রোদ শুভ্রর প্রেমকথন পর্ব ৫৩
লেখনীতে- নৌশিন আহমেদ রোদেলা
আজ থেকে উনিশ বছর আগে, বুধবার দিবাগত রাতে যখন জন্মগ্রহণ করেছিলাম তখন বোধকরি স্বপ্নেও চিন্তা করিনি ‘বুধ’ মহাশয় ভূতের মতোই পেছনে লেগে থাকবে আজীবন। জীবনে প্রথম যেদিন আলমারিতে আম্মুর কাপড়ের তলা থেকে শ’খানেক টাকা সরালাম, আইসক্রিম খাব বলে। সেদিনও ছিল বুধবার। তখন গুণতে জানতাম না। ফলাফল, আম্মুর হাতে অগণিত মার খেলাম। আমার আইসক্রিম খাওয়ার স্বাদ একরকম মিটে গেল। হাইস্কুলে গণিতের খাতায় যেদিন প্রথম লাড্ডু পেলাম সেদিনও ছিল বুধবার।
স্কুলে যাওয়ার পথে একবার প্রেমে পড়েছিলাম। ছেলেটির সুন্দর চেহারা দেখে একরকম লাড্ডু ধরনের প্রেম। যেদিন ছেলেটি পথ আটকিয়ে, তুলে নেওয়ার ভয় দেখিয়ে আমাকেই প্রোপোজ করে ফেলল সেদিনও ছিল বুধবার। শুভ্র ভাইয়ের সাথে যেদিন আমার প্রথম দেখা? আশ্চর্যরকম ভাবে সেদিনও ছিল বুধবার! শুভ্র ভাইয়ের সাথে যেদিন আমার হুট করে রেজিস্ট্রি ফেজিস্ট্রি হয়ে গেল সেদিনও সেই বুধবারই। আমি বুঝে গিয়েছিলাম, আমার আর বেশিদিন বাঁচা হবে না। এই বুধবারেই শুভ্র নামক ভূতের হাতে মৃত্যু আমার নিশ্চিত। সৌভাগ্যবশত এখনও আমি বেঁচে আছি। কিন্তু বুধ মহাশয় শনির মতো চিপকে থেকে ঘটনা যা ঘটানোর ঘটিয়ে ফেলেছেন।
জুলাই মাসের একুশ তারিখ। আমি মটকা মেরে পড়ে আছি। বুকের উপর ইয়া মোটা এক উপন্যাসের বই। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। জানালার একটা পাল্লা খোলা। অল্প অল্প ছাঁট আসছে। আমি দুই লাইন করে পড়ছি আর বাইরে তাকিয়ে বৃষ্টি দেখছি। ঠিক সেই সময়, বুধবারের ভূত মহাশয়, শুভ্র ভাই এলেন বৃষ্টিতে ভিজে। উনার হাতে বুদ্ধদেব গুহ’র বই, Madhukari – Art of Honey gathering. শুভ্র ভাই বইটা আমার টেবিলের উপর রাখলেন।
আধ ভেজা পাঞ্জাবিটা ঝাড়তে ঝাড়তে অদ্ভুত এক কাজ করে ফেললেন। আমার গায়ের কাঁথাটা আচমকা টেনে নিয়ে মাথা মুছলেন। আমি হতভম্ব। ভারী উপন্যাসের বইটা ধপ করে পড়ে গেল নাক বরাবর। বোঁচা নাক বুঝি আরও একটু বোঁচা বনে গেল। নাকের কথা ভেবেই রাগে শরীরটা জ্বলে উঠল আমার। আমি তেজ নিয়ে উঠে বসলাম। শুভ্র ভাই নিরুদ্বেগ মুখে বিছানায় বসে ভেজা পা ঘষলেন কাঁথায়। আমি কাঁথা টেনে ধরে বললাম,
‘ আপনার মতো বিখ্যাত যুব সমাজ কাঁথা দিয়ে হাত-পা মোছামুছি করছে জানলে পাবলিক কী বলবে শুভ্র ভাই? আমার কাঁথা ছাড়ুন! খবরদার আমার কাঁথা দিয়ে মোছামুছি করবেন না।’
শুভ্র ভাই ভুরু বাঁকিয়ে তাকালেন। কাঁথাটা আচমকা টেনে নিয়ে বললেন,
‘ তোর! তোর কাঁথা হয় কী করে? এই কাঁথা সেলাই করা, কেনা, ধোঁয়া কোনটাতে তোর বিন্দুমাত্র অবদান আছে? নেই। শুধু গায়ে দিয়েই মালিক বনে গেলে তো সমস্যা। তোর মতো অলস প্রজাতির জন্যই পৃথিবীটা ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। তুই এক অলস, তোর বাপ এক অলস। অলসে অলসে ভরে যাচ্ছে পৃথিবী।’
রাগে-দুঃখে আমার মাথাব্যথা হয়ে গেল। হাতের মোটা উপন্যাসের বইটা ছুঁড়ে উনার মাথা ফাটিয়ে দেওয়ার তীব্র ইচ্ছে দমন করলাম। কলেজে পৌরনীতির বই কপচেছি। বুঝেছি, কূটনৈতিক সম্পর্ক বজায় রাখতে হবে। শুভ্র ভাইয়ের মতো সবলের সাথে যুদ্ধ জড়ানো মানেই ভয়ংকর মৃত্যু। এই বয়সে মারা যাওয়ার ইচ্ছে না থাকলে যুদ্ধে জড়ানো যাবে না। সুতরাং, সহ্য করায় শ্রেয়। আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম,
‘ আমাকে বকলেন ভালো কথা। বাবাকে নিয়ে উদ্ভট কথা বলবেন না। বাবাকে আমি সবচেয়ে ভালোবাসি। বাবাকে নিয়ে কিছু বললে মাথায় ইট মেরে মাথা ফাটিয়ে দিব।’
‘ কী সাংঘাতিক মেয়ে তুই! একফোঁটা মেয়ে হয়ে আমাকে ধমকি দিচ্ছিস? এই তোর বয়স কত? আমি তোর থেকে কয় বছরের বড়? তোকে তো বিনা বিচারে ছাদ থেকে ফেলে দেওয়া উচিত, বেয়াদব।’
শুভ্র ভাইয়ের ধমকে অসহায় চোখে তাকালাম। ক্লান্ত কন্ঠে বললাম,
‘ বাবাকে বললেন বলেই না বললাম। বাবাও তো আপনার বড়।’
শুভ্র ভাই বালিশ টেনে বালিশে ঠেস দিয়ে বসলেন। বিরক্ত হয়ে বললেন,
‘ তোর বাপ!’
আমি কপাল কুঁচকে তাকাতেই কথা বদলে বললেন,
‘ আই মিন সেই শ্রদ্ধেয়, মহামান্য ধুরন্ধর লোককে তো দিনরাত ভর্ৎসনা করা উচিত। আমি অতি ভদ্র বলে গালি না বলে ভর্ৎসনা বললাম৷ অভদ্র হলে বলতাম, গালি দেওয়া উচিত। লোকটা কতটা পাল্টিবাজ! এই যে বাংলাদেশ ধীরে ধীরে ফতুর হয়ে যাচ্ছে? দোষটা কার জানিস? তোর বাপের! নিজে এক ধুরন্ধর। মেয়েকে বানিয়েছে আরেক ধুরন্ধর। ক’দিন পর নাতি-নাতনিও হবে সব ধুরন্ধর। ধুরন্ধরে ধুরন্ধরে ভরে যাবে বিশ্ব। কতটা ধুরন্ধর হলে তুই আমায় ফেসবুকে ব্লক মারতে পারিস, আমি তো চিন্তায় করতে পারছি না।’
আমার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। খুব সাবধানে শুভ্র ভাইয়ের মুখের দিকে তাকালাম৷ বুঝতে পারলাম, কপালে আজ বুধ ঘুরছে। ভূতের ঘাড়ে ভর করে বুধ মহাশয় এসে গিয়েছে। শুভ্র ভাইয়ের দিকে চেয়ে বোকা বোকা হাসি দিয়ে বালিশের পাশ হাতড়ে নিজের ওড়না উদ্ধার করলাম। ওড়নাটা গায়ে জড়িয়ে সচেতন দূরত্ব বজায় রেখে এমন একটা ভাব করলাম, যেন এই মাত্র আকাশ থেকে পড়ে ফেটে গিয়েছি,
‘ ব্লক! কীসের ব্লক? কীসের কথা বলছেন শুভ্র ভাই?’
শুভ্র ভাই কুটিল চোখে তাকালেন। পাঞ্জাবির হাতা গুটিয়ে বললেন,
‘ আমি বুঝাব কীসের ব্লক?’
আমি দাঁত বের করে নার্ভাস হাসি দিয়ে বললাম,
‘ না ব-বু-বু-বুঝালে কীভাবে বু-বুঝব?’
‘ আচ্ছা! আয় বুঝাচ্ছি।’
শুভ্র ভাই এটুকু বলে উঠে দাঁড়ানোর উদযোগ করতেই লাফিয়ে বিছানা থেকে নেমে দাঁড়ালাম আমি। টেবিলের বইগুলো ওড়না দিয়ে ঝাড়তে ঝাড়তে বললাম,
‘ দূ-দূরে। দূর থেকে বুঝান। যত দূর থেকে বুঝানো হয়, আমি তত ভালো বুঝি।’
শুভ্র ভাইকে আমার দিকে গরম চোখে তাকিয়ে থাকতে দেখে অসহায় চোখে চাইলাম। তার থেকেও অসহায় কন্ঠে বললাম,
‘ বিশ্বাস করেন শুভ্র ভাই। আমি এক বছর ধরে ফেসবুকই চালায় না। এক বছর নয় থুক্কু থুক্কু ছয়-সাত মাস। আমি ছয়- সাত মাস ধরে ফেসবুক কী জিনিস জানিই না। আগের আইডিটার মতো এই আইডিটাও গেছে। আপুর কসম। থুক্কু, আপনার কসম৷ না না আপনার বন্ধুর কসম।আমি আপনাকে ব্লক দেব? এতবড় স্পর্ধা আমার আছে? অসম্ভব!’
শুভ্র ভাই ফোন বের করলেন। বাঁকা হেসে আমার সামনে আমার জ্বলজ্যান্ত আইডিটা ধরে বললেন,
‘ এইটা তাহলে ফেইক আইডি? তাই তো বলি এতো ফলোয়ার্স কেন? কাজের মহিলা ছকিনা বানুর তো এতো ফলোয়ার্স থাকার কথা না৷ কোনো সমস্যা নাই। আজ রাতের মাঝেই এই আইডি ভ্যানিশ।’
আমার আত্মাটা যেন ছলাৎ করে বেরিয়ে এসে মেঝেতে গড়াগড়ি খেতে লাগল। আমি পৃথিবীর সব থেকে অসহায় মানবীটির মতো বললাম,
‘ আপনি ফেইক আইডি ব্যবহার করেন? এসব তো ঠিক না শুভ্র ভাই। মানুষকে ধোঁকা দেওয়া পাপ। রীতিমতো দূর্নীতি।’
‘ আহা! ‘হোয়াইট লাই’ শব্দটা শুনেছিস কখনও? আমার কাজটাও হয়েছে অনেকটা সেরকম। আমি সমাজসেবামূলক কাজ করছি। এইযে দেখ, ফেইক আইডিটা খুলেই তোর নামে চালানো মিথ্যা কীর্তিকলাপগুলো ধরে ফেললাম? তুই কোনো চিন্তা করিস না। আজ রাতের মাঝেই কবজ হয়ে যাবে এই আইডির জান।’
‘ ইন্না-লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাহি রাজিউন। শুভ্র ভাই? কী দরকার এতো সমাজ সেবা করার? ছেড়ে দেন না। আইডি বেচারার তো কোনো দোষ নাই।’
শুভ্র ভাই গম্ভীর কন্ঠে জানালেন,
‘ কোনো ছাড়াছাড়ি নেই।’
আমি এবার অতল সমুদ্রে হাবুডুবু খেতে লাগলাম। চোখের সামনে, সরিষা ফুলের জায়গায় দেখতে লাগলাম বিভিন্ন সাইজের বাঁশ। এদিকে গেলে নিজের জীবন শেষ। ওদিকে গেলে আইডির জীবন শেষ। এবার আমি কোনদিকে যাই? শুভ্র ভাই আমার সামনেই তার এক বন্ধুকে ফোন লাগালেন। ফোন ধরেই বললেন,
‘ তোকে একটা লিংক দিচ্ছি জিহান। আজ..’
উনার কথার মাঝপথেই দৌঁড়ে গিয়ে ফোন টেনে নিলাম আমি। শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা যাওয়া আইডির প্রাণ বাঁচাতে পেরে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। শুভ্র ভাই আমার হাত থেকে ফোন কেড়ে ভ্রু নাচালেন,
‘ কী ব্যাপার?’
আমি চোখে-মুখে ধোঁয়া তুলশীপাতা টাইপ ভাব নিয়ে ক্ষীণ কন্ঠে বললাম,
‘ আমার না দুই দিন ধরে প্রচুর হ্যালুসিনেশন হচ্ছে শুভ্র ভাই। দুনিয়ার সব কেমন ভুলে ভুলে যাচ্ছি। এটা যে আমার আইডি মনেই ছিল না। এই মাত্র মনে পড়ল। কসম!’
শুভ্র ভাই ধমক দিয়ে বললেন,
‘ এক চড় দিয়ে তোর কসমের পিন্ডি চটকে ফেলব। বেয়াদব! কত বড় বেয়াদব হলে তুই আমাকে ব্লক মারিস! বড়দের প্রতি কোনো রেসপেক্ট নেই না? তোকে এক ধাক্কা দিয়ে দুই তলা থেকে ফেলে দেওয়া উচিত, ইন্সট্যান্ট! তার থেকেও উচিত কাজ হলো ফুপ্পিকে তোর এই অনৈতিক কর্মকান্ডের কথা জানানো। বড়দের ব্লক ট্লক মেরে ফেসবুকময় করিসটা কী তুই? আমার তো ভাবতেই ঘাম ছুটে যাচ্ছে। আমাদের বংশের মানসম্মান কঁচুকাটা করে ফেলেছিস নির্ঘাত। দাঁড়া তোর খবর আছে।’
আমি নিরীহ কন্ঠে বললাম,
‘ আমার একটু ফেসবুক চালানোর জন্য আপনাদের মানসম্মান যে কচুঁকাটা হয়ে যেতে পারে তা কখনও ভাবনাতেও আসে নাই শুভ্র ভাই। ভাবনাতে আসলে, ফেসবুকের ‘ফ’, ‘ফ’ এর পর ‘ব’ ও উচ্চারণ করতাম না। এতো মানুষ ফেসবুকে আছে কই কারো কাটাকাটির খবর তো পেলাম না?’
‘ পাবি। অবশ্যই পাবি। তোর কী ধারণা? আমার কাছে কোনো খবর নেই? আমরা চোখ বন্ধ করে চলাচল করি? সুপ্ত প্রেমিক, টুপ্ত প্রেমিকের ঢং আমরা দেখি না? তোর এসব যন্ত্রণায় তো ফেসবুকেই ঢোকা যাচ্ছে না। এই কয়দিনেই ফেসবুকের ভবিষ্যত নষ্ট করে ফেলেছিস তুই। ফুপ্পিকে তো এসব ব্যাখ্যা করে বুঝাতে হবে। ফুপ্পিকে যখন তোর ওসব অনৈতিক কর্মকান্ডের কথা জানানো হবে। শাস্তি হিসেবে তোকে যখন কেটেকুটে ব্রহ্মপুত্রে ভাসিয়ে দেওয়া হবে তখন এসব খবর ফটাফট পেয়ে যাবি। চিন্তা নেই।’
আমি চুপ হয়ে গেলাম। মা জননীকে এই অসভ্য পুরুষ কত ধরনের বানোয়াট কথা বলতে পারেন তা ভেবেই গলা শুকিয়ে গেল আমার। মা জননীর ঝাড়ুর সাইজের কথা মনে পড়ে শুধু গলা নয় আত্মা, কলিজা, মেরুদন্ড সবই যেন হয়ে গেল এক একটা মরুভূমির প্রান্তর। আমি হতাশ চোখে তাকালাম। এই মুহূর্তে সটান অজ্ঞান হয়ে যেতে পারলে ভালো হতো। ভালোই ভালোই আপদটা তো কেটে যেতো? আমি দুনিয়ার সব থেকে অসহায় চোখে চেয়ে, মুখটিকে ছোট্ট বিড়াল ছানার মতো আদুরে করে প্রতিজ্ঞা করে ফেললাম,
‘ এই ছোট্ট একটা বিষয়কে রাবারের মতো টানাটানির কী দরকার শুভ্র ভাই? আপনার আইডি আনইউজড থাকে বলে ভুলবশত ব্লক টক হয়ে গিয়েছে। বিশ্বাস করেন শুভ্র ভাই, এই ইহজীবনে আমি আর কোনো মানবকে ব্লক ফ্লক করব না। ভুলবশত তো দূরে থাক। অজ্ঞানবশতও করব না। কসম। তবুও এবার নিস্তার দিন। এসব কাটাকাটির দরকার নাই।’
বুধবারের ভূত মহাশয় মধু কথায় ভুললেন না। বিছানায় আরাম করে বসে বললেন,
‘ যা এক গ্লাস পানি নিয়ে আয়।’
আমি এবারের মতো বেঁচে গিয়েছি ভেবে ঘোড়ার বেগে ছুটে পানি আনলাম। শুভ্র ভাই গ্লাসটা হাতে নিয়েই আদেশ দিলেন,
‘ ফটাফট কানে ধরে উঠবস শুরু করে দে। টানা একশোবার উঠবস করে তবে থামবি। তোর বৃহৎ পাপের জন্য অতি সামান্য শাস্তি দেওয়া হলো। কুইক।’
আমি হতাশ চোখে চেয়ে রইলাম। দুই মিনিটের জন্য ভুলে গেলাম আমি আমার বাড়ি আছি নাকি উনার? আমার বাড়িতে, আমার ঘরে, আমার বিছানায় বসে আমার উপরই রাজকীয় রব ঝারছে! লিমিটলেস অসভ্য মানুষ! এই লোকের অবশ্যই অবশ্যই সিঁড়ি থেকে পড়ে মাথা ফেটে যাওয়া উচিত। আমাকে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বিশাল এক ধমক দিলেন শুভ্র ভাই। এডমিশনের আগে ফোন বাজেয়াপ্ত হয়ে যাওয়ার ভয়ে প্রত্যুত্তর না করে অসহায় চোখে তাকালাম। উনার মন গলবে দূর, টলল না পর্যন্ত। কান ধরা পর্ব শেষ হতেই উনি বললেন,
‘ শাস্তিটা ঠিকঠাক হয়নি। শাস্তি ব্যাক। নতুন শাস্তি দেওয়া হবে। তুই বরং একটা কাজ কর। পা টিপে দে। বড়দের পা টিপে দেওয়া মানেই গন্ডায় গন্ডায় সওয়াব।’
আমি এবার জ্বলন্ত চোখে তাকালাম। একশোবার কানে ধরিয়ে বলছে, শাস্তি ব্যাক? পা টিপ? মামার বাড়ির আবদার? আমার এই একশোবার উঠবস ফিরিয়ে দিতে পারবি তুই? আমার এই কোমর ব্যথার কী হবে? ব্যাটা বেয়াদব। ড্রেসিং টেবিলের উপর থাকা কাঁচিটা তুলে নিয়ে উনার দিকে তাক করে বললাম,
‘ তার থেকে বরং কাঁচি দিয়ে পা’টা কেটে নিই? সকাল দুপুর রাত টিপব আর সাওয়াব কামাব?’
আমার জ্বলন্ত চোখের দিকে চেয়ে নিরুদ্বেগ ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়ালেন শুভ্র ভাই। উনাকে হঠাৎ এভাবে দাঁড়াতে দেখে বিভ্রান্ত হলাম। ভরকে গিয়ে এক পা পিছিয়ে গেলাম অনিচ্ছা সত্ত্বেও। উনি আচমকা হাত থেকে কাঁচিটা ছিনিয়ে নিয়ে তার থেকেও আচমকা আমার বেনুনির নিচের দিকে ইঞ্চি খানিক চুল কেটে ফেললেন। আমি হতবাক।
শুভ্র ভাই কিছুই হয়নি এমন একটা ভাব নিয়ে কাঁচিটা আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে চুলগুলো নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বেরিয়ে গেলেন। আয়নায় নিজের কাটা চুলের দিকে তাকিয়ে রাগে-দুঃখে ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়তে ইচ্ছে করল আমার। নয়তো কাঁচি দিয়ে তার মুন্ডু কেটে ভরা রোদে শুকাতে দিতে ইচ্ছে হলো। উফ! লোকটা অসহ্য! অসহ্য! এই দপদপে রাগ নিয়েই চুল কেটে কোমর থেকে পিঠ পর্যন্ত তুললাম। আম্মুর অজস্র বকা খেলাম। আল্লাহ যদি কলে বলে একটা খুন মাফ করে। এই অসভ্য, বেয়াদব, অসহ্য লোকটিকে অবশ্যই খুন করব বলে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম। তারপর এলো সন্ধ্যা। রাগটা যখন একটু কমলো তখন চোখ পড়ল টেবিলের উপর। শুভ্র ভাইয়ের সেই বইটি এখনও টেবিলে পড়ে আছে।
আমি বইটা নিয়ে উল্টে পাল্টে দেখলাম। উপর-নিচ দেখে যা বুঝলাম, এটা আদ্যোপান্ত ইংরেজি বই। ভেবেছিলাম বইটায় আগুন জ্বালিয়ে খান খান করে দেব। তীব্র এক বদলা নেব। কিন্তু ভাবনায় পরিবর্তন আনলাম। কয়েকটা পাতা উল্টেপাল্টে দেখতেই টুপ করে পড়ে গেল ডায়েরির ছেঁড়া কাগজ। কাগজটা কাউকে দেওয়ার জন্য নয়। প্রাত্যহিক ডায়েরির কোনো এক অংশ বলে মনে হলো। তবুও সন্ধ্যা নিগড়ে এলো কিছু ভালো লাগে। চারপাশ হলো স্নিগ্ধ, মনোরম।
‘ রাগ কী থাকেই মনের মধ্যে,
ছুতোর করে অপেক্ষা
নাকি রাগ হলো, ক্ষোভের প্রকাশ
কিংবা দিতে শিক্ষা।
উচিত রাগের মূল্য অনেক
সে রাগ হয় না বন্দী
আসে আর যায়, ভাব বিনিময়
মুহূর্তে হয় সন্ধি!
কবিতাটা আমার নয় সুবীর গুপ্তের লেখা। অনেকদিন পর কাগজ নিয়েছি জবরদস্ত একটা প্রেমপত্র লিখব বলে। কিন্তু প্রেম তো পাচ্ছে না। তাই রাগ পত্র লিখতে বসলাম। তোমার প্রতি যে আমার আকাশ সমান রাগ সেটা তো প্রকাশ করা দরকার। সুবীর বাবু রাগের পর সন্ধি করতে বলেছেন। কিন্তু আমি সন্ধি টন্ধি করব না। তোমার সাথে চলবে আমার সারাজীবনের আড়ি। সারাজীবনের ঝগড়া। আমি কখনও বলব না তোমায় লাল শাড়িতে মিষ্টি লাগে। পায়েল পায়ে বৃষ্টি লাগে। কাজল চোখে লাগে সমুদ্রের মতোই স্নিগ্ধ। আমি বলব না তোমার গায়ের গন্ধ, বেলীর থেকেও প্রাণবন্ত। আমি বলব না, তোমার জন্য হিংসুক হয়ে উঠার অনুভূতি আমার জীবনে সবচেয়ে দমবন্ধ। ‘
লেখাগুলো পড়ে চট করেই ছেঁড়া কাগজটা লুকিয়ে ফেললাম আমার ডায়েরির ভাঁজে। তারপর উত্তর-দক্ষিণ দেখে শুভ্র ভাইয়ের বই আর দিয়াশলাই নিয়ে চলে গেলাম বাগানের এক কোণে। বইটা ছিড়ে টুকরো করে আগুন জ্বালাতেই ভেতরের কুটিল মন বাঁকা বাঁকা হাসল। কৌতুক করে বলল, ‘ শুভ্র নয় তো কী? শুভ্রবাবুর বইখানা দাহ করেই শান্ত হও পৃথিবী।’ আমার রাগ মাথা দুলিয়ে হাপুস করে নেমে গেল নিচে। শান্ত হয়ে গেল মন,মস্তিষ্ক। আহা কী শান্তি! শান্তি! কিন্তু শান্তিটুকু বেশিক্ষণ টিকল না। আগুনের ধোঁয়া যখন আকাশে মিলালো ঠিক তখনই সুবুদ্ধি উদয় হলো মাথায়। মাথায় টং টং করে বেজে উঠে বলল, ‘ শুভ্র ভাই কাল বইটা নিতে এলে তোমার কী হবে রোদ্রাণী? ছাদ থেকে লাফাবে? নাকি রেললাইনে গলা দিবে? ভূত মহাশয়ের হাতে তোমার মৃত্যু এবার নিশ্চিত!’
রোদ শুভ্রর প্রেমকথন সম্পূর্ণ গল্পের লিংক
https://kobitor.com/rodsuvro/
[ অনেক দিন পর এমন ভীষণ রাতে গল্প দিলাম। রি-চেইক করা হয়নি। এইযে ব্যস্ততা রেখে লেখা দিয়েছি। যাদের কাছে লেখা পৌঁছাবে তাদেরকে রেসপন্স করার অনুরোধ। ভালোবাসা ]