রোদ শুভ্রর প্রেমকথন পর্ব ৩৫
#লেখিকা- নৌশিন আহমেদ রোদেলা
____________________
শরৎ কালের মাঝামাঝিতেও বর্ষার মতো ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে। প্রকৃতির সাথে তাল মিলিয়ে আমার মুখটাও ঘন মেঘে ঢেকে আছে। আমার ঠিক সামনে ভ্রু কুঁচকে বসে আছেন শুভ্র ভাই। তার চোখে-মুখে বিরক্তি স্পষ্ট। কিছুক্ষণ বইয়ের পাতা উল্টেপাল্টে দেখে, বিরক্ত চোখজোড়া তুলে আমার দিকে তাকালেন। ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বললেন,
—-” A good student is never indifferent to his studies. এখানে ইনডিফারেন্টের পর ‘টু’ কেন বসলো, বল তো?”
আমি চোখ পিটপিট করে তাকালাম। উনার কুঞ্চিত ভ্রু জোড়া আরো খানিকটা কুঁচকে এলো। দু’ভ্রুয়ের মাঝে হাজার টন বিরক্ত এঁটে নিয়ে বললেন,
—-” কি হলো? বল!”
আমি ঘাড় চুলকিয়ে বললাম,
—-” ক্ষুধা লেগেছে। প্রচুর!”
শুভ্র ভাই শান্ত চোখে তাকালেন। বইয়ের পাতা উল্টাতে উল্টাতে বললেন,
—-” ‘টু’ কেন বসলো বল।”
আমি অসহায় চোখে তাকালাম। কোথায় কিসের ‘টু’ না ‘ফু’ বসেছে তা নিয়ে মোটেও ভাবতে ইচ্ছে করছে না। মূলত পড়তেই ইচ্ছে করছে না। আমি গালে হাত দিয়ে বসে…উনার দিকে স্থির দৃষ্টি রেখে বললাম,
—-” বিয়ে করবো।”
উনি আবারও চোখ তুলে তাকালেন। উনার গভীর শান্ত চাহনী দেখেই মনের মাঝে প্রেমময় হাওয়া বয়ে গেলো। উনাকে চুপ থাকতে দেখে ঠোঁট উল্টে বলে উঠলাম আমি,
—-” পড়াশোনা ভাল্লাগে না। তার থেকে বরং বিয়ে করে ফেলি। ব্যাপারটা দারুন হবে। আপনি একটু ছেলে টেলে দেখুন তো। যে ছেলে জীবনেও পড়তে বসতে বলবে না তাকেই বিয়ে করবো।”
শুভ্র ভাই এবারও কিছু বললেন না। বইটা বন্ধ করে গম্ভীর চোখে তাকালেন। উনার এই শান্ত ভঙ্গিমা আমার ঠিক হজম হলো না। ঢোক গিলে নিয়ে বললাম,
—-” মনের কথা শুনতে হয়। মন যা চায় তাই করতে হয়। আমার বিয়ে করতে ইচ্ছে করছে তাই বলছিলাম যে….”
আমার কথাটা শেষ না হতেই গম্ভীর গলায় বলে উঠলেন শুভ্র ভাই,
—-” আমারও এখন তোকে ঠাডিয়ে চড় লাগাতে ইচ্ছে করছে। আমার কি আমার মনের কথা শুনা উচিত?”
আমি খানিক চুপসে গেলাম। কলম আর খাতাটা তুলে নিয়ে পড়াশোনায় অতিরিক্ত ব্যস্ততা দেখাতে লাগলাম। উনি ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন,
—-” ইংলিশে তোর বেসিকটা ঠিক কোন লেভেলে আছে তাই বু…..”
উনি এটুকু বলতেই হুট করে বলে উঠলাম আমি,
—-” ব্ল্যাক টি-শার্টে আপনাকে একদম অস্থির লাগছে শুভ্র ভাই। অনেকটা সাউথ ইন্ডিয়ান ফিল্মের হিরোদের মতো।”
উনি এবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন। রাগ নিয়ে বললেন,
—-” সমস্যাটা কি তোর?”
আমি অবাক হওয়ার চেষ্টা করে বললাম,
—-” আমার আবার কিসের সমস্যা? আমি তো জাস্ট সত্যটা বললাম। লুকিং ড্যাশিং!”
—-” তুই কি আজ মার খাওয়ার সিদ্ধান্তটা নিয়েই পড়তে বসেছিস রোদু?”
আমি মুখ ভার করে বললাম,
—-” আমি আপনার প্রসংশা করলাম আর আপনি আমায় বকছেন? মারতে চাইছেন? অন্যকেউ হলে কখনোই এমন করতো না। নিরামিষ!”
শুভ্র ভাই চাপা গলায় বললেন,
—-” আমি অন্যকেউ নই বলেই তোর এই ট্রিকটা কাজে লাগবে না। এতোগুলো বছরে একবারও আমাকে ড্যাশিন, কিউট মনে হলো না তোর। আজ পড়তে বসেই আমি ড্যাশিন? এতো সহজ আমাকে ডিসট্রেক্ট করা? চুপচাপ পড় নয়তো মাইর।”
আমি অসহায় বাচ্চার মতো তাকিয়ে থেকে চেয়ারে গা এলিয়ে দিলাম। আহ্লাদী গলায় বললাম,
—-” আমি এখন পড়বো না। ঘুম পাচ্ছে আমার। প্লিজ প্লিজ!”
শুভ্র ভাই অধৈর্য্য গলায় বললেন,
—-” এখন কিসের ঘুম? বাচ্চামো না করে পড়তে বস। এক ঘন্টা ধরে কিচ্ছু পড়িস নি তুই। এখন সত্যিই চড় লাগাবো আমি।”
—-” আমার সত্যিই ঘুম পাচ্ছে। লুক এট মাই আইস্। তাছাড়া, আপনার কাছে পড়া টড়া হবে না আমার। ক্রাশ টাইপ ছেলেদের সামনে পড়তে বসলে বইয়ের থেকে মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয় বেশি। এভাবে পড়া সম্ভব?”
আমার কথায় মুখ ফুলিয়ে শ্বাস ছাড়লেন শুভ্র ভাই। আমি হাসি হাসি মুখ নিয়ে উনার দিকে তাকিয়ে রইলাম। উনাকে বিরক্ত করতে ভীষণ আনন্দ লাগছে আমার। কিন্তু সেই আনন্দটা খুব বেশিক্ষণ টিকলো না। ডান পা’টা চেয়ারে আটকিয়ে আমিসহ চেয়ারটাকে নিজের দিকে টেনে নিলেন উনি। টেবিলের সাথে এই আকস্মিক ঘর্ষনে চমকে উঠলাম আমি। উনি দরজায় চোখ বুলিয়ে নিয়ে নিচু গলায় বললেন,
—-” রোদপাখি? আমি আমার ফুল ফর্মে চলে এলে শুধু পড়া কেন? তোমার এখানে বসে থাকাটাও হয়ে উঠবে না। তুমি কি তাই চাইছো?”
উনার কথায় বিস্ফারিত চোখে তাকালাম আমি। শুভ্র ভাই মৃদু হাসলেন। পা দিয়ে ঠেলে, চেয়ারটা আবারও ঠিক জায়গায় পৌঁছে দিয়ে স্বাভাবিক গলায় বললেন,
—-” কাল থেকে আমার বাসায় গিয়ে পড়ে আসবি তুই। নিজের ঘরে বসে পড়িস কারণেই ঘুম, ক্ষুধা, বিয়ে, ড্যাশিন এতোকিছু…. আমার ঘরে বসে পড়লে এসব কিছুই হবে না। আমি ফুপ্পিকে বলে রাখবো। কাল থেকে ওই বাসায় গিয়ে পড়বি তুই। তারপর দেখবো ঘুমটা কিভাবে আসে তোর।”
আমি উদাস চোখে জানালা ভেদ করে আকাশের দিকে তাকালাম। মেঘে ঢাকা আকাশ থেকে ফোঁটা ফোঁট বৃষ্টি পড়ছে। যেকোনো সময় শুরু হবে মুষলধারার বর্ষন। চারপাশে থমথমে ভাব। প্রকৃতিও যেন আমার মতোই দুঃখী মন নিয়ে অস্থির, অলসভাবে বসে আছে সর্বক্ষন। আমার ভাবনার মাঝেই স্কেলের দানবীয় আঘাতে টেবিলেটাকে কাঁপিয়ে দিলেন শুভ্র ভাই। আমি চমকে উঠে সচেতন চোখে তাকালাম। উনি শক্ত গলায় বললেন,
—-” পড়। নয়তো নেক্সট মাইরটা তোর গায়ে পড়বে।”
আমি অসহায় চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকেই পড়ায় মনোযোগ দিলাম। টানা দু-ঘন্টা পড়ার পর আবারও চেয়ার গা এলিয়ে দিলাম আমি। ঝুঁটি করে রাখা লম্বা চুলগুলো একটানে খুলে নিয়ে বললাম,
—-” মাথাটা ধপধপ করছে। আর একটা হরফও পড়বো না আমি।”
শুভ্র ভাই জবাব দিলেন না। চেয়ারের গায়ে ঠেস দিয়ে গভীর দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। আমি আবারও জানালা ভেদ করে বাইরে তাকালাম। অঝোরে বৃষ্টি হচ্ছে। হঠাৎ করেই মনে পড়লো ‘আমি-তুমি’ তো বারান্দায়! চেয়ার ছেড়ে দৌঁড় গেলাম বারান্দায়। বারান্দার এক কোণায় মোটা রডে আটকে রাখা আমি-তুমির ছোট্ট খাঁচাটা। বৃষ্টির ছাঁটে খাঁচার একটা কোণ ভিজে একাকার। বারান্দার মেঝেও পানিতে পিচ্ছিল। আমি পা টিপে টিপে বারান্দার দক্ষিণের কোণের দিকে এগিয়ে গেলাম। বৃষ্টির ছাঁটে জামা আর ওড়নার একপাশটা ভিজে এসেছে প্রায়। এক হাতে কপাল চুইয়ে পড়া পানিটুকু মুছে নিয়ে অন্যহাতে খাঁচার দিকে হাত বাড়ালাম।
খাঁচার রিংটা রডের কোণায় আটকে যাওয়ায় বেশ বেগ পেতে হলো আমায়। টেনে হিঁচড়েও খাঁচাটা নিজের হাতের মুঠোয় না আনতে পেড়ে মেজাজটাই বিগড়ে গেলো। এমন সময়, আমার হাতের ওপর দিয়ে একটা লম্বা, শক্ত হাত এসে থামলো খাঁচাটার ওপর। চোখের পলকেই রিংটা খুলে নিয়ে আমাকে সহ খানিকটা দূরে এসে দাঁড়ালেন। বৃষ্টির ছাঁট থেকে নিরাপদ দূরত্বে এসে দাঁড়ানোর পর পেছন ফিরে তাকালাম। শুভ্র ভাই মিষ্টি হেসে বললেন,
—-” ‘তুমিটা’ একদম ভিজে গিয়েছে।”
উনার কথার ভিত্তিতে চোখ ফিরিয়ে খাঁচার দিকে তাকালাম। হলুদ রঙা পাখিটা সত্যিই ভিজে গিয়েছে খুব। বার বার গা ঝাড়া দিয়ে পানি ঝাড়ছে। সবচেয়ে অদ্ভুত বিষয় হলো নীল পাখিটা বারবার হলুদ পাখিটার গা ঘেঁষে দাঁড়াচ্ছে…. মাঝে মাঝে একবার দু’বার ঠুকরে দিচ্ছে। তার ভাব দেখে মনে হচ্ছে সে ‘তুমির’ ভিজে যাওয়া ঠান্ডা শরীরটাকে নিজের উত্তাপটুকুও বিলিয়ে দিতে চাইছে। ওদের এমন কাজে বিস্মিত চোখে তাকিয়ে রইলাম আমি। শুভ্র ভাই হেসে বললেন,
—-” কি মারাত্মক প্রেমিক ‘আমি’। ‘তুমিকে’ কতো ভালোবাসে দেখেছিস? কিন্তু আফসোস, তুমিরা সবসময় বোকা হয়।”
আমি স্নিগ্ধ চোখে উনার দিকে তাকালাম। উনি আমার থেকে কিছুটা দূরত্ব নিয়ে দাঁড়ালেন। নিজের চুল আর কাঁধের দিকটা ঝাঁড়তে ঝাঁড়তে বললেন,
—-” গর্দভের মতো দাঁড়িয়ে আছিস কেন? গিয়ে ড্রেস চেইঞ্জ কর! ভিজে গেছিস তুই।”
আমি একবার উনার দিকে তাকালাম। ভেজা চুল আর ভেজা শার্টে ভীষণ স্নিগ্ধ লাগছে উনাকে। কয়েক সেকেন্ড উনার দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে থেকে ফ্লোরের কাছে নামিয়ে রাখলাম আমি-তুমির ছোট্ট সংসার। বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে বললাম,
—-” আজ বৃষ্টিবিলাসের দিন। বৃষ্টির ছোঁয়ায় পাগল হওয়াটা আজ চাইই চাই।”
এটুকু বলে, পায়ের নুপুরে তুমুল রুনুঝুনু শব্দ তুলে দৌঁড়ে বেরিয়ে গেলাম রুম থেকে। ড্রয়িংরুমে বসে পালংশাক বাছছিলেন আম্মু আর ফুপ্পি। আদিবা-জারিফ এদিক ওদিক ছুটাছুটি করে চলেছে অনবরত। ওদেরকে দেখেই উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বলে উঠলাম আমি,
—-” এই বাচ্চাপার্টি? বৃষ্টিতে ভিজবি?”
ওরা কিছু বলার আগেই চেঁচিয়ে বলে উঠলেন ফুপ্পি,
—-” খবরদার বৃষ্টিতে ভিজবি না। মাত্রই জ্বর থেকে ওঠলি। একদম কুটে ফেলবো দুটোকে।”
ফুপ্পির কথার তোয়াক্কা না করে আম্মুর দিকে তাকালাম,
—-” আম্মু ভিজি? প্লিজ প্লিজ।”
আম্মু গম্ভীর গলায় বললেন,
—-” একদম না।”
—-” প্লিজ!!”
—-” না মানে না।”
ততক্ষণে বসার ঘরের দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়েছেন শুভ্র ভাই। ট্রাউজারের পকেটে হাত ঢুকিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন সেই অনেকক্ষণ। আমি মুখ ভার করে শুভ্র ভাইয়ের দিকে তাকালাম। শুভ্র ভাই মৃদু হেসে ঘাড় কাত করলেন। চোখের ইশারায় বুঝালেন, ‘পারমিশন গ্রেন্টেড’। দৌঁড়ে ছাদে উঠে যাওয়ার দায়িত্ব আমার আর আম্মুকে সামলানোর সব দায় নিতান্তই উনার। আমার চোখে-মুখে মুহূর্তেই খুশির ঝিলিক খেলে গেলো। সিঁড়ি ঘরের দিকে দৌঁড় লাগিয়ে বললাম,
—-” আম্মু আমি ভিজতে গেলাম।”
আম্মু চেঁচিয়ে বললেন,
—” রোদ… রোদ…”
ততক্ষণে সিঁড়িঘর পেরিয়ে গিয়েছি আমি। মোটা মোটা বৃষ্টির ফোঁটায় শরীর রাঙিয়ে ছুটে বেড়াচ্ছি ছাদের এ কোণ থেকে ও কোণ। বৃষ্টির ঠান্ডা স্পর্শে শরীরটা কেঁপে কেঁপে ওঠছে। দুই বাহু ফেলে আকাশের দিকে মুখ করে তাকাতেই ঢলে পড়া আকাশটাকে মনে হচ্ছে অন্য এক ভুবন। আমার ছাদে আসার কিছুক্ষণ পরই আদিবা-জারিফও দৌড়ে এলো ভিজতে। তার কিছুক্ষণ পর আপুও এলো। এক ফাঁকে শুভ্র ভাইও এলেন।
তবে না ভিজে, ছাঁদের দরজায় ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন চুপচাপ। আপু আর বাচ্চাদের সাথে হৈ-হুল্লোড়ের মাঝে উনার দিকে চোখ পড়তেই মিষ্টি হাসলাম আমি। আমার হাসির পরিবর্তে একগুচ্ছ নেশাগ্রস্ত দৃষ্টি ছুঁড়ে দিলেন উনি। গভীর চোখে তাকিয়ে রইলেন শুরু থেকে শেষ অব্দি।
#রোদবালিকা
রোদ শুভ্রর প্রেমকথন সম্পূর্ণ গল্পের লিংক
https://kobitor.com/rodsuvro/
[ আজ আরশিযুগল প্রেম দিবো ইনশাআল্লাহ। একটু লেট হতে পারে তবে দেওয়ার চেষ্টা করবো।]