কাছ থেকে শেখার খুব তীব্র বাসনা আমার।
– ঘুমাওনি?
চমকে উঠলেন মিসেস খন্দকার।
– আমি তো সারাদিন বাসায় থাকি। বিকালের দিকে ঘুমিয়ে ছিলাম তাই ঘুম আসছে না। আপনি ঘুমান।
– একটা কথা বলি?
– বলেন।
– বুকের ভিতর এতো ভালোবাসা জমে রেখেছ যে প্রিয় মানুষের জন্য সে কেন বদলে গেলো জানতে ইচ্ছা করেনি?
আপনি বলেছিলেন আমার অতীত নিয়ে কোন প্রশ্ন করবেন না।
– তোমার অনুমতি নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম।
– অতীত নিয়ে প্রশ্ন করবেন বুঝলে অনুমতি দিতাম না।
– আতিক সাহেব আজকে সকালে ইন্তেকাল করেছেন।
ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রযিউন
মিসেস খন্দকার এর মুখে অমাবস্যার অন্ধকার
কি বলছেন উনি? আতিকের নাম জানে কি করে।
আতিক মারা গেছে, এসব কি বলে।
শোয়া থেকে ধপ করে উঠে বসে পড়লেন।অন্ধকরে স্বামীর দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন।
খন্দকার সাহেব শুয়ে শুয়ে বললেন,
– আতিক সাহেব দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত ছিল। তোমাদের পালিয়ে বিয়ের পরিকল্পনা করার কদিন পরে জানতে পারে। তারপর সে তোমাকে রেখে একা পালিয়ে আসে ঢাকায়। এখানে সে আমাদের হাসপাতালে ভর্তি হয়। বিয়ে করার জন্য তখন আমি গ্রামের বাড়িতে।তারপর ঢাকায় এসে ছুটি কাটিয়ে যোগ দিলাম হাসপাতালে।এতোদিন আতিক সাহেবের চিকিৎসা করতেন ডা.জামিল।
দুদিন যাবত জামিল সাহেব অসুস্থ। তাই আতিকের দায়িত্ব পড়লো আমার উপর। আমি তার মোবাইলের স্ক্রিনে তোমার ছবি দেখে অবাক হলাম। তারপর একজন বন্ধু হয়ে জিজ্ঞেস করলাম।
প্রথম প্রথম ইতস্তবোধ করলো, বলতে চায়নি।তারপর নানা বিষয়ে গল্প করলাম। আর জানই তো নিঃসঙ্গ মানুষেরা এমনই হয়।
শুরুতে কথা বলতে দ্বিধা করে।কিন্তু পছন্দের বা স্পর্শকাতর কোন বিষয়ের অবতারণা হলে আর নিজেকে আটকাতে পারেনা। প্রিয় মানুষকে নিয়ে কথা বলতে সবাই পছন্দ করে।
সে তোমাদের ভালোবাসার গল্পটা আমাকে বললো গতকাল রাতে। ভেবেছিলাম আজকে সকালে তোমাকে নিয়ে যাবো। কিন্তু তুমি বললে তোমার শরীর বেশি ভালো না। তাই আর জোর করিনি। তবে যদি জানতাম সকালের নতুন সূর্য দেখার জন্য সে থাকবে না তাহলে তোমাকে নিয়ে যেতাম।
মিসেস খন্দকার ডুকরে কেঁদে উঠলেন।
তারপর আস্তে আস্তে বললেন,
– আতিক এখন কোথায়?
– বিকেলে ওর লাশ গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যাবার কথা। আমার ধারণা মধ্যরাতে কিংবা ভোরবেলা পৌঁছে যাবে।
– মিসেস খন্দকার চুপচাপ বসে রইলেন।খন্দকার সাহেবও অনেকক্ষণ যাবত চুপচাপ। তারপর বললেন,
– তোমাকে এসব কথা বলার ইচ্ছা ছিলো না।কিন্তু ভেবে দেখলাম আমি না বললে তুমি কখনো সত্যিটা জানবে না।
আতিকের কথা শুনে বুঝতে পেরেছিলাম
তোমার মনের মধ্যে ওর প্রতি প্রচুর ঘৃণা জন্মে আছে।
যদিও সে নিজেই এটা সৃষ্টি করেছে। কিন্তু আমি চাই তুমি তাকে ঘৃণা না করে সম্মানের সঙ্গে স্মরণ করো। এমনিতেও তুমি তাকে ভুলতে পারবে না। তাই ঘৃণার চোখে স্মরণ না করে ভালোবাসা আর সম্মান দিয়ে স্মরণ করো। এতদিন তোমার হয়তো তার প্রতি রাগ হতো। কিন্তু এখন দেখবে তার কথা মনে পড়লে দোয়া করতে ইচ্ছে করবে। একজন মানুষ হিসেবে আমি চাই তুমি ওর জন্য অভিশাপ নয়, দোয়া করো।
প্রেমের সিঁড়িতে দুমুখী স্রোত-
একদল আশা নিয়ে উঠছে
অন্যদল হতাশ হয়ে ফিরছে।