আমার স্বামী রাসেল যখন তার দ্বিতীয় স্ত্রী তমাকে নিয়ে বাসায় ঢুকলো আমি একটুও অবাক হলাম না। মোটামুটি তিন বছর ধরেই আমি তার বিয়ের গুঞ্জন শুনছি। ব্যাপারটা যে সত্যি তা বুঝতে পেরে আব্বা-আম্মা মানে আমার শ্বশুর শাশুড়ি গ্রামের বাড়িতে চলে গেছেন, তারা তাদের ছেলের এই কাজ কিছুতেই মেনে নিতে পারেননি। আমি যদি তাদের সাথে যেতে পারতাম, কিন্তু আফসোস তাদের নিজেদেরই এখন দিন চলেনা তারমধ্যে আমি আবার বোঝা হয়ে যাব, তাই সিদ্ধান্ত নিলাম একমাত্র মেয়ে রিনিকে নিয়ে যত কষ্টই হোক এখানেই থাকবো।
রাসেলের মুখ দেখলাম হাসি হাসি, তমা সন্তান সম্ভাবা, বিয়েটা যে গুঞ্জন ছিল না এটা পরিষ্কার। আমি কিছুটা পাথরের মত দাঁড়িয়ে থাকলাম। রিনি বারবার প্রশ্ন করতে থাকলো ওই আন্টিটা কে?
রাসেলের এরকম হাসি হাসি চেহারা আরও একবার আমি দেখেছিলাম , যখন রিনি ছিল আমার পেটে, আদরের কমতি ছিল না। সব আদর উড়ে গেল যখন মাত্র সাড়ে সাত মাসে আমার প্রসব বেদনা উঠলো, আমার যখন জীবন মরণ দশা শিক্ষিত ছেলে হয়েও রাসেল একটাই প্রশ্ন করেছিল বিয়ের সাড়ে সাত মাসে বাচ্চা হয় কি করে? এই বাচ্চা নিশ্চয়ই আমার না । ডাক্তার ম্যাম ধমক দিয়ে তাকে বের করে দিয়েছিলেন। তিনি আমাকে বাঁচাতেই তখন ব্যস্ত, রাসেলের মত শিক্ষিত গাধাকে কাউন্সেলিং করা তখন তার পক্ষে সম্ভব ছিল না আর এই যুগের একটা ছেলে এই ধরনের অবান্তর কথা বললে যে কারো রেগে যাওয়া স্বাভাবিক।
তার পরেও রিনির জন্মের পর ডাক্তার তাকে বুঝিয়ে বলেছিল যে রিনি প্রিম্যাচিউর বেবী, কিন্তু কে কার কথা শোনে রাসেলের মাথায় কি ঢুকেছিল কে জানে? সে একনাগাড়ে বলে চলছিল, এই সন্তান আমার না । নিষ্প্রাণ চোখে চেয়ে দেখেছিলাম, শশুর আব্বা তাকে একটা থাপ্পর মেরে ছিলেন ।পুরনো যুগের মানুষ হয়েও তাদের অন্তর টা ছিল আধুনিক ।
আচ্ছা রাসেল কি সত্যি সত্যি বোঝেনি নাকি ইচ্ছে করে এমনটা করেছে কারণ আমাদের বিয়েটা পারিবারিকভাবে হয়েছে, বিয়েতে নাকি ওর মত ছিল না, পরে শুনেছিলাম আমি। কিন্তু ভয়ঙ্কর শকড হলাম যখন রিনিকে একবার কোলে পর্যন্ত নিলো না ও।
এরপর কেটে গেছে প্রায় পাঁচ বছর । আমরা একই বাড়িতে থাকি কিন্তু আলাদা রুমে ।আমি আমার মেয়েকে নিয়ে থাকি। রাসেল রাতভর কারো সাথে গল্প করে ,ফোনে চ্যাটিং করে, হাসাহাসি করে আমি শুনেও না শোনার ভান করি রোবটের মত, কোন উপায় নেই ,যাওয়ার কোন জায়গা নেই, বাবা মা নিজেই তো ভাইয়ের সংসারে বোঝা। চাকরির বয়সসীমাও শেষ হয়ে গেছে, কোন মূলধন নেই যে নিজে ব্যবসা শুরু করবো, আসলে কিছুই নেই আমার একটা মাত্র মেয়ে ছাড়া আমার পুতুল টার কাজল কালো চোখের দিকে তাকালে ভয়ঙ্কর মায়ায় আমি ডুবে যাই। এই চোখ দেখেও রাসেল কি করে অন্যদিকে চোখ ফিরিয়ে নেয় আমি বুঝতেই পারি না।
রিনির মনে এখন হাজার প্রশ্ন উদয় হয়, সবার বাবা এত আদর করে ওর বাবা এমন কেন? আমি নির্বাক থাকি, কি উত্তর দিবো মেয়েকে তবুও মাঝে মাঝে জোরাজুরিতে বলি সবাই তো আর একরকম হয় না এখন তুমি বড় হচ্ছো আস্তে ধীরে সব জানবে বুঝবে , রিনি গালে হাত দিয়ে শোনে। মায়ের কষ্টটা সে এখন একটু একটু বুঝতে শিখেছে।
স্কুলে যেবার আমার আদরের পুতুলটা প্রথম হলো দৌড়ে গিয়ে বাবাকে রিপোর্ট কার্ড দেখালো রাসেল শুধু রিপোর্ট কার্ড টা ছুড়েই মারে নি রিনিকে একটা ঠাস করে থাপ্পর বসিয়ে দিয়েছিল ।আবার মারতে যখন উদ্যত হলো আমি দৌড়ে গিয়ে মেয়েকে জাপ্টে ধরলাম আমার পিঠে প্রচন্ড একটা আঘাত পেলাম, ভাবতেই শিউরে উঠলাম আমার মেয়েটাকে না ধরলে আঘাতটা এই ছোট্ট শরীরটা সইতো। কি করে পারে এসব রাসেল?
কিছুদিন পর তমার একটি পুত্র সন্তান হলো। রাসেলের সে কি আনন্দ পাড়া-প্রতিবেশী বন্ধু-বান্ধব সবাইকে মিষ্টি খাওয়াচ্ছে। কোল থেকে বাচ্চাটাকে নামাচ্ছে না। আমি আড়চোখে দেখি, না রাসেলকে না, রিনিকে ওর চোখে মুখে কেমন একটা হতবিহবল ভাব ,অনুভূতিটা অনেকটা ব্যাখ্যাতীত, যেন আমায় নিয়ে তো বাবা এমন কিছু করেনা তাহলে ওকে নিয়ে কেন? আমি যতটা সম্ভব রিনিকে দূরে রাখি, মেয়ের আবদার গুলো পূরণ করার চেষ্টা করি যদিও টাকার জন্য সেই রাসেলের কাছেই হাত পাততে হয় ।
“মামনি বাবা কেন আমায় আদর করে না? ওই ছোট্ট বাবুটাকে কত আদর করে । ”
আমি বিষণ্ণ হয়ে মেয়ের দিকে তাকাই।
“চলনা মামনি আমরা বাবুটাকে অন্য কোথাও দিয়ে আসি তাহলে বাবা আমাকে ওর মত আদর করবে। ” আমার বুক ফেটে যায়, চোখ কোন বাঁধা মানে না অঝোরে কেঁদে যায়।
এভাবেই কেটে গেল প্রায় আড়াই বছর।
এক বিষন্ন সন্ধ্যায় বসে বসে আমাদের বিয়ের ছবিগুলো দেখছিলাম, মলিন ঝাপসা স্মৃতি। এই আড়াই বছরে আমাদের সম্পর্কের আরও অবনতি ঘটেছে। মোটামুটি বাইরের মানুষের কাছে এখন আমি কাজের মহিলা।
-মামনি তুমি কি করছো? নিষ্পাপ কণ্ঠে বলে উঠলো আমার সাত বছরের মেয়ে রিনি। আমি কোনমতে চোখের পানি সামলে বললাম,
– কিছুনা মা এমনি বসে আছি, কিছু বলবে তুমি আম্মু?
-জানো মামনি, ছোট ভাই ছাদ থেকে পড়ে গেছে
-কি? আমার অন্তরাত্মা কেঁপে উঠলো
-তুমি কি করে জানলে
– বাহ রে আমরা একসাথে খেলছিলাম তো, নিচে উঁকি মারতে গিয়ে পড়ে গেছে।
-আমি অপলক দৃষ্টিতে আমার শিশুকন্যার দিকে তাকিয়ে থাকলাম, কি নির্বিকারভাবে এত কঠিন একটা কথা বলছে। ও কি জানে এর ফল কি হবে?
-সত্যি করে বলতো মা তুমি কি ওকে ধাক্কা দিয়েছো? আমি কাঁপা কাঁপা কন্ঠে জিজ্ঞেস করলাম।
-না মামনি, ও নিজেই পড়ে গিয়েছে ।বাবা এখন আমাকে ভাইয়ের মত আদর করবে কোলে নিয়ে স্কুলে যাবে, দোকানে গিয়ে চকলেট কিনে দেবে, তাইনা মামনি। দিনে দিনে ওর প্রতি রাসেলের অবহেলা থেকে ছোট্ট মন অবচেতনভাবে এটাই কল্পনা করে নিয়েছে যে ভাই না থাকলে বাবা হয়তো তাকে ভালবাসবে, আদরে মমতায় ভরিয়ে রাখবে, কিন্তু সত্যিটা যে তা না তা এ শিশুমন কে বোঝাবে?
তার ঠিক পাঁচ মিনিটের মধ্যে রাসেলের হিংস্র কণ্ঠ ভেসে আসলো, “দরজা খোল, তোর ওই জারজ সন্তান কে আজকে আমি টুকরা টুকরা করে কুত্তা দিয়ে খাওয়াবো।” তমার আর্তনাদ আর রাসেলের চিৎকারে আমার দম বন্ধ হয়ে যেতে লাগলো। আমি জাপ্টে ধরে বসে থাকলাম আমার রিনিকে, আমার আদরের পুতুলকে।
( বি.দ্র: অনেকেই ডিএনএ টেস্টের কথা বলছেন, অনেকেই পার্সোনাল অ্যাটাক করে বলছেন লেখিকার কোন জ্ঞান বুদ্ধি নেই ডিএনএ টেস্টের ব্যাপারে, লেখিকা বিষয়টা জানেইনা। আপনাদেরকে দের অবগতির জন্য জানাই ডিএনএ টেস্ট করাটা অসম্ভব নয় তবে এটাও মনে রাখা জরুরী যে ডিএনএ টেস্ট করতে গেলে কোর্ট পারমিশন দরকার, তার বিষয়ে জ্ঞান থাকা দরকার এবং উপযুক্ত কারণ দেখানো দরকার আর গল্পে ছোট্ট রিনির মায়ের এসব মামলা নিয়ে ছোটাছুটি করার মত কোন অর্থ সম্পদ ছিল না আর হাজবেন্ডের চরিত্রে আমরা দেখেছি কখনোই সে স্ত্রীর সঙ্গ দিত না। অত্যন্ত দুঃখের সাথে জানাচ্ছি যে ইদানিং পাঠক সমাজ ব্যক্তিগত আক্রমণ করে কেন যেন একটা হিংস্র মজা পায়, সবাইকে ধন্যবাদ)
Kobitor কবিতর