রোদ শুভ্রর প্রেমকথন পর্ব ২৪
#নৌশিন আহমেদ রোদেলা
১২.
“ভালো আছি, ভালো থেকো
আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখ…..”
মাঝে মাঝে ভালো থাকাকে ঠিক ভালো থাকা বলা যায় না। হয়তো,ভালো থাকা কাকে বলে তা উপলব্ধিই করা হয়ে উঠে না। আমিও আছি। বেশ ভালোই আছি। কিন্তু চিঠিটা লেখা হয় নি। শুভ্র ভাইয়ের মস্ত আকাশটাতে ভয়ঙ্কর সব প্রেমের চিঠিগুলো উড়িয়ে দেওয়া হয়ে উঠে নি। বড় বড় কালো চোখে আগ্রহ নিয়ে উনার মুখের ‘পরে তাকানোটা হয়ে উঠে নি। অনেক কিছু না হওয়ার মাঝেও কিছু একটা তীব্র থেকে তীব্রতর হয়েছে —–
“অবহেলা আর এড়িয়ে চলার বাহানা।” আজকাল এড়িয়ে চলাটা বেশ শিখে ফেলেছি আমি। আমি একা নই উনিও শিখেছেন, এড়িয়ে চলার বিদ্যা! একসময় কথায় কথায় হাজার কথা বলা মানুষদুটো এখন চুরের মতো হাঁটি। হঠাৎ দেখা হওয়ার ভয়ে দু’জনেই তটস্থ থাকি। কেন এতো ভয়? কেন এতো বাহানা? জানি না। হয়তো আমার অভিমান আর তার প্রতীজ্ঞা!
রাফিয়াকে নিয়ে মার্কেটে ছুটেছি প্রয়োজনীয় কিছু কিনবো বলে। কিন্তু হায় নিয়তি! গন্তব্য পর্যন্ত পৌছানোর আগেই আকাশ কালো হয়ে এলো বর্ষনে। ছুটে গিয়ে মোবাইল সার্ভিসিং দোকানের ছোট্ট বারান্দাটায় গিয়ে দাঁড়ালাম। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে বৃষ্টির ছাঁট বাড়তেই দু-পা পিছিয়ে গেলাম দুজনে। অসহায় ভঙ্গিতে এদিক-ওদিক তাকাতেই চোখে পড়লো অনাকাঙ্ক্ষিত সেই মুখ।
শুভ্র ভাই! এতোক্ষণ হয়তো আমাদের দিকেই তাকিয়ে ছিলেন। চোখে চোখ পড়তেই চোখটা সরিয়ে নিলেন খুব কৌশলে। নিজের মনে হাসলাম। মনে পড়ে গেলো আগের কথাগুলো। বেশিদিন তো নয় মাত্র একমাস আগের কথা। তখনও আমার দিকে তাকাতেন উনি। চোখে চোখ পড়লেও চোখ সরাতেন না কখনো। আমি অস্বস্তি আর লজ্জায় মিশে যেতাম তবুও উনি থাকতেন নির্বিকার। একসময় এই তাকানো নিয়েও সাজতো কথার পসরা,ঝগড়া কতো কিছু।
একমাসের ব্যবধানে পরিবর্তন হয় অনেক কিছু। সেই সাথে মানুষগুলোও। আমিও চোখ ফিরিয়ে নিয়ে বৃষ্টির ফোঁটায় ফোঁটায় দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। আজ একটা মাস পর দেখা হলো দুজনের। একটি মাস কি খুব বেশি সময়? বেশি বৈকি! ত্রিশ ত্রিশটা দিন, সাতশো বিশ ঘন্টা! রাফিয়ার কন্ঠে ভাবনার প্রহর কাটিয়ে কান খাঁড়া করলাম। রাফিয়া খুশি খুশি গলায় বললো,
—“আরে শুভ্র ভাইয়া? কেমন আছেন ভাইয়া?”
ওপাশ থেকে অপ্রস্তুত গলায় উত্তর এলো,
—” আলহামদুলিল্লাহ। তুমি কেমন আছো?”
রাফিয়া উত্তর দেওয়ার আগেই আবারও বললেন উনি,
—” খাও না নাকি? শুকিয়ে গেছো অনেক।”
রাফিয়া বিস্মিত কন্ঠে বললো,
—” বলেন কি ভাইয়া? সবাই বলছে ময়মনসিংহ এসে নাকি ফুলে ফেঁপে গেছি আমি। আর আপনার কাছে শুকনো মনে হচ্ছে আমায়? আমাকেই শুকনো মনে হলে রোদকে কি মনে হবে বলুন তো? ও যা শুকিয়েছে না। দেখুন…”
কথাটা বলেই বামহাতটা হেঁচকা টানে জোর করে উনার দিকে ঘুরিয়ে দাঁড় করিয়ে দিলো আমায়। আমি মাথা নিচু করে দাঁড়ালাম আর উনার দৃষ্টি স্থির। কয়েক সেকেন্ডের মাথায় রাফিয়ার হাত থেকে হাতটা ছাড়িয়ে আবারও পেছন ফিরে দাঁড়ালাম। রাফিয়া হেসে গল্প জুড়লো,
—” ভাইয়া? এখন বাসায় আসেন না কেন বলুন তো? আসলেও কখন আসেন কখন যান খুঁজেও পাওয়া যায় না। মিথি আপুর বিয়েটা যে ঠিক হয়ে গেছে জানেন?”
—” হ্যাঁ জানি। আম্মু কাল বলছিলো বিয়ের কথা।”
—“বিয়েটা কিন্তু রোদের বাসাতেই হচ্ছে। যদিও শুধু কাবিন হবে তবু বিয়ে তো। মিহি আপু,মিথি আপু,মিথুন ভাইয়া সবাই এসেছেন। আপনি না থাকলে আড্ডা জমে? আজ সন্ধ্যায় আপনাকে অবশ্যই ডেকে পাঠাবেন জেঠু। আসবেন না?”
ওপাশ থেকে নরম গলায় জবাব এলো,
—” আজকাল ব্যস্ত থাকি। তাই ও বাড়িতে সময় করে যাওয়া হয় না। সময় পেলে যাবো।”
একটু থেমে আবারও বললেন,
—” ভেতরের দিকে এসে দাঁড়াও। ভিজে যাচ্ছো।”
রাফিয়া খানিকটা সরে দাঁড়ালো। আমি জেদের বসে আরো একপা এগিয়ে দাঁড়ালাম। মনে হচ্ছে এখানে দাঁড়িয়ে থাকার চেয়ে বৃষ্টি মাথায় নিয়ে বাড়ি ফেরাটাও বেশি সুখের হতো। এটলিস্ট বৃষ্টির সাথে চোখের জলের মেলবন্ধনটা তো হতো।
—” এই রোদ? কিনারায় দাঁড়িয়েছিস কেন? ভিজে যাচ্ছিস তো।”
রাফিয়ার কথায় বিরক্ত হয়ে বললাম,
—” আমি ঠিক আছি।”
—“কিন্তু….”
রাফিয়াকে কথাটা শেষ করতে না দিয়েই বলে উঠলেন শুভ্র ভাই,
—” তোমরা দাঁড়াও আমি বরং একটা অটো দেখি। এখানে আর কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবে? ভিজে যাচ্ছো ঠান্ডা-জ্বর হলে আবার সমস্যা। এমনিতেই তো শরীরে কিছু নেই। বাতাসে উড়ে যাওয়ার মতো অবস্থা।”
রাফিয়া কনফিউজড হয়ে বললো,
—” ভাইয়া? আপনি কি আমাকে বলছেন? নাকি…”
শুভ্র ভাইয়া দ্রুত বললেন,
—“তোমাকেই বলছি রাফিয়া। আর কাকে বলবো? দাঁড়াও এখানে আমি অটো দেখছি…”
পাঁচ/দশমিনিট পর একটি অটোরিক্সা নিয়ে আমাদের সামনে দাঁড়ালেন উনি। রাফিয়া আনন্দে গদগদ গলায় বললো,
—” জলদি চল রোদ।”
আমি শক্ত গলায় বললাম,
—” তুই যা। আমি যাবো না।”
রাফিয়া অবাক হয়ে বললো,
—” যাবি না মানে? কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবি এখানে?এতো বৃষ্টির মাঝে কেনাকাটা করা লাগবে না বোন। অন্য একসময় আসবো। এবার বরং চল।”
আমি কাটকাট গলায় বললাম,
—” বললাম তো যাবো না। তুই যা না।”
—” আশ্চর্য! তুই এতো জেদ করছিস কেন রোদ? দু’জন একসাথে এসে আমি একা চলে যাবো? এই বৃষ্টির মধ্যে কেনাকাটা না করলে চলছে না তোর?”
—” না। চলছে না। তোর ইচ্ছে হলে তুই যেতে পারিস।”
—” এবার কিন্তু বাড়াবাড়ি করছিস তুই।”
—” করলে করছি। আমি তো বললাম তুই চলে যা৷ বৃষ্টি কমলে আমি চলে আসবো। তুুই-ই বা জেদ করছিস কেন?”
—” আমি জেদ করছি?”
আমাদের কথার মাঝেই অটো থেকে নেমে এলেন শুভ্র ভাই। গায়ের এ্যাশ রঙের টি-শার্টটার বেশি অর্ধেকই ভিজে গেছে তার। মাথার চুলগুলোও ভিজে নেতিয়ে পড়েছে কপালে। দোকানের ছাউনির নিচে দাঁড়িয়ে চুল আর টি-শার্টটা হালকা ঝাড়লেন উনি। পকেট থেকে ফোন বের করে মৃদু গলায় বললেন,
—” হ্যালো আম্মু?”
ওপাশের কথাগুলো কানে এলো না আমাদের। খানিকক্ষণ চুপ থেকে আবারও কথা বললেন উনি,
—” একটা দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। বৃষ্টিটা একটু কমলেই চলে আসবো। তুমি শুধু শুধু টেনশন করো না তো। জ্বর তো এখন আর নেই রে বাবা।”
আমি আড়চোখে তাকালাম।উনি আবারও বলে উঠলেন,
—” আর জ্বর হবে না। বৃষ্টিতে ভিজলেই জ্বর হয় কে বললো? তোমার ছেলের স্ট্রং বডি আম্মু…”
উনার কথার মাঝেই বৃষ্টি মাথায় রাস্তায় নেমে গেলাম আমি। পেছন থেকে চেঁচিয়ে উঠলো রাফিয়া,
—” এই রোদ? কই যাস? জেঠীমনি ভিজতে বারণ করেছিলো। রোদ? এই রোদ?….”
ধীরে ধীরে রাফিয়ার গলাটা মিলিয়ে গেলো বৃষ্টির রিমঝিম শব্দের আড়ালে। আমি দ্রুত পা ফেলে এগিয়ে চলেছি। হঠাৎই একটা অটোরিক্সা গা ঘেঁষে দাঁড়ালো। প্রথমে চমকে উঠলেও পরবর্তীতে রাফিয়ার গলা শুনে শান্ত দৃষ্টিতে তাকালাম,
—“রোদ পাগলামো করিস না ওঠে আয়। দেখ, এভাবে বাড়ি ফিরলে জেঠীমনি তোকে সহ আমাকেও পেদাবে। প্লিজ বইন…প্লিজ।”
আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে হাঁটার প্রস্তুতি নিতেই শুভ্র ভাই নেমে এলেন। অন্যদিকে তাকিয়েই হাতটা ধরে অটোরিকশায় নিয়ে বসালেন। একবার হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করতে গিয়েও কি মনে করে থেমে গেলাম। আবারও মনে পড়লো সেই কথাটায়….” একমাস পর!”
দু’জনেই পাশাপাশি বসে আছি। অটোর দুপাশে কালো মোটা পর্দা টানা। ভেতরটা আধো অন্ধকারে ছায়া। দু’জনের গা ভেজা বলেই আলাদা একটা সিটে বসেছে রাফিয়া। রাফিয়া বেশ মনোযোগ দিয়ে ফোন ঘাটছে। আর আমরা দু’জনেই দমবন্ধকর পরিস্থিতিতে হাসফাস করছি।
পর্দার আড়ালে রাস্তাটাও দেখা যাচ্ছে না বলে বাধ্য হয়েই খুব মনোযোগে একে অপরের হৃদস্পন্দন শোনার চেষ্টা করছি। কিছুটা এগিয়েই খানিকটা হেলে পড়লো অটো। আমরা উল্টো সিটটাতে বসায় তাড়াতাড়িই একহাতে আমার কোমর জড়িয়ে ধরলেন উনি। ঠান্ডা শরীরে গরম হাতের ছোঁয়ায় কেঁপে উঠলাম আমি। অস্বস্তি আর কৌতূহল দুটোর তুমুল লড়াইয়ের পর কৌতূহলই জয়ী হলো। এতোগুলো দিন পর মুখ ফুটে কথা বেরিয়ে এলো আমার,
—-” আপনার গায়ে জ্বর।”
আমার কন্ঠে যেন চমকে উঠলেন উনি। জিগ্যাসু দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন। আমি আবারও বললাম,
—” আপনার গায়ে প্রচুর জ্বর।”
উনি ছোট্ট করে উত্তর দিলেন,
—” জানি।”
—” তাহলে ভিজলেন কেন? মামানি বকবে।”
উনি হয়তো হালকা হাসলেন। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন,
—” মামানিদের ভাগ্নীরা যদি এতো জেদি হয় তাহলে আমার মতো নিস্পাপদের তো মামানিদের হাতের মার খেতেই হবে।”
আমি চোখ ছোট ছোট করে তাকালাম। উনি কি ফাজলামো করছেন? এতোদিন ভং ধরে থেকে এখন ফাজলামো?
#রোদবালিকা….
রোদ শুভ্রর প্রেমকথন সম্পূর্ণ গল্পের লিংক
https://kobitor.com/rodsuvro/