#প্রণয়ের আসক্তি পর্ব ৩৬
#writer_Mousumi_Akter
মৃথিলা আর নাবিলার জীবনের দূর্দশা এখানেই শেষ নয়।সর্বনাশের আরো কয়েকধাপ বাকি ছিলো।এর কিছুদিন পরেই নাবিলা নিঁখোজ হয় রাণীগঞ্জ থেকে।নাবিলার সাথে আরো কতগুলো মেয়ে নিঁখোজ হয়।নাবিলা সেদিন পাচারকারীদের সনাক্ত করতে পারে।পাচারকারীদের হাতে পড়ে কেউ কোনদিন ফিরে আসতে পারে নি কিন্তু প্রথমবার নাবিলা ফিরে আসে।আর নাবিলাকে নিরব ই সেদিন উদ্ধার করে।
নাবিলার কাছে সেদিন ভীষণ সন্দেহ হয় যে তার মা-বাবার খু*ন করেছে সেই নিকৃষ্ট মানুষ ই নিজের জীবনের রিস্ক নিয়ে এসব মেয়েদের রক্ষা করছে এমন কি নাবিলাকেও রক্ষা করল।নাবিলার অবাকের চরম মাত্রা বাড়তে দেখে নিরব সেদিন নাবিলাকে একটা ভিডিও দেখায় যে ভিডিও দেখে নাবিলা কাঁন্নায় ভেঙে পড়ে।নাবিলা নিরব কে বলে আমার একটা ছোট বোন আছে নিরব ভাইয়া যদি আমার কিছু হয়ে যায় ওকে দেখবেন আপনি।নিরব নাবিলাকে বলে তোমার কিচ্ছু হবেনা নাবিলা।
একমাত্র তুমি আছো যে ওই পাচারকারীদের খুব কাছ থেকে দেখেছো।আমাকে বাকি মেয়েদের উদ্ধার করতে হবে।ক’দিনে ফিরতে পারব আমি জানিনা। তোমাকে আমাদের লোক আমাদের বাড়ি পৌছে দিবে।তুমি ওখানে নিশ্চিন্তে থাকবে।আমার পরিবারের সাথে।আমি বাড়িতে ফোন করে জানিয়ে দিচ্ছি।ফিরে বাকি কথা শুনব।নিরব নাবিলাকে নিজের বাড়িতে পাঠিয়ে চলে যায় ওই পাচারকারী গ্যাংসহ ধরার জন্য।নিরব কে দশ দিন বাড়ির বাহিরে থাকতে হয়।এরপরে নিরব ফিরে এসে আর নাবিলা কে জীবীত পায়না।
বাড়ি এসে দেখে তার ফ্যামিলির সবাইকে র*ক্তা*ক্ত করে কেউ বা কারা নাবিলাকে খু*ন করে রেখে গিয়েছে।আর নাবিলা বুঝতে পেরেছিলো এমন কিছুই হবে।আর সেটাই মৃথিলাকে ফোন করে জানিয়ে যায়।কারা নাবিলাকে মা*র*তে চায় এটুকু বলার আগেই প্রাণ চলে যায় নাবিলার।শুধু নীলাভ এর অত্যাচারের ঘটনা টুকু বলতে পারে।আর এখান থেকেই শুরু হয় ভয়ংকর এক খেলা।
এই রহস্যময় ভয়ানক অতীত ই মৃথিলাকে আজ এতটা হিংস্রাত্মক করে তুলেছে।মৃথিলা শান্তির নীড়ে খুজেও কোথাও সেই চিঠি খুজে পায় নি।মৃথিলার ধারণা নিরব ই সেই চিঠি গায়েব করে ফেলেছে।
রিফাত চাকরি থেকে রিজাইন করেছে।রিফাতের এই পৃথিবীর কিছুই ভাল লাগেনা।পৃথিবীর সব কিছুই তিক্ত লাগে।সারাক্ষণ বন্ধ ঘরে ঘুমের ওষুধ খেয়ে সুয়ে থাকে।চোখ খুললেই সুপ্তির হাসিমাখা মুখ রিফাত কে ক্ষত-বিক্ষত করছে।জীবন টা ভয়ানক রকমের অসহ্য হয়ে গিয়েছে রিফাতের।সারাক্ষণ মৃ*ত্যু কামনা করেও কোনো লাভ হচ্ছেনা তার।প্রিয়জনের ভয়ানক মৃ*ত্যু কতটা যন্ত্রণাদায়ক হতে পারে তা ক্ষণে ক্ষণে উপভোগ করছে রিফাত।জীবনে নরকের থেকে ভয়াবহ হয়ে গিয়েছে।
প্যান্টের দুই পকেটে হাত গুজে শান্তির নীড়ের পাঁচ তলার ছাদে গভীর রাতে দাঁড়িয়ে আছে নিরব।চোখ দুটো অশ্রুসিক্ত,বিষাক্ত এক যন্ত্রণায় হৃদয় জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে।বিশাল আকাশের দিকে তাকিয়ে ঘন ঘন তীব্র যন্ত্রণাদায়ক নিঃশ্বাস ছাড়ছে।আকাশের পানে তাকিয়ে চোখ খিচে বন্ধ করে রেখে যন্ত্রণা হালকা করার চেষ্টা করছে।নিরব জীবনের প্রথমবার এতটা ভেঙে পড়েছে, এতটা অসহায় লাগছে।নিরবকেও কখনো এমন তীব্র যন্ত্রণা পেতে হবে নিরবের বোধহয় ধারণাতেও ছিলো না।এই বাড়ির ছাদে কতশত স্মৃতি জড়িয়ে রয়েছে। গভীর রাতে সে আর মৃথিলা দাঁড়িয়ে চন্দ্রবিলাস করেছে।এই মাঝ রাতে নিরব বায়না ধরেছে,’ মৃথিলা প্লিজ গোলাপি শাড়িটা চেঞ্জ করে আমার আনা নতুন কালো শাড়িটা পরবে।’
মৃথিলা অবাক হয়ে বলেছে, ‘এখন?
এখন কয়টা বাজে দেখুন রাত বারোটা বাজে।’
নিরব মৃথিলাকে জড়িয়ে ধরে বলেছে, ‘এই নিস্তব্ধতায় ভরা রাতে তোমাকে দেখার সময় কেউ ডিস্টার্ব করবে না। আমি অপলক চেয়ে চেয়ে দেখব আমার বউকে।এত সুন্দর বউ আমার, সারাদিন কাজের ফাঁকে যেটুকু দেখি আমার মন ভরে না।এখন থেকে ভোর পর্যন্ত দেখব একটুও চোখের পলক ফেলব না।’
মৃথিলা সাথে সাথে কালো শাড়ি পরে নিয়েছে।নিরব পাজা কোলে তুলে ছাদে নিয়ে এসেছে।গাল ভরে আদর দিয়ে নিজের বুকে মৃথিলার মাথা রেখে পরম আদরে জড়িয়ে রেখেছে মৃথিলাকে।নিরবের হাতে আজ সেই ঘড়িটা।মৃথিলার অভাব তাকে বড্ড কষ্ট দিচ্ছে।প্রথমদিন নিরবের ঘড়িতে যে শাড়িটা আটকে গিয়েছিলো।ঘড়িতে আটকে যাওয়া সেই শাড়ির অংশ নিরব আজ ও ফেলে দেয় নি।ফোনের স্ক্রিণে মৃথিলার হাসি ভরা মুখটা ভেষে রয়েছে।
অশ্রুসিক্ত চোখ আর কাঁপা কন্ঠে মৃথিলার ছবির দিকে তাকিয়ে নিরব বলছে, ‘কোথায় হারিয়ে গেলে প্রিয়দর্শিনী তুমি।তোমাকে ছাড়া বেঁচে থাকা যে এত বেশী যন্ত্রণার তার থেকে সেদিন আমার মৃ*ত্যু গ্রহন করাই উচিত ছিলো।তুমি ছাড়া এত কঠিন আর যন্ত্রণাদায়ক জীবন আমি ভাবতেও পারিনি।এই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করতে পারলে হয়ত যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতাম।কিন্তু না এইভাবে সব ত্যাগ করে চলে গেলে তোমার কি হবে।
ওরা তাহলে তোমাকেও মে*রে ফেলবে।তোমার কখনো জানাও হবেনা কি ছিলো তোমার অতীত।প্লিজ প্রিয়দর্শিনী কাম ব্যাক ইন মাই লাইফ।আই ওয়ান্ট ইউ।আমাকে মৃত্যু দাও,তবুও ফিরে এসো,নিজ হাতে মা*রো আমায়,তবুও ফিরে এসো।তোমার চলে যাওয়ায় বদলে গিয়েছে অনেক কিছু,থেমে গিয়েছে অনেক কিছু।বদলে গিয়েছে আমার স্বপ্নরা,পালটে গিয়েছে জীবনের সব রঙিন বসন্ত,বিষাক্ত হয়ে গিয়েছে অনুভূতি। প্রতিশোধ যদি নেওয়ার ই ছিলো তাহলে তো অনেকবার ই সুযোগ ছিলো কেনো খাবারে বিষ মিশিয়ে খাইয়ে দিলেনা।তাহলে একবার ই মরে যেতাম।তুমি এমন এক পথ অবলম্বন করেছো যেখানে মৃত্যু নেই তবে মৃত্যুর চেয়ে তীব্র যন্ত্রণা উপভোগ করছি।তুমি আমায় এমন ভয়ানক বিচ্ছেদ কেনো উপহার দিলে বলোতো।তুমি আমায় এতটা গভীর ক্ষত,আর আজীবনের বিচ্ছেদ উপহার না দিলেও তো পারতে।
ছেড়ে চলে যাওয়া প্রতিশোধের ক্ষত কত বেশী গভীর,ভয়াবহ আর তীব্র যন্ত্রণাদায়ক তুমি যদি এর এক অংশ অনুভব করতে পারতে আমাকে এত নিষ্টুর পরিণতি উপহার দিতে পারতে না।
পরে আরো একটা দিন কেটে গেলো।শান্তির নীড় কেমন শষান এর মতো হয়ে গিয়েছে।এই বাড়িতে আগের মতো মানুষ গিজ গিজ করেনা।নিরা হেসে খেলে বেড়ায় না।আরিফা,রাহিলা, কুতুবের মা কেউ আর রান্নায় ব্যাস্ত থাকেনা।ইসহাক হাসান এখন বিছানায় পড়ে গিয়েছেন। ইরিনা হাসান বসে আছে বারান্দায়।ইরিনা হাসান কে বেশ চিন্তিত দেখাচ্ছে।নিরব না খেয়ে অফিসে যাচ্ছে।ইরিনা হাসান নিরব কে বলল, ‘তোমার সাথে কথা আছে আমার নিরব।’
‘বলো মা।’
‘মৃথিলার কাহিনী কি বাবা।এই মেয়েকে আমার এখন সুবিধার মনে হচ্ছেনা।এই মেয়ে এই বাড়িতে আসার পর থেকেই সব কিছু কেমন তছনছ হয়ে গিয়েছে।যে চলে গিয়েছে তার জন্য কেনো এত ছটফট করছো বাবা।আমি তোমার বিয়ে নবনিতার সাথে দিতে চাই আবার।’
‘আমার জীবনে দ্বীতীয় কোনো নারীকে দেবার মতো কিছুই নেই মা।’
এরই মাঝে নবনিতা বাড়িতে প্রবেশ করল।সাথে নবনিতার মা বাবা ও এসছে।বাড়িটা ফাঁকা ফাঁকা হওয়াতে ইরিনা হাসান তাদের এসে থাকতে বলেছে।অনেকদিন পর নবনিতা আর নিরবের দেখা।নিরব নবনিতার দিকে একবার তাকিয়ে আবার বেরিয়ে গেলো।দুপুর টাইম নিরবের অফিস টাইম শেষ।প্যান্টের পকেটে ফোন বাজছে নিরবের।ফোনের স্ক্রিণে নবনিতার নাম্বার।নিরব রিসিভ করতেই নবনিতা বলল, ‘নিরব আঙ্কেল এর ওষুধ নিতে এসছি।একটু ফার্মাসির সামনে আসবে।’
‘আসছি ওয়েট করো।’
কিছুক্ষণের মাঝে নিরব পৌছে গেলো।নবনিতার থেকে প্রেসক্রিপশন নিয়ে বাবার ওষুধ নিলো।সামনেই একটা রেস্টুরেন্ট।নবনিতা বলল কিছু খাওয়াবে আমার প্রচন্ড খুদা লেগেছে।নিরব বলল, ‘ চলো।’
রেস্টুরেন্টে বসে নিরব নাবিলার সাথে মৃথিলার সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো শেয়ার করছে।হঠাত নিরবের খেয়াল হলো তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মায়াবী দুটো চোখ তাকিয়ে আছে নিরবের দিকে,মুখে মাস্ক লাগানো।রেস্টুরেন্টের বাইরেই দাঁড়িয়ে আছে।পরণে কালো জিন্স,কালো শার্ট,চুল হাত খোপা করে রাখা।নিরবের দৃষ্টি সেদিকে যেতেই মেয়েটি নিজের হাত কাচের দরজায় জোরে বাড়ি মারল সাথে সাথে হাত কেটে র*ক্ত গড়িয়ে গেলো।ক্যাশ কাউন্টার এর লোকটি বলে উঠল, ‘আপা কি হলো,হাত তো অনেকটা কেটে গিয়েছে।’
এই দুটো চোখ চিনতে নিরবের একটুও ভুল হলোনা।নিরব এক ঝটকায় চেয়ার ছেড়ে উঠল।বাইরে আসতে আসতেই মৃথিলা রাস্তা ক্রস করে চলে গেলো।নিরব উন্মাদের মতো এদিক সেদিক খুজে চলেছে কিন্তু কোথাও নেই মৃথিলা।কাচের দরজায় লেগে আছে মৃথিলার হাতের র*ক্ত।নিরব সব টুকু র*ক্ত নিজের রোমাল দিয়ে মুছে নিলো।মৃথিলা হাতে কতটুকু ব্যাথা পেয়েছে অনুমান করে নিরবের বুকে অসহনীয় যন্ত্রণা শুরু হলো।কিন্তু মৃথিলা নিজের হাতে আঘাত করল কেনো?তার পাশে নবনিতাকে দেখে।নিরবের মুখে হাসি ফুটল তার মানে মৃথিলা তাকে ভালবাসে।নবনিতা ভেতরে বসে দেখছে নিরবকে।এই মানুষ টাকে তার করে পাওয়া কোনদিন ই সম্ভব নয়।নিরব মৃথিলাতে আটকে গিয়েছে সারাজীবন এর জন্য।নবনিতার কষ্ট হচ্ছে, চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ল।নিরব নবনিতাকে কিছু না বলেই বেরিয়ে গেলো।নিশ্চয়ই আশে পাশে মৃথিলা কোথাও আছে।আর মৃথিলাকে খুজে আজ সব সত্য জানাতে হবে।
মৃথিলার প্রচন্ড রাগ হচ্ছে,নিরবের পাশে নবনিতাকে সহ্য করতে পারছেনা।সেতো নিরব কে ঘৃণা করে তাহলে কেনো হচ্ছে এমন।এমন তো হওয়ার কথা নয়।নিরব যার সাথে ইচ্ছা থাকুক।এসব ভেবেও কোনো লাভ হচ্ছেনা। কাঁন্না আটকাতে পারছেনা মৃথিলা।হেলেদুলে হেঁটে চলেছে।হঠাত মৃথিলার সামনে একটা মহিলা পড়ে।এই মহিলাকেই মৃথিলা খুজে চলেছে বহুদিন ধরে।এবার হয়তো নীলয় আর নীরার মৃ*ত্যু রহস্য জানতে পারবে মৃথিলা।
চলবে…..