#প্রণয়ের আসক্তি
পর্ব ৩৪
#writer_Mousumi_Akter
‘তুমি যদি আমার মৃত্যু তে খুশি হও তবে তাই হোক প্রিয়দর্শিনী।মৃত্যু আমাকে হারাতে পারবে না ভালবাসার যুদ্ধে।ভালবাসার যুদ্ধে আমি শ্রেষ্ঠ সৈনিক।তুমি মানো আর না মানো এটা সত্য।আমি তোমার জন্য মৃত্যু বরণ করে নিচ্ছি শেষ বারের মতো তোমার হাত টা একটু দিবে, আমি একটু ছুঁয়ে দেখতাম,তোমার হাতের একটা আঙুল স্পর্শ করতে দিবে আমাকে?একটা আঙুলে ওষ্ট ছোঁয়াতে দিবে।আমার পাপি হাত তোমাকে স্পর্শ করবে না করেও নি কখনো,আমার ভালবাসার পবিত্র ছোঁয়া তোমাকে ছুঁতে চাইছে।’
মৃথিলা তীব্র ঘৃনা নিয়ে নিরবের দিকে তাকালো।নিরবের কোনো কথা মৃথিলা সহ্য করতে পারছে না।ভয়ানক রাগি চোখ নিয়ে বসে পড়লো মাটিতে ঘৃণা ভরা চো’চোখে নিরবের জন্য আছে শুধুই অবহেলা।সুপ্তির মৃত্যু মৃথিলাকে আরো ক্রোধী করে তুলেছে।নিরবের মুখে খানিক টা থু থু মেরে বলল, ‘কষ্ট হচ্ছে তাইনা?খুব কষ্ট।কষ্ট হলে কেমন লাগে জানেন।ঠিক এরকম ই কষ্ট আমার হয়েছিলো।যন্ত্রণায় ছটফট করেছিলাম প্রিয় মানুষ দের হারিয়ে।’
‘তোমার ঘৃণা ভরা চোখের একটা পলক আমাকে যে যন্ত্রণা দিচ্ছে সেই যন্ত্রণার তুমি এক অংশ ও সহ্য করতে পারতে না।তুমি কি ভাবছো মৃত্যু আমাকে যন্ত্রণা দিতে পারবে।মৃত্যু তো আমাকে মুক্তি দিবে,এই মুহুর্তে আমার যে অসহনীয় কষ্ট হচ্ছে তার থেকে মৃত্যু ই শ্রেয় আমার জন্য।এই চোখে তাকিয়ে দেখো কতটা অসহায় আর কাতর আমি।’
‘ এই অসহায় চোখ দু’টো দেখার জন্য অনেকগুলো দিন আমি অপেক্ষা করেছি। নিজের শরীর পর্যন্ত আপনার কাছে বিলিয়ে দিয়েছি।নিজের চরম শত্রুর সাথে সংসার করতে কেমন লাগে জানেন।ঘৃণা হতো,শরীর রিরি করত তবুও মাড়ি চেপে সহ্য করেছি সব শুধু মাত্র এই দিনটার জন্য।যতবার আমাকে স্পর্শ করেছেন ততবার আমি মৃ*ত্যু*র স্বাদ গ্রহণ করেছি, নিজের শরীরের প্রতি ঘৃণা হয়েছে।আমি মরে গেছি আরো বহুদিন আগে, পাথরের মূর্তির মতো বেঁচে ছিলাম এতদিন।এতদিন যে মৃথিলা কে দেখেছেন অভিনয় করে হলেও মৃথিলা আসলেও অমন মেয়েই ছিলো।কিন্তু আপনি আপনার ফ্যামিলি সহজ, সরল মৃথিলাকে আজ খু*নি বানিয়েছেন।কেনো আমার জীবন টা এমন হলো।আর পাঁচ জনের মতো একটা নরমাল জীবন কেনো পেলাম না আমি।সব কিছুর জন্য আপনি আর আপনার ফ্যামিলি দায়ী।সম্পত্তি,ঠিক কত টাকার সম্পত্তির জন্য আমার বাবাকে মেরেছিলেন বলুন।কি চেয়েছিলো আমার বাবা শুধু তার অংশ বুঝে নিতে চেয়েছিলো এটাই কি তার দোষ ছিলো।’
‘আর তুমি কত বোকা প্রিয়দর্শিনী, কিছু না জেনেই আমার প্রিয় জনদের কেড়ে নিলে।আমার এই মুহুর্তে কেমন অনুভূতি হচ্ছে বলে বোঝাতে পারব না।যাকে এই পৃথিবীতে সব থেকে বেশী ভালবাসি সেই আমার পুরো পরিবারকে শেষ করেছে।আমার ভাই -বোন সব আত্মীয় সব কিছু।তবুও আমিও তোমাকে এক বিন্দু পরিমাণ ঘৃণা করতে পারছি না।ভালবাসা যেনো তোমার এক মুহুর্তের ঘৃণায় আরো বহুগুন বেড়ে গিয়েছে।’
‘আমার ক্ষেত্রেও সেইম অনুভূতি অফিসার প্রলয় হাসান নিরব। যার সন্তান আমার পেটে ধরেছি সে আমার পুরো ফ্যামিলিকে ধ্বংস করেছে।তবুও এই সন্তান কে আমি ত্যাগ করতে পারছিনা।বারবার মনে হচ্ছে ওই মুহুর্ত টুকু সত্য ছিলো।’
‘প্রিয়দর্শিনী আমাকে একটা সুযোগ দাও।সব কিছুই সত্য ছিলো।তোমার আমার কিছুই মিথ্যা ছিলো না। সত্যটা জানানোর সুযোগ দাও প্লিজ।আমি মরে যাবার আগে অন্তত একটা সুযোগ দাও।তোমার অনেক কিছু জানার বাকি আছে।’
‘আমি সব জানি নাবিলা আপু আমাকে সব বলে গিয়েছে, আমি শুধু এটাই জানি আপনি আমার জীবনের সব কিছু কেড়ে নিয়েছেন।’
‘আমার থেকে তোমার বেশী কষ্ট হচ্ছে তাইনা?যাকে ভীষণ ভালবাসো তাকেই মারতে কতটা কষ্ট হয় আমি বুঝি।’
‘কিসের ভালবাসা,আমি আপনাকে ভালবাসিনা।ঘৃণা করি,ভীষণ ঘৃণা করি।আপনার মৃত্যু আমাকে এতটুকু কষ্ট দিবেনা।’
‘তাহলে এখনো কেনো আমাকে আপনি আপনি করে বলছো?তুই এর থেকে নিম্ন কিছু বলতে পারছো না কেনো?কেনো জঘন্য ভাষায় গালি দিচ্ছো না।কেনো আমাকে রেখে চলে যাচ্ছো।কেনো দাঁড়িয়ে দেখতে চাইছো না আমার মৃত্যু। সহ্য করতে পারবে না বলে।’
‘এমন কোনো ব্যাপার নেই।’
‘ওই মায়াবী চোখের ভাষা আমি পড়তে জানি। আই লাভ ইউ প্রিয়দর্শিনী।নিজেকে ভাগ্যবান মনে হচ্ছে।এত কিছুর পরেও তোমার চোখে ভালবাসা দেখতে পাচ্ছি আমি।আমার সন্তানের জন্মধারিনী।আমাকে তো একটা সুযোগ দিলে না একটা কথা মাথায় রেখো তোমার এই পা*গ*ল মানুষ টা তোমাকে নিজের থেকেও বেশী ভালবাসত।আমার সন্তান কে বলো তার বাবা তার মায়ের মতোই তাকে ভালবাসত।কিন্তু তুমি কি পারবে আমাকে মুছে ফেলতে।আমার স্মৃতি কখনোই তুমি মুছতে পারবেনা।আমাকে তোমার থেকে বিচ্ছিন্ন করলেও তোমার হৃদয় থেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারবেনা।এই পারে না হয় ঘৃনা করলে ওই পারেও কি ঘৃণা করবে।আমি যে দীর্ঘকাল তোমার জন্য অপেক্ষা করব এতটা অপেক্ষার পরেও কি আমাকে ঘৃণা করবে।’
সন্তানের কথা নিরবের মুখে শুনে হৃদয় কেমন ব্যাকুল হয়ে উঠল মৃথিলার।হাহাকার করে উঠল বুকের মাঝে।নিরবের কষ্ট মৃথিলা সহ্য করতে পারছে না।নিজ চোখে প্রিয়তম স্বামির মৃত্যু সহ্য করতে পারছে না।অনেক চেষ্টা করেছে নিজেকে শক্ত রাখার কিন্তু আর পারছে না।
নিরব কে সে ভীষণ ভালবাসে,অভিনয় করতে করতে গভীর ভালবাসা মনে স্হাপন করে ফেলেছে।আকাশের দিকে তাকিয়ে হুহু করে কেঁদে উঠল মৃথিলা।ভয়ানক আর্তনাদ সেই কাঁন্নার।নিরব এক্ষুনি পড়ে যাবে আর দেখা হবেনা তাদের।মৃথিলার মাথায় কিছুই আসছে না, কি করবে বুঝে উঠতে পারছে না দ্রুত নিরবের হাত ধরে ফেলল।মুখোমুখি দুজন অসহায় ভালবাসার মানুষ, তুমুল ঘৃণা থাকার পরেও জীবন বাঁচাতে মরিয়ে হয়ে উঠে পড়েছে।মৃথিলার চোখ ভরা পানি,নিরবের ঠোঁট ভরা হাসি।মৃথিলা নিজেও জানেনা নিরব তার প্রতি কতটা দূর্বল,কত বেশী ভালবাসে।মৃথিলার মুখের দিকে তাকালেই নিরবের মেঘলা আকাশ রঙিন হয়।
দুজনের ই কনুই ছুলে র*ক্ত বেরোচ্ছে।মৃথিলা নিরব কে তুলে হাত ছেড়ে খানিক টা দূরে গিয়ে দাঁড়ালো আকাশ পানে তাকিয়ে।নিরব ভেতর থেকে ভেঙে চুরে গুড়িয়ে গিয়েছে।ক্লান্ত দুটো চোখের অসহায় চাহনি মৃথিলাকে দেখছে।মৃথিলা একবার ও ভাবে নি এত কিছু জানার পরে নিরব কে বাঁচালে সে মৃথিলাকে এখান থেকে ফেলে দিতে পারে।মৃত্যুর থেকে ভালবাসা হারানোর ভ*য় টা বোধহয় মৃথিলা বেশী পেয়েছে।নিরব এক পা দু’পা করে মৃথিলার দিকে এগোচ্ছে।নিচেই বিশাল খাঁদ।নিরব কি এখনি মৃথিলাকে ধাক্কা দিয়ে ফে*লে দিবে।মৃথিলার সেসব কোনো চিন্তা নেই।অনুভূতি শূন্য হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।নিরব মৃথিলার কাছে গিয়ে মৃথিলাকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘হৃদয় টা ভীষণ হাহাকার করছে তুমি ছাড়া।সব যেনো শূন্য হয়ে গিয়েছে।আমার চেনা পৃথিবী আজ বড্ড অচেনা লাগছে।আমার আকাশের রংধণু আজ বিলীন হয়ে গিয়েছে।প্রিয়দর্শিনী তুমি নিজেও জানোনা এই কঠিন ছেলেটা তুমি বাদে পৃথিবীর কারো কাছে দূর্বল নয়।’
এতকিছুর পরেও নিরবের এমন আকুল কথা মৃথিলাকে তছনছ করে ফেলছে।যন্ত্রণায় ক্ষত -বিক্ষত হচ্ছে হৃদয়।দু’চোখ বন্ধ করে মৃথিলা নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছে।কষ্টের করুণ দীর্ঘঃশ্বাস বেরোচ্ছে ক্রামাগত।নিরব কে নিজের থেকে আলাদা করতে না পারার যন্ত্রণা পোড়াচ্ছে।
নিরব মৃথিলাকে বুকে জড়িয়ে বলল, ‘তুমি যাকে খু*নে*র অপরাধে আমাকে খু*নি ভাবছো হ্যাঁ আমি তাকে খু*ন করেছি কারণ সে তোমার বাবা ছিলোনা, তোমার বাবার খু*নী ছিলো।তোমার মায়ের খু*ন সে করেছিলো।’
মৃথিলা নিরব কে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিয়ে বলল, ‘বাহ!নাটক সাজাচ্ছেন।আমার বাবা যার হাত ধরে আমার বড় হওয়া সে আমার বাবা নয়।আমাকে আমার বাবা চেনাচ্ছেন।’
‘তোমার অনেক কিছুই জানা নেই।’
‘আমাকে জানানোর দায়িত্ব আপনাকে দেওয়া হয়নি।আপনি সুপ্তিকে কেনো মারলেন।আপনি জানেন মেয়েটা আমার জন্য আপনাকে ফোন করত।আমাকে সাহায্য করতে নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সারাক্ষণ আমার সাথে থেকেছে।অপরাধ আমি করেছি খু*ন সব আমি করেছি সুপ্তি নয়।নীলাভসহ বাকি যারা সবাই কে আমি মে*রে*ছি।’
‘আর আমাদের নিরা।’
‘নিরার খু*নি কে আমি জানিনা,আমি নিরার মতো পবিত্র একটা ফুল কে কেনো মা*র*ব।খু*নীর নাম জানলে আমি নিজেই তাকে শে*ষ করব।’
‘আমি জানতাম তুমি নিরাকে মা*র*তে পারোনা।’
বাইরে এম্বুলেন্স হুইসেল দিচ্ছে।মৃথিলা আর কথা না বাড়িয়ে এম্বুলেন্স এ গিয়ে উঠল।সুপ্তিকে সুপ্তির বাড়ি নিয়ে দাফন করা হল।
রিফাতের আত্মচিৎকার কেউ হয়ত বুঝবেনা শুনতেও পাবেনা।কোনদিন স্বাভাবিক হতে পারবে কিনা কেউ জানেনা।
কেটে গিয়েছে পনেরো দিন।মৃথিলা নিরব কে ছেড়ে এসেছে কোথায় আছে নিরব জানেনা।যন্ত্রণায় ছটফট করছে নিরব।মৃথিলার স্মৃতি নিরব কে জর্জরিত করছে।কোনো সত্যি মৃথিলাকে জানাতে পারেনি নিরব।সুপ্তির দাফনের পরে মৃথিলা হঠাত হাওয়া হয়ে গিয়েছে।
কয়েক বছর আগের কথা।রাণীগঞ্জের চেয়্যারম্যান এর বাড়ির বাগানে একটা টিনসেটের ঘরে মৃথিলা বেড়ে উঠছিলো।মা,বাবা আর বড় বোন নাবিলার সাথেই হাসিখুশি ভাবে দিন যাচ্ছিলো।
চলবে..