#প্রণয়ের আসক্তি
পর্ব ৩৩
#writer_Mousumi_Akter
রিফাতের গগণ কাঁপানো চিৎকারে চারদিক থেকে টর্চ নিয়ে মানুষ এগিয়ে এলো।ধীরে ধীরে রিফাত আর সুপ্তিকে ঘিরে গোল হয়ে দাঁড়ালো মানুষ জন।সুপ্তির র*ক্তে রিফাতের সমস্ত শরীর ভিজে গিয়েছে,সুপ্তিকে বুকে জড়িয়ে ছটফট করছে,বার বার চেষ্টা চালাচ্ছে সুপ্তিকে ডেকে তোলার।কিন্তু প্রকৃতির ডাক বড়ই নিষ্টুর একবার কেউ ঘুমোলে আর কেউ জাগেনা।কিছুক্ষণের মাঝেই ইরিণা হাসান আর মৃথিলা উপস্হিত হলো সাথে নিরব ও আছে।পুরো এলাকায় খবর ছড়িয়ে গিয়েছে।মানুষের ভিড় ঠেলে মৃথিলা এগিয়ে গেলো।মৃথিলা ভেবেছে আগের মতোই কোনো মেয়ের লা*শ পাওয়া গিয়েছে হয়ত।কিন্তু মৃথিলার কল্পনার বাইরে ছিলো সুপ্তির ম*রা দেহ দেখবে সে।মৃথিলা থর থর করে কাঁপছে,অস্বাভাবিক গতি বেগে কাঁপছে তার হাত পা, ঠোঁট সহ সমস্ত শরীর থর থর করছে।এত কষ্ট হচ্ছে,এত বেশী কষ্ট হচ্ছে এখনি হৃদয় ফেটে চৌচির হয়ে যাবে মৃথিলার।জীবনের সব থেকে প্রিয় কেউ হারালে মানুষের ঠিক কতটা কষ্ট হয় ভুক্তভোগী মানুষ ছাড়া পৃথিবীর কেউ জানেনা।ভয়ানক একটা চিৎকারে মৃথিলা মাটিতে বসে পড়ল।দু’চোখের পানিতে প্লাবিত হচ্ছে সব কিছু।সুপ্তির নিথর দেহর দিকে মৃথিলা তাকাতে পারছে না।মৃথিলার কাঁন্না আর রিফাতের আত্মচিৎকারে পুরো পাহাড়ি এলাকার মানুষ নিজেদের কাঁন্না আটকাতে পারছেনা।সুপ্তির হাত ধরে মৃথিলা উত্তেজিত কন্ঠ আর করুণ আর্তনাদ নিয়ে বলছে,
‘এই সুপ্তি এটা হতে পারেনা।তুই না এটা,এটা তুই হলে আমি সব কিছু তছনছ করে ফেলব।আমি সহ্য করতে পারছি না সুপ্তি,এখনি দম বন্ধ হয়ে যাবে প্লিজ ওঠ।তুই আমার সব কিছু সুপ্তি।সারাজীবন আমার জন্য আত্মত্যাগ করে গেলি ।আমাকে কিছুই করার সুযোগ দিলিনা।আমি দায়ী তোর মৃ*ত্যুর জন্য।আমার জন্য ই তুই জীবনের সব ঝুঁকি নিয়েছিস।আত্মত্যাগ করতে করতে নিজের জীবন ই দিয়ে দিলি।এই সুপ্তি তুই তো জানতি পৃথিবীতে কেউ নেই আমার তুই ছাড়া।আমার সন্তান কে দেখবে। কি কথা ছিলো তোর আর আমার।আমি এই পৃথিবীতে আর এক দন্ড নিঃশ্বাস নিতে পারব নাহ।কে মেরেছে আমার সুপ্তিকে,আমি একবার জানতে চাই শুধু,কে মে*রে*ছে।’
রিফাত কে অস্বাভাবিক দেখাচ্ছে,একদম ই অস্বাভাবিক দেখাচ্ছে।এই মুহুর্তে খারাপ কিছু ঘটিয়ে ফেলতে পারে।উন্মাদের মতো আচরণ করছে শুধু।নিরব কি করবে বুঝতে পারছে না।মৃথিলা আর রিফাতের জীবনের একটা উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো জ্বলছিলো সুপ্তি দুজনের জীবনে।ইরিনা হাসান মৃথিলাকে সামলানোর চেষ্টা করছে।নিরব রিফাত কে সামলানোর চেষ্টা করছে।নিরব ও যেনো আকাশ থেকে পড়ল এখানে এভাবে সুপ্তিকে কে মা*র*বে।কোনো কিছুই মাথায় আসছে না নিরবের। সুপ্তির মৃত্যু কেউ মেনে নিতে পারছে না।রিফাত সহ্য করতে না পেরে নিজের মাথায় কি দিয়ে আঘাত করেছে কেউ জনেনা,মাথা ফেটে র*ক্ত গড়িয়ে যাচ্ছে।
এরই মাঝে নিরবের ফোন বেজে উঠল।নিরব ফোনটা কানে দিতেই ফোনের ওপাস থেকে বলল, ‘স্যার আপনাকে যে ফোন কল করে সেই সিম ইউজার এর নাম সুপ্তি রহমান।’
নিরবের মাথার মাঝে ঝাঁকি মেরে উঠল,মস্তিষ্ক যেনো ফাঁকা হয়ে আসল।মানে সুপ্তি তাকে এত গুলা বছর ধরে রহস্যময় কল করে গিয়েছে।সুপ্তি আজ মারা গিয়েছে আর আজ ই সেই ভয়ংকর সত্য টা সামনে এসছে।কিন্তু কেনো?কেনো সুপ্তি ফোন করত।নাবিলার সাথে কি কানেকশন সুপ্তির।তাছাড়া সুপ্তি নাবিলার বাবার খু*নে*র ব্যাপার টা ও জানে।সুপ্তি পুলিশের কাছে না বলে কেনো দুইটা বছর একটানা ফোন করেছে। নিরব ওহ নো! বলে মাথার চুল খানিক টা খামচে ধরে মৃথিলার দিকে তাকালো।তার মানে কি মৃথিলাও সব জানে?নাকি মৃথিলা কিছুই জানেনা।নাকি সুপ্তি মৃথিলাকে ইউজ করে নিরবের বাড়িতে ঢুকেছিলো।সুপ্তি কি তাহলের নাবিলার বোন।নাবিলার বোন হলে তো সুপ্তি।নিরব এর সমস্ত মাথা ঘুরছে।বার বার সব সত্যর কাছে গিয়েও কোন না কোনো বাঁধা নিরব কে আটকে দিচ্ছে।সুপ্তি তার চাচাতো বোন কিনা ভেবেই কাঁন্না পাচ্ছে নিরবের।নাবিলার বোন কে অনেক কিছুই বলার ছিলো নিরবের,অনেক অজানা সত্য তার জানা বাকি ছিলো।নিরব মৃথিলার দিকে তাকিয়ে ভাবছে প্রিয় বন্ধুর ভয়ংকর অতীত জানলে মৃথিলা কি সহ্য করতে পারবে।পৃথিবীর সব কিছু এলোমেলো লাগছে সুপ্তির,দারূণ এক যন্ত্রণা হচ্ছে।
ভোর রাত হতে হতেই গাড়ি ভর্তি পুলিশ সহ এম্বুলেন্স চলে এলো।সুপ্তিকে তার গ্রামে নিয়ে যেতে হবে।সুপ্তির লাশ নেওয়ার আগেই নিরবের মৃথিলাকে জানাতে হবে সুপ্তির ব্যাপার টা।তাছাড়া মৃথিলা সুপ্তির অতীত নিয়ে কিছু জানে কিনা সে ব্যাপারেও প্রশ্ন করতে হবে।এক্ষুনি মৃথিলাকে না জানালে হয়ত আরো দেরি হয়ে যাবে।সুপ্তির লা*শে*র সাথে মৃথিলা এম্বুলেন্স এ ওঠার আগেই নিরব মৃথিলার হাত ধরে টেনে পাহাড়ের চূড়ায় নিয়ে গেলো।মৃথিলা পাথরের মূর্তির ন্যায় নিরবের সাথে যাচ্ছে।নিরব কোথায় নিচ্ছে কেনো নিচ্ছে কিছুই জিজ্ঞেস করছে না।মৃথিলার কানে সুপ্তির সেই কথাটা বাজছে শুধু নিরব আমায় মে*রে ফেলবে,ও সবটা জেনে গিয়েছে।মৃথিলা এখন নিশ্চিত নিরব ই সুপ্তিকে মেরেছে।মৃথিলা কিছুই বলছে না একদম গম্ভীর হয়ে গিয়েছে।পৃথিবীতে ঘূর্নিঝড় আসার আগে প্রকৃতি কেমন থম মেরে থাকে।সব লন্ডভন্ড করার আগে যেমন গম্ভীর থাকে প্রকৃতি মৃথিলা ও তেমন গম্ভীর হয়ে আছে।মৃথিলা এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নিরবের দিকে।পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে আছে দুজন।
নিরব ভীষণ উত্তেজিত হয়ে বলল, ‘ প্রিয় দর্শিনী তোমাকে আমার কিছু বলার আছে।’
মৃথিলা থম মেরে থেকেই বলল, ‘যা যা বলার আছে শেষ বারের মতো বলুন আর বলার সুযোগ পাবেন না।’
‘শেষ বারের মতো মানে?’
‘যা বলতে এনেছেন বলুন,আমার সুপ্তি একা থাকবে আমি সেটা হতে দিবোনা।যে সুপ্তিকে মেরেছে তাকেও সুপ্তির কাছে পাঠাতে হবে।’
‘তুমি জানো আমাকে এতদিন যে উড়ো কল দিতো সেটা সুপ্তি।’
‘জানি?’
‘তুমি জানো।’
‘হ্যাঁ জানি।আর এ জন্যই সুপ্তিকে মে*রে ফেলেছেন।’
‘আমি সুপ্তিকে মা*রি নি।সুপ্তি সেই মেয়ে সেটা আমি কিছুক্ষণ আগেই জেনেছি মাত্র।’
‘মিথ্যুক,আর কত মিথ্যা বলবেন।খু*নি,আমার পুরা ফ্যামিলি ধ্বংস করেছেন আপনি।আমার মা,বাবা, বোন, বাকি ছিলো সুপ্তি তাকেও কেড়ে নিয়েছেন।এত খারাপ আপনি?মানুষ এতটাও নিকৃষ্ট হয়।ভাল মানুষের আড়ালে এতটা কুৎসিৎ চেহারা লুকিয়ে ছিলো আপনার।’
‘এসব কি বলছো,মাথা ঠিক আছে।আমি তোমার নিরব,তোমার ভালবাসা।আমি কিভাবে তোমার ফ্যামিলিকে খু*ন করতে পারি।’
‘আমার ভালবাসা,আমার কোনো ভালবাসা নেই বুঝেছেন।আপনি আমার ভালবাসা নন।লিসেন মিস্টার নিরব আজ যখন সুপ্তি নেই তাহলে নাটক টা ক্লিয়ার করে ফেলি।আমি কোনো ভালো টালো বাসিনি আপনাকে।এতদিন যা ছিলো তার সবটায় অভিনয় ছিলো।কোনো বাচ্চা ছিলোনা আমার পেটে,নীলাভ কে আমি ফঁসিয়েছিলাম ওর খু*ন আমিই করেছি ওর ফ্রেন্ডদের খু*ন ও আমি করেছি।আপনি আমার পরিবার কেড়ে নিয়েছেন আমিও আপনার পরিবার ধ্বংস করেছি, নিঃশ্বেস করে ফেলব ওই শান্তির নীড়।আপনার মা -বাবা কাউকে ছাড়ব না আমি।’
নিরবের অনুভূতি টা ঠিক কি নিরব নিজেও জানেনা।সহজ সরল মৃথিলার এমন ভয়ংকর রুপ দেখে নিরব মস্তিষ্ক যেনো ফাঁকা হয়ে গেলো।নিরব অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখছে মৃথিলার অগ্নিরুপ চেহারা।
নিরব এর শরীরের যেনো সমস্ত শক্তি ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে।আস্তে করে উচ্চারণ করল, ‘প্রিয়দর্শিনী এটা তুমি হতে পারোনা।’
মৃথিলা নিরবের বুকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়ে বলল,’ গুড বাই নিরব।’
নিরব সাথে সাথে পড়ে গেলো,পাহাড়ের খাদে ঝুলছে নিরব,এখনি পড়ে যাবে, এত নিচে পড়লে মৃত্যু নিশ্চিত। মৃথিলা যে সত্যি ধাক্কা মারবে নিরব ভাবতেও পারেনি।নিরবের চোখে পানি টলটল করছে।মৃথিলা অগ্নিচোখে তাকিয়ে আছে নিরবের দিকে।নিরব চোখ দিয়ে পানি ছেড়ে বলল, ‘প্রিয়দর্শিনী নিচে ভয়ানক খাদ।এখনি পড়ে যাবো আমি।পড়লে আর বাঁচব না।আমি মরতে চাইনা তোমাকে ছেড়ে।তোমাকে নিয়ে আরো কয়েক টা যুগ বাঁচতে চাই আমি।প্লিজ আমাকে বাঁচাও প্রিয়দর্শিনী।আমি এভাবে মরতে চাইনা।তোমাকে বড্ড বেশী ভালবাসি আমি।’
‘গো টু হেল নিরব।’
‘প্রিয়দর্শিনী একবার বলো কেনো মারতে চাও আমাকে।আমার ভালবাসায় কি কোনো খাদ ছিলো।’
‘মৃত্যু পথযাত্রী মানুষের শেষ ইচ্ছা পূরণ করা উচিত তাইনা?ওকে তাহলে শুনুন আপনার আপণ চাচা ইমরাণ হাসান কে কে খু*ন করেছিলো।’
‘আমি। ‘
‘উনিই আমার বাবা,আর নাবিলা আমার বোন।আমার বাবার খু*নি আপনি।ঘৃণা করি আমি আপনাকে।’
‘তোমার ওই মুখে ঘৃণা শুনলে আমি সহ্য করতে পারব না।আমি তোমার বাবাকে মারিনি মেরেছিলাম তোমার বাবার খু*নি কে।’
‘লজ্জা করেনা মৃত্যুর সময় মিথ্যা বলতে।’
‘আমি মিথ্যা বলছি না,প্লিজ একবার শোনো।’
‘হাসি মুখে মৃত্যু কে বরণ করুণ অফিসার প্রলয় হাসান নিরব।’
‘তুমি ভালবাসি বললে আমি এখনি হাসতে হাসতে জীবন দিবো।’
‘আমার ভালবাসা পেলে আপনি মৃত্যু ও হাসি মুখে গ্রহন করবেন।’
‘হ্যাঁ।’
‘তবে তাই করুণ।’
চলবে?..