সেই রাতে মদিনা বেগম
মাঝ রাতে লাইটের সুইচ অফ করে যখন ঘুমাতে যাব।তখনই মাথার কাছে ফিসফিসিয়ে এক মহিলা বললেন,
“আমি শুধু শাড়ি পড়ছি।শাড়ির নিচে ছায়া-ব্লাউজ কিছু পড়িনাই।খবরদার আমার দিকে চোখ ঘুরাবি না।”
আমি আগ্রহ নিয়ে সাথে সাথে মাথা তুলে তাকানোর চেষ্টা করি।অন্ধকারে কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। তিনি আমাকে ঠাস করে চড় মেরে বলেন, “মাথা তুলতে নিষেধ করেছি না? করেছি কি করিনাই?”
আমি আবার মাথা নিচু করি।ছোট করে নিশ্বাস ছেড়ে বলি, “দুনিয়ায় এতো জায়গা থাকতে আপনি এখানে কেন?তাও এই মাঝ রাতে ।আবার শুধু শাড়ী পড়া।“
–এই পোলা তোর তো দেখছি সাহস কম না।ভুতের মুখে-মুখে তর্ক করিস?
আপনি ভুত নাকি?
–ভুত তো আমার জামাই।আমি পেত্নী। তোরা মানুষরা আমাদের ছেলে-মেয়ে সবাইকে ভুত বলিস কেনো? আমরা কি তোদের সবাইকে “মাগি” বলি?
আপনারা কি বলেন তা আমি কি জানি? তা আপনার স্বামী কই?
–আমার স্বামী তোর গার্লফ্রেন্ড এর রুমে বসে আছে।তুই নাকি তাকে সময় দিস না?
বাজে কথা বলবেন না।এখনি তাকে আমার গার্লফ্রেন্ড এর রুম থেকে আসতে বলেন।লজ্জা করেনা; মাঝ রাতে মেয়েদের রুমে যেতে?
–শুন আমরা তোদের মতো নির্লজ্জ-বেহায়া না।তোর গার্লফ্রেন্ড যখন জামা-পাজামা চেইঞ্জ করে তখন আমার লটকন ফিরেও তাকায় না।
“লটকন” কে?
–আমার স্বামীর নাম।উনার পুরো নাম “চান্দা-বাগা বলোজ পিলু কহতগ পিচুবিকলী”।আমি তাকে ভালোবেসে “লটকন” ডাকি।
আল্লাহ আল্লাহ…..লা ইলাহা ইল্লা আন্তা সুবহানাকা ইন্নী কুনতু মিনাজ জালীমিন।
–দোয়া ইউনুস পড়ছিস কেন?আমি কি খারাপ পেত্নী নাকি যে দোয়া পড়ার সাথে সাথে ফুস করে উড়ে যাবো।আমি নিজেও ফজর আর এশার নামাজের পর আল্লাহর জিকির করি।
আপনি তাহলে কেমন পেত্নী?
–আমি নিম গাছের পেত্নী।তবে ঈদ-কুরবানীতে বট কিংবা অর্জুন গাছে বান্ধবীদের বাসায় বেড়াতে যাই। তোদের তেঁতুল গাছের দোপালীর মতো না।
দোপালী আবার কে?
–চিনিস না?
রাতের বেলা
নগ্ন হয়ে তোর আম্মু আর বিল্ডিং এর মানুষকে ভয় দেখায়।
আপনার নাম কি?
–আমার ইসলামি শরীয়ত অনুসারে নাম “মদিনা বেগম”। তবে লটকন আমাকে ভালোবেসে চন্দ্রমুখী ডাকে।
বাহ!দেবদাস সিনেমার নায়িকা?
–লটকন বলেছে আমি হাসলে মাধুরীর চেয়েও সুন্দর লাগে। আর গায়ের রং ঐশ্বরিয়ার চেয়েও উজ্জ্বল।
আমি কি আপনাকে একবার দেখতে পারি?
–না না! লটকন আমাকে পরপুরুষের সাথে দেখা করতে বারণ করেছে।তুই অবশ্য আমার ছেলের মতো।তোর বয়েসি আমার এক ছেলে ছিলো।নাম ছিলো তরমুজ।
ছিলো মানে? এখন কোথায়?
–বাইচ্চা নেই।একটা মাইয়ার পিরিতে মজেছিল, পরে বিয়া হয় নাই। কাইন্দিতে কাইন্দিতে মরে গেছে।
কান্না করতে করতে মরে গেছে?!!
–হুঁ।তোগো কাইন্দিলে যেমন পানি পড়ে আমরা কাইন্দিলে আলো ঝড়ে।
কিসের আলো?
–আমরা ভূত পেত্নীরা আলো-বাতাসের তৈরি।বেশী কান্নাকাটি করলে শরীর থেকে আলো বের হয়ে যায়।শরীরের রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা কইম্মা যায়।তখন ভূত-পেত্নীরা অসুস্থ হয়ে পড়ে।
সবকিছু আমার মাথার উপর দিয়া যাচ্ছে।তরমুজের সাথে মেয়েটার বিয়ে হয়নি কেনো?
–মেয়েটা তোগো মতো রক্ত মাংসের মানুষ আছিল। আর আমার ছেলে আছিলো ভূত।তেলে-জলে কি কখনো মিশ খায়? খায় না।
বলেই মদীনা বেগম হাউ-মাউ করে কেঁদে উঠলেন।
আমি তাকে কি বলে সান্ত্বনা দেবো বুঝলাম না।তিনি প্রায় ৪/৫ মিনিট একইভাবে কাঁদলেন।
তারপর পুচফুচ শব্দ করে বললেন, “বেশি কাঁদলে আমার আবার সর্দি লাগে।”
–কান্না করবেনন না।আপনি কান্না করলে আমার খারাপ লাগে।
এই তোর খারাপ লাগবে কেনো?আমি তোর কে?
–আমি কারো কান্না সহ্য করতে পারি না।তার উপরে আবার মেয়ে মানুষের কান্না।
তিনি বললেন, তোর কথা শুনে আমার তরমুজের কথা মনে পড়ে গেলো।আমি একটু তোর মাথায় হাত বুলায়।
হ্যাঁ, হাত বুলান।
আমার মাথায় কারো হাত অনুভব করলাম না।শুধু হালকা মৃদু ঠান্ডা বাতাসে চুলগুলো উড়তে লাগলো।
তিনি কোমল গলায় বললেন,
“একদিন বোরকা পড়ে তোর সাথে দেখা করবো নে।তুই রাত-দুপুরে আমাকে দেখলে ভয় পাবি। নাহলে অবশ্য এখুনি দেখা করতাম।আমার চেহারা আগুনে পুড়ে খারাপ হয়ে গেছে। তবে আমি সত্যিই আগে অনেক সুন্দর ছিলাম।
পুরে যাবার পরেও লটকন আমাকে ছেড়ে যায় নি।বরং মাঝেমধ্যে আমার মনে হয় ও আমাকে আগের চেয়ে বেশী ভালোবাসে।লটকন অনেক সুদর্শন পুরুষ চাইলেই আরেকটা বিয়ে করতে পারতো।বল পারতো না?”
পারতো।
–কিন্তু তিনি তা করেন নি।
মদিনা বেগম এবার দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন।কিছুক্ষন পর আবার বললেন,বল তুই ওর জায়গায় হলে কি করতি?
আমি কি উত্তর দেবো ভেবে পেলাম না।
–চুপ করে আছিস কেনো বল;বল কি করতি?
আমি জানি না কি করতাম।রাত অনেক হয়েছ,ঘুম পাচ্ছে ঘুমোবো।
–জানিস না মানে।তুই ঘুমোতে পারবি না। উঠে বস,আমাকে উত্তর দে।সত্যি উত্তর দে,মিথ্যা বললে কিন্তু আমরা ধরতে পারি।
অন্য একদিন বলবো।
–তুই আজই বলবি। ওঠ; উঠে বস বলছি।
হঠাৎ গলার স্বরটা অন্যরকম লাগলো।আমি উঠে বসে দেখি আম্মু বিছানার পাশে বসে।
কি হয়েছে?
আমি বললাম,মদিনা বেগম কোথায়?
–মদিনা বেগম কে? ঘুমের ঘোরে একা একা কথা বলছিস কেনো? আজ নিশ্চয়ই বালিশের নিচে তাবিজ রেখে ঘুমাস নি।
একটা বিষয় বলে রাখা দরকার।আম্মুর মাঝেমধ্যে মনে হয় আমি একা একা কথা বলি, হিহি করে হাসি।
গভীর রাতে কখনো
ছেলেদের আবার কখনো বা মেয়েদের গলায় গান ধরি।এই কারনে তিনি গাউস পীরের মাজার থেকে পানি পড়া,তাবিজ-টাবিজ নিয়ে এসেছেন।
একটা তাবিজ বালিশের নিচে রেখে ঘুমোনোর নিয়ম। আমার সেটা মনে থাকে না।মনে না থেকে অবশ্য ভালো হয়েছে মদীনা বেগমের দেখা পেলাম।যদি তাবিজ রেখে ঘুমোতাম মদিনা বেগমের দেখা পেতাম না কোনদিন।
আম্মু এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,বললি নাতো মদিনা বেগম কে?
কেউ না।হয়তো দুঃস্বপ্ন দেখেছিলাম।
–আদা-লবঙ্গ দিয়ে এক কাপ রং চা বানিয়ে দেবো? খেলে ভালো লাগবে।
তুমি জানোনা আমার রং চা ভাললাগে না?
–পীর বাবার থেকে লবঙ্গ পড়া এনেছিলাম। ওটা রং চায়ের সাথে মিশিয়ে খেতে হবে।
আমি খাবো না।তোমার ইচ্ছে হলে তুমি খাও।
আম্মু হতাশ হয়ে চলে গেলেন।
সারাদিন আমি মদিনা বেগমের বিষয়টা নিয়ে ভাবলাম।যদি রাতে তিনি আবার আসেন এবং আমাকে জিজ্ঞাসা করেন “আমার ভালোবাসার মানুষের চেহারা পুড়ে ঝলসে গেলে আমি কি করতাম?”
তাহলে কি উত্তর দেবো?
রাতে খাবার টেবিলে আম্মুকে বললাম,যদি কিছু মনে না করো একটা কথা বলি।
আম্মু বললেন,এতো ঢং করার কি আছে?বলে ফেল।
“যদি তোমার প্রিয় মানুষের চেহারা আগুনে পুড়ে যায় তুমি কি করবে?”
আম্মু চোখ বড় বড় করে আমার দিকে তাকালো।তারপর কাঁদো কাঁদো স্বরে বললো, তুই আমার সাথে এখনি একবার পীর বাবার কাছে চল।তোর কাছে আমি আর কিছু চাই না।
সেদিন রাতে
আগেই আমি আম্মুর রেখে যাওয়া তাবিজ বালিশের নিচ থেকে সরিয়ে ঘুমোলোম।
শেষ রাতের দিকে মদিনা বেগম এসে বললো, “ঘুমিয়েছিস?”
না ঘুমাইনি।আপনার জন্যেই অপেক্ষা করছিলাম।
–আমার আসার জন্যে এসব তাবিজ-পোলতে সরানোর দরকার নেই। আমি এমনিতেই আসতে পারতাম।
আপনি সব বুঝতে পারেন?
–সব না কিছু কিছু জিনিস পারি।আর কিছু বিষয়ে একটু সংশয়ে থাকি।তোকে গতকাল যে প্রশ্নটা করেছিলাম ওটা আজ আর করবো না।
কেনো করবেন না?
–কাল মনে সংশয় ছিলো কিন্তু আজ নেই।এখন তুই কি উত্তর দিবি আমি জানি।
কি উত্তর দেবো?
–সকাল থেকে তুই আমার আর লটকনের বিষয়টা নিয়ে অনেক ভেবেছিস।যদি হুট করে কেউ তোকে এই প্রশ্ন করতো তুই সাথে সাথে মিথ্যা বলতি “ভালোসার মানুষের পাশে থাকবো।”
এখন কি বলতাম?…
–একই উত্তর দিবি তবে আজকের উত্তরটা সত্যি।
কীভাবে?
–ওই যে বললাম। তুই আমার আর লটকনের বিষয়টা নিয়ে অনেক ভেবেছিস।সেই ভাবনা তোর মাঝে অতিরিক্ত মূল্যবোধ আর বিবেক সৃষ্টি করেছে।তাই তোর প্রেমিকার প্রতি যেটুকু ভালোবাসা অবশিষ্ট ছিলো সেটুকুও পূর্ণ হয়ে গেছে।তাই আজ সত্যি বলতি।
আমি আর মদিনা বেগম দুজনেই কিছুক্ষন চুপ করে রইলাম।মদিনা বেগম বললো,তোর জন্যে মায়া জমে গেছে।আমি তোর রুমে আসা যাওয়া করি প্রায় ৩ মাস। তোর সাথে কথা বলছি ২/৩ দিন।মাঝেমধ্যে বিভিন্ন গলায় গান গেয়ে রাত কাটাইতাম।তোর আম্মু শুনতে পায়,কিন্তু তুই নাক ডেকে ঘুমিয়ে থাকিস।
–এসব কেনো বলছেন?
কারন আমরা বেড়াতে যাবো আবার কবে আসবো ঠিক নেই।
–কোথায় বেড়াতে যাবেন?
পরশু ভোর রাতে
পৌছাব সৌদি আরব। তারপর লটকন কোথায় নিয়ে যাবে জানিনা।
–আবার কবে আসবেন?
জানিনা।আর হয়তো নাও আসতে পারি।তোর মা এমনিতেই তোকে নিয়ে অনেক দুঃচিন্তায় থাকে।
–আসবেন না কেনো।মাঝেমধ্যে আসবেন।
তোকে আমার অনেক ভালো লেগেছে।তোকে একটা উপহার দিয়ে যাচ্ছি। জিনিসটা আমার ছেলের আছিল।
–কই দেখি।
অনেক রাত হয়েছ।এখন দেখতে হবে না,ঘুমা।সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখিস।তোর পড়ার টেবিলে রেখে গেলাম।
–আপনি এখুনি চলে যাবেন?
না,একটু আগে লটকন এসেছে। তোর সাথে দেখা করাবো তারপর যাবো।
–কোথায় তিনি।
তোর সিলিং ফ্যানের উপরে বসে আছে।
–কি বলেন ফ্যান তো চলছে।
তাতে ওর কিছু হয় না।ওর আরো মজা লাগে।
–আমার সাথে কথা বলবেনা?
না ওর আবার লজ্জা বেশী।তোদের মধ্যে যেমন মেয়েদের লজ্জা বেশী আমাদের মধ্যে আবার ছেলেদের লজ্জা বেশী।তোর প্রমিকাকে লটকন একটা কলম উপহার দিয়ে এসেছে।একটা কলমের মধ্যে ৪ টা রঙ।লাল-নীল,হলুদ আর বেগুনী।
মদিনা বেগমের সাথে কথা বলতে বলতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি।
আম্মু সকালে ডেকে ফোন টা হাতে দিয়ে বললো, দেখতো সকাল থেকে তোর কোন বান্ধবী তোকে খুঁজছে।বললো জরুরি কথা।
আমি ফোন ধরতেই আয়েশা (গার্লফ্রেন্ড) বললো, তুমি কীভাবে জানলে আমি এমন একটা কলম বহুদিন ধরে খুঁজছি?
কিসের কলম?
–তুমি জানোনা?সকাল সকাল “লটকন” নামের একটা বাচ্চা ছেলেকে দিয়ে কলম পাঠালে।
আমি চমকে উঠলাম।
আম্মু সাথে সাথে পড়ার টেবিলের দিকে তাকিয়ে বললেন,
“ওমা এতো সুন্দর ডায়রি কবে কিনেছিস?
আমাকে আজকাল কিছু দেখাস ও না।”
ফোনের ওপাশ থেকে আয়েশা তখনও বলেই চলেছে, তোমায় একটা রঙিন চিঠি লিখবো বলে কতোদিন থেকে এমন একটা কলম খুঁজছিলাম।আমি তো কখনো তোমায় বলিনি। বলোতো বলেছি কিনা?
আম্মু ততক্ষনে ডায়রির সব পাতা উল্টিয়ে পাল্টিয়ে বললো,তুই দেখছি এই ডায়রিতে গল্প ও লিখেছিস “তরমুজের গল্প”।এটা কেমন গল্পরে আমাকে তো শুনালি না।
আমি আয়েশার ফোন টা রেখে আম্মুকে বললাম,
“ওই গল্পটা মদিনা বেগমের ছেলের গল্প।গল্পটা শেষ করা হয় নি,কাল রাত শুরু করেছি।তোমাকে শেষ হলেই শুনাবো।”
পাশের বাসার ভাবী বোকা আর্মি আঁখি শুধু তুমি শুধু তোমাকেই ভালোবাসি লকডাউন ও আমি