রোদ শুভ্রর প্রেমকথন পর্ব ৪০
#লেখনীতে – নৌশিন আহমেদ রোদেলা
আকাশ মেঘলাটে। দু’ঘন্টার টানা বৃষ্টির পর রাস্তার পাশের গাছগুলো কাচের মত ঝকঝক করছে। ব্যালকণির পাশে থাকা মাঝারি আকারের হিজল গাছটির পাতা চুইয়ে এক দু’ফোটা বৃষ্টির জল গড়াচ্ছে। এক পাতা থেকে অন্য পাতায় জল গড়িয়ে পড়তেই অদ্ভুত সুরে বেজে উঠছে ‘টপটপ, টপটপ’। বাসার সামনের পিচ ঢালা বিশাল রাস্তাটার এখানে সেখানে ঘোলাটে পানি জমে আছে।
কিছুক্ষণ অন্তর অন্তর চলন্ত রিকশা,অটোরিকশার চাকার চাপে ছিটকে ওঠে আরো একটু ঘোলাটে রঙে রাঙা হচ্ছে । সামনের বিল্ডিংয়ের কাঁটাতারে মোড়া প্রাচীরটিতে অলস ভঙ্গিতে হেঁটে চলেছে একটি শুভ্র বিড়াল। বিড়ালটি দু- এক পা এগিয়েই ফিরে ফিরে তাকাচ্ছে। বার কয়েক অলস ভঙ্গিতে ‘মেও’ ‘মেও’ করে আবারও রাজকীয় চালে এগিয়ে যাচ্ছে। আমি ব্যালকণির ভেজা গ্রীলে মাথা ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। টবে লাগানো পাতা বাহারি গাছগুলো কিছুদিন হল কচি ডালপালা ছেড়েছে।
বৃষ্টির সংস্পর্শে তাদেরকে দেখাচ্ছে উচ্ছল কিশোরীর মত। ডানহাতে গাছের কচি লতায় হাত বুলাতেই পাতা চুইয়ে দু’ফোটা জল গড়িয়ে পড়ল হাতে। সেই সাথে ভারী চোখ জোড়াতেও নামল জলের বহর। আমি মুখ ফুলিয়ে শ্বাস টেনে নিয়ে আবারও রাস্তার দিকে তাকালাম। মনটা ভীষণ খারাপ আজ।
চোখদুটোও অভিমানে ফুলে ফেঁপে আছে। ঈর্ষান্বিত মনটা বার বারই বলে উঠছে, ‘শুভ্র নামক ছেলেটা তাসনিম নামক অতি সুন্দরী মেয়েটার সাথে কথা বলবে কেন? যদিও বা বলে, কথার সাথে সাথে চমৎকার সেই হাসিটাই বা দেবে কেন? তবে কি শুভ্র তাকে ঝংকার তোলা সেই হাসি শোনার অধিকারটা দিয়ে দিল? সত্যিই দিয়ে দিল?’ কথাগুলো ভাবতেই আবারও চোখের কোণা চিকচিক করে উঠল।
নিজেকে পৃথিবীর সব চেয়ে দুঃখী আর অসহায় বলে বোধ হতে লাগল। সুপ্ত মনটা তাসনিম নামক প্রাণীটাকে কল্পনা করতে লাগল ভয়ানক ডাইনি রূপে। সেই সাথে আমি হয়ে উঠলাম দুর্সাহসী রাজকন্যা। যার কাছে আস্ত একটা জাদু ঝুলি থাকবে। রাজপুত্রকে…… আমার ভাবনার মাঝেই রাস্তা থেকে ছেলেদের কোলাহলের আওয়াজ কানে এলো। আমি ঘাড় এগিয়ে নিচের দিকে তাকাতেই ১৪/১৫ বছরের পাঁচ-ছয়জন ছেলেকে দেখতে পেলাম। সবার প্যান্টের পকেটেই বই-খাতার অংশাবশেষ দেখা যাচ্ছে।
টিউশনি ফেরত ছেলেগুলো গোল হয়ে দাঁড়িয়ে বেল পুড়ি খাচ্ছে আর হাসাহাসি করছে। তাদের বেল পুড়ি খেতে দেখে আমার কষ্টটা যেন আকাশ ছুঁলো। বেল পুড়ি খেতে না পাওয়ার দুঃখে চারতলা থেকে লাফিয়ে আত্মাহুতি দেওয়ার মত ভয়ানক চিন্তাও ঘুরপাক খেয়ে গেল পুরো মস্তিষ্ক জুড়ে। কিছুক্ষণ মুখ ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে থাকার পর পাশের ব্যালকণিতে থেকে চেঁচিয়ে বলে উঠলেন কেউ,
—–” এই সাইম? খাওয়া শেষ হলে উপরে বেল পুড়ি দিয়ে যাস তো।”
সাইম উপরের দিকে তাকাল। ব্যালকণিতে শুভ্র ভাইকে দেখতে পেয়ে মুচকি হাসল। চেঁচিয়ে উঠে বলল,
—-” কয় প্লেট ভাইয়া?”
শুভ্র ভাই আমার দিকে তাকালেন। আমি মুখ ফিরিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে রইলাম। শুভ্র ভাই হালকা কেশে দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করলেন। কিন্তু লাভ বিশেষ হল না। আমি উল্টো দিক তাকিয়ে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। শুভ্র ভাই দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
—-” ম্যাডাম? ছোট্ট পেটটাতে কতটুকু জায়গা হবে?”
আমি উত্তর দিলাম না। শুভ্র ভাই কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে চেঁচিয়ে উঠে বললেন,
—-” মামাকে সবগুলো দিয়ে দিতে বল। ঠেলাতে যতগুলো আছে সব।”
আমি চমকে উঠে উনার দিকে তাকালাম। বিস্ময় নিয়ে বললাম,
—-” কিহ! পাগল? এতো খাবে কে?”
শুভ্র ভাই হাসলেন। ভ্রু নাচিয়ে বললেন,
—-” বাহ্ কথা ফুটল তাহলে? তো? কয় প্লেট চায়?”
আমি মুখ ভেঙিয়ে অন্যদিকে তাকালাম। সাইমকে ইশারা করে বললাম,
—-” দুই প্লেট।”
সাইম চেঁচিয়ে উঠে বলল,
—-” দুই প্লেট শুভ্র ভাই?”
শুভ্র ভাই হেসে বললেন,
—-” ম্যাডাম যা বলে তাই।”
শুভ্র ভাইয়ের কথাটা শেষ হতেই রাস্তার কিনারায় কাজিনদের দল চোখে পড়ল। তাদের পেছনেই ভারিক্কি চালে হেঁটে আসা বাবা, মা, ছোট ফুপ্পি, ফুপাসহ সবাই। সাইমকে বেল পুড়ির কথা বলতে দেখেই নিচ থেকে সর্বশক্তি দিয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন আলিফ ভাই,
—-” শুভ্র ভাই? সব বিল তোমার।”
—-” জিন্দেগীতে না। তোরা আমাকে ফকির বানিয়ে ছাড়বি।”
পাশ থেকে অদুদ ভাইয়া বললেন,
—-” ওমন করছ কেন? তুই বড়লোক্স মানুষ। আমাদের মতো মিসকিনদের ওপর দয়ামায়া দেখা ভাই।”
শুভ্র ভাইকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই বেল পুড়ির ঠেলার ওপর হামলে পড়ল সবাই। শুভ্র ভাই অসহায় দৃষ্টিতে তাকালেন। দাঁতে দাঁত চেপে বললেন,
—-” তোর ভাই সম্প্রদায় একদিন আমায় পাগল করে ছাড়বে। তোদের গোষ্ঠীতে কি সবাই পেটুক নাকি? শালার শালাময় ঝামেলা সব!”
উনার কথায় ফিক করে হেসে ফেললাম আমি। উনি ধমকী ধামকী দিয়ে আমাকে নিয়ে নিচে নেমে গেলেন। সারাদিনে জমিয়ে রাখা অভিমানগুলো যেন রঙিন প্রজাপতি হয়ে আকাশময় উড়ে বেড়াতে লাগল। ভালোবাসাময় বিশাল আকাশটাকে শুধু এবং শুধুই আমার নামে লিখে দিল!
___________________
এই পৃথিবীতে জন্মানোর পেছনে প্রত্যেকটা মানুষের আলাদা আলাদা উদ্দেশ্য থাকে। শুভ্র ভাইয়েরও আছে। আমার ধারণা ঠিক হলে, তার জন্মানোর পেছনে প্রথম এবং একমাত্র উদ্দেশ্য হল আমাকে বিরক্ত করা। আর আমার উদ্দেশ্য হল উনার উদ্ভট কথাবার্তায় সাধ্যাতীত বিরক্ত হওয়া। আজও তাই হচ্ছি। চোখে-মুখে এক আকাশ বিরক্তি টেনে নিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছি। শুভ্র ভাই এদিক-ওদিক কিছু একটা খুঁজছেন। কিছুক্ষণ খুঁজাখুঁজির পর স্থির হয়ে দাঁড়ালেন। ভ্রু কুঁচকে আমাকে নিচ থেকে উপর পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করলেন। কপাল কুঁচকে বললেন,
—-” সোজা হয়ে দাঁড়া। এভাবে বেঁকে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?”
উনার কথায় চোখ-মুখ কুঁচকে তাকালাম আমি। নিরস গলায় বললাম,
—-” আপনার প্রয়োজনটা কি সেটা বলুন। আমি বেঁকে দাঁড়িয়ে আছি নাকি স্ট্রেইট দাঁড়িয়ে আছি সেটা কোনো ইম্পোর্টেন্ট বিষয় নয়।”
শুভ্র ভাই অনামিকা আঙ্গুলে চাবি ঘোরাতে ঘোরাতে বললেন,
—-” অবশ্যই ইম্পোর্টেন্ট। বেঁকে দাঁড়িয়ে থাকা কোনো পোলিও রুগীকে তো আর কাজের হুকুম দেওয়া যায় না। তারা এমনিতেই রুগী। রুগীদের কাজ করার অনুমতি নেই।”
—-” তাহলে আমিও রুগী। এবার দয়া করে নিজের কাজটা নিজে করুন।”
কথাটা বলে ঘুরে দাঁড়াতেই লম্বা বিনুনি টেনে ধরলেন উনি। আকস্মিক বাধায় ব্যথায় আর্তনাদ করে উঠলাম আমি। চুলে হাত দিয়ে উনার দিকে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকাতেই নির্মল হাসি হাসলেন। বিনুনিটা আরো একদফা টেনে দিয়ে মিষ্টি করে গাইলেন,
—-” You’re light, you’re the night
you’re the color of my blood
you’re the cure, you’re the pain
you’re the only thing I wanna
touch…..”
উনার হঠাৎ গেয়ে উঠায় বিস্মিত চোখে তাকিয়ে রইলাম আমি। উনি নিচের ঠোঁট কামড়ে চোখ টিপলেন। ফিচেল গলায় বললেন,
—-” ইংরেজি টিংরেজি আদৌ বুঝিস? কি যন্ত্রণাদায়ক ফিলিংস হচ্ছে বুঝতে পারছিস?”
আমি সরু চোখে তাকালাম। উনার কথার আগামাথা বুঝতে না পেরে হঠাৎই ভীষণ বিরক্ত বোধ করলাম। উনি কয়েক পা এগিয়ে একদম আমার সামনাসামনি এসে দাঁড়ালেন। আমি সরে যেতে নিতেই চুলের বিনুনিতে টান পড়ল। উনি ফিচেল হেসে আমার মুখের ওপর ঝুঁকে এলেন। উনার এমন ব্যবহারে হঠাৎই ভীষণ হকচকিয়ে গেলাম আমি। ভ্রু কুঁচকে বার কয়েক ঢোক গিললাম। উনি আরো খানিকটা ঝুঁকে এসে হাতের চাবিটা চোখের সামনে উঁচু করে ধরলেন। কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বললেন,
—-” ‘চাবি’ কোন ভাষার শব্দ?”
এতো ঢং করার পর উনার এমন প্রশ্নে বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। উনি কিছুটা সরে গিয়ে ভ্রু নাচিয়ে বললেন,
—-” বল।”
আমি চোখ পিটপিট করে তাকালাম। সন্দেহী গলায় বললাম,
—-” আপনি আমায় পড়াচ্ছেন?”
আমার কথায় হেসে ফেললেন উনি। হাসি চেপে বললেন,
—-” কেন? তুই কি গভীর কিছু ভেবেছিলি নাকি?”
উনার মুখে পর পর এমন সব কথা শুনে চোয়াল ঝুলে পড়ার জোগাড় হল আমার। কপট রাগ নিয়ে বললাম,
—-” আপনি….আপনি আসলেই একটা বদমাশ।”
উনি হাসলেন। আলমারি থেকে একগাদা কাপড় বের করে বললেন,
—-” আচ্ছা? তাহলে ‘বদমাশ’ শব্দটা কোন ভাষা থেকে এসেছে, বল তো? আমার ওপর একটা শব্দ প্রয়োগ করবি আর সেই শব্দটা কোন ভাষার মেহমান তা জানবি না, তা তো মেনে নেওয়া যায় না। বল বল।”
আমি নাক ফুলিয়ে উনার দিকে তাকালাম। বিনুনিটা টেনে ছাড়িয়ে নিয়ে মুখ ভেঙিয়ে রুম থেকেই বেরিয়ে এলাম। উনি চেঁচিয়ে উঠে বললেন,
—-” আরে! যাচ্ছিস কই? আমার জামা-কাপড় ধুয়ে দিয়ে যা। চার পাঁচ বছর পর তো বরের কাপড়-চোপড় ধুয়েই জীবন কাটবে। এখন থেকেই ট্রাই কর, বুঝলি?”
আমি দরজার বাইরে থেকে মাথা হেলিয়ে উনার দিকে তাকালাম। ডানপাশের চুলগুলো কানে গুঁজে দিয়ে বললাম,
—-” জি নট। নিজের কাজ নিজে করতে শিখুন। চার-পাঁচ বছর পর তো বউয়ের কাপড়-চোপড় ধুয়ে ধুয়েই জীবন কাটবে। এখন থেকে শিখে রাখলে ভালো হয় না? তাছাড়া, আমার বর আমাকে ওয়াশিং ম্যাশিন কিনে দেবে। হুহ।”
শুভ্র ভাই হেসে ফেললেন। কাপড়গুলো বিছানায় রেখে হাত ভাজ করে দাঁড়ালেন। সরু চোখে তাকিয়ে বললেন,
—-” তাই নাকি? তোর বর এতো ভালো হবে বলে তো মনে হচ্ছে না। আমার সিক্স সেন্স বলছে……. ”
—-” আপনার ফালতু সিক্স সেন্সের গল্প আমি শুনব না।”
—-” আরে, শোন তো। আমি তো তোকে রোমান্টিক উপন্যাস শুনাচ্ছি না। আমি তোকে কঠিন বাস্তবতার গল্প শুনাচ্ছি।”
আমি বিরক্তি নিয়ে বললাম,
—-” আমি আপনার কঠিন বাস্তবতার গল্প শুনতে ইচ্ছুক নই।”
উনি ঠোঁট টিপে হাসলেন। এগিয়ে এসে আমার সামনাসামনি দাঁড়ালেন। ভ্রু নাচিয়ে বললেন,
—-” তাহলে কি রোমান্টিক উপখ্যান শুনতে চাস? তুই শুনতে চাইলে আমি…..”
উনার কথার মাঝেই কলিংবেল বাজল। উনি সামনের দিকে উঁকি দিতেই কিছুটা সরে দাঁড়ালাম আমি। বসার ঘরের দিকে যেতে যেতে ঝাঁঝালো গলায় বললাম,
—-” এসব রোমান্টিক উপখ্যান আপনার বাচ্চাকালের প্রেমিকাকে শুনান। আমাকে নয়…. মেয়েবাজ পুরুষ মানুষ!”
উনি হাত বাড়িয়ে আমাকে ধরার চেষ্টা করে বললেন,
—-” এই যে আম্মুর ছেলের বউ? আমার কাপড়গুলো তো ধুয়ে দাও!”
উনার কথা শুনেও না শোনার ভান করে বসার ঘরে এসে দাঁড়ালাম। সোফায় উবু হয়ে মোবাইলে গেইম খেলছেন আলিফ ভাইয়া,রাতুল ভাইয়া আর তুষার ভাইয়া। দরজার বিকট কলিংবেলের শব্দেও তাদের ধ্যান ভঙ্গ হচ্ছে না। আমি কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়ে বাঁকা চোখে তাকালাম। শক্ত গলায় বললাম,
—-” আশ্চর্য! এইখানে বসে থেকেও দরজা খুলছ না কেন?”
আলিফ ভাইয়া ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়েই জবাব দিলেন,
—-” কভার দিচ্ছি। সামনে থেকে সর তো! গেইমে হারলে তোর খবর আছে।”
আমি ভ্রু কুঁচকে তাকালাম। মনে মনে তৎক্ষনাৎ শক্ত একটা দোয়া করলাম। মুখে বললাম,
—-” কভার দিচ্ছি! এমন একটা ভাব যেন পৃথিবী উদ্ধার করে ফেলছে। আজাইরা পাবলিকের আজাইরা কাজ।”
কথাগুলো বলে এক মুহূর্ত দাঁড়ালাম না আমি। দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে থাকা অস্থির মানুষটাকে মুক্ত করতে দরজার দিকে এগিয়ে গেলাম। কপাল কুঁচকে বিরবির করতে করতে দরজা খুলতেই একজোড়া কৌতূহলী চোখের ওপর চোখ পড়ল। মহিলাটি আমাকে আগাগোড়া নিরক্ষণ করে বললেন,
—-” বাড়ির বউয়ের এটা কেমন ব্যবহার? মুরুব্বিদের যে সালাম দিতে হয়, জানে না নাকি? মাথায় কাপড়টাও নাই।”
আমি ভ্রু কুঁচকে তাকালাম। ‘আমি শুভ্রর বউ’ এই ধারণাটা এখনও উনি মনেপ্রাণে ধারণ করে রাখায় বেশ অবাক হলাম। এই মহিলার কি কমন সেন্স লেভেল জিরো? আমাকে দরজা আগলে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তিক্ত মুখে তাকালেন উনি। আমার হাতটা সরিয়ে নিজে নিজেই ঘরে ঢুকে গেলেন। তার পেছন পেছন ঢুকল পিংকি নামের মেয়েটি। আমি দরজাটা লাগিয়ে সরু চোখে তাকিয়ে রইলাম। মহিলাটি বসার ঘরের সোফার দিকে তাকিয়ে থমকে দাঁড়ালেন। চোখ ছোট ছোট করে বললেন,
—-” তোমরা কে? কে হও?”
আলিফ ভাই মুখ তুলে না তাকিয়েই বলল,
—-” আপনি যা ভাবছেন তাই।”
—-” মানে?”
রাতুল ভাই মুখ তুলে তাকালেন। আমাকে ইশারা করে থমথমে গলায় বললেন,
—-” ওর ভাই।”
মহিলাটি একবার আমার দিকে চোখ বুলিয়ে নিয়ে আবারও রাতুল ভাইয়ার দিকে তাকালেন। বিস্ময় নিয়ে বললেন,
—-” তোমরা সবাই বউয়ের ভাই?”
আলিফ ভাইয়া বললেন,
—-” কেন? কম মনে হচ্ছে? আরো দু’জন ছাদে আছে। একজন ভেতরের ঘরে ঘুমাচ্ছে। আর দু’জনকে বাসায় রেখে আসছি। আরও দুই একটা পৃথিবীতে ল্যান্ড করবে করবে ভাব। আই মিন, প্রক্রিয়া চলছে।”
মহিলাটি সরু চোখে তাকিয়ে রইলেন। আলিফ ভাইয়া উনার সাথে মজা করছেন কিনা বুঝার চেষ্টা করছেন। আমি ঠোঁটে ঠোঁট চেপে দাঁড়িয়ে আছি। বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকার পর কিছু বলার জন্য মুখ খু্ললেন উনি। ঠিক তখনই শার্টের বোতাম লাগাতে লাগাতে বেরিয়ে এলেন শুভ্র ভাই। মহিলাটিকে দেখে মিষ্টি করে হাসলেন। কাছাকাছি দাঁড়িয়েই হাস্যোজ্জল কন্ঠে বললেন,
—-” আসসালামু আলাইকুম আন্টি। কেমন আছেন?”
এতোক্ষণ উল্টাপাল্টা উত্তর পেয়ে অনেকটাই বিরক্ত ছিলেন মহিলা। শুভ্র ভাইয়ের কথায় বিরক্তিটা কাটিয়ে প্রফুল্ল মনে হাসলেন। গদগদ কন্ঠে বললেন,
—-” ওয়ালাইকুম আসসালাম বাবা। তুমি ভালো আছ তো? কি লক্ষ্মী একটা ছেলে। দেখলেই প্রাণ জুড়িয়ে যায়। তোমার মা কোথায়? শুনলাম তোমার বাবা স্টোক করেছেন? তাই দেখতে এলাম।”
শুভ্র ভাই হাসলেন। নম্র গলায় বললেন,
—-” আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। আম্মু রুমেই আছেন। এখানে দাঁড়িয়ে না থেকে ভেতরে চলুন আন্টি। ডানদিকের রুমটাই আম্মুর।”
মহিলাটি খুশি হয়ে শুভ্র ভাইয়ের দেখিয়ে দেওয়া রুমের দিকে পা বাড়াতেই পেছন থেকে চিৎকার করে ‘দুলাভাই’ বলে ডেকে উঠলেন আলিফ ভাই। উনার চিৎকারে শুভ্র ভাই চমকে তাকালেন। আমি দু’হাতে মুখ চেপে অন্যদিকে তাকালাম। তুষার ভাইয়া আর রাতুল ভাই ফিক করে হেসে উঠলেন। শুভ্র ভাই অবাক হয়ে বললেন,
—-” কি ব্যাপার?”
আলিফ ভাই দাঁত কেলিয়ে বললেন,
—-” কিছু না ভাই। তোমার কাঁধের দিকে ধুলা লেগে আছে। এই জন্য বললাম ধুলা ভাই।”
শুভ্র ভাই সরু চোখে তাকালেন। কিছু বলবেন তার আগেই ফোন কানে বেরিয়ে এলো সেই মধ্যবয়স্কা মহিলা। সবাই তার দিকে তাকাতেই আবারও ‘দুলাভাই’ বলে চেঁচিয়ে উঠলেন আলিফ ভাই আর রাতুল ভাই। শুভ্র আবারও চমকে উঠলেন। বুকে থুতু ছিটিয়ে অবাক দৃষ্টিতে তাকালেন। হঠাৎ চিৎকারে খানিকটা হকচকিয়ে গেলেন সেই মহিলা। হাত থেকে ফোনটা পড়ে যেতে যেতেও ধরে ফেললেন। কিছুক্ষণ বিস্মিত চোখে তাকিয়ে থেকে ব্যালকণির দিকে চলে গেলেন। আমি কোনোরকম হাসি চেপে কিছুটা সরে দাঁড়ালাম। শুভ্র ভাই কপাল কুঁচকে বললেন,
—-” ওই? কি সমস্যা? একটা থাপ্পড় লাগাব। হঠাৎ দুলাভাই দুলাভাই করে চেঁচাচ্ছিস কেন? আমাকে কি বলদ মনে হয়?”
আলিফ ভাই ইনোসেন্ট মুখ নিয়ে বলল,
—-” ধুর! ইন্ডাইরেক্টলি যে তোমাকে বোনের জামাই বলে স্বীকৃতি দিচ্ছি বুঝতে পারছ না?”
শুভ্র ভাই ঘাড় কাত করে ভ্রু বাঁকালেন। আলিফ ভাই দাঁত কেলিয়ে বললেন,
—-” এই খুশিতে একটা ট্রিট দিয়ে দাও ভাই। আই মিন দুলাভাই।”
—-” আমিও সেটাই ভাবছি, অনেকদিন ধরে কাউকে জুতোপেটা করা হয় না। আই মিন জুতো দিয়ে বাংলা মাইর দেওয়া হয় না। তোরে দিয়েই শুরু করব, আয়!”
_____________________
আকাশ জুড়ে কালো মেঘের ছুটোছুটি। ভোর রাতের ঢালা বৃষ্টিটা সারাদিন ঝিমঝিমিয়ে বিকেলে এসে প্রগাঢ় রূপ ধারণ করেছে। সেই সাথে পরিবেশটাতে ছড়িয়ে দিয়েছে এক মুঠো শীতকাল। ব্যালকণির পর্দা ছাপিয়ে ভারী ফোঁটা এসে পড়ছে ব্যালকণির সাদা রঙা মেজেতে। চারতলার ওপরও নাম না জানা ফুলের তীক্ষ্ণ গন্ধ ভেসে আসছে। বৃষ্টির এই ঝুপঝাপ শব্দের সাথে চঞ্চল হয়ে উঠেছি প্রতিটি প্রাণ। ঠান্ডা ঠান্ডা আবহে কাজিনরা মিলে টেবিল সাজিয়ে বসেছি। মায়ের পাঠানো ভূনা খিচুড়ি আর গরুর মাংস সামনে নিয়ে পরম উৎসাহে গিলে চলেছি। বৃষ্টিভেজা দিনে ভোজন প্রিয় বাঙালির জন্য খিচুড়ি মানেই মহোৎসব। খিচুড়ির সাথে মাংস আর মাছ ভাজি হলে তা যেন পরম সুখ। আমরাও সেই সুখে সুখী হয়ে গরুর হাড় চিবুচ্ছি। এমন সময় খাওয়া থামিয়ে ভ্রু কুঁচকে তাকালেন আলিফ ভাই। সন্দেহী গলায় বললেন,
—-” টেবিলের নিচ দিয়ে প্রেমবিভ্রাট ঘটাচ্ছ কে ভাই?”
উনার কথায় সবাই চোখ তুলে তাকাল। একে অপরকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করার পরও যখন চোর ধরা গেল না। তখন শুভ্র ভাইয়ের দিকে তাকালেন আলিফ ভাই। মুখ ফুলিয়ে কিছু বলবেন তার আগেই গম্ভীর গলায় উত্তর দিলেন শুভ্র ভাই,
—–” উল্টা পাল্টা কথা বলবি তো লাথ্থি দিয়ে চারতলা থেকে ফুটপাতে ফেলে দেব। আমার এমন থার্ডক্লাস প্রেম কোনদিনই পায় না। অযথা আমায় ঘাটতে আসবি না।”
আলিফ ভাই কিছু বললেন না। ‘টেবিল তলার প্রেম’ এর রহস্যোদ্ধার না করতে পেরে সবাই আবারও খাবারে মন দিল। কয়েক মিনিট পর আবারও চেঁচিয়ে উঠলেন আলিফ ভাই। গোল গোল চোখে তাকালেন,
—–” আবার! আবার খোঁচা মারল! সত্যি করে বলো কে করছ এই কাজ? প্রেম করবা ভালা কথা আমার পায়ে লাথি মারো কেন ভাই?”
আবারও এক দফা পর্যবেক্ষণ চলল। আলিফ ভাই ব্যর্থ চিত্তে আমার দিকে তাকালেন। ভ্রু কুঁচকে বললেন,
—–” তুই?”
আমি অবাক হয়ে বললাম,
—-” আমি তোমাকে লাথি মারতে যাব কেন? আজব।”
—-” না। স্টেশন ভুল করে চলে আসতেও পারে। পারে না?”
আমি নাক মুখ ফুলিয়ে বললাম,
—-” জ্বি না। পারে না।”
আলিফ ভাই কিছু বললেন না। দীর্ঘশ্বাস ফেলে সবার মুখের দিকে তাকালেন। অদুত ভাইকে ইশারা করে বললেন,
—-” ভাইয়া!!”
অদুত ভাই জিভ কেটে বললেন,
—-” নাউজুবিল্লাহ! ছোট ভাই-বোনের সামনে সরি ছোট ভাই-বোনদের চোখের নিচ দিয়ে এসব অশ্লীলতা আমি করি না। অশ্লীলতা হবে…….”
শুভ্র হালকা কেশে বললেন,
—-“ভাই তুই মুখে ব্রেক লাগা। যেকোনো সময় এক্সিডেন্ট হয়ে যেতে পারে।”
শুভ্র ভাইয়ের কথায় হেসে উঠল সবাই। আলিফ ভাই এবার তন্নী আপুর দিকে তাকালেন। ভ্রু নাচিয়ে বললেন,
—-” কি গো বড় ভাইয়ের বান্ধুপি? তাহলে কি আপনি?”
তন্নী আপু বিষম খেলেন। চোখ বড় বড় করে বললেন,
—-” ছি! একদমই না।”
আলিফ ভাই বিরক্ত চোখে তাকালেন। অধৈর্য্য গলায় বললেন,
—–” ছি! একদমই না। সবার উত্তর যদি ‘ছি’ই হয় তাহলে লাথিটা মারল কে? আমি কি নিজের পায়েই নিজে লাথি মেরেছি নাকি?”
শুভ্র ভাই শান্ত চোখে তাকালেন। বললেন,
—–” মারতেও পারিস। তোর জন্য কিছুই অবিশ্বাস্য নয়।”
আলিফ ভাই অসহায় চোখে তাকালেন। কিছুক্ষণ পর যথারীতি আবারও চেঁচিয়ে উঠলেন আলিফ ভাই। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,
—-” এই ষড়যন্ত্র আমি মানব না। এই তরুণ সিরাজ-উদ-দ্দৌলা হারবে না। কিছুতেই না। এই আদিবা? আদিবা?”
আদিবা ব্যালকণিতে বৃষ্টির পানি দিয়ে খেলছিল। আলিফ ভাইয়ার ডাকে আধভেজা জমা নিয়ে দৌঁড়ে এলো। কৌতূহলী গলায় বলল,
—-” বয়ো।”
—-” কোনো বলাবলি নেই। ডিরেক্ট ঢুকে যা।”
আলিফ ভাইয়ের কথার ভাবার্থ বুঝতে না পেরে বড় বড় চোখ মেলে তাকাল আদিবা। আলিফ ভাই খানিকটা ঝুঁকে বললেন,
—-” এই মুহূর্তে তুই মানুষ না। তুই হলি ক্যামেরা। জীবন্ত ক্যামেরা। ডিরেক্ট টেবিলের তলায় ঢুকে যা। যার পা নড়বে তার পায়েই কামড় বসাবি। প্রতি কামড়ের জন্য একটা করে ডেইরি মিল্ক। কুইক!”
আদিবা মুখ ফুলিয়ে বলল,
—-” পা পঁচা।”
—–” আরে পাগলা, পায়ের তলায় কামড় দিতে কে বলেছে তোকে? কামড় তো দিবি হাঁটুর নিচ বরাবার। ঢুক জলদি। প্রতি কামড়ের জন্য দুটো ডেইরি মিল্ক পাবি যা। অফার সীমিত।”
আদিবা রাজি হল। আদিবাকে টেবিলের নিচে একদম মাঝ বরাবর বসিয়ে দিয়ে খাবারে মনোযোগ দিলেন আলিফ ভাইয়া। আমরা সবাই খাবার রেখে চুপচাপ বসে রইলাম। কিছুক্ষণ পর আবারও চেঁচিয়ে উঠলেন আলিফ ভাই। চোখ বড় বড় করে টেবিলের নিচে তাকালেন। উনার সাথে সাথে আমরাও তাকালাম…..
রোদ শুভ্রর প্রেমকথন সম্পূর্ণ গল্পের লিংক
https://kobitor.com/rodsuvro/
[ বিঃদ্রঃ পড়াশোনা নিয়ে প্রচুর চাপে আছি। তাই লিখতে পারছি না বা দেরি হচ্ছে। সময় সল্পতার কারনে তেমন একটা সাজিয়ে গুছিয়ে লিখতেও পারি নি। কেমন যেন অগোছালো আর অনুভূতিহীন হয়েছে পুরো লেখা। রি-চেইক করারও সময় হয় নি। দুঃখিত]