স্ত্রীর মৃত্যুর চার বছর পর শশুর বাড়িতে এসেছি। রাতে খাবার শেষে শাশুড়ী বললো,
– বাড়ির পিছন থেকে পালিয়ে যাও বাবা। নাহলে তোমার শশুর তোমাকে মেরে ফেলবে। কোনো কথা না বলে চুপচাপ পালিয়ে যাও। আর কোনদিন আমাদের বাড়িতে এসো না।
আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম।
বললাম,
– কিন্তু কেন আম্মা? আমাকে খুন করে আব্বার লাভ কি? আমি কি করেছি?
শাশুড়ী আমার কথার কোনো জবাব না দিয়ে চোখ দিয়ে কিছু একটা ইশারা করে চলে গেল। আমি চুপচাপ করে বসে রইলাম। হঠাৎ পিছনে কারো উপস্থিতি অনুভব করে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি এই বাড়িতে যেই ছেলেটা কাজ করে সেই ‘বাদল’ দাঁড়িয়ে আছে। বাদলের বয়স ২২/২৩ বছর হবে। এ বাড়িতে প্রায় পনের বছর ধরে কাজ করে। তার চোখে চোখ পড়তেই অদ্ভুত লাগলো। কেমন জানি ক্ষুধার্ত বা প্রতিশোধের আহ্বান জানিয়ে দিচ্ছে বাদলের সেই চোখ দুটো।
হঠাৎ মোবাইলে কল এলো। কল করেছে আমার শাশুড়ী নিজেই। আমি রিসিভ করতেই তিনি বললেন,
” বাদল তোমাকে সারাক্ষণ চোখে চোখে রাখছে। বাহিরে আরও তিনজন আছে। কেউ যেন বুঝতে না পারে যে তুমি ওদের উদ্দেশ্য জেনে গেছো। রিক্তার বাবা তোমাকেই রিক্তার মৃত্যুর জন্য দায়ী করছে। আমি কিছু করতে পারলে করতাম বাবা। তুমি পালিয়ে যাও আমি চাই তুমি নিজের জীবন নিয়ে যেন ফিরে যাও। আর আমি আমার সংসার নিয়ে বেঁচে থাকি! মেয়ে তো গেছে, এখন তোমাকে মেরে স্বামীকেও হারাতে চাই না। আমি আগে জানলে কিছুতেই তোমাকে আসতে বলতাম না। ”
রিক্তা আমার মৃত স্ত্রীর নাম। শাশুড়ীর কথা শুনে আমি ঘামতে লাগলাম। এদিকে শশুরের প্রহরী বাদল আমার দিকে তাকিয়ে বললো ,
– আপনাকে চাচায় ডাকে।
– কোথায়?
– কাচারি ঘরে বসে আছে , আপনার সঙ্গে নাকি জরুরি কথা আছে। চলেন আমার সঙ্গে।
– তুমি যাও তাহলে, আমি আসছি।
বাদল গেল না , সে আমার সামনেই দাঁড়িয়ে রইল। আমি একটু বিরক্ত কিন্তু ভয়মিশ্রিত কণ্ঠে বললাম,
– কি হলো, তোমাকে যেতে বললাম না?
– আপনাকে নিয়েই যেতে হবে। আপনার কাজ থাকলে কাজ শেষ করেন, তারপর চলেন।
– আমি কাপড় পাল্টাবো, আর সেটা তোমার সামনে কীভাবে করবো বলো তো?
– কেন, আপনি কি মেয়ে মানুষ নাকি আমি মেয়ে মানুষ। আমার সামনেই পাল্টান সমস্যা কি। আমি আপনাকে না নিয়ে গেলে চাচায় ধমক দিবে।
এখন কি বলবো আর খুঁজে পেলাম না। আমার কি যাওয়া উচিৎ নাকি বাদলকে এখানে ঘায়েল করে পালানো উচিৎ বুঝতে পারছি না। যদি সেটা করতে পারি তাহলে পালানোর একটা সুযোগ পাবো কিন্তু যদি কাছারি ঘরে যাই তাহলে তো আর সুযোগ না ও আসতে পারে।
রিক্তা আর আমি বিয়ে করেছিলাম গোপনে। রিক্তা পড়াশোনা করতো ঢাকায় , সেখানেই আমাদের পরিচয়। প্রায় দুই বছরের কাছাকাছি আমাদের ভালোবাসার গল্প। তারপর এক ছুটিতে রিক্তা তার গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে আসে। বাড়িতে এসেই জানতে পারে রিক্তার বাবা ওর বিয়ে ঠিক করেছে। তখন ইউনিয়নের পরপর দুবার নির্বাচিত চেয়ারম্যান রিক্তার বাবা জুলফিকার মৃধা।
রিক্তা আমাকে কল দিয়ে কান্নাকাটি করলো। আমি তাকে কোনো সমাধান দিতে পারলাম না। কারণ মা-বাবার কাছ থেকে একটা মেয়ে পালিয়ে যাক সেটা আমি চাইনি। আবার নিজের ভালোবাসার মানুষ সারাজীবনের জন্য অন্য কারো হয়ে যাক সেটাও কল্পনা করতে পারছিলাম না। ভেবেছিলাম আমি সরাসরি রিক্তার বাবার সঙ্গে কথা বলবো। কিন্তু তার আগেই রিক্তা তার বাবাকে বলেছে এবং তিনি সরাসরি না করেছে।
সম্পুর্ণ একদিন এক রাত রিক্তার নাম্বার বন্ধ ছিল। রিক্তাদের বাড়ির সম্পুর্ণ ঠিকানা জানতাম না। তবে জেলা উপজেলা আর ইউনিয়নের নাম জানতাম। আর যেহেতু ওর বাবা তখন রানিং চেয়ারম্যান ছিল তাই সহজেই তার বাড়ির খুঁজে পাওয়া যাবে এটাই
স্বাভাবিক।
ঢাকা থেকে রওনা দিয়ে পদ্মা নদীর কাছাকাছি আসতেই একটা অপরিচিত নাম্বার থেকে কল আসে। তখন কিন্তু পদ্মা সেতুর উদ্ভোদন হয়নাই। সকল যানবাহন ফেরীতে কিংবা লঞ্চে করে করে পারাপার হতো।
কল রিসিভ করতেই রিক্তার কণ্ঠ শুনতে পেলাম। রিক্তা এলোমেলো আর কান্নামিস্রিত কণ্ঠে যা বলেছিল তার সারমর্ম হচ্ছে,
” বাবার সঙ্গে রাগারাগি করছে। তার বাবা জোর করার কারণে রিক্তা সুইসাইডের চেষ্টা করেছে। তারপর তাকে অসুস্থ অবস্থায় খুলনার একটা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। একবেলা থেকেই খানিকটা সুস্থ হয়ে রিক্তা হাসপাতাল থেকে পালিয়ে গেল। যে নাম্বার দিয়ে কল করেছিল সেটা ছিল ওর এমন বান্ধবীর নাম্বার। ওই বান্ধবীও রিক্তার সঙ্গে একসঙ্গে পড়াশোনা করে। রিক্তা একবার তাদের খুলনার বাসায় গেছিল। মেয়েটার নাম সুরমা, সুরমা নিজেও তখন ছুটির কারণে খুলনার বাড়িতে ছিল। তাই রিক্তা সুরমাদের বাসায় গিয়ে আমাকে কল করেছে। ”
ঘটনার সংক্ষিপ্ত বলার পরে রিক্তা আমাকে বললো,
– তুমি যদি আমাকে সারাজীবন তোমার কাছে রাখতে চাও তাহলে আমাকে এসে নিয়ে যাও। আর যদি আমাকে ছাড়া থাকতে পারো, আমাকে ছাড়া তোমার জীবন চলে তাহলে বলে দাও। তাহলে আমি হাসপাতালে ফিরে যাবো।
আরেকটা পুরুষ কণ্ঠস্বর শুনে আমার ভাবনায় ছেদ পড়লো।
– বাদল ভাই আপনাকে চেয়ারম্যান সাহেব কি করতে বলছে। করেন না কেন।
বাদল বিরক্ত গলায় আমাকে বললো,
– তাড়াতাড়ি চলেন তো। চাচায় কিন্তু রেগে যাবে।
– মোবাইলটা চার্জে দিয়ে আসতেছি।
– আচ্ছা চার্জ দেন।
তাকিয়ে দেখি বাদলের পাশে আরেকটা লোক দাঁড়িয়ে আছে। দুপুরে পুকুর থেকে মাছ ধরার সময় এই লোকটাকে দেখেছিলাম জাল ফেলতে। আমি মোবাইল চার্জে দিয়ে নিরুপায় হয়ে তাদের সঙ্গে হাঁটা ধরলাম। যা আছে কপালে, আগে দেখি ঘটনা কি। তাছাড়া যেহেতু আমার শশুর এখানকার পরপর দুবার নির্বাচিত চেয়ারম্যান ছিলেন। তাই তিনি চাইলেই তো আমাকে মেরে ফেলতে পারবেন না। সমাজের মধ্যে কেউ তার নিজের সম্মান নষ্ট করতে চায় না।
আমি গিয়ে রিক্তার বাবা জুলফিকার মৃধা অত্র ইউনিয়নের দুবারের সাবেক চেয়ারম্যানের সামনে গিয়ে বসলাম। আমার পিছনেই বাদল দাঁড়িয়ে আছে তবে জাল দিয়ে মাছ ধরা লোকটাকে এখানে আর দেখতে পাচ্ছি না।
– আব্বা আমাকে ডেকেছেন?
– হ্যাঁ, চা খাও।
বাদলের দিকে তাকিয়ে বললো, “জামাইকে চা দে”
চায়ের মধ্যে বিষ দিবে নাকি? মৃত্যুর পড়ে যেন দায় এড়ানো যায় সেজন্য কৌশল করছে না তো।
বাদল চলে গেল চা আনতে। রিক্তার বাবা সামনে রাখা কাগজপত্র মনোযোগ দিয়ে পড়ছে। রিক্তার মা-বাবা দুজনই শিক্ষিত মানুষ। আমার শাশুড়ী যখন
অনার্স শেষ করেছেন রিক্তার তখন দুই বছর বয়স।
সেদিন আমি পদ্মা নদী পার হয়ে সরাসরি খুলনা এসেছিলাম। খালিশপুরে রিক্তার বান্ধবীর বাসা থেকে সেই রাতেই ট্রেনে এসেছিলাম ঢাকা। ঢাকায় ফিরে সবার আগে আমার বন্ধুদের ডেকে বিয়ে করলাম। আমার বাবা নেই, মায়ের নতুন বিয়ে হয়েছে নাটোরে। মা সেখানেই থাকে, মা’কে শুধু জানালাম আমি বিয়ে করবো। মা ভিডিও কলে রিক্তাকে দোয়া করলেন।
বিয়ের পরে রিক্তা বললো, আমরা ঢাকা শহরে আর থাকবো না। চলো নতুন কোনো শহরে গিয়ে দুজন মিলে একসঙ্গে থাকবো। ঢাকার মধ্যে থাকলে বাবা আমাদের যেভাবেই হোক খুঁজে বের করবে। রিক্তার কথা শুনে আমি অসহায় দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। তবে চারদিন পরে আমরা সবকিছু গুছিয়ে নাটোরে চলে গেলাম। মা সেখানে আমার একটা জবের ব্যবস্থা করে দিলেন।
নাটোরে আসার তিনদিন পরে আমরা যে বাসায় ভাড়া উঠেছি সেই বাড়ির মালিক আমাদের রুমে এলেন। তার হাতে বড় বড় দুটো লাগেজ আর সেই লাগেজটা যে রিক্তার সেটা আমি এবং রিক্তা দুজনেই বুঝতে পেরেছি।
বাড়িওয়ালা রিক্তাকে বললেন,
– তোমার বাবা এগুলো পাঠিয়েছে , এখানে তোমার ব্যবহৃত সবকিছু ঠিকঠাক আছে। তোমার সখের যা কিছু ছিল তিনি নিয়ে এসেছেন। আশা করি তোমার আর অসুবিধা হবে না।
আমি কিছু বলার আগেই রিক্তা বললো ,
– আপনি আমার বাবাকে চিনেন?
– নাহ , ভদ্রলোক কীভাবে আপনাদের সন্ধান পেয়ে এখানে এসেছে আমি জানি না। তোমাদের বিষয় সবকিছু বললো , তারপর এগুলো দিয়ে তিনি চলে গেছেন।
আমি ও রিক্তা দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে রইলাম। সবসময় রিক্তার মুখে তার বাবার বিষয় যত কথা শুনেছি তার অনেকটাই ভুল প্রমানিত হলো। রিক্তার কথা অনুযায়ী তার বাবা হচ্ছে তার দেখা সর্বশ্রেষ্ঠ রাগী মানুষ। অথচ সেই মানুষটা এভাবে আমাদের খুঁজে বের করে নিজের হাতে মেয়ের ব্যবহৃত সবকিছু নিয়ে এসেছে। আবার খুব যত্নে সেগুলো বাড়িওয়ালার কাছে দিয়ে গোপনে বিদায় নিয়ে গেছে। মনে মনে তখন মানুষটাকে একটা অপ্রকাশিত ধন্যবাদ দিলাম।
বাড়িওয়ালা যাবার সময় রিক্তাকে বললেন,
– তোমার বলেছেন তার ভয় পালাতে হবে না। কারণ সবজায়গা থেকে খুঁজে বের করার ক্ষমতা তার আছে। তোমার বাবা চান তুমি তোমার পড়াশোনা শেষ করো। তাই পড়াশোনা বন্ধ না করে ঢাকায় গিয়ে ফাইনাল পরীক্ষায় অংশ নিতে বলেছেন।
~
বাদল চা নিয়ে এসেছে আমি চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে চুপচাপ বসে আছি। রিক্তার বাবা আমার দিকে না তাকিয়েই বললেন ,
– চা খাও নাহলে ঠান্ডা হয়ে যাবে।
– আমি চা খাবো না।
– ওহ্ আচ্ছা , একটু বলতে তাহলে শুধু শুধু নষ্ট হতো না। বাদল চা নিয়ে যা, তুই খেয়ে ফেল।
আমার পিছনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বাদল চা খাচ্ছে। রিক্তার বাবা এবার তার সামনের কাগজপত্র এক সাইডে রেখে বসলেন। টেবিলে রাখা মোবাইলটা হাতে নিয়ে বললেন ,
– তোমার মোবাইল কোই?
– মোবাইল রুমে রেখে এসেছি আব্বা। মোবাইলে চার্জ ছিল না তাই চার্জে দিছিলাম।
রিক্তার বাবা বাদলের দিকে তাকিয়ে বললো,
– ঘর থেকে জামাইর মোবাইলটা নিয়ে আয় তো।
আমি চুপচাপ বসে আছি, তিনি তার মোবাইলে কি যেন টাইপ করছেন। সম্ভবত কিছু লিখছে কারো কাছে। আমি যেমন ছিলাম তেমনই বসে রইলাম। বাদল ভেতর থেকে মোবাইল নিয়ে আসলো। আমি মোবাইল হাতে নিলাম।
আমার শশুর তখন বললেন,
– তোমার মোবাইলে MB আছে?
– জ্বি আছে।
– ডাটা চালু করো, দেখো তো তোমার মেসেঞ্জারে কোনো মেসেজ এসেছে কি-না।
আমি ডাটা চালু করলাম। আর তখনই মাত্র কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে সবচেয়ে বড় ধাক্কাটা খেলাম।
রিক্তা মারা গেছে আজ থেকে চার বছর আগে। আজ রিক্তার মৃত্যুবার্ষিকী ছিল তাই আমি এসেছি। কিন্তু আজ হঠাৎ রিক্তার সেই পুরনো ফেসবুক আইডি দিয়ে মেসেজ এলো কীভাবে। এই আইডি তো গত চার বছর ধরে বন্ধ ছিল।
আমি মেসেঞ্জারে গিয়ে রিক্তার আইডি দিয়ে আসা মেসেজটা পড়তে লাগলাম ,
” আমার মেয়েটা তো আমাদের চেয়েও তোমাকে বেশি ভালোবেসেছিল। আমি ভেবেছিলাম তুমি হবে আমার মেয়ে সারাজীবন সুখে থাকার অছিলা। কিন্তু ওর মৃত্যুর কারণ যে তুমি হবে, তোমার জন্য ওকে মরতে হবে এটা তো ভাবিনি। আমার মেয়েটাও তো ভাবেনি এমনটা হবে। ”
মেসেজ পড়ে আমি রিক্তার বাবার দিকে তাকালাম। ভয়ঙ্কর সেই চেহারা, প্রতিশোধের জন্য অপেক্ষায় থাকা তার সম্পুর্ণ শরীর।
আমি কিছু বলার আগেই তিনি বলেন,
– আমার মেয়ে যখন মারা যায় তখন থেকে আমার কেন যেন মনে হতো আমার মেয়েটার মৃত্যুর পিছনে কোনো কারণ আছে। রাগ করে ছিলাম ঠিকই কিন্তু ভুলে তো যাইনি তাকে। রিক্তার মৃত্যুর পরে ওর ব্যবহার করা সিমকার্ড ওর মা ব্যবহার করতেন।
– আপনিই ওর আইডিতে লগইন করেছেন।
– রাজনীতিবিদ মানুষ আমি, সবকিছুর একটা গভীর চিন্তা থাকে। আমার দলের একটা ছেলে আছে খুব বিশ্বস্ত। সে বললো যে একটা রিস্ক নিয়ে দেখা যায়। মানুষের সিমকার্ড দিয়ে নাকি তার ফেসবুক আইডি নিয়ন্ত্রণে আনা যায়। যদি সেই সিম দিয়ে আইডি চালু করা হয়। আর আমি তো ভালো করে জানি রিক্তা ওর জীবনে মাত্র একটাই সিম ব্যবহার করেছে। তাই আমার দলের সেই ছেলেটার সাহায্যে আমি রিক্তার আইডিতে গেলাম। কারণ সেখানে হয়তো কিছু না কিছু পাবো সেই বিশ্বাস আমার ছিল। হয়তো তোমার কাছে, নয়তো তার নিজের কোনো কাছের বন্ধুর সঙ্গে নিশ্চয়ই হতাশার কথা শেয়ার করেছে।
এবার আমার গলা শুকিয়ে গেল। রিক্তার মৃত্যুর আগে সত্যি সত্যি আমার সঙ্গে ঝামেলা হচ্ছিল। তবে সেটা রিক্তার এক বন্ধুকে নিয়ে।
রিক্তার বাবা বলেন,
– আমার মেয়ে আমার কাছে অনেক কিছু। আমি ভেবেছিলাম সেই ছোটবেলায় বারবার ভুল করে আবার আমার সামনে আসতো। আর এক হাতে কান ধরে অন্য হাতে নাক ধরে বলবে, ” বাবা এবারের মতো ক্ষমা করে দাও। ” যখন এসেছে তখন আমি তাকে কাছে টেনে নিতে পারিনি।
আমি চুপ করে মাথা নিচু করে বসে রইলাম।
তিনি আবার বললেন,
– এতটাই যখন অসহ্য লেগেছিল তাহলে আমাকে একটিবার বলতে। আমি গিয়ে আমার মেয়েকে নিয়ে আসতাম। তোমার বিশ্বাসঘাতকতার আঘাতে আমার মেয়ে কষ্ট পেত, আমি তাকে নিজ হাতে খাইয়ে দিতাম। রাতে নিজে নাহয় ঘুম পারিয়ে দিতাম তবুও আমার কাছে তো থাকতো।
হঠাৎ বাড়ির ভেতর একটা বাইকের শব্দ শুনতে পেলাম। মনে হচ্ছে কেউ একজন বাইক নিয়ে বাড়ির ভিতরে এসেছে।
একটু পরেই বাদল এসে বললো,
– চাচা একটু সমস্যা হয়ে গেছে।
– কে এসেছে?
– বোরহান দাদুর নাতি, সাজু ভাই এসেছে।
– কিহহ, সাজু এ অসময়ে কেন আসবে? তাকে কে খবর দিয়েছে?
.
কি ছিল মেসেঞ্জারে?
কীভাবে মৃত্যু হলো রিক্তার?
সবকিছুর জন্য কি তার স্বামী দায়ী?
.
.
.
~ চলবে…
#গল্প আজ রিক্তার মৃত্যুবার্ষিকী।
#পর্ব এক (০১)
লেখাঃ-
মোঃ সাইফুল ইসলাম (সজীব)
আজ রিক্তার মৃত্যুবার্ষিকি
পর্ব ২
‘ সাজু ভাই ‘ নামটা আমি রিক্তার মুখে অনেকবার শুনেছি। রিক্তা বলতো সাজু নামের একটা ছেলে আছে তাদের এলাকায়। যিনি সবসময় রহস্যের গন্ধ শুঁকে দেশের প্রতিপ্রান্তে ঘুরে বেড়ান৷ এমনকি ঢাকা থাকতে সে একবার এই লোকটার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল।
বাদল বললো,
– কে খবর দিছে জানি না, আমাকে বললো বাদল চাচি আম্মা কোথায়?
বাদল আরো কিছু বলতে চাচ্ছিল কিন্তু রিক্তার বাবার হাতের ইশারায় চুপ করে রইল। পরক্ষণেই তার পিছনে সাজু ভাই এসে দাঁড়ানোর শব্দ পেল। বাদল বুঝতে পারলো সাজুকে দেখেই তাকে কথা বলতে নিষেধ করা হয়েছে।
সাজু ভাই এসে বললো,
– চাচা আসসালামু আলাইকুম, কেমন আছেন?
– ওয়া আলাইকুমুস সালাম, আমি ভালো আছি। তোমার কি খবর, হঠাৎ এই অসময়ে?
– চাচির জন্য আসলাম, চাচি আমাকে অনেকবার কল দিছিল।
রিক্তার বাবার ভ্রু কুচকে গেল। তিনি এ পলক বাদলের দিকে তাকিয়ে আবার সাজু ভাইয়ের দিকে দৃষ্টি রেখে বললেন,
– তোমার চাচি কল করেছে অনেকবার?
– হ্যাঁ চাচা, আমি আবার এশার নামাজের সময় মোবাইল মিউট করে তারপর মসজিদে গেছিলাম। কিন্তু নামাজ পড়ে বের হয়ে মোবাইলে আর হাত দেওয়া হয় নাই। বাজারের মধ্যে কতক্ষণ ঘুরলাম, তারপর বাজার থেকে বাড়িতে গেলাম, ডিনার শেষ করে দাদুর কাছে বসলাম। তারপর যখন বাবার কাছে কল দেবো তখন মোবাইল বের করে দেখি চাচির এতগুলো কল।
একদমে কথাগুলো শেষ করে একটু থামলো সাজু ভাই। রিক্তার বাবা বললেন,
– তারপর তোমার চাচি কি বললেন?
– চাচির সঙ্গে তো কথা হয় নাই যে চাচি আমাকে কিছু বলবে। আসলে এতগুলো কল দেখে আমি তো অবাক হয়ে গেছি। ভাবলাম বিশেষ জরুরি কিছু কথা নিশ্চয়ই আছে নাহলে চাচি আম্মা তো এতবার কল দিবে না। কারণ চাচি একবার কল দিলেই আমি রিসিভ করতে না পারলেও পরে অবশ্যই কলব্যাক করি।
সাজু ভাই আর রিক্তার বাবার কথোপকথন চলছে। আমি শুধু সাজু নামের লোকটার দিকে তাকিয়ে আছি। এই লোকটাকে অছিলা করে আল্লাহ হয়তো আমাকে বাঁচিয়ে দিতে পারেন। আর সাজু ভাইকে আমার শাশুড়ী কল দিয়েছে সেটা শুনেই বুঝতে পরলাম যে আমাকে বাঁচানোর জন্যই তিনি হয়তো সাজু ভাইকে ডেকেছে।
সাজু ভাই আবার বললেন,
– ভাবলাম সরাসরি বাড়িতেই চলে আসি। তাছাড়া বিকেলে শুনলাম রিক্তার হাসবেন্ড এসেছে তাই তার সঙ্গেও একটু দেখা করে যাবো।
রিক্তার বাবা বেশ গম্ভীর হয়ে গেলেন। তবে হাত দিয়ে আমার দিকে ইঙ্গিত দিয়ে বললেন,
– এর নাম সাজু, আমি চেয়ারম্যান হবার আগে ওর দাদুই আমাদের এলাকার চেয়ারম্যান ছিলেন।
আর সাজু, এই হচ্ছে আমাদের রিক্তার স্বামী শেখ সাব্বির।
সাজু ভাই আমার দিকে তার হাতটা বাড়িয়ে দিল। আমি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম। তার হাতে হাত রেখে তাকিয়ে রইলাম।
সাজু ভাই বললেন,
– আশা করি ভালো আছেন, রিক্তার মৃত্যুর চার বছর পর এলেন। দেখে ভালো লাগছে।
আমি বললাম,
– আপনি কেমন আছেন?
– জ্বি আলহামদুলিল্লাহ। আপনার কি জরুরি কোন কাজ আছে? যদি না তাহলে আমার সঙ্গে যেতে পারেন। চাচি আম্মার সাথে কথা শেষ করে আমি একটু নদীর পাড়ে যাবো।
আমি বেশ উত্তেজিত হয়ে বললাম,
– না না কোনো কাজ নেই, আপনার সঙ্গে কথা বলতে পেরে অনেক ভালো লাগছে। তাছাড়া সেই বিকেল থেকে একা একা বসে আছি, কারো সঙ্গে গল্প করার মতো সুযোগ হচ্ছিল না।
রিক্তার বাবা বিরক্ত হয়ে বললেন,
– এখন এই রাতে নদীর পাড়ে কেন সাজু? কালকে সকালে এসে তারপর নাহয় নিয়ে যাবে। সাব্বির এখন বিশ্রাম করুক।
আমি বললাম,
– আব্বা আমার কোনো সমস্যা নেই। আপনি চিন্তা করবেন না। তাছাড়া শহরে বসে আমি তো রাত তিনটার আগে কখনো ঘুমাইনা।
– এটা শহর নয় গ্রাম। কখন কোন অঘটন ঘটে যায় বলা যায় না। আমরা রাজনীতির সাথে জড়িয়ে মানুষ। চারিদিকে আমাদের শত্রুর অভাব নেই।
– মাঝে মাঝে দুরের শত্রুর চেয়ে নিজেদের মধ্যে কিন্তু শত্রু কম থাকে না আব্বা। তাই শত্রুর ভয় করে আরে কি হবে, মৃত্যু কপালে থাকলে কেউ তো আটকাতে পারবে না তাই না?
আমার কথা শুনে রিক্তার বাবা আমার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। তখন আমার মনে হলো হয়তো একটু বেশি বলে ফেলেছি। সাজু ভাই বললেন,
– ভাই আপনি বসুন আমি বরং চাচি আম্মার সঙ্গে কথা বলে আসি। কেন ডাকলেন সেটা শুনে আসি।
বাদল পিছন থেকে বললো,
– চাচিমা ঘুমিয়ে গেছে। সন্ধ্যা থেকে তার শরীরটা খারাপ তাই সকাল সকাল ঘুমিয়ে গেছে।
– কি বলো, তাহলে তো দেখতেই হয়। চলো আমার সঙ্গে, আমি ডাকলে উঠবে সমস্যা নেই।
– আহ সাজু, কেন রাতদুপুরে এরকম করছো বলো তো? একজন অসুস্থ তাকে ডেকে কথা বলতে চাইছো। আরেকজন ক্লান্ত তাকে নিয়ে নদীর পাড়ে যেতে চাইছো, কি ব্যাপার বলো তো।
– কোনো ব্যাপার নেই, আপনি রাগ করছেন চাচা?
– না না রাগ করবো কেন? এমনিতেই নিজের ছেলের মতো করে বললাম।
– তাহলে ছেলেকে তার মায়ের সঙ্গে দেখা করতে দিতে চাইছেন না কেন?
বাদল বললো,
– সাজু ভাই চলেন আমার সঙ্গে। চাচা আপনি কি চা খাবেন আরেক কাপ?
– নাহ।
সাজু ভাই ও বাদল চলে গেল। আমিও ভিতরে যাবার জন্য পা বাড়ালাম। রিক্তার বাবা বললো,
– বাবা তুমি বসো, সাজু তোমার শাশুড়ীর সঙ্গে কথা বলে আসুক তারপর যেও একসঙ্গে।
আমি আবার বসলাম। সাজু ভাই কাছারি ঘর পেরিয়ে বাড়ির ভিতর চলে গেলেন। আমি মাথা নিচু করে বসে রইলাম। নিজের বুকের ভেতর ধুকপুক শব্দ নিজেই শুনতে পাচ্ছি।
আমার শশুর বললো,
– বেশি দেরি করবে না। তাড়াতাড়ি ফিরে আসবে। সাজু ছাড়া অন্য কেউ হলে কিছুতেই তোমাকে যেতে দিতাম না। সাজু খুব ভালো একটা ছেলে, ওর অনুরোধ যে কেউ রাখতে চায়। তাছাড়া আমি যখন চেয়ারম্যান হলাম তখন সাজুর দাদা বোরহান কাকা আমাকে সাহায্য করেছেন। তিনি না হলে আমি কোনদিনই পরপর দুবার চেয়ারম্যান হতে পারতাম না।
ভাবলাম আমার কিছু বলা দরকার।
বললাম,
– এখন বর্তমান চেয়ারম্যান কে? আপনি এবার নির্বাচন করেন নি?
– করেছিলাম কিন্তু হেরে গেছি। স্বতন্ত্র প্রার্থী ছিল আরেকজন, তার কারণেই হেরে গেছি। আচ্ছা তোমার শাশুড়ী কি তোমাকে কিছু বলেছে?
– কোন বিষয়?
– না কিছু না। আচ্ছা এবার বলো তো আলফাজ নামের যে ছেলেটাকে নিয়ে তোমার আর রিক্তার মধ্যে ঝামেলা সৃষ্টি হয়েছিল। সেই আলফাজ কে? তোমার বন্ধু নিশ্চয়ই, কিন্তু কেমন বন্ধু?
আমি খানিকটা নড়েচড়ে বসলাম। আলফাজের কথা উঠে এসেছে, তারমানে রিক্তার বাবা অনেক কিছু জেনে ফেলেছে।
– আব্বা আলফাজ সাহেব রিক্তার বান্ধবী সুরমা নামের একটা মেয়ের বড়ভাই।
– খুলনার খালিশপুরের সেই মেয়েটা?
– জ্বি বাবা।
– তার সঙ্গে তোমার বন্ধুত্ব কীভাবে হলো? তুমি কি তাকে আগে থেকে চিনতে নাকি?
– না চিনতাম না না। তার সঙ্গে আমার সেরকম কোনো সম্পর্ক ছিল না। রিক্তাই তার সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিছিল।
– সেটা কি তোমরা নাটোর থেকে ঢাকা আসার পর না আগে?
– ঢাকা আসার পর।
↓
↓
” স্যার ”
ডায়েরির পাতা থেকে দৃষ্টি উঠালেন মাহবুব আলম। পরপর দুবারের নির্বাচিত সাবেক চেয়ারম্যান মোঃ জুলফিকার মৃধার একমাত্র মেয়ের হাসবেন্ড সাব্বির শেখের খুনের তদন্ত মাহবুব আলমের উপর।
দারোগা মাহবুব আলম বললেন,
– কি হয়েছে রমজান?
– সাজু এসেছে, আপনার সঙ্গে দেখা করতে।
– আজ কতো তারিখ রমজান?
– ২৩ অক্টোবর, কেন স্যার?
– তারমানে চেয়ারম্যান সাহেবের মেয়ের হাসবেন্ড এই ডায়েরি লিখেছেন যেই রাতে সে মারা গেছে সেই রাতেই।
– মারা গেছে নাকি ওই চেয়ারম্যান খুন করেছে?
– এখন পর্যন্ত যতটুকু লেখা পড়লাম তাতে তো চেয়ারম্যানের উপরই সন্দেহ আছে।
– তাহলে স্যার আমাদের সন্দেহ ঠিক আছে।
– কিন্তু আমার তো মাথা এলোমেলো হয়ে গেছে।
– কেন স্যার?
– বোরহান সাহেবকে চিনো না তুমি?
– জ্বি স্যার চিনি তো।
– ওনার নাতি সাজু সেই রাতে চেয়ারম্যানের বাড়িতে গিয়েছিল। তাহলে তারপরও কীভাবে ছেলেটাকে খুন করলো সে?
– স্যার চলেন সাজুর সঙ্গে কথা বলেন।
মাহবুব আলম সাজুকে প্রথম যে প্রশ্নটা করলো সেটা হচ্ছে,
” আপনার সঙ্গে সেই রাতে চেয়ারম্যানের মেয়ের হাসবেন্ড সাব্বির কিছু বলেছিল? কেউ তাকে মারতে চায় বা এরকম কিছু বলেছে? ”
– না তো, কেন কি হয়েছে?
– আপনাকে একটা ডায়েরির কথা বলেছিলাম না? যেটা সাব্বির যে ঘরে খুন হয়েছে সেই ঘরের মধ্যে আমরা পেয়েছিলাম।
– হ্যাঁ মনে আছে, পড়েছেন আপনি?
– হ্যাঁ পড়লাম, সেখানে সাব্বির লিখেছে তার শশুর তাকে খুন করতে চায়। আর সে পালানোর জন্য পথ খুঁজে বেড়াচ্ছে।
– সেটা কীভাবে সম্ভব? আমি তো সেই রাতে তাকে আমার সঙ্গে আমার বাড়িতে যাবার জন্য বারবার অনুরোধ করলাম। কিন্তু সে রাজি হচ্ছিল না। সে ইচ্ছে করেই চাচার বাড়িতে চলে গেলে। যদি সেরকম কিছু হতো তাহলে আমি আমার সঙ্গে যাবার প্রস্তাব দেবার পরও কেন গেল না?
– বুঝতে পারছি না।
– সাব্বিরের সাহেবের লাশের ছবিগুলো একটু আরেকবার দেখান তো আমাকে।
– আরেকটা কথা সাজু সাহেব।
– জ্বি স্যার বলেন।
– নদীর পাড়ে যাবার আগে চেয়ারম্যান সাহেবের স্ত্রীর সঙ্গে যখন কথা বলতে গেলেন তখন তিনি কিছু বলেছেন?
– না তো।
– আশ্চর্য, তিনিও বলেন নাই যে সাব্বিরকে খুন করার ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে।
– না বলে নাই, কেন চাঁচি কি জানতো নাকি।
– আপনার চাচির সঙ্গে কথা বলতে হবে। মহিলার মধ্যে নিশ্চয়ই কিছু একটা আছে।
~
~
নিশ্চিত মৃত্যুর কথা জেনেও সাজুর সঙ্গে তার বাসায় না গিয়ে সাব্বির রিক্তার বাড়িতেই কেন গেল? কি কারণে?
.
~ চলবে…
লেখাঃ-
মোঃ সাইফুল ইসলাম (সজীব)
আজ রিক্তার মৃত্যুবার্ষিকি পর্ব তিন ৩
– আপনি মিথ্যা বলছেন না তো সাজু সাহেব?
– আশ্চর্য! আমি কেন মিথ্যা বলবো? আপনার কেন মনে হয় যে আমি আপনার সঙ্গে মিথ্যা বলছি।
মাহবুব আলম খানিকটা হাসার চেষ্টা করলেন। তারপর আস্তে আস্তে বললেন,
– সাজু সাহেব, রিক্তার হাসবেন্ড সাব্বির খুন হয়েছে গতরাতের আগের রাতে। সম্ভবত শেষ রাতের দিকে হতে পারে। গতকাল সকাল নয়টার দিকে তার লাশ আবিষ্কার করে চেয়ারম্যানের স্ত্রী। আমরা চেয়ারম্যানের বাড়িতে গেলাম সাড়ে এগারোটার দিকে। কিন্তু আপনার এলাকার ঘটনায় আপনিই গেলেন না এটা আশ্চর্য নয়?
– হ্যাঁ অবশ্যই আশ্চর্য।
– আপনি গতকাল সারাদিনের মধ্যে কিন্তু খবর নেননি। অথচ আমি যতটুকু জানি যে এরকম ঘটনা ঘটলে আপনি সবার আগে উপস্থাপন হোন।
সাজু ভাই বললেন,
– আপনার উত্তরগুলো আমি দেবো। তবে সেটা সেই রাতে চেয়ারম্যান বাড়িতে যাবার পর থেকে যা যা ঘটেছে সব বলবো। এখন আপনি আমাকে বলুন আপনারা রিক্তার বাবাকে খুনি ভাবছেন কেন আমি তো সেটাই বুঝতে পারছি না।
দারোগা মাহবুব আলম বললেন,
– আমি এখন পর্যন্ত সাব্বিরের লেখা যতটুকু পড়ে শেষ করেছি তাতে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে চেয়ারম্যান খুন করেছে বা করিয়াছে। এখন কাকে দিয়ে করিয়েছে সেটাই আসল বিষয়।
– কিন্তু কেন মনে হচ্ছে? ডায়েরিতে লেখা আছে, সেজন্য?
– হ্যাঁ, আমার মনে হয় সাব্বির নিজের মৃত্যুর কথা নিশ্চিত বুঝতে পেরেছিল। সেজন্য ঘটমান সবকিছু সে লিপিবদ্ধ করে গেছে। এবং খুব সুন্দর করে গল্প বা উপন্যাসের মতো সাজিয়ে লিখেছে।
সাজু একটু বিরক্ত হলো। মাথা মোটা দারোগার কথার যুক্তি তাকে হতাশ করেছে। একটা মানুষ নিজের মৃত্যুর কথা জেনে সে কীভাবে সাজিয়ে সাজিয়ে নিজের প্রেম, বিয়ে সংসারের কথা লিখতে বসবে। মানুষটা তো তখন নিজের জীবন বাঁচানোর চেষ্টা করবে। এটা তো ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি নয় যে কোনকিছু করবে না। যদি সেরকম কিছু হতো তাহলে হয়তো আসামি বলতো যে আমি মরার আগে কিছু কথা লিখতে চাই, এটাই আমার শেষ ইচ্ছে। তাহলে হয়তো সেই আসামি সুন্দর করে নিজের মনের আবেগ লিখতে পারে।
কিন্তু সাব্বিরের তো সেরকম করার কথা নয়। তার কাছে মোবাইল ছিল, সে যে কাউকে কল করে সাহায্য চাইতে পারতো৷ ডায়েরি লিখে সময় নষ্ট না করে সে অন্য উপায় খুঁজতো।
সাজু বললো,
– আর কি কি লেখা আছে ডায়েরিতে?
– আর তেমন কিছু নাই। ঘটনার রাত্রে আপনি সেই বাড়িতে যাবার পরে সাব্বিরকে নদীর পাড়ে যাবার প্রস্তাব করেন। তারপর রিক্তার মায়ের সঙ্গে কথা বলতে ভিতরে চলে যান৷ সেখান থেকে ফিরে দুজন মিলে নদীর দিকে রওনা দেন, এতটুকুই লেখা আছে।
– তাহলে চলুন গ্রামের দিকে যাই। যাবার সময় আমি বাকিটা বলবো আপনাকে। সেই থেকে শুরু করে এখন আপনার কাছে আসার আগ পর্যন্ত সব বলবো।
– সত্যিটা বলবেন তো, নাকি…
– মানে?
– না কিছু না, আসলে পুলিশের মন তো। সন্দেহের তালিকা বিশাল বড়।
সাজু স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। তাকেও সন্দেহ করছে পুলিশ, কিন্তু কেন? সেই রাতে চেয়ারম্যান বাড়িতে যাবার জন্য, নাকি রিক্তার হাসবেন্ডকে সঙ্গে নিয়ে বের হবার জন্য।
সাজু তার বাইক নিয়েই এসেছে। দারোগা মাহবুব আলমকে পিছনে বসিয়ে গ্রামের দিকে রওনা দিল সাজু ভাই। আর চলতে চলতে দারোগার সঙ্গে বলতে লাগলো,
আমি ভিতরে গিয়ে দেখি চাচি বসে আছে। বাদল বলেছিল চাচি আম্মা ঘুমাচ্ছে। আমি বাদলের কথা আর না তুলে সরাসরি চাচিকে বললাম,
– চাচিআম্মা আপনি অনেকবার কল করেছিলেন। কি হয়েছে? আমি তো জরুরী ভেবে সরাসরি বাড়ির ভিতর এলাম।
– চাচি বারবার বাদলের দিকে তাকালেন। আমি বাদলকে চাচির ঘর থেকে বের হতে বললাম।
বাদল বের হয়ে গেল, কিন্তু চাচি এবং আমি উভয়ই বুঝতে পারলাম বাদলের দুটো কান আমাদের এদিকেই পাতানো আছে।
– বলেন চাচি।
– না তেমন কিছু না বাবা, রিক্তার জামাই সেই দুপুরের আগে আসলো। সারাদিন একা একা বসে আছে। শহরের মানুষ তো তাই হয়তো ভালো লাগে না ওর। তুমি যেহেতু গ্রামের বাড়িতে তাই ভাবলাম যদি একটু সঙ্গে করে বাজারের দিকে যেতে।
– ওহ্! আসলে চাচিআম্মা নামাজ পড়ে মোবাইল আর চেক করা হয়নি।
– ঠিক আছে বাবা, এতো রাতে আবার শুধু শুধু কষ্ট করে এলে।
– সমস্যা নেই, চাচি আমি একটু রিক্তার জামাইকে নিয়ে বাইরে যাচ্ছি।
– এতো রাতে?
– সমস্যা নেই চাচি তাছাড়া আজ অক্টোবর মাসের ২১ তারিখ। এখনো শীত তেমন বেশি পড়া শুরু হয়নি।
চাচির সঙ্গে কথা শেষ করে আমি রিক্তার হাসবেন্ড সাব্বিরকে নিয়ে বের হলাম। নদীর পাড়ে দুজন একসঙ্গে বসলাম, সাব্বির বললো,
– ভাই আপনি বিয়ে করেন নাই?
– বললাম, করেছিলাম কিন্তু ডিভোর্স হয়ে গেছে। কেন বলেন তো, হঠাৎ এরকম প্রশ্ন?
– না তেমন কিছু না। এতো রাতে আমাকে নিয়ে ঘুরতে এলেন। বাসায় ভাবি থাকলে তো এরকম বের হতে পারতেন না।
– কেন, রিক্তাকে বিয়ে করার পড়ে আপনার কি সেরকম অবস্থা হয়েছিল নাকি।
সাব্বির তখন হাসার চেষ্টা করলো৷ আমি কিছু না বলে তার উত্তরের অপেক্ষা করলাম।
মাহবুব আলম বললেন,
– তখন কি তার মধ্যে কোনো চিন্তার ছাপ ছিল? কোনকিছু নিয়ে মানুষ টেনশন করলে যেরকম মনে হয় তেমন কিছু।
– নাহ তা তো মনে হয়নি। তবে একটা সেখানে অবাক করা একটা ঘটনা ঘটেছিল।
– কি ঘটনা?
– বাদল আর মোতালেব ভাইকে আমরা দেখেছি সেখানে। দুরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছে। সিগারেটের আগুন কিন্তু বহুদুর থেকে দেখা যায়। আমরা তখন সেখানে গেলাম। প্রথমে তারা একটু লুকানোর চেষ্টা করে। কিন্তু পরে ঠিকই দেখে ফেলি আমরা।
– কেন গেল তারা, জিজ্ঞেস করেন নাই?
– করেছিলাম।
– তারপর।
– বললো চেয়ারম্যান চাচা নাকি পাঠিয়েছে। তার কোনো শত্রু যদি আক্রমণ করে তাই ওরা দুর থেকে আমাদের পাহারা দিচ্ছে।
– সাব্বির তাদের পারিবারিক সমস্যার কোনো কথা শেয়ার করেছে?
– নাহ সেরকম কিছু বলেনি। আচ্ছা স্যার, সাব্বিরের লাশটা কোথায়? মর্গে নাকি।
– সেটা তো বাগেরহাট পোস্টমর্টেম করার জন্য গতকাল পাঠানো হয়েছে। লাশ কোথায় দাফন হবে কিছু জানেন নাকি?
– নাহ, আমি তো খুলনা থেকে সরাসরি আপনার সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। গ্রামের কারো সঙ্গে এখনো দেখা হয়নি আমার।
– গতকাল কোথায় ছিলেন বললেন না তো৷
– খুলনাতে ছিলাম। পরশু রাতে চেয়ারম্যান বাড়িতে সাব্বিরকে রেখে আমি দ্রুত বাড়িতে যাই। কাছে দাদি কল করে বলেছিলেন দাদার শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। আমি সাব্বিরকে বারবার অনুরোধ করলাম আমার সঙ্গে যাবার জন্য কিন্তু সে রাজি হলো না। তাই তাকে বাড়ির সামনে ছেড়ে দিয়ে আমি আমাদের বাড়িতে চলে যাই। বাজারের ডাক্তার হারুন আঙ্কেলকে গিয়ে নিয়ে আসলাম। তিনি সবকিছু দেখে দ্রুত হাসপাতালে নিতে বলেন। তাই বাইকে রেখে আমাদের গাড়ি নিয়েই বের হলাম।
দারোগা মাহবুব আলম এবং সাজু ভাই চেয়ারম্যান বাড়ির সামনে এসে থামলো। বাড়িতে প্রচুর ভিড় এবং সোরগোল চলছে। আগে দুবার চেয়ারম্যান থাকার কারণে এখনো এটা চেয়ারম্যান বাড়ি হিসেবে পরিচিত।
বাড়ির ভিতর প্রবেশ করে ভিড় এবং সোরগোলের কারণ জানা গেল। সাব্বিরের মা এসেছে, ছেলের মৃত্যুর খবর শুনে তিনি নাটোর থেকে এসেছেন। তার আগমনকে কেন্দ্র করে পাড়াপ্রতিবেশির ভিড় জমেছে।
রিক্তার বাবা বাড়ির উঠোনে বড় চেয়ার পেতে বসে আছেন। তার পাশে কিছু বয়স্ক লোকজন। সাজু কাছে যেতেই রিক্তার বাবা বললেন,
– সাজু একটা পরামর্শ দে তো।
– কি চাচা?
– আমি চাই রিক্তার কবরের পাশে জামাইরে কবর দিতে। বিষয়টা কেমন হবে, ভালো হবে না?
সাজুর আগেই দারোগা মাহবুব আলম বললেন,
– হঠাৎ এরকম সিদ্ধান্ত কেন বলেন তো। নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার জন্য নাকি।
– কি বলছেন দারোগা?
– সরি চেয়ারম্যান সাহেব, আপনার বাড়িতে কাজ করে বাদল কোথায়? ওকে ডাকেন তো।
– কেন বাদলকে কেন ডাকবো।
– কাজ আছে আমার।
– সে নাই, বাজারে গেছে।
– আসবে তো, নাকি হারিয়ে যাবে।
– আপনার মোবাইলটা দিন তো!
– কেন?
– হ্যাঁ দিন, আর সেই সাথে আপনার মেয়ে মৃত্যুর আগে যে ফেসবুক আইডি ব্যবহার করতো সেটা ওপেন করে দিন।
– আমার মেয়ের পারসোনাল আইডি আপনার কাছে কেন দেবো বলেন তো।
– কারণ বিষয়টার সঙ্গে আপনার মেয়ের হাসবেন্ডের হত্যাকান্ড জড়িত।
চেয়ারম্যান সাহেব মোবাইল এগিয়ে দিলেন। সিনথিয়া আক্তার রিক্তা নামের যে আইডি আছে সেখানে সাব্বিরের কোনো মেসেজ নেই। সবগুলো মেসেজ একসঙ্গে রিমুভ করা হয়েছে।
– কোনো মেসেজ নেই কেন? আপনার মেয়ে ও তার হাসবেন্ডের মেসেজ গুলো দরকার আমার।
সাজু সাহেব, আপনি কিছু বলেন। তিনি আইডি থেকে সব মেসেজ ডিলিট করে দিয়েছে কেন।
সাজু বললো,
– চাচা কেন করেছেন বলেন।
রিক্তার বাবা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন,
– আমি করিনি সাজু, তোর চাচি আম্মা ডিলিট করেছে গতকাল রাতে।
ঘরের ভিতর থেকে মহিলারা সবাই একসঙ্গে চেচিয়ে উঠলো। সাজু দৌড়ে ঘরের ভেতরে চলে গেল।
সবার চেচামেচির কারণ হচ্ছে, রিক্তার মা নিজের ঘরে শাড়ি গলায় ফাঁস দিয়ে মরার চেষ্টা করছিল। সেটা দেখেই চিৎকার করে। পুরনো আমলের কাঠের দরজা হওয়ায় দরজা ভেঙ্গে এযাত্রা রক্ষা করলো সবাই।
সাজু রিক্তার মায়ের সামনে গিয়ে বললো,
– চাচি কি হয়েছে, পাগলামি করছেন কেন? বাড়ি ভর্তি মানুষের সামনে এসব কি চাচি আম্মা?
~
– চলবে…
লেখাঃ-
মোঃ সাইফুল ইসলাম (সজীব)
আজ রিক্তার মৃত্যুবার্ষিকি পর্ব ৪
সাজুকে জড়িয়ে ধরে রিক্তার মা হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো। ঘরভর্তি মানুষে গিজগিজ করছে। সাজুর পিছনে দাঁড়িয়ে আছে মাহবুব আলম। প্রতিবেশী সব মহিলারা শুধু ভিড় তরেই সন্তুষ্ট নয়, সবাই কানাকানি আর ফিসফিসে শব্দে ঘরটার ভেতর হৈচৈ পড়ে গেল।
দারোগা মাহবুব আলম উপস্থিত সকল মহিলাদের ঘর খালি করার নির্দেশ দিলেন।
– কি ব্যাপার এতো মানুষ কেন এখানে? এভাবে ভিড় করার তো কোনো ঘটনা ঘটেনি। এভাবে সবাই একসঙ্গে দলা পাকিয়ে একটা বিপদ করবেন বলে মনে হচ্ছে। বের হন.. বের হন..!
দারোগার কথা শুনে ঘর সম্পুর্ণ খালি হবার তেমন কোনো লক্ষন দেখা গেল না। দু একজন যারা বের হয়ে গেল তারা মূলত পাড়ার লজ্জাবতী গৃহিণী কিংবা অল্পবয়সী মেয়ে। রিক্তার মা তখনও সমানে কাঁদছে, তার হাতটা ধরে মাথাটা নিজের শরীরে মিশিয়ে রাখলেন সাজু ভাই।
– আরে কি মুশকিল, আপনারা কথা শুনতে পান না নাকি? এখন তো মনে হচ্ছে লাঠিপেটা করে বের করতে হবে। কি অদ্ভুত পাবলিক রে বাবা।
এবারের ধমকে বেশ কিছু মহিলা বের হয়ে গেল। তবে সম্পুর্ন খালি হলো না কারণ সাজু ভাই সেই মুহূর্তে রিক্তার মা’কে বললো,
– চাচী কি হয়েছে? এতবড় একটা ঘটনা ঘটলো আর আপনি এভাবে ফাঁস নিলেন কেন?
রিক্তার মায়ের কান্না বাড়তে লাগলো। তার কান্না দেখে বিরক্ত হলো দারোগা মাহবুব। আর সাজুর প্রশ্নের উত্তর রিক্তার মায়ের মুখ থেকে শোনার জন্য উৎসুক হয়ে আছে অন্যান্য মহিলারাও।
– বলেন চাচী, কি হয়েছে আপনার? আপনি কি রিক্তার স্বামীর মৃত্যুর কিছু জানেন? আমাকে সব বলেন, আমি আছি আপনার ছেলে। আপনারা কোনো বিপদে পড়েন এরকম কিছু আমি কখনো হতে দিবো না ইন শা আল্লাহ।
– আমি কিছু জানি না সাজু, বিশ্বাস কর বাপ আমি জানতাম না এভাবে কিছু হবে।
দারোগা মাহবুব আলম বললেন,
– তাহলে আপনি আপনার মেয়ের হাসবেন্ডকে রাতে খাবার শেষে সতর্ক করেছিলেন কীভাবে? কীভাবে বলেছিলেন বাড়ির পিছনের বাগান দিয়ে পালিয়ে যেতে।
ঘরের ভেতরে আবারও গুঞ্জন উঠে গেল। দারোগা আবারও ধমক দিলেন সবাইকে। কোর্টে জর্জ সাহেব যেভাবে সবাইকে চুপ করতে বলেন ঠিক সেভাবেই চলছে দারোগার কাজকর্ম।
– চাচী বলেন।
অভয় দিয়ে জিজ্ঞেস করলো সাজু৷
মাহবুব আলম বললেন,
– আপনার স্বামী সেদিন আপনার মেয়ের হাসবেন্ড সাব্বিরকে খুন করতে চাইছে আপনি কীভাবে জানলেন।
সাজু ভাই মাহমুবের দিকে তাকিয়ে বললো,
– স্যার প্লিজ, চাচীকে তার নিজের মতো করে বলতে দিন প্লিজ। এমনিতেই বাড়িসুদ্ধ মানুষের জন্য তিনি নার্ভাস হয়ে গেছে।
– কেন, নার্ভাস কেন হবে? নিজে যদি কোনো দোষ না করে তাহলে নার্ভাস হবার প্রশ্নই ওঠে না।
রিক্তার মা বললো,
– জামাইকে খেতে দিয়ে আমি কাছারি ঘরে যাই তোর চাচাকে ডাকার জন্য। ভেবেছিলাম একসঙ্গে খেতে দেবো তাদের। তখন বিদ্যুৎ ছিল না, আমি যে দরজার সামনে গেছি সেটা বাদল আর তোর চাচা কেউই দেখেনি।
– তারপর? তারপর কি হলো সেখানে? আপনি কি তাদের মধ্যে খারাপ কিছু বলতে শুনেছেন।
– তোর চাচার আগে থেকেই রিক্তার স্বামীর প্রতি রাগ ছিল। তিনি কিন্তু কোনদিন চাইতেন না রিক্তার স্বামী এ বাড়িতে আসুক। এমনকি রিক্তা যখন চট্টগ্রাম থেকে ফেরার পথে এক্সিডেন্ট করে মারা গেল। তখনও জামাইকে আসতে দেয়নি তোর চাচা।
ঘর প্রায় নিস্তব্ধ হয়ে গেছে। দারোগা সাহেব নিজেও তাকিয়ে আছে মনোযোগ দিয়ে শোনার জন্য। সাজু কিছু না বলে চুপ করে অপেক্ষা করতে লাগলো। রিক্তার মা আবার বললেন,
– চট্টগ্রামের হাসপাতাল থেকে রিক্তার লাশ নিয়ে আসার সময় তোর চাচা সাব্বিরকে বারবার বলে দেন যেন আমাদের বাড়িতে কখনো না আসে।
দারোগা মাহবুব আলম বললেন,
– আপনার মেয়ে কীভাবে মারা গেছে বললেন?
– এক্সিডেন্ট করে, বিয়ের পরে ওর যখন ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হয়ে গেল তখন রিক্তা একটা চাকরি নিয়েছিল। সেই চাকরির জন্যই রিক্তা চট্টগ্রামে গেছিল। সেখান থেকে ফেরার পথে এক্সিডেন্ট করেছিল ওরা।
– সাজু বললো, ওই প্রসঙ্গ পরে আসবো চাচী। আপনি সেই রাতের ঘটনা বলেন।
– কিছুদিন আগে তোর চাচা হঠাৎ আমাকে বলেন যে রিক্তার স্বামীকে এবার ওর মৃত্যুবার্ষিকীতে আসতে বলবেন। আমি সন্দেহের সঙ্গে তোর চাচার কাছে বললাম ” হঠাৎ এমন সিদ্ধান্ত নিলেন কেন। ”
তোর চাচা বললো, ছেলেটার তো কোনো দোষ নেই। আসুক নাহয়, একবার দেখে যাক।
– আপনার সঙ্গে কি রিক্তার স্বামীর সবসময় কথা হতো চাচী?
– হ্যাঁ হতো, সাব্বির নিজেই দু একদিন পরপর কল দিত আমাকে। তোর চাচা কোনদিন কথা বলেনি, তাই আমাকে বললেন আমি যেন সাব্বিরকে রিক্তার এবারের মৃত্যুবার্ষিকিতে আসতে বলি। আমিও ভাবলাম যে মানুষের রাগ তো চিরকাল থাকে না৷ তাই সাব্বিরকে বললাম যে তোমার শ্বশুর তোমাকে আসতে বলছেন। সাব্বির অনেক খুশি হয়ে গেছিল। তারপর বললো ” আম্মা আমি তো চাকরি করি। যেদিন রিক্তার মৃত্যুবাষিকী সেদিন তাহলে আসবো। ”
আমি তোর চাচার কাছে বললাম, তিনি বললেন ঠিক আছে আসুক কোনো সমস্যা নেই। তারপর আর কি, সাব্বির আসলো সেদিন।
মাহবুব আলম বললেন,
– এতো বিস্তারিত বলতে হবে না। এগুলো যখন আদালতে যাবেন তখন বলবেন। আপনি রাতে আপনার স্বামীকে ডাকতে গিয়ে কি শুনেছেন? যখন বিদ্যুৎ ছিল না।
– উনি আর বাদল জামাইকে নিয়েই কথা বলছিল। তাদের কথাবার্তা শুনে আমি ভয় পেলাম। আমার মনে হচ্ছিল সাব্বিরকে ওনারা মেরে ফেলবে।
– কেন মনে হচ্ছিল আপনার?
– কারণ তোর চাচা বারবার বলছিল যে ছেলেটার জন্যই আমার মেয়ে মারা গেছে। ওর সঙ্গে ঝগড়া করে আমার মেয়ে চট্টগ্রামে গেছে। চট্টগ্রামে যাবার জন্য আমার মেয়ের সঙ্গে অনেক খারাপ ব্যবহার করছে। আমার মেয়ের মৃত্যুর জন্য ও-ই দায়ী। বাদল তখন বলে, চাচা তাহলে ওরে জনমের শিক্ষা দিয়ে দেবো? সেটা শুনে তোর চাচা কিছু বলে নাই।
– আর কিছু বলে নাই?
– জানি না, কারণ আমি তখন কাছারি ঘরের সামনে থেকে চলে আসি।
– তাহলে সাব্বিরকে কেন বললেন যে আপনার স্বামী তাকে খুন করতে চায়। মেয়ের হত্যার জন্য প্রতিশোধ নিতে চায় সেটা কেন বলেছেন। যদি সেরকম কিছু না হয়ে থাকে তাহলে কেন শুধু শুধু এরকম কথা বলবেন।
– ভয় দেখানোর জন্য! আমি ভেবেছিলাম যদি মারধর করে কিংবা কিছু করে। তাই একটু আগ বাড়িয়ে বেশি বলে ফেলেছিলাম যেন তাড়াতাড়ি চলে যায়।
মাহবুব আলম হতাশ হয়ে গেলেন। তবে কতটুকু বিশ্বাস করলেন সেটা বোঝা গেল না। মনে মনে বললেন, মহিলা মানুষের এতো প্যাঁচ কেন আল্লাহ। কিসের মধ্যে কি হয়ে গেছে বুঝলাম না।
রিক্তার মা বললেন,
– পরশু রাতে তুই রিক্তার স্বামীকে নিয়ে বাহিরে যাবার পরে তোর চাচা আমার কাছে এসে আমাকে বকাবকি করে।
– কেন?
– সাব্বির নাকি কাছারি ঘরে বসে তোর চাচাকে জিজ্ঞেস করছে ” আব্বা আপনি কি আমাকে খুন করতে চান? যদি খুন করার ইচ্ছে থাকে তাহলে আমাকে বলেন। শুধু শুধু নিজে কেন মারবেন। ”
তারপর তোর চাচা তো অবাক হয়ে গেছে। তখন সাব্বিরকে জিজ্ঞেস করার পড়ে সাব্বির বলছে যে আমি বলেছি তিনি ওকে খুন করবে। তাই তুই সাব্বিরকে নিয়ে যাবার পরে তোর চাচা আমার কাছে এসে জিজ্ঞেস করছে। অনেক বকাবকি করলো সাজু৷ বললো যে ” রাগারাগি করতে পারি তাই বলে কি জামাইকে খুন করবো? ” এরকম বেআক্কল মার্কা কথা কেন বললাম।
সাজু ভাই বললো,
– তারপরই আপনি রিক্তার স্বামীর কাছে আবার কল করেছিলেন তাই না? তাকে বলেছিলেন যে আপনার শুনতে ভুল হয়েছে। সে যেন নির্ভয়ে বাড়ি যায় তাই তো।
– হ্যাঁ, তাই বলছিলাম আমি। তারপর তো তুই ওকে বাড়ির সামনে দিয়ে চলে গেলি। আমি সাব্বিরের জন্য বিছানা ঠিকঠাক করে দিয়ে গেলাম। সাব্বির রুমের দরজা বন্ধ করে দিল।
মাহবুব আলম বললেন,
– রাতে কতক্ষণ পর্যন্ত তার রুমের বাতি জ্বালিয়ে রেখেছিল বলতে পারেন? সাজু সাহেব, আপনি তো জানেন সাব্বির ডায়েরি লিখেছিল। সুতরাং সে তো অবশ্যই অনেক রাত পর্যন্ত জেগে তারপর ডায়েরি লিখেছে।
আচ্ছা সকাল বেলা সবার আগে সাব্বিরের লাশটা কে দেখেছে? আপনি নাকি অন্য কেউ।
– আমিই দেখেছিলাম। সকালে ডাকতে এসে দেখি দরজা খোলা বিছানায় সাব্বিরের লাশ পড়ে আছে। বুকের উপর রক্তে সব লাল হয়ে আছে। আমি চিৎকার করে রিক্তার বাপ রিক্তার বাপ বলে ডাকাডাকি শুরু করি।
সাজু কিছু বললো না, শুধু সবগুলো কথা ভাবতে লাগলো। যদি রিক্তার মায়ের কথা সত্যি হয়ে থাকে তাহলে ঘরে ঢুকে পিস্তল দিয়ে গুলি করবে কে? গুলির শব্দ পেল না কেউ, তারমানে কি খুনির পিস্তলে সাইলেন্সর লাগানো ছিল। কিন্তু যদি খুনি এসে থাকে তাহলে দরজা খুলে দিল কে? আর সাব্বির কি সত্যি সত্যি এতকিছুর পরও থাকবে।
সাজু বললো,
– আমার সঙ্গে যখন নদীর পাড়ে গেছিল তখন কি শুধু আপনিই কলে কথা বলেছিলেন। নাকি চাচাও কিছু বলেছিল তাকে।
– তোর চাচাও কথা বলেছিল।
দারোগা মাহবুব আলম বললেন,
– কেন বলেছেন? আদর করে বাড়িতে এনে রাতে গুলি করে মারার জন্য নাকি? আচ্ছা বলেন তো খুনটা করেছে কে, আপনি নাকি আপনার স্বামী।
” এরা কেউ আমার ছেলেকে খুন করেনি অফিসার সাহেব। আমার ছেলেকে খুন করেছে ঢাকার কিছু লোক। ”
দরজার সামনে থেকে আসলো কথাগুলো। সাজু ভাই, মাহবুবসহ সবাই তাকিয়ে রইল দরজার সামনে। দরকার সামনে ভেজা চোখে সাব্বিরের মা দাঁড়িয়ে আছে। তার পিছনে দাঁড়িয়ে আছে একটা ছেলে।
সাজু বললো,
– আপনিই কি সাব্বির সাহেবের মা?
– জ্বি। আর এই হচ্ছে সাব্বিরের সবচেয়ে কাছের বন্ধু ইলিয়াস, ওর কাছেই সাব্বিরের মৃত্যুর খবর পেয়েছি। আমি নাটোরে বসেই জানতে পেরেছি আমার ছেলেকে খুন করা হয়েছে।
সাজু বললো,
– আপনি কীভাবে জানলেন যে আপনার ছেলেকে এখানকার কেউ খুন করেনি।
– আমি সাব্বিরকে বারবার বলেছিলাম যা হবার হয়ে গেছে সব ভুলে যা। ওর বউ মারা গেছে সে তো আর আসবে না। তাহলে তার খুনিদের পিছনে লেগে থেকে লাভ কি?
মাহবুব আলম বিস্ময় নিয়ে বললেন,
– রিক্তাকে খুন করা হয়েছিল?
– হ্যাঁ। রিক্তা এক্সিডেন্টে মারা যায়নি। জোর করে এক্সিডেন্টের মাধ্যমে তাকে খুন করা হয়েছে।
~
~
~ চলবে…?
লেখা:-
মোঃ সাইফুল ইসলাম (সজীব)
আজ রিক্তার মৃত্যুবার্ষিকি পর্ব পাঁচ ৫
রিক্তার শাশুড়ির কথা সম্পুর্ণ পরিবেশ পরিবর্তন করে দিল। ঘটনার কতটুকু সত্য আর কতটুকু মিথ্যা সেটা পরের বিবেচ্য বিষয় হলেও কথাগুলো মাথার মধ্যে গেঁথে গেল সবার।
সাজু বললো,
– কে মেরেছে রিক্তাকে? আর সেই খুনির ক্ষমতা এতটা বেশি কীভাবে হলো যে তিনি এই গ্রামের মধ্যে এসে সাব্বিরকে খুন করেছে।
মাহবুব আলম বললেন,
– আমরা আপনার ছেলের একটা ডায়েরি পেয়েছি। সেখানে তিনি এরকম কিছু লিখে যাননি। সেরকম কিছুর আশংকা থাকলে আপনার ছেলে অবশ্যই সেটা লিখে যেতেন।
– হয়তো সুযোগ পায়নি। তাছাড়া সাব্বির আমার কাছে যখন কল করেছিল তখন কেঁদে কেঁদে বলছিল ও নাকি সুইসাইড করবে।
– কেন? সুইসাইড করার কথা কেন বলছিল? আর আপনি তখন কিছু বলেন নাই কেন।
– রাত তিনটার দিকে আমাকে সাব্বির কল করে। আমার ছেলে এ বাড়িতে এসেছে আমি জানতাম না। সাব্বির কল করে যখন বললো ” মা আমি যদি আত্মহত্যা করি তাহলে কি তুমি কষ্ট পাবে? ” তখন ওর কথা শুনে আমার ঘুম কেটে যায়। আমি তখন বললাম, কিসব পাগলের মতো কথা বলিস। সাব্বির তখন বলে, মা আজ আমি রিক্তাদের বাড়িতে এসেছি। এখন যদি এখানে মারা যাই তাহলে ওরা আমাকে রিক্তার কবরের কাছে কবর দিবে। এভাবে পালিয়ে আর কতদিন থাকবো। একদিন তো ঠিকই ওরা খুঁজে বের করে মারবে।
সাজু বললো,
– কারা মারবে? আর কাদের জন্য সাব্বির পালিয়ে থাকতো?
– বউমার বান্ধবীর বান্ধবীর বড়ভাই।
সাব্বিরের বন্ধু ইলিয়াসের দিকে তাকিয়ে মহিলা বললেন,
– ছেলেটার নাম কি ছিল যেন?
– আলফাজ। আলফাজের ছোটবোন ভাবির বান্ধবী ছিল। ভাবি খুলনা থেকে পালিয়ে যাবার সময় প্রথম তাকে দেখেছিল।
– তিনি ঢাকায় কী করতেন?
– ঠিক নাই, জাল টাকার ব্যবসা, বিভিন্ন স্থানে জুয়ার আসর বসানো, মাদকদ্রব্য বিক্রি ইত্যাদি।
তার পরিবার থেকে এসব জানতো কিনা জানি না। আমি এসব সাব্বিরের কাছে শুনেছি। সাব্বির যখন নাটোর থেকে ঢাকায় আসে তখন ওদের দুজনের চলতে খানিকটা অসুবিধা হয়ে যেত। পরীক্ষা শেষ হবার আগেই ভাবি তার সেই বান্ধবীর সাহায্যে আলফাজের মাধ্যমে একটা ছোট জবের ব্যবস্থা করে। ভাবি চাইলে তার বাড়ি থেকে টাকা নিতে পারতো কিন্তু আত্মসম্মানের দিক থেকে কেউ সেটা চায়নি। তবে চাকরির ব্যবস্থা করার সুবাদে আলফাজের সঙ্গে সাব্বির ও ভাবির একটা আলাদা পরিচয় সৃষ্টি হয়। সম্ভবত সাব্বির কিছুটা বুঝতে পেরেছিল যে আলফাজের মনের মধ্যে কিছু একটা খারাপ উদ্দেশ্য আছে। সাব্বির সেটা নিয়ে ভাবির সঙ্গে কথা বলে কিন্তু ভাবি গুরুত্ব না দিয়ে উল্টো রিয়্যাক্ট করেন। সাব্বির তখন আমাকে বলতো আর আফসোস করতো। আমি বলতাম যে ভাবি যদি সাবধানে থাকে তাহলে তো কোনো সমস্যা নেই। ঢাকা শহরে ভালো খারাপের অনেক মানুষ আছে, তাই নিজেকে নিজের মতো রক্ষা করতে হবে।
তবুও বাসায় মাঝে মাঝে সাব্বিরের সঙ্গে ভাবির ঝগড়া হতো। তারপরই ভাবির পরীক্ষা শুরু হয়। সাব্বির আর কোনো কথা বলে না, রাগারাগি করে না কারণ পরীক্ষা খারাপ হতে পারে।
পরীক্ষা শেষ করে ভাবি তার পার্ট টাইম জবটা ফুল টাইম হিসেবে শুরু করে। এরিমধ্যে একদিন সাব্বির একটা রেস্টুরেন্ট থেকে ভাবির বান্ধবী, ভাবি আর আলফাজকে বের হতে দেখেন। সেদিন নাকি আলফাজের জন্মদিন ছিল।
সেই রাতে সাব্বির আর ভাবির সঙ্গে সারারাত ঝগড়া চলে। সাব্বির দুটো চড় মেরেছিল ভাবিকে৷ পরদিন সকাল বেলা ভাবি রাগ করে তার বান্ধবীর বাসায় চলে যায়। আমি এসব কিছুই জানতাম না। ঘটনার চারদিন পরে সাব্বির আমার কাছে টাকা চায়। আমাকে বলে চট্টগ্রামে যাবে তাই টাকার দরকার। আমি কারণ জিজ্ঞেস করতেই সাব্বির সবকিছু খুলে বলে।
ভাবি নাকি চাকরির কাজে চট্টগ্রামে গেছে। তাদের মধ্যে চারদিন আগে বাসায় যা কিছু হয়েছে সবকিছু খুলে বলে আমাকে। আমি সাব্বিরকে বকাবকি করি তারপর সাব্বির টাকা নিয়ে আমার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে যায়।
এরপর সাব্বিরের সঙ্গে আমার যখন কথা হয় তখন ভাবি মারা গেছে। চট্টগ্রাম যে হোটেলে তিনি ছিলেন সেই হোটেল থেকে বের হয়ে দামপাড়া বাসস্ট্যান্ডে যাবার সময় সিএনজি এক্সিডেন্ট করে ভাবি৷ সাব্বির তখনও জানতো না ওর স্ত্রীর মৃত্যুতে আলফাজের হাত আছে।
সাজু বললো,
– সাব্বির কীভাবে জানলো? সাব্বির তো তখন চট্টগ্রামে থাকার কথা। নাকি তখনও ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে যায়নি।
– সাব্বির চট্টগ্রামেই ছিল। হাসপাতালে ভাবির লাশ নিয়ে দৌড়ঝাঁপ করলো৷ ভাবির বাবা ভাবির লাশ নিয়ে এলেন, সাব্বিরকে তার গ্রামের বাড়িতে আসার জন্য বারবার নিষেধ করলেন।
রিক্তার বাবা কখন এসে সবার পিছনে দাঁড়িয়ে ছিলো কেউ বুঝতে পারেনি। সবার খেয়াল ছিল সাব্বিরের বন্ধু ইলিয়াসের দিকে।
রিক্তার বাবা পিছন থেকে কান্না জড়িত কণ্ঠে বললেন, এজন্য আমার মেয়ের সঙ্গে ওর অমন মেসেজ দেখেছিলাম। আমার মেয়ে বারবার বলছিল সে খারাপ কিছু করছে না। আর ছেলেটার মধ্যে খারাপ কিন্তু দেখছে না। কিন্তু জামাই ওকে বারবার ভুল বুঝতো আর কতো কথা বলতো। আহারে আমার কলিজার টুকরো মেয়ে।
জুলফিকার মৃধা সেখানে কাঁদতে লাগলো। গ্রামের মানুষজন এক অসহায় বাবার মেয়ে হারানোর অনুভূতি দেখতে পেল। যে মানুষটা এলাকার চেয়ারম্যান হিসেবে দশটা বছর পার করলো সেই মানুষটা আজ কেমন কান্না করছে।
সাজু বললো,
– সাব্বির কীভাবে জানলো যে আলফাজ রিক্তাকে এক্সিডেন্ট করে মেরেছে। যেহেতু এক্সিডেন্ট ছিল তাই এসব তো জানার কথা নয় তাই না।
– সাব্বির তখনও খুনের বিষয় জানতো না। কিন্তু আলফাজের জন্যই যত সমস্যা হয়েছিল তাই সাব্বির তাকেই অপরাধের জন্য দায়ী করতো। ঢাকায় ফিরে সাব্বিরের একটাই কাজ ছিল আর সেটা হচ্ছে আলফাজের মৃত্যু। আমি সবসময় সাব্বিরকে বোঝাতাম যে এসবের পিছনে গিয়ে নিজের জীবন নষ্ট করিস না। কিন্তু সাব্বির আর কিছুতেই কারো কথা শুনতো না। গ্রামের বাড়িতে গিয়ে জমিজমা কিছু বিক্রি করে আসে। যেহেতু ওর বাবা ছিল না তাই নিজের জমি বিক্রি করতে পেরেছিল। আমার কাছে ওর মা জানতে চায় যে সাব্বির জমি বিক্রি করবে কেন। তখন আমি সব তাকে খুলে বললাম। আন্টি নিজেও বোঝাতে শুরু করে কিন্তু কাজ হয় না।
অবশেষে একদিন অনেক মালামালসহ আলফাজ পুলিশের কাছে ধরা পড়ে। সাব্বিরই কাজটা করেছিল। আর তখন আলফাজের এক সহকারীর কাছে জানতে পারে যে আলফাজই ভাবিকে খুন করেছে। আলফাজের ওই সহকারীকে সাব্বির মেরে ফেলে৷
– কিহ, সাব্বির খুন করে?
– হ্যাঁ। তবে আলফাজের তো উপরের মাথা আছে তাই দশদিনের মধ্যে জেল থেকে বের হয়। আর সাব্বিরের কথা জানতে পারে। সাব্বির যে তার একটা সহকারীকে খুন করেছে সেটাও জেনে যায় আলফাজ৷ তারপর থেকেই সাব্বিরকে মারার জন্য খুঁজে বেড়াচ্ছিল আলফাজ। সাব্বির পালিয়ে থাকতো সবসময়, তবে সেও সুযোগ খুজতো আলফাজকে শেষ করার। আর এভাবে পালিয়ে পালিয়ে আর নিজের জেদের কারণে এতদূর এসে যায়। সেদিন ভাবির মা সাব্বিরকে কল দিয়ে রিক্তা ভাবির চতুর্থ মৃত্যুবার্ষিকীতে ডাকার পরে সাব্বির আমার কাছে বলে। আমি বললাম যে সাবধানে গিয়ে ঘুরে আয় তাহলে।
গতকাল সকালে আমি আমাদের আরেকটা বন্ধুর কাছে জানতে পারি সাব্বির ওর শশুর বাড়িতে মারা গেছে। আলফাজের কাছেই নাকি জানতে পেরেছে সাব্বিরকে তারা মেরে ফেলেছে। তারপর আমি সাব্বিরের মাকে সবকিছু কল দিয়ে বললাম। আন্টি নাটোর থেকে ঢাকায় এলো। এরপর আমি তাকে নিয়ে এখানে এসেছি।
– রিক্তাকে আলফাজ কেন মেরেছে সেটা জানেন না কিছু? মানে সাব্বির জানতে পারে নাই?
– নাহ। সেই কারণটা শুধু আলফাজই বলতে পারবে। আপনারা আলফাজকে যেভাবেই হোক গ্রেফতার করুন। লোকটা খুব খারাপ, দেশের মধ্যে মাদকদ্রব্য ছড়িয়ে দেওয়া, নকল টাকার ব্যবসা করা ইত্যাদি অনেক কিছু বন্ধ হবে।
↓
রাত ৮ঃ৪৯ pm.
তিনটা লোক নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে। ঠিক দুদিন আগে এখানেই সাজুর সঙ্গে ঘুরতে এসেছিল সাব্বির। যারা এখন দাঁড়িয়ে আছে তাদের মধ্যে একজন শুধু এই গ্রামের আর বাকি দুজন ঢাকার।
রিক্তার কবরের পাশে সাব্বির লাশ দাফন করা হয়েছে আসরের নামাজের পড়ে। সাজু সন্ধ্যা বেলা চলে গেছে খুলনায়, তার দাদার শরীর তেমন একটা ভালো নয়। সাব্বিরের মা এবং ইলিয়াস চেয়ারম্যান বাড়িতেই আছে।
শহুরে দুজনের একজন আবারও মোবাইলের স্ক্রিনে সময় দেখলো। সামনের ইটের পাকা রাস্তায় কেউ একজন মোবাইলের বাতি জ্বালিয়ে এগিয়ে আসছে। লোকটা কাছাকাছি আসতেই শহুরে দুজনের একজন বললো,
– কিরে ভাই, এতক্ষণ লাগে আসতে?
– ভাই আপনিও এসেছেন এখানে?
– কেন কি ভেবেছিলে ইলিয়াস ভাই? তোমার বন্ধুকে খুন করেছি বলে তুমি পুলিশের কাছে সাক্ষী দিবে আর আমি জানতে পারবো না।
– ভা ভাই আমি তো আমার নিজের উপর থেকে সন্দেহ ওঠার জন্য বলছি। যদি ওরা জানতে পারে যে…
– কি? যদি সবাই জানতে পারে তুমি সাব্বিরকে সেই রাতে কল দিয়ে দরজা খুলতে বলছো। তুমি দরজা খুলতে বলছো বলে সাব্বির অনায়াসে দরজা খুলে দিয়েছে। আমি ঘরে ঢুকে সাব্বিরকে মেরেছি। তাহলে তোমার বিপদ হবে তাই তো।
– হ্যাঁ ভাই, আলফাজ ভাই আপনি কিন্তু আমাকে বলেছিলেন যে আমার সব রকমের নিরাপত্তা আপনি দিবেন।
– কিন্তু তুমি তো পুলিশের কাছে সবকিছু বলে দিয়েছ ইলিয়াস। তোমাকে বাঁচিয়ে রাখলে আমার আরো কতো বিপদ হবে কে জানে৷ যে মানুষ তার নিজের বন্ধুর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে আমাকে খুন করতে সাহায্য করে। সেই তুমি আমার সঙ্গেও বেঈমানী করবে জানতাম। কিন্তু এতো তাড়াতাড়ি করবে জানতাম না। পুলিশের কাছে সব বলে দিলে।
তিনজনের মধ্যে গ্রামের যে লোকটা আছে সে বললো,
– ভাই তাড়াতাড়ি মারেন। রাস্তা থেকে ইট নিয়ে নৌকায় রাখছি৷ মারার পরে লাশের সঙ্গে ইট বেঁধে নদীতে ফেলে দেবো। আর কোনদিন কেউ এর লাশ খুঁজে পাবে না।
.
.
চলবে…
লেখা:-
মোঃ সাইফুল ইসলাম (সজীব)
আজ রিক্তার মৃত্যুবার্ষিকি পর্ব ৬ সমাপ্ত
চারিদিক থেকে কমপক্ষে ১৫-২০ টা টর্চ লাইট একসঙ্গে জ্বলে উঠলো। আলফাজ ও তার সঙ্গে থাকা লোকটা কিছু বুঝে ওঠার আগেই গ্রামের লোকটা তার হাতের বৈঠা দিয়ে আলফাজকে আঘাত করলো। ইলিয়াস নিজেও দাঁড়িয়ে না থেকে পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী আঘাত করে শহরের দ্বিতীয় লোকটাকে। আর কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে চারিদিক থেকে এগিয়ে আসে টর্চ জ্বালানো সকল পুলিশ সদস্যের দল। আলফাজ ও তার সঙ্গীকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেন পুলিশ। যতটা বিপদের সম্মুখীন হবার আশঙ্কা ছিল, তার কিছুই কষ্ট করতে হয়ে দারোগা মাহবুব আলমকে।
আলফাজ ও তার সঙ্গে গ্রামের যে লোকটা ছিল তার নাম মান্নান মোল্লা। তিনি পেশায় একজন ইজিবাইক চালক। তিনিসহ চারজনকেই গ্রেফতার করা হয়েছে। আলফাজ ও তার সঙ্গী তো আগে থেকে আছে, খুনির সহযোগী হিসেবে ইলিয়াস ও মান্নান মোল্লাকেও পুলিশ আটক করেছে।
↓
↓
সাজু ভাই ও রিক্তার বাবা জুলফিকার মৃধা থানায় দারোগা মাহবুব আলমের সামনে বসে আছে।
রিক্তার বাবা বললো,
– কীভাবে কি করলেন বলেন তো?
– মাহবুব আলম বললেন, আমিও তো সবকিছু জানতাম না। এখনো পুরোপুরি জানি না। যা কিছু জিজ্ঞেস করার সেটা সাজুকে করতে হবে।
– সাজু তুই বল তো কীভাবে এদের ধরলি?
– সাজু বললো, তেমন কিছু না চাচা। সব চোখের সামনেই ছিল, শুধু হিসাব মিলিয়ে একসঙ্গে জড়ো করলাম।
– সেটা কি?
– চাচা শুনুন তাহলে, রিক্তার স্বামী যে রাতে খুন হয়েছে সেই রাতের শেষ দিকে কিন্তু দাদু অসুস্থ হয়েছিল। আমি যখন বাইক নিয়ে ডাক্তার হারুন আঙ্কেলকে আনার জন্য তাদের বাড়িতে যাচ্ছি তখন দেখেছিলাম মান্নান মোল্লা তার ইজিবাইকে করে তিনজন যাত্রী নিয়ে গ্রামের ভিতরে যাচ্ছে। মাঝরাতে অনেকেই যেতে পারে এটা স্বাভাবিক। তাছাড়া দাদুর অসুস্থতার জন্য দুনিয়ার কোনো চিন্তা তখন মাথার মধ্যে ছিল না। রিক্তার স্বামীর উপর যে কোনো বিপদ আসবে সেরকম কোনো তথ্যও তো জানতাম না যে সন্দেহ করবো। তবে ভাবলাম যে পরবর্তীতে মান্নান মোল্লাকে জিজ্ঞেস করে দেখবো অতো রাতে কাকে নিয়ে এসেছিল। কিন্তু সেই সুযোগ আর হচ্ছিল না।
গতকাল সাব্বিরের বন্ধু ইলিয়াস যখন বললো যে, আলফাজ এসে খুন করেছে। তখনই আমার মাথায় ইলিয়াসও ঢুকে গেল।
কারণ হচ্ছে দুটো।
প্রথমত, সাব্বির তার লেখা ডায়েরি লিখে শেষ করতে পারেনি। সুতরাং সেখানে বোঝা যায় যে তাকে কেউ বাহির থেকে ডেকেছে। তাই সে ভিতর থেকে দরজা খুলে বের হয়েছে এবং খুনি ঘরের ভেতর প্রবেশ করে তাকে খুন করেছে। আর সেই রাতে সাব্বির নিজ থেকে দরজা খুলে দেবার মানে হচ্ছে বাহিরের আগন্তুক সাব্বিরের পরিচিত। তাই নিজে নিজে হিসাব করলাম যদি আলফাজ খুন করে তাহলে নিশ্চয়ই তার সঙ্গে এমন কেউ ছিল যিনি সাব্বিরের বিশ্বস্ত। যার ডাকে সাব্বির খুব সহজেই দরজা খুলে দিবে। আর সাব্বির শ্বশুর বাড়িতে এসেছে এটা সে ইলিয়াসকে বলে এসেছে। সেটা তো গতকালই ইলিয়াস বললো যে তাকে গ্রামের বাড়িতে আসার কথা জানিয়েছে। অতএব আলফাজ এখানে সাব্বিরের বন্ধু ইলিয়াসকে ব্যবহার করছে সেটা বোঝা যাচ্ছিল।
দ্বিতীয়ত, আমি ঢাকার এক বড়ভাইকে দিয়ে সাব্বিরের সেই রাতের মোবাইলের কললিস্ট চেক করেছিলাম। সেখানে দেখা গেছে সেই রাতে একটা নাম্বারের সঙ্গে দিনে এবং রাতেও বেশ কিছু সময় কথা হয়েছে। আর ওই নাম্বারটা যে ইলিয়াসের সেটাও চেক করে বের করলাম।
এটা তো গেল সন্দেহ করার কারণ।
সাব্বিরের লাশ নিয়ে যখন লাশবাহী গাড়ি গ্রামের মধ্যে আসে তখন মান্নান মোল্লাকে আমি চাচার বাড়িতে দেখতে পাই। তখনই চাচার বাড়িতে কাজ করা বাদলকে দিয়ে মান্নানকে আলাদা ঘরে নেবার ব্যবস্থা করলাম। তারপর মান্নানকে ভালো করে জিজ্ঞেস করলাম। ভয় দেখালাম, কারণ গ্রামের সহজসরল ইজিবাইক চালক ভয়ে সত্যি কথা বলে দিবে এটা জানতাম। আমি মান্নানকে বললাম,
– তুমি তো নিশ্চয়ই ইলিয়াসকে দেখেছো। চাচার মেয়ে জামাইয়ের বন্ধু, সেদিন রাতে তিনজনের মধ্যে সেও ছিল কিনা বলো। যদি সত্যি কথা বলো তাহলে তোমার ভালো হবে। আর যদি সে নাহয় তাহলে কে ছিল সেই যাত্রী তাদের নামে বলো। এতো রাতে নিশ্চয়ই দুরের কেউ ছিল না, যদি থাকে তাহলে কার বাড়িতে গেছে।
প্রথমে স্বীকার না করলেও পরে অবশ্য সবকিছু মান্নান স্বীকার করে।
মান্নান বলে,
– আমাকে টাকা দিয়েছে তারা। আবার পিস্তল দিয়ে মেরে ফেলার ভয় দেখিয়েছে। আমি বাধ্য হয়ে তাদের নিয়ে আসছি সাজু ভাই। নদীর পাড়ে দুজন নেমে গেছিল আর একজন আমার ইজিবাইকে পিস্তল নিয়ে বসে ছিল। আমি গাড়িটা নদীর পাড়ে একটু আড়ালে থামিয়ে রাখি। আপনি যখন আপনাদের গাড়িতে করে আপনার দাদুকে নিয়ে গেছেন তখন সব দেখেছি৷ কিন্তু আমরা আড়ালে থাকার জন্য আপনি দেখতে পাননি।
প্রায় ঘন্টা খানিক পরে ওই দুজন এসেছিল তারপর আবার তাদের বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছে দিছিলাম। আমাকে বলছিল কাউকে যেন না বলি তাহলে মেরে ফেলবে। টাকার লোভে আর নিজের জীবন বাঁচাতে কাউকে কিছু বলিনি।
মান্নানের সব কথা শুনে আমি বুঝতে পারছিলাম যে ইজিবাইক থেকে সম্ভবত আলফাজ ও ইলিয়াস এরাই নেমেছিল। মান্নান আবার বললো যে সেই বাকি দুজন নাকি গ্রামের মধ্যে আছে। মান্নানকে নাকি কল করেছিল।
মান্নানকে বললাম, যেভাবেই হোক তাদের পুলিশে দিতে হবে। তাই আমাদের যেন সহযোগিতা করে। নাহলে যে ওর অনেক বিপদ হবে সেটাও বুঝিয়ে দিলাম। মান্নান বুঝতে পেরেছিল যে একবার যেহেতু খুনিদের সাহায্য করেছে তাই বারবার মনে সাহায্য করতে হবে। তাই মান্নান আমাকে সাহায্য করার জন্য রাজি হয়ে গেল। আমি মান্নানকে বললাম যে ওদে কল দিয়ে বলো ইলিয়াস সবকিছু পুলিশকে বলে দিয়েছে। মান্নান সেটাই করলো, আর সব শুনে আলফাজ ইলিয়াসকে মারার সিদ্ধান্ত নিল।
বাড়িতে তখন সাব্বিরের লাশের দাফনের ব্যবস্থা করার আয়োজন চলছিল। আমি সুযোগ বুঝে ইলিয়াসকে আলাদা কথা বলতে নিয়ে গেলাম। সেও মান্নানের মতো প্রথমে কিছু স্বীকার করতে চাইলো না। কিন্তু পরে যখন মান্নান এসে সামনে দাঁড়িয়ে বললো তখন আর স্বীকার করা ব্যতিত কোনো উপায় ছিল না। ইলিয়াস আমার হাত ধরে বললো,
– ভাই আমি ইচ্ছে করে করিনি। বিশ্বাস করুন নিজ থেকে এরকমটা করিনি আমি। সাব্বির যেদিন গ্রামের বাড়িতে আসে সেদিনই আলফাজ আমাকে ওর কাছে নিয়ে যায়। জানের মায়া তো সবারই থাকে তাই না? পুরান ঢাকার সেই নির্জন বাড়িতে আমাকে মেরে ফেললে কেউ আমার লাশটাও খুঁজে বের করতে পারতো না। নগদ দুই লাখ টাকা আর সঙ্গে আমার নিজের প্রাণ ফিরে পাবার জন্য রাজি হয়ে গেলাম। তারপর ওরাই আমাকে নিয়ে গ্রামের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়। বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে গাড়ি রেখে আমরা ইজিবাইকে উঠি কারণ গ্রামের মধ্যে গাড়ি নিয়ে গেলে সবাই সন্দেহ করতো।
ইজিবাইকের চালক আমাদের নদীর পাড়ে নিয়ে আসে। কারণ আপনাকে সেই রাতে দেখার পড়ে ওই চালককে আলফাজ জিজ্ঞেস করেছিল। সে বললো, বাইকে তো সাজু ভাই যাচ্ছে। আপনার পরিচয় শুনে আলফাজ ভাই বাড়ি পর্যন্ত গাড়ি নিয়ে আসতে চায় নাই। নদীর পাড়ে ইজিবাইক রেখে আমি আর আলফাজ এসেছিলাম। আমি সাব্বিরকে কল দিয়ে যখন বললাম যে আমি চলে এসেছি তখন সাব্বির অবাক হয়েছিল। কিন্তু সে সন্দেহ করে নাই কারণ আমাকে দিনের বেলা বারবার বলছিল যে গ্রামের মধ্যে একা একা ভালো লাগে না তাই তুই থাকলে ভালো হতো। আমি তাই রাতে কল দিয়ে বললাম যে দোস্ত সারপ্রাইজ দিতে চলে এসেছি।
সাব্বির নিজেই বলেছিল যে বাড়ির ভিতর দুটো বাড়ি আছে। একটা বড় পুরনো আমলের কাঠের। আরেকটা নতুন তোলা হয়েছে পাকাবাড়ি। নতুন ঘরে নাকি সাব্বির আছে আর ওর শ্বশুর শাশুড়ী পুরনো আমলের কাঠের বাড়িতে।
আমি দরজা খুলতে বললাম, সাব্বির দরজা খুলে দিল আর সঙ্গে সঙ্গে আলফাজকে দেখে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল।
আলফাজ ওর মুখ চেপে ধরে সঙ্গে সঙ্গে গুলো করে কিন্তু শব্দ হয়নি। আলফাজ সাব্বিরের পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে। আমরা দুজন দ্রুত সেখান থেকে বের হয়ে যাই। আর তখন একটা গাড়ি আসতে দেখি, সম্ভবত সেটা আপনি ছিলেন। কারণ পরে সেই ইজিবাইকের চালক বলেছিল যে বাইকের লোকটা আর এই গাড়ির লোক একই৷ আপনাদের নাকি নিজস্ব গাড়ি আছে।
আমার বাসস্ট্যান্ড গিয়ে আবারও শহরে রওনা দিলাম। তারপর দিনের বেলা সাব্বিরের মাকে কল দিয়ে বললাম সাব্বির মারা গেছে।
আন্টি নাটোর থেকে সন্ধ্যার পরে ঢাকা পৌঁছান। কিন্তু আমি তাকে ব্যস্ততার অজুহাত দিয়ে তার সঙ্গে রাত এগারোটার দিকে দেখা করি৷ তারপর সেই শেষ রাতে আবার আন্টির সঙ্গে গ্রামের বাড়িতে রওনা দেই।
আমি বললাম,
– তাহলে আপনার আলফাজদের কথা স্বীকার করলেন কেন?
– কারণ ওরা সাক্ষী হিসেবে আমাকে বেশিদিন বাঁচিয়ে রাখবে না এটা জানতাম। হয়তো সেদিনই মারতো, কিন্তু কেন মারলো না জানি না।
আমি বললাম,
– আলফাজ এখান বাগেরহাটেই আছে। আপনি আর মান্নান মোল্লা যদি সাহায্য করেন তাহলে আলফাজকে গ্রেফতার করা সম্ভব হবে।
ইলিয়াস রাজি হয়ে গেল। কারণ আলফাজের সব কথা বলে দেবার পরে আলফাজ ওকে পথের কাটা হিসেবে সরিয়ে দেবে এটা ইলিয়াস ভালো করে বুঝতে পেরেছে। তাই সে আমাকে সব ধরনের সাহায্য করতে রাজি হয়ে গেল। আমি যেহেতু এর আগেই মান্নানকে দিয়ে আলফাজের কাছে কল দিয়ে সব বলতে বলেছিলাম। তাই আলফাজ নিজেই ইলিয়াসকে কল করে এবং রাতে নদীর পাড়ে দেখা করতে বলে। আমি সাব্বিরের লাশ দাফন হবার পর দাদুকে দেখতে যাবার নাম করে বাইক নিয়ে গ্রাম থেকে বের হয়ে গেলাম। মান্নান সেই কথা আলফাজকে বলে দিল, আলফাজ তখন মান্নানকে রাতে রেডি থাকতে বললো। আর টাকার লোভ দিল পঞ্চাশ হাজার।
দারোগা মাহবুব আলমের দিকে তাকিয়ে সাজু বললো,
– আমি তখন আপনার কাছে আসলাম। তারপর তো আপনাকেই বললাম যে রাতে একটা কাজ করতে হবে বেশ কিছু লোক লাগবে। আপনিও সবাইকে প্রস্তুত করলেন। তারপর কি হয়েছে সেটা তো জানেন।
স্থান নির্বাচন করে দিছিলাম আমি। রাত সাড়ে আটটা থেকে নয়টার মধ্যে ইলিয়াসকে আসতে বলেছিলাম। আর মান্নানকে বলেছিলাম সে যেন আলফাজদের সঙ্গে থাকে।
রিক্তার বাবা বললো,
– বাহ সাজু, তুই তো ভালো বুদ্ধি জানিস।
মাহবুব আলম বললেন,
– কিন্তু সেই ডায়েরি? সেটা লেখার কারণ কি হতে পারে বলেন তো সাজু সাহেব?
– সাব্বির সম্ভবত সুইসাইড করতে চেয়েছিল। ওর মাকে তো সেটাই বলেছিল কল দিয়ে তাই না? হয়তো শ্বশুর শাশুড়ীর এরকম মনোভাবে নিজে কষ্ট পেয়েছিল বেচারা। তাই সবটা লিখে নিজের আবেগ প্রকাশের চেষ্টা করেছিলো। আলফাজ তাকে খুন না করলেও সম্ভবত আত্মহত্যা করে মারা ডেত সাব্বির।
রিক্তার বাবা বললো,
– আমার রিক্তাকে ওই ছেলে কেন মারলো?
– সেটা আদালতে জানতে পারবেন। তাছাড়া সব জিজ্ঞেস করার জন্য দারোগা স্যার তো আছেই।
থানা থেকে বিদায় নিল সাজু। বাইক নিয়ে এগিয়ে চললো খুলনার দিকে। সাজুর দাদু আগের চেয়ে মোটামুটি সুস্থ আছে।
বাগেরহাট পর্যন্ত যেতেই যোহরের আজান দিল। খানিকটা সামনে গিয়ে দশানী আর মাজার মোড় পার হয়ে ষাটগম্বুজ মসজিদের সামনে বাইক রাখলো। ষাট গম্বুজ মসজিদ থেকে যোহরের নামাজ পড়ে বের হতে প্রায় দুইটা বেজে গেল। বাইকে উঠে স্টার্ট করার আগে মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেখলো ঢাকা থেকে ডিবি অফিসার হাসান আলী তিনবার কল করেছে।
সাজু কলব্যাক করলো।
– কেমন আছেন ভাই?
– আলহামদুলিল্লাহ, তুমি কেমন আছো। তোমার সেই মামলা শেষ হয়েছে?
– শেষ হয়নি ভাই, তবে অপরাধী ধরা পড়েছে।
– একটা নতুন খবর আছে সাজু।
– কি খবর ভাই?
– আজকে রাফসান মাহমুদের আবারও কোর্টে শুনানি ছিল। ওর এক আঙ্কেল হাইকোর্টে আপিল করার পড়ে তো এতদিন পুনরায় তদন্ত চলছিল।
– ওহ্ আচ্ছা, তারপর আজ কি হয়েছে?
– আদালত ফাঁসির আদেশ বহাল রেখেছে। এবার সম্ভবত খুব তাড়াতাড়ি ফাঁসি হয়ে যাবে। আমিও মামলার সাক্ষী হিসেবে আদালতে ছিলাম। আমাকে বললো, ” সাজু ভাইকে বলবেন, মৃত্যুর আগে তার সঙ্গে একটু দেখা করতে চাই। বলবেন, সাজু ভাই যদি আমার সঙ্গে দেখা করে তাহলে আমি মেলা মেলা খুশি হবো। ”
সাজু চুপ করে রইল। হাসান আলী বললো,
– কিরে, আসবি নাকি?
– দাদু তো হাসপাতালে ভাই। হাসপাতাল থেকে বাড়িতে নিয়ে যাবার পরে যাবো। ততদিনের মধ্যে যদি ফাঁসি নাহয় তাহলে তো দেখা হবে। আর যদি হয়ে যায় তাহলে তো আর দেখা হবে না।
– ঠিক আছে, সাবধানে থেকো।
সাজু বাইক নিয়ে ছুটতে লাগলো। তাড়াতাড়ি যেতে হবে দাদুর কাছে। তিনি অপেক্ষা করে আছেন। নোয়াপাড়া মোড় পার হবার সময় ডানদিকে ঢাকার রাস্তার দিকে তাকিয়ে সাজু ভাবলো।
ঢাকায় চলে যাবো, নাকি সামনে খুলনা যাবো?
দুই মিনিট পরে সে খুলনার দিকে গেল। একজন আসামির জন্য তার মনের মধ্যে মায়া থাকতে নেই।
আসামি..! এই সমাজের সবাই কি আসামি থাকে। নাকি কিছু কিছু মানুষ সমাজের কারণে আসামি হয়ে যায়।
[ এখানেই সমাপ্ত! রিক্তার মৃত্যুর কারণ আদালত অবশ্যই বের করবে। যেহেতু আসামি গ্রেফতার করা হয়েছে। কিন্তু যাদের কাছে মনে হচ্ছে যে রিক্তার মৃত্যুর কারণ টেনে আনা উচিৎ ছিল। তাদের জন্য নিচে পরিশিষ্ট উল্লেখ করলাম। ]
পরশিষ্টঃ-
রিক্তা চট্টগ্রামে অফিসের কাজে গিয়ে হোটেলে উঠেছিল। আলফাজ নিজেও সেখানে গিয়েছিল। একটা সময় সে তার নিজের নিজের মনের মধ্যে লুকানো খারাপ উদ্দেশ্য ব্যক্ত করে। রিক্তা রাজি না হলে আলফাজ নিজের ধৈর্য হারিয়ে রিক্তাকে জোরজবরদস্তি ভাবে ক্ষতি করার চেষ্টা করে।
রিক্তা সেগুলো আলফাজের বোনের কাছে ও মায়ের কাছে বলে দেবার হুমকি দেয়। নিজের মা বোনের কাছে সবসময় ভালো মুখোশ পরে থাকা আলফাজ সেটা মানতে পারেনি। রিক্তা রাগ করে চলে আসার সময় আলফাজ ক্ষিপ্ত হয়ে এমনভাবে এক্সিডেন্টে তাকে মেরেছে যেন কেউ বুঝতে না পারে।
পরিশিষ্টাংশ উল্লেখ না করলেও ক্ষতি ছিল না।
কারণ এতে গল্পের তেমন পরিবর্তন হবে না।
তবুও যদি প্রশ্ন রাখেন তাই হালকা উল্লেখ করলাম।
—– সমাপ্ত —–
লেখা:-
মোঃ সাইফুল ইসলাম সজীব।