# এক মুঠো রোদ .
# writer :নৌশিন আহমেদ রোদেলা
# পর্ব -২৯
৫৩.
জিনুল আমিনের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গাড়িতে বসলো ওরা। রোজা-তীর্থ দু’জনের মুখই শুকিয়ে আছে। দু’জনের মনটাই ভীষন রকম খারাপ। মৃন্ময় ওদের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকায়। কুঁচকানো ভ্রু দুটো আরো খানিকটা কুঁচকে নিয়ে বলে,
— হোয়াট হ্যাপেন্ড গাইস?
তীর্থ মুখ ফুলিয়ে বলে,
— হোয়াট হ্যাপেন্ড! সেই কবে থেকে শুধু চড়কার মতো ঘুরেই যাচ্ছি তো ঘুরেই যাচ্ছি। আরিয়া আহমেদ ফয়সালকে খুঁজে বের করার জন্য বের হলাম শাইয়াম চাং কে খুঁজতে। আবার শাইয়াম চাং কে খুঁজে পাওয়ার জন্য বের হলাম তাহেরা পতামকে খুঁজতে। এই তাহেরা পতামকে খুঁজে পাওয়ার জন্য এলাম জিনুল আমিনের কাছে। আর এই এতোকিছু করে ফলাফল জিরো। এরপরও আপনি বলছেন হোয়াট হ্যাপেন্ড?
মৃন্ময় ডানচোখের ভ্রু খানিকটা উঁচু করে তাকায়। শান্ত গলায় বলে,
— জিরো কিভাবে হলো? উনি তো বললেন যে তাহেরা পতাম মাগুরছড়ায় আছেন। ওখানে গেলেই পেয়ে যাবো উনাকে।
— আর যদি না পাই?
তীর্থর প্রশ্নে বিরক্ত হয় মৃন্ময়। বিরক্ত কন্ঠে বলে,
— ধৈর্য রাখতে শিখো তীর্থ। এতো অল্পে ধৈর্য জার্নালিজম হবে না। মনে রেখো, ফলাফলটা সবসময় তোমার হাতে থাকে। তুমি যা ভাববে তোমার ফলাফলও তাই হবে। যতক্ষণ পর্যন্ত তুমি নিজে বিশ্বাস না করবে যে তুমি হেরে গেছো ততক্ষণ পর্যন্ত পৃথিবীর কোনো শক্তিই তোমায় হারাতে পারবে না। একমাত্র সৃষ্টিকর্তা ছাড়া। গট ইট?
তীর্থ মাথা ঝাঁকায়। রোজা ক্লান্ত গলায় বলে,
— এবার তাহলে সরাসরি মাগুরছড়া যাচ্ছি আমরা?
মৃন্ময় সানগ্লাসটা চোখে দিতে দিতে সামনে তাকিয়ে বলে,
— ইয়াহ্।
আলী আবারও গাড়ি ছুটায়। গাড়ি ছুটে চলে লাউয়াছড়া বনের দিকে। লাউয়াছড়া জঙ্গলের কাছেই মাগুরছড়া খাসিয়াপুঞ্জি। লাউয়াছড়ার আরেক নাম হলো “রেইন ফরেস্ট”। শ্রীমঙ্গল উপজেলা শহর থেকে ৬ কি.মি. দূরে লাউয়াছড়া বন আর শহর থেকে ৮ কি.মি. দূরে মাগুরছড়া খাসিয়াপুঞ্জি। লাউয়াছড়ার কাছাকাছি আসতেই গাড়ি থামাতে বলে মৃন্ময়। রোজা-তীর্থের দিকে তাকিয়ে বলে,
— টায়ার্ড হয়ে পড়েছেন তো। চলুন ইনভেস্টিগেশন থেকে বিরতি নিয়ে বনটা ঘুরে দেখি। অসাধারণ একটা জায়গা।
রোজা তীর্থ দুজনেই নেমে আসে। চারদিকে সবুজের সমারোহ। কতো শত অচেনা পাখির ডাক। জঙ্গলের ভেতরের দিকে হাঁটতে হাঁটতেই বলে উঠলো মৃন্ময়,
— এই বনে প্রায় ১৬৭ প্রজাতির উদ্ভিদ আছে মিস.রোজা। এছাড়া ৬৪ প্রজাতির বন্য প্রাণীও আছে।
রোজা ভয় পাওয়া চোখে তাকিয়ে বলে,
— বন্য প্রাণী!
মৃন্ময় শয়তানী হাসি দিয়ে বলে,
— হ্যাঁ। বন্য প্রাণী। হনুমান,উল্লুক এসব সামনে পড়া যাওয়াটা খুবই নরমাল। আর..
মৃন্ময়ের কথা শেষ না হতেই ভীতু গলায় বলে উঠে তীর্থ,
— বস? আমার আর টায়ার্ড ফিল হচ্ছে না। এখানে বন্যপ্রাণীর সাথে প্রেমালাপ না করে চলুন বরং মাগুরছড়াতেই যাই।
কিন্তু ততক্ষণে রোজা পগারপার। মুগ্ধ দৃষ্টিতে সবকিছুই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে সে। চাপালিশ,গর্জন,তেলসুর নামে কতো উঁচু উঁচু গাছ। রোজাকে দৌঁড়াতে দেখে হেসে এগিয়ে আসে মৃন্ময়। হাসিমুখে বলে,
— আস্তে মিস.রোজা।
রোজা খুশিতে গদগদ হয়ে বলে,
— কি সুন্দর ফুল! এসবের নাম কি?
— এগুলো বনফুল মিস রোজা।
— ওয়াও! এতো রকমের বনফুল কখনো দেখি নি আমি। তীর্থ? দেখ কি অসম্ভব সুন্দর এই ফুল।
তীর্থ এগিয়ে এসে উঁকি দেয়। ফুলটা সুন্দর লাগায় টান দিয়ে ছিঁড়তে গেলেই গাছের পাশ থেকে বেরিয়ে আসে সবুজ রঙের একটি সাপ। সাপটা দেখেই চেঁচিয়ে উঠে তীর্থ। এমনভাবে লাফিয়ে উঠে যে তার ধাক্কায় রোজার পড়া যাওয়ার অবস্থা। রোজা ধাক্কা সামলাতে না পেরে মৃন্ময়ের গায়ের উপর পড়ে। দু’হাতে মৃন্ময়ের জ্যাকেট খামচে ধরে নিজের আত্মরক্ষা করে। মৃন্ময়ও দ্রুত হাতে রোজার কোমর জড়িয়ে ধরে। সাথে সাথেই সারা শরীর কেঁপে উঠে রোজার। গলা শুকিয়ে আসে। চোখের পলক ঝাপিয়ে মৃন্ময়ের মুখের দিকে তাকায়। মৃন্ময় ঝটপট কোমর ছেড়ে খানিক দূরে দাঁড়িয়ে বলে,
— ইউ ওকে?
রোজা মাথা নাড়ে। লজ্জা আর অস্বস্তি নিয়ে আবারও ফুলের দিকে তাকায়। সাথে সাথেই শুরু হয় বর্ষন। রোজা অবাক হয়ে বলে,
— হঠাৎ করে বৃষ্টি কেন?
মৃন্ময় রোজার হাত টেনে গাড়ির দিকে দৌড়ে যেতে যেতে বলে,
— এই জন্যই এই বনের আরেক নাম “রেইন ফরেস্ট” মিস. রোজা।
গাড়ির কাছাকাছি এসে গাড়িতে না উঠে মৃন্ময়ের হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে রোজা। মৃন্ময় অবাক হয়ে বলে,
— কি হলো? ভিজে যাচ্ছি তো। গাড়িতে উঠুন।
রোজার ঠোঁটের কোনো দুষ্টহাসি ফুটে উঠে।দাঁত কেলিয়ে বলে,
— ভিজবো। গহীন বনে বৃষ্টিবিলাসের মজাই আলাদা নায়ক সাহেব। এবং আমার সাথে আপনিও ভিজবেন।
মৃন্ময় চোখ বড় বড় করে বলে,
— কখনোই না মিস.রোজা। ঠান্ডা লেগে যাবে। গাড়িতে চলুন।
— না না। প্লিজ একটু।
— মিস.রোজা! চলুন বলছি।
— ওকে ফাইন। যাবো…
কথাটা বলেই রাস্তার পাশে গাছের বড় শিকড়ে বসে পড়ে রোজা। মৃন্ময় অবাক চোখে তাকায়। রোজার এসব পাগলামোতে ভীষন রাগ লাগছে তার। দু-জনেই ভিজে রীতিমতো চুপচুপে হয়ে গেছে তারওপর রোজার এই পাগলামো! মৃন্ময় অধৈর্য গলায় বলে,
— আজব তো! বসে পড়লেন কেন?
— আপনি একটা গান শুনান। বৃষ্টির গান! গান শেষ হলে তবেই যাবো। এর আগে নয়৷ দেখুন বন,বৃষ্টি আর পাহাড়ী মাটির সংমিশ্রণে কি নেশা ধরানো বৃষ্টি! একটা গান ধরেন না প্লিজ।
মৃন্ময় অবাক হয়ে বলে,
— এই পরিস্থিতিতে গান? পাগল হয়েছেন আপনি?
রোজা গো ধরা গলায় বলে,
— পাগল হলে পাগল। আপনার কাছে দুটো অপশন আছে। এক. আমাকে রেখে গাড়িতে উঠে বসে পড়ুন। দুই. একটা কিউট গান শুনান। নাও চয়েজ ইজ ইউরস।
মৃন্ময় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে গাড়িতে ঠেস দিয়ে দাঁড়ায়। আলী আর তীর্থও জানালা দিয়ে মুখ বের করে আগ্রহ নিয়ে তাকায়। মৃন্ময় বাধ্য হয়ে গায়,
—” রিম ঝিম ঝিম বৃষ্টি…
রিম ঝিম ঝিম বৃষ্টি…
মাটির কানে কানে
কি কথা নিয়ে পড়ে ঝরে – ঝরে?
আমারও সারাদিন কিভাবে কেটে যায়?
শুধু তুমি, তুমি, তুমি তুমি করে
রিম ঝিম ঝিম বৃষ্টি।
কি করে জুঁই ফুল জলের উচ্ছ্বাস
এভাবে বুকে তার সয়ে যায়?
আমার কানাকানি তোমার মন ছুঁয়ে
কি করে জানাজানি হয়ে যায়?
হয়তো.. এরই নাম প্রথম ভালোবাসা!
কিছু জ্বালা সয় মালা পরে পরে!
আমারও সারাদিন কিভাবে কেটে যায়?
শুধু তুমি, তুমি, তুমি তুমি করে
রিম ঝিম ঝিম বৃষ্টি।
কি ভাবে, এ বাতাস… যখনই বয়ে যায়
ওমনি মনে হয় কে যেন গান গায়।
কি ভাবে, এ বাতাস… যখনই বয়ে যায়
ওমনি মনে হয় কে যেন গান গায়।
কি করে দু’টি চোখ অচেনা এত রঙ
না দেখা এতো রূপ দেখে যায়?
যা ছিলো স্বপ্নেতে মনের ভাবনাতে
সে ছবি অপলকে এঁকে যায়।
তবুও আরও সাধ, আরও কী কল্পনা
কাছে এসে এসে যায় সরে সরে।
আমারও সারাদিন কিভাবে কেটে যায়
শুধু তুমি, তুমি, তুমি তুমি করে…..”
মৃন্ময় গান শেষ করতেই সিটি বাজায় তীর্থ। মৃন্ময় কিছুটা এগিয়ে গিয়ে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলে,
— এবার উঠুন। কি হলো?উঠুন!
রোজা চোখ বড় বড় করে তাকায়। ঘোর লাগা গলায় বলে,
— আপনি সত্যিই অসম্ভব সুন্দর গান। আরেকটা প্লিজ?
মৃন্ময় এবার রাগী চোখে তাকিয়ে হুট করেই কোলে তোলে নেয় রোজাকে। রোজা হতভম্ব চোখে তাকায়। গাড়ি থেকে মুখ বের করে জোরে জোরে সিটি বাজিয়ে বলে উঠে তীর্থ,
— ওহহো! কিয়া সীন হ্যা মাম্মু! ওয়ান ক্যাপচার প্লিজ!
আলীও মুখ দিয়ে অন্যরকম এক শব্দ বের করে বলে উঠে,
— আজকের বৃষ্টি সার্থক,স্যার। মনে হইতাছে লাইভে সিনেমা দেখতাছি আপনার।কি এন্ট্রি! ওয়াহ্
ওদের কথায় কান না দিয়ে দ্রুত পায়ে গাড়ির কাছে এসে রোজাকে সিটে বসিয়ে দিয়ে নিজের সিটে গিয়ে বসে মৃন্ময়। রোজাকে উদ্দেশ্য করে রাগী গলায় বলে,
— আপনি বাচ্চা নন মিস.রোজা। আমরা এখানে কাজে এসেছি। ঠান্ডা লাগিয়ে, জ্বর বাঁধিয়ে পড়ে থাকলে আপনার সেবাই করবো নাকি ইনবেস্টিগেশন করবো? এমন হলো কালই ঢাকা ব্যাক করুন৷এমন কেয়ারলেস সহকর্মী প্রয়োজন নেই আমার।
মৃন্ময়ের এতো বকাঝকা, কড়া কথা, কিছুই যেন কানে ঢুকছে না রোজার। সে এখনো বিশ্বাসই করতে পারছে না মৃন্ময় তাকে কোলে তুলেছে! হঠাৎই ভ্রু কুঁচকে এলো রোজার। এসব ছোট খাটো বিষয় নিয়ে এতো ভাবতে বসায় নিজেই অবাক হলো সে। আশ্চর্য! কোলে নিয়েছে তো নিয়েছে তাতে এতো ভাবাভাবির কি আছে? কিন্তু মন তো আর ব্রেনের কথা শুনে না। সারা শরীরে মাখামাখি হওয়া মৃন্ময়ের উত্তাপ তো কিছুতেই কমে না! কি করবে তার রোজা?
৫৪.
গ্রামের নাম সোনাপুকুর। আরুদের গ্রামের বাড়ি। খুবই প্রত্যন্ত একটি অঞ্চল হলেও শিল্পীর আঁকা আমায়িক সুন্দর এই গ্রাম। আরুর মনে হয় আধুনিক প্রযুক্তি যেখানে যত কম সেখানের সৌন্দর্য তত বেশি। এখানে দু’চালা ঘর আছে তাদের। ঘরের সামনে বিশাল খোলা বারান্দা। একপাশে রান্না ঘর। গ্রামে একে বলে “ছেইলা”। ঘরের পেছন দিকে একটা পুকুরও আছে। লাল লাল পদ্মই ভরে আছে সেই পুকুর। পানিতে শ্যাওলা পড়ে তার রঙ হয়েছে হালকা সবুজ। আরুর মনে হয় এই পুকুরে সবুজ রঙের পানিই মানায়। স্বাভাবিক রঙের পানি এই পুকুরে খুবই অস্বাভাবিক লাগতো। খুব বেশিই অস্বাভাবিক! বাড়ির চারপাশে ইউক্যালিপটাস,সেগুন,মেহগনি গাছের ছড়াছড়ি। আরুর রুমটার জানালার পাশেই মস্ত এক শিউলিফুলের গাছ। এই বন্ধী জীবন! সেই অভিশপ্ত রাফিনের কাছ থেকে ছাড়া পেয়ে এই গ্রামটাকে যেন স্বর্গের মতো লাগছে আরুর। আবারও চোখে মুখে খুশির ঝিলিক। আগের সেই চঞ্চলতা। ভাবির সাথে মাটির চুলোয় ধোয়া উড়িয়ে রান্না করতে গিয়ে ধম ফাটা কাশিতে মত্ত হতেও বেশ লাগে তার। ভাইয়ার হাত ধরে ধুকপুক মন নিয়ে পুকুরে গোসল করতে গিয়েও তার চরম আনন্দ। কিছু দিনের ঝড়ঝাপটা সবকিছু ভুলে গিয়ে পুরো পরিবারই যেন প্রাণ ফিরে পেয়েছে আবার। সবার মনে একটাই আশা, ” আর কোনো অঘটন নয়। এবার একটু শান্তি চাই”। কিন্তু ভাগ্য কি সহায় হবে? রাফিন নামক কালো ছায়া কি এতো সহজে ভালো থাকতে দেবে তাদের? আরুর মতো মেয়েরা হয়তো জানে না রাফিন নামক কালো ছায়া কখনো পিছু ছাড়ে না। কাউকে নিঃশেষ করে দিতেই তাদের শান্তি। কারো হাসিমুখটা কালো ছায়ায় ঢেকে দেওয়াতেই তাদের প্রশান্তি। “ভালোবাসা” — খুবই সুন্দর একটি শব্দ। এর অনুভূতিগুলোও কল্পনাতীত কিন্তু ভুল মানুষকে ভালোবাসার অনুভূতিগুলো খুব বিষাক্ত। বড্ড তেঁতো!
# চলবে…
[লেইট হয়ে গেছে তাই রি-চেইক করি নি। সরি ফর বিং লেইট]