রোদ শুভ্রর প্রেমকথন পর্ব ৩০
#লেখিকা — নৌশিন আহমেদ রোদেলা
_________________
সকালে প্রায় আটটার দিকে ঘুম ভাঙলো আমার। এই হল্লাময় বাড়িতে আমি আটটা পর্যন্ত বিছানায় শুয়ে আছি তা ভেবেই আমি বিস্মিত। তারওপর আজকে ইদের দিন। কেউ কি একবারও ডাকতে আসে নি আমায়? ব্যাপারটা বেশ অদ্ভুত। জানালার হালকা সবুজ পর্দা ভেদ করে তীর্যক রোদ এসে পড়ছে বিছানায়।
সেই রোদের দিকে চোখ পড়তেই যেন ফাপরে পড়লো শরীর। কাঁথায় মোড়ানো শরীরটা টেনে বিছানায় পা ছড়িয়ে বসলাম। কাল রাতে তো এই “কাঁথা” নামক ঝামেলা নিয়ে ঘুমাই নি। এই গরমের মধ্যে শরীরে এটা পেঁচিয়ে দিলো কে, কে জানে? পিঠময় পড়ে থাকে এলোমেলো চুলগুলোর কিছুটা কানের পেছনে গুঁজে দিয়ে ডানদিকে তাকালাম। রুমের দরজাটা খোলা হওয়ায় বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা শুভ্র ভাইয়ের উপরই চোখ পড়লো প্রথম।
কালো রঙের উপর সোনালী সুতোয় কাজ করা একটি পাঞ্জাবি পড়েছেন উনি। চুলগুলো সবসময়ের মতোই কপালে ছড়িয়ে আছে। চোখে-মুখে বিরক্ত ভাব। ডার্ক রেড ঠোঁট জোড়া জিহ্বা দিয়ে ভিজিয়ে নিয়ে মামানির সাথে কথা বলছেন উনি। কথা নয়… উনাকে দেখে মনে হচ্ছে নিচুস্বরে মামানির সাথে রাগারাগি করছেন উনি। এই ছেলেটার কি সারাদিনই রাগ উঠে থাকে নাকি? ইদের দিনেও কিসের এতো রাগারাগি? উনাদের কথাবার্তার মাঝেই বাবার ভড়াট গলার ডাক কানে এলো। শুভ্র ভাই ডানহাতটা সামনে এনে ভ্রু কুঁচকালেন।
ডানহাতে পড়ে থাকা কালো রঙের ঘড়িটিতে মনোযোগী দৃষ্টি নিক্ষেপ করে মামানির হাত থেকে জায়নামাজটা নিয়ে ব্যস্ত ভঙ্গিতে বেরিয়ে গেলেন। যাওয়ার সময় খোলা দরজার ফাঁক দিয়ে কয়েক সেকেন্ডের জন্য আমার দিকে তাকালেন। আমি বেশ অপ্রতিভ বোধ করলাম। উনার এই খনিকের চাহনিতে যেন গাঢ় কোনো মায়া ছিলো। যে মায়াটা আমায় সূক্ষ্ম কম্পনে কম্পিত করে গেলো চোখের পলকে। কাঁথা সরিয়ে আলুথালু শরীর নিয়ে বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসতেই মামনি রুমে ঢুকলেন। প্রথমেই ডান পা’টা চেইক করে বললেন,
—” আগের থেকেও তো ফুলে গেছে রোদু। ব্লিডিংও হচ্ছে। এই ডাক্তারে কি ঔষধ দিচ্ছে বল তো? ব্যাটা কি সত্যিই ডাক্তারির কিছু পারে নাকি এমনি? নির্ঘাত নকল করে পাস করেছে।”
মামানির কথায় হেসে ফেললাম আমি। এলোমেলো চুলগুলো খোঁপা করতে নিতেই পাশে এসে বসলেন মামানি। আমার চুলগুলো দু’হাতে খোঁপা করে দিতে দিতে বললেন,
—” তোরা কি আমার একটা কথাও শুনবি না রোদ? তোদের দু’জনকে না বলেছি একে অপরের সাথে কথা বলবি না। দূরে দূরে থাকবি। কিন্তু কে শুনে কার কথা!”
আমি মন খারাপ বললাম,
—” আমি তোমার ছেলের সাথে কথা বলি না। উনি ইচ্ছে ইচ্ছে করে কথা বাড়ান।”
মামানি হেসে ফেললেন। বিছানার কাঁথাটা গোছাতে গোছাতে বললেন,
—” ও তো বলবেই। ও যে আমার কথা মেনে নিয়ে কিছুদিন চুপচাপ ছিলো তা দেখেই তো আমি অবাক। ওকে ধরে রাখা আমার কর্ম নয়। শুভ্র যখন ভেবে নেয়, কোনো কিছু তার চায় বা এটা তার প্রয়োজন তখন তার সেই ভাবনা চেঞ্জ করার ক্ষমতা স্বয়ং আল্লাহ ছাড়া কারো নেই। আবার যদি তার মনে হয়, এই জিনিসটা তার পছন্দ নয়। তারমানে সেটা তার পছন্দ নয়। সেই জিনিসের ওকালতি করে করে তুই মরে গেলেও সেটা তার পছন্দ নয়। ওর মতের বাইরে ওকে দিয়ে একটা কাজ করানো জাস্ট অসম্ভব।
ওকে যদি কখনো বলি, “শুভ্র? বাবা এই কাজটা একটু করে দে তো।” ওর যদি কাজটা মনে ধরে তো ভালো কথা। আর ভালো না লাগলে সুন্দর করে বলবে, “এই কাজ আমার ভালো লাগে না।” ভালো লাগে না মানেই সে করবে না। তুই যদি বলিস এটা না করলে আমি মরে যাবো তবুও সে করবে না। এটা একাধারে তার ভালো এবং খারাপ অভ্যাস। এক নাম্বারে পিছলা আমার ছেলে। তোর থেকে দূরে থাকতে বলেছি সে কথা তার পছন্দ হয় নি। তাই সে আমার কথা মানবে না…এটাই তার সুন্দর এবং সহজ যুক্তি।”
আমি নিরীহ চোখে তাকালাম। চোখ পিটপিট করে বললাম,
—” তাহলে তো উনি খুব ডেঞ্জারাস মামানি।”
মামানি বালিশগুলো একপাশে সাজিয়ে রেখে হাসিমুখে বললেন,
—” সেটা তো আমি তোকে আগেই বলেছি। ওর এই বিহেভগুলোতে ছোটবেলায় বেশ বিরক্ত হতাম। যখন ক্লাস ফাইভে পড়ে তখন স্কুলে একটা ছেলের সাথে তুমুল ঝামেলা করলো। ঝগড়ার শুরুটা খেলায় ব্যাটিং করা নিয়ে। শুভ্রর রাগ তো জানিস? রাগে ছেলেটাকে বেদরাম পেটালো। ছেলের বাবা ছিলো তৃষাল থানার ওসি। কি একটা অবস্থা ভাব? হেড স্যার আমাদের ডেকে পাঠালেন। আমি আর তোর মামু সরি টরি বলে সব ঠিকঠাক করে ওকে বলেছি “বাবা, সরি বলো।” তাহলেই মিটে যায় সব। কিন্তু সে কি বললো জানিস? সে সোজা বলে দিলো,” সরি বলবো না। মা বাসায় চলো নয়তো আমি ওকে আবার মারবো।”
এই কথা শুনে তো হেডস্যারসহ ওসি সাহেবও অবাক। আমি রাগ করে ওর গালে একটা চড় বসালাম। তোর মামু ইচ্ছেমতো বকাবকি করলো কিন্তু ছেলের এক কথা সে সরি বলবে না। তার ধারনা এখানে তার দোষ নেই। বিনাদোষে সরি বলা তার পছন্দ নয়। তাই সে সরি বলবে না।
হ্যাডস্যার আদর করে বললেন, “দেখো আবরার, তুমি ওকে মেরেছো তাই তোমাকে সরি বলা উচিত। নয়তো ওর বাবা কিন্তু পুলিশ তোমায় লকাপে বন্ধী করে দেবেন।” এ কথা শুনে শুভ্র বললো, ” ওর বাবা যেহেতু পুলিশ তাহলে ওর উচিত উল্টো আমায় সরি বলা। ও আমাকে বাজে গালি দিয়েছে। বইয়ে পড়েছি যারা খারাপ কাজ করে পুলিশ তাদের ধরে নিয়ে শাস্তি দেয়। আর ও আমার মাকে নিয়ে বাজে কথা বলে খারাপ কাজ করেছে।
পুলিশের ছেলে হয়ে বাজে কাজ করতে পারলে আমি ওকে মারলে সেটা দোষ কেন হবে? আমি তো একা মারি নি। ও নিজেও আমাকে মেরেছে। ও গাধা বলে আমার শরীরে লাগাতে পারে নি। এটা কি আমার দোষ? আমি সরি বলবো না। পুলিশে নিয়ে গেলেও না।” চিন্তা করতে পারছিস রোদু?দশবছরের এক বাচ্চার মুখে এতো চটাং চটাং কথা মানায়? এতো সাহস যে ওই কোথায় পায় আল্লাহ জানে।”
মামানির কথা বলার ভঙ্গিতে খিলখিল করে হেসে ফেললাম আমি। মামানি নিজেও হালকা হেসে বললেন,
—” হাসিস না রে মা। ছেলের টেনশনে অস্থির অস্থির লাগে আমার। ওকে বিয়ে করানোর পর বউয়ের কোনো একটা কিছু পছন্দ না হলে মারপিট শুরু করে দেবে কি না কে জানে? এটা নিয়েও চিন্তার শেষ নেই আমার।”
আমি হাসিমুখেই বললাম,
—” মামানি? তুমি এক কাজ করো। একটা দর্জালি মেয়ে দেখে বিয়ে দিয়ে দাও। দু’জনে মিলে মারামারি করবে। আহা! কি সিন!”
মামনি চোখ ছোট ছোট করে বললেন,
—” ওর ইচ্ছের বিরুদ্ধে ওকে শোয়া থেকে ওঠে বসানো যায় না আর তুই বলছিস বিয়ের কথা? ঘরবাড়ি ভেঙে ফেলবে একদম। আর যদি শুনে এই বুদ্ধি তুই দিয়েছিস তাহলে যে কি করবে…. আল্লাহ! রক্ষা করো।”
এটুকু বলে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন মামানি। রান্নাঘর থেকে আম্মুর চেঁচামেচি শুনে তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে গেলেন। আমিও মাথা চুলকে ব্যাগ থেকে ব্রাশটা বের করে পেছনের উঠোনের বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। বাচ্চারা উঠোন জুড়ে ছোটাছুটি করছে। সবার গায়েই নতুন জামা, চকচকে লিপস্টিক, কাজল। বড়রাও গোসল সেরেছে সেই অনেকক্ষণ আগে। একমাত্র আমিই হতভাগা ব্রাশ নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি।
বন্যা আর করোনা দুটোর জন্যই ইদের নামাজের ব্যবস্থা করা হয়েছে মসজিদে। আমাদের বাড়ির বারান্দা থেকেই চকচকে পাকা রাস্তাটা চোখে পড়ে। সেই রাস্তা পেরিয়ে কিছুটা পথ এগিয়ে যেতেই চোখে পড়ে মসজিদ। আমি দাঁত ব্রাশ করতে করতেই রহিজ চাচা গাছের গুঁড়ি আর দাঁ, চাকু নিয়ে উঠোনে রাখলেন। রহিজ চাচা আমাদের এখানে বছর বাঁধা কাজ করেন। শরীরের রং একদম মিশমিশে কালো। দাদু বলতেন এটা নাকি জাম কালো। ছোট ছোট পিচ্চিরাও হাত ভর্তি দশ,বিশ টাকার কচকচে নোট আর গায়ে নতুন পাঞ্জাবি আর টুপি পড়ে উঠোনে এসে দাঁড়ালো।
তাদের প্রধান আকর্ষণ কোরবানি দেওয়ার জন্য এনে রাখা লালটে চামড়ার গরুটা। বন্যায় কোরবানির মাঠ ডুবে যাওয়ায় বাড়ির পেছন উঠোনেই গরু কোরবানির ব্যবস্থা করা হয়েছে। বাড়ির পেছনে একসময় মস্ত এক কামরাঙা গাছ ছিলো। সেই ছায়াতেই ছায়াময় হয়ে থাকতো পুরোটা উঠোন। কিন্তু একবছর আগে গাছটা কেটে ফেলায় উঠোনটা কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা বিরহী হয়ে উঠেছে। সেই সাথে বাড়িয়ে দিয়েছে রোদের উত্তাপ।
ছোট্ট বেলা আমার ঘরের জানালার পাশেই ছিলো এই গাছ। ঘুম ভেঙেই হাজারও সবুজ কামরাঙা আর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র লাল- সাদা ফুল চোখে পড়তো আমার। আম্মু স্কুলে চলে গেলে সেই কামরাঙা গাছই ছিলো আমার একমাত্র খেলার সাথি। ওই গাছটাতে উঠেই গাছে উঠতে পারার প্রথম গৌরব অর্জন করেছিলাম আমি। সেগুলো আজ যত্নময় অবহেলায় মোড়া কিছু স্মৃতি মাত্র। আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থাতেই আব্বু-ভাইয়াদের নামায পড়ে ফিরতে দেখা গেলো।
ওদের দেখেই ঝটপট ওয়াশরুমে ঢুকে গেলাম শাওয়ার নিবো বলে। ইদের দিন দেরি করে গোসল করাটা আমার বাবার খুব একটা পছন্দ নয়। গোসল সেরে ইদের জামা না পরে হুট করেই সিদ্ধান্ত নিলাম শাড়ি পরবো। আম্মুর গরম চোখে ঝলসিত হয়েও মামানির সাপোর্টে লাল রঙা এক শাড়ি পরলাম আমি। ভেজা চুলগুলো খোলা রেখে পেছনের বারান্দায় গিয়ে দেখলাম রাফিয়ারা সবাই হাসাহাসি করছে। বারান্দার বাইরে উঁকি দিয়ে ব্যাপারটা বুঝার চেষ্টা করে বললাম,
—” কি রে? হাসছিস কেন তোরা?”
রাফিয়া আমোদিত গলায় বললো,
—” দেখ, জেঠো সব কটাকে মাংস কাটতে বসিয়ে দিয়েছে। এমনকি শুভ্র ভাইকেও।”
আমি রাফিয়ার পাশ দিয়ে উঁকি দিয়ে বাইরে তাকালাম। বাইরে উজ্জ্বল রোদ তারসাথে প্রচন্ড গরমও। ছাউনির নিচেই আমাদের যা অবস্থা তো বাইরের মানুষগুলোর কি হাল কে জানে? শুভ্র ভাই পাঞ্জাবির হাতা গুটিয়ে কোমরে গামছা বেঁধে মাংস কাটছেন। কপালে পড়ে থাকা চুলগুলো তার গরম যেন বাড়িয়ে দিচ্ছে বহুগুণ। কখনো কনুই দিয়ে তো কখনো ফু দিয়ে চুলগুলো সরানোর চেষ্টা করছেন উনি।
ফর্সা মুখটা রোদে আর গরমে লাল টকটকে টমেটোর মতো হয়ে গেছে। খোঁচা খোঁচা দাঁড়িগুলোতে বিন্দু বিন্দু ঘামগুলো যেন রোদের ঝিলিকে চিকচিক করে উঠছে। উনার এই শোচনীয় অবস্থা দেখে হালকা খারাপ লাগলেও হাসি পেলো ব্যাপক। মুচকি হেসে নিজের মনে আওড়ালাম, বাহ্! কাটাকাটিও তাহলে করতে পারে মহাশয়।
কিছুক্ষণ মাংস কাটাকাটি করে ঘেমে নেয়ে সব কটা এক এক করে উঠে এলো। একে একে সবার থেকে কেড়ে, মেরে, খাঁমচিয়ে হলেও সালামি নেওয়া হলো। আলিফ ভাইয়াকে গার্লফ্রেন্ড নিয়ে ব্ল্যাকমেইল করে সালামি নেওয়া হলো। কিন্তু শুভ্র ভাইয়ের কাছে আটকে গেলো সবাই। শুভ্র ভাইকে মারার কলিজা তো নাই-ই কারো। তারসাথে ব্ল্যাকমেইল করার মতোও কিছু খুঁজে পেলো না কেউ। শুভ্র ভাইয়ের থেকে সালামি নিতে পারা নিয়ে রীতিমতো বাজি লেগে গেলো। সেই বাজি রক্ষা করতে গিয়েই শুভ্র ভাইয়ার কাছে সালামি চাইলাম আমি। উনি আড়চোখে আমার দিকে তাকালেন। সটান উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,
—” সালাম কর। তোর সালাম যদি আমার পছন্দ হয় তাহলে সালামি পাবি নয়তো না।”
আমি অবাক হয়ে বললাম,
—” সালাম কেন করবো? এখন আর সালামি পেতে সালাম করতে হয় না। দিন বলছি…”
—” এমনভাবে দিন দিন বলছিস যেন আমার পকেটে তোর টাকা রেখেছিস। চাওয়া মাত্র দিয়ে দিতে আমি বাধ্য।”
আমি কপাল কুঁচকে বিরক্তি নিয়ে বললাম,
—” এতো কিপ্টা কেন আপনি? ছোট ছোট বোনদের এক্টু সালামি দিতে পারেন না? কিপ্টুস!”
—” আমি তো বলি নি দিবো না। অবশ্যই দিবো। তার আগে সালাম কর। সালাম না করে সালামি নিয়ে যাবি তা তো হতে পারে না। আমি খুব স্বচ্ছ মানুষ স্বচ্ছভাবে বলছি। সালাম কর সালামি নে। ব্যস!”
আমি রাগী চোখে তাকিয়ে বললাম,
—” করবো না সালাম।”
—” তাহলে টাকাও পাবি না।”
কথাটা বলেই বিছানায় গা এলিয়ে দিলেন উনি। আমি তেঁতে উঠে বললাম,
—” জীবনেও বউ পাবেন না আপনি। আপনার মতো মানুষ তো বউকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে শেষ করে দিবে। আল্লাহ! রহম করো সেই রমনীকে। আমিন!”
শুভ্র ভাই হেসে ফেললেন। মাথাটা একটু উঁচু করে মাথার নিচে হাতদুটো রেখে বললেন,
—” শুভ্রর কাছাকাছি আসবে অথচ জ্বলবে না তা তো হয় না। তবে তুই একটু ভুল বললি। শুধু জ্বালাবো এটা ভুল। বউকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছাই ছাই করে দেওয়ার প্ল্যান আমার। আর শকুনের দোয়ায় গরু মরে না, জানিস তো? তেমনি তোর দোয়াতেও আমার বউ পাওয়া আটকাবে না। বউতে আমি পাবোই… সেটা তুই দোয়া করলেও আর না করলেও। এখন বেশি কথা না বলে সালাম কর নয়তো ফুট।”
আমি অধৈর্য গলায় বললাম,
—” দেখুন! সালামি দেন বলছি নয়তো ব্যাপারটা ভালো হবে না।”
উনি ভ্রু কুঁচকে বললেন,
—” দিন দিন গুন্ডি হয়ে যাচ্ছিস তুই। সালাম না করে চাঁদাবাজি করার চেষ্টা করছিস। এই তোর বাপ না হাজী মানুষ? তুই যে এভাবে চাঁদাবাজী করিস সেটা শুনলে তো তোর বাপ ডিরেক্ট উপরে চলে যাবে।”
আমি কোমরে হাত রেখে বললাম,
—” খবরদার বাবাকে নিয়ে কিছু বলবেন না।”
—” আশ্চর্য! কথায় কথায় এমন ধমকি দিচ্ছিস কেন তুই? যাহ্ তোর বাপকে নিয়ে কিছু বললাম না। তো তোর শশুড়কে নিয়ে কিছু বলবো?”
—” আপনি আসলেই একটা অসহ্য। মেয়েদের মতো এতো লেগে লেগে ঝগড়া করেন কেন শুনি?”
উনি এবার ওঠে বসলেন,
—“আমি কই লেগে লেগে ঝগড়া করছি? আমি কি তোর বাপের মতো বহুদা ঝগড়া করি?”
—” আবার বাবাকে টানছেন!”
—” ওপস্ সরি। যা বাপ ক্যান্সেল। আমি কি তোর শশুড়ের মতো বেহুদা ঝগড়া করি?”
আমি দাঁতে দাঁত চেপে বললাম,
—” আমার শশুড়কে নিয়েই বা আপনার এতো জ্বালা কেন শুনি? একদম উল্টাপাল্টা কথা বলবেন না।”
উনি বাঁকা হেসে বললেন,
—” বাহ্! আমার থেকে আমার বাপের প্রতি তোর দরদই বেশি দেখি।”
আমি কনফিউজড হয়ে চোখ কুঁচকালাম,
—” মানে? কি বললেন আপনি?”
—” বললাম, লাল শাড়ি পরে বউ বউ ভাব নিয়ে আমার চোখের সামনে ঘুরঘুর করছিস কেন? পরে ভুলে বউ মনে করে নিলে তো ঝামেলা। বাপের মতোই ধাপ্পাবাজ হয়েছিস। আমাকে ডিস্ট্রেক্ট করার চেষ্টা চালাস অলওয়েজ।”
আমি এবার আর রাগ ধরে রাখতে পারলাম না। চেঁচিয়ে ওঠে বললাম,
—” আপনি আবার বাবাকে বাজে কথা বলছেন। আমার কিন্তু এখন প্রচন্ড রাগ লাগছে। মামামি? মামানি? মামানি তুমি কই?”
—” আরে! কথায় কথায় ম্যা ম্যা করিস কেন? একবার আম্মু তো আবার অন্যের আম্মু। তো…”
উনার কথার মাঝেই মামানি এসে বললেন,
—” ঘরটাকে বাজার বানায় ফেলছিস। চেঁচাচ্ছিস কেন?”
—” মামানি দেখো তোমার ছেলে আমায় সালামি দিচ্ছে না। তারওপর উল্টাপাল্টা কথা বলছে।”
মামানি সরু চোখে তাকিয়ে বললেন,
—” শুভ্র? ওকে সালামি দিচ্ছিস না কেন?”
শুভ্র ভাই বিছানায় বসে পাঞ্জাবির হাতা গোটাতে গোটাতে বললেন,
—” ও যদি আমার কাছে টাকা চাইতো তো দিয়ে দিতাম। কিন্তু ও তো টাকা নয় সালামি চেয়েছে তারজন্য আগে সালাম করতে হবে না? আগে সালাম করুক তারপর টাকা। আম্মু তুমি যাও তো…ওর সাইড নিয়ে কথা বলবা না একদম। সালাম ওকে করতেই হবে।”
মামানি বিরক্ত হয়ে বললেন,
—” তোরা পারিসও বটে। বিরক্ত করে ফেলিস একদম।”
এরমধ্যেই মামানির ডাক পড়লো। ভেতরের বারান্দায় সবাই খেতে বসেছে। মামানি আমাদের রেখে তাড়াহুড়ো করে বারান্দায় চলে গেলেন। শুভ্র ভাই আয়েশ করে বসে আমার দিকে তাকিয়ে ভ্রু নাচালেন,
—” করবি না সালাম? শাড়ি যেহেতু পরেছিস সালাম তো তোকে করতেই হবে। আমি সালামি না দিলেও এখন তোকে সালাম করতে হবে। সালাম না করে রুম থেকে এক পা বের হলে খবর আছে।”
আমি মুখ ফুলিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে আসতে নিতেই আঁচলের কোণা ধরে আটকালেন উনি। শাড়ির আঁচলের কোণাটা নিজের অনামিকা আঙ্গুলে শক্ত করে বেঁধে ফোন নিয়ে বসে পড়লেন। আমি শাড়ির আঁচল টেনে ধরে দাঁড়িয়ে আছি। মাঝে মাঝে আঁচল রক্ষার চেষ্টা চালাচ্ছি। উনি ফোন স্ক্রল করতে করতে বললেন,
—” অযথা লেইট না করে সালাম কর। তাহলেই ছেড়ে দিবো তোকে। নয়তো এখানেই বসে থাক। কেউ এসে দেখলে বলবো সব দোষ তোর।”
আমি রাগে অভিমানে সালাম করার জন্য এগিয়ে গেলাম। উনি আমার মতিগতি বুঝতে পেরেই সোজা হয়ে দাঁড়ালেন। আমি অস্বস্তি নিয়ে নিচু হয়ে উনার পা ছুঁতেই আমার মাথায় হাত রাখলেন উনি। হেসে ফেলে বললেন,
—” স্বামী সোহাগী হও রোদপাখি। তোমার বর তোমাকে জ্বালাময় ভালোবাসায় ভরিয়ে তুলুক।”
উনার কথায় রাগী দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ওঠে দাঁড়ালাম। উনি চোখ টিপে বললেন,
—” আমার দোয়া তোর দোয়ার মতো ঠুনকো নয়। অক্ষরে অক্ষরে মিলে যাবে দেখিস।”
আমি কিছু না বলে রাগ নিয়ে আঁচলটা ছাড়াতে নিতেই উনি নিজেই খুলে দিলেন আঁচলের বাঁধন। রাগে তখন চোখ দুটো টলমল করছে আমার। সেই টলমলে চোখ নিয়ে রুম থেকে বেরুতে নিলেই হাতটা টেনে ধরলেন উনি। আমি হাত মুচড়ামুচড়ি করতেই হেসে উঠলেন উনি। ভরাট গলায় বললেন,
—” তোমার দুপুর সকালটা কে
করো সঠিক ভাগ
আমার জন্য কখন কখন
করবে তুমি রাগ ।
তোমার রাগের সময়টুকু
খুব ই ভালো লাগে
নরম কোমল স্বর্ণ ঘাম
নাকের অগ্রভাগে ।
রাগের সময় মুখটা তোমার
আমার দিকে ফিরে
কি যেন সব বলতে থাকে
খুব ই ধিরে ধিরে ।
রাগের সময় কাঁচের চুড়ি
ভাঙে তোমার হাত
তখন আমার সপ্নে আসে
শুধুই বাসর রাত ।
রাগলে যাদের মন্দ লাগে
তুমি তেমন নয়
তোমার আমার জীবনটা তাই
হোক না রাগময় ।”
—- collected
উনার কথায় রাগ ভুলে লজ্জায় লাল হয়ে গেলাম আমি। উনি শক্ত হাতে আমার হাত ধরে রাখায় রুম থেকে বেরুতেও পারছিলাম না আর না পারছিলাম উনার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে। উনি পেছন থেকেই ডানহাতে কিছু একটা গুঁজে দিয়ে ফিসফিস করে বললেন,
—” এবার যেতে পারেন ম্যাডাম।”
কথাটা বলে আমাকে ছেড়ে বিছানায় বসে পড়লেন উনি। আমি ধীর পায়ে দু’পা এগিয়ে গিয়েই এক দৌঁড়ে পাশের রুমে গিয়ে দরজা দিলাম। বুকটা কেমন ধরফর করছে আমার। হাত-পা অল্পবিস্তর কাঁপছে। শাড়ির আঁচল দিয়ে মুখের ঘামটা মুছে নিয়ে ফ্যানের সুইচটা অন করেই বিছানায় গিয়ে বসলাম আমি। মুঠো করে রাখা ডানহাতটা চোখের সামনে আনতেই চোখে পড়লো চকচকে এক হাজার টাকার নোট। এতো টাকা দেখে আমি চোখ বড়বড় করে তাকালাম। টাকাটা উল্টাতেই চোখে পড়লো সাদা কাগজ। কাগজটা টাকার সাথে স্ট্রেপ্লার দিয়ে লাগানো। তাতে ছোট ছোট করে লেখা,
“শুভ্রর বাবার বউমাটা একটু বেশিই লাজুক……টাকাটা যে তার জন্যই বরাদ্দ ছিলো। সালাম না করলেও যে টাকাটা সেই পেতো তা না শুনেই দৌঁড়ে পালালো। এভাবে শাড়ি পরে চোখের সামনে ঘুরঘুর করে মাথা নষ্ট করার অপরাধে এইটুকু শাস্তি কি তার প্রাপ্য নয়?”
#রোদবালিকা
রোদ শুভ্রর প্রেমকথন সম্পূর্ণ গল্পের লিংক
https://kobitor.com/rodsuvro/