রোদ শুভ্রর প্রেমকথন পর্ব ৫৫
লেখনীতে- নৌশিন আহমেদ রোদেলা
ঘড়িতে এখন দশটা বাজে। দশটা উনিশ। আমার ছোট্ট সাবলেট ঘরের বারান্দায় রাজ্যের অন্ধকার। দুই একটা মশা উড়ে যাচ্ছে কানের পাশ দিয়ে। পাঁচিলের উপর রাখা চায়ের কাপটা মৃদু মৃদু ধোঁয়া ছাড়ছে। আমি কাঠের চেয়ারে পা তুলে বাবু হয়ে বসে আছি। বহুদিন চুল বাঁধা হয় না।
খোলা চুলগুলো পাটের রোঁয়ার মতো রুক্ষ। উড়ছে এলোমেলো। কাঁধ থেকে গড়িয়ে পড়া ওড়নায় মন খারাপের স্পর্শ। চায়ের কাপের পাশেই ভাঁজ করা একটা সুন্দর কাগজ। সকালের খবরের কাগজের সাথে এসেছে। নীলা আপুর ভাষ্যমতে, নিচের তলার কুঁকড়া চুলের ছেলেটা নিজ দায়িত্বে দিয়ে গিয়েছে। আমি কাগজটা পড়েছি। ধবধবে সাদা কাগজের মাঝ বরাবর খুব সুন্দর করে লেখা হয়েছে, ‘ আপনি অনেক সুন্দর করে কথা বলতে পারেন।
আপনার কথাগুলো মন খারাপ করে দেওয়ার মতো সুন্দর।’ আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। বামহাতের কব্জির গোড়ায় প্রায় মিলিয়ে যাওয়া রেখাটা স্পর্শ করে অন্ধকার আকাশের দিকে চেয়ে রইলাম। মন খারাপ করে দেওয়ার মতো সুন্দর! তাই তো। আজকের আকাশটাও কেমন মন খারাপ করে দেওয়ার মতো সুন্দর। কিন্তু, মন খারাপ কী কখনো সুন্দর হয়? কই, আমার তো হয় না। এই যে দীর্ঘ অন্ধকারে ডুবে আছি। এই দীর্ঘ অন্ধকারটাকে তো কখনো সুন্দর মনে হয় না। সুন্দর মনে হয় না আগস্ট থেকে গোটা জানুয়ারি মাস। তার আমার বিচ্ছেদের কঠোর নির্যাস।
আগস্টের সেই দুপুরে শুভ্র ভাইয়ের সাথে কঠিন এক রফাদফা হওয়ার পর ঝুপ করেই শান্ত হয়ে গেলাম আমি। বাসায় ফিরে ঘরে খিল এঁটে ভাবতে গিয়ে বুঝলাম, কেঁদেকেটে মরে যাওয়ার মতো কিছু ঘটেনি। শুভ্র ভাই আমাকে তার জীবন থেকে আউট করে দিলেই দুঃখের সাগরে ভেসে যেতে হবে এমন কোনো ব্যাপার নেই। উনি অত্যন্ত ফালতু একটা মানুষ। উনার জন্য কেঁদে কেটে সমুদ্র বানানোর কোনো মানে হয় না। সুতরাং, বুকের ভেতর ঘৃণার এক আগুন জ্বালানোর চেষ্টায় অস্থির হয়ে উঠলাম। পৃথিবীর সমস্ত দোষ তার ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে ভারমুক্ত হতে চাইলাম। মস্তিষ্কের শিরায় শিরায় ছড়িয়ে পড়ল অপ্রতিরোধ্য রাগ।
নাকি রাগের আড়ালে লুকিয়ে থাকা অবুঝ অভিমান? আগষ্টের সেই গনগনে দুপুরেই কঠোর এক সিদ্ধান্ত নিলাম আমি, শুভ্র ভাইকে নিয়ে আর এক মুহূর্ত নয়। পৃথিবীতে তাসনিমদের অভাব নেই। তাসনিমরা ভালোবেসে কষ্ট পায়। কিন্তু রোদরা পায় না। রোদ শুভ্রকে কখনো ভালোবাসেনি। শুভ্র নিতান্তই এক অভ্যাস ছিল, ভালোবাসা নয়। যে আমাকে ছুঁড়ে ফেলে, তার কাছেই ছুটে যাওয়ার আকুতি নারীসুলভ দুর্বলতা বই কিচ্ছু নয়। কিন্তু দিনশেষে আমি নারী।
যাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে আমার নারী জীবনের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ বসন্তগুলো, তাকে কী এতো সহজে ভুলতে পারি? আমিও পারছিলাম না। আর পারছিলাম না বলেই হয়তো অথবা নিজের কাছে ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়েই হয়তো বইয়ের পাতায় ডুব দিলাম আকন্ঠ। আম্মুর থেকে পাওয়া রূঢ় ব্যবহার, শুভ্র ভাইয়ের দেওয়া মানসিক চাপ, কারো কাছে নিজেকে প্রকাশ করতে না পারার কষ্ট সবকিছু সামলে উঠতে না পেরে হুট করেই গম্ভীর হয়ে গেল আমার মস্তিষ্ক।
কেটে গেল শিশুসুলভ সকল ব্যবহার। পরিবারের সাথে দূরত্ব বাড়লো। ঘরের দরজাটা বন্ধ থাকতে লাগল দিবারাত্র। সদা উচ্ছল, ছুটোছুটি করতে থাকা আমি তখন আর হাসার কোনো কারণ খুঁজে পেতাম না। অবচেতন মনে সর্বদাই অস্পষ্ট কোনো চিন্তা চলতো। কারো সাথে কথা বলা, সামাজিকতা রক্ষা সবই কেমন ভুলতে বসলাম। টানা দুটো সপ্তাহ চোখ-কান বন্ধ রেখে পড়াশোনায় ডুবে রইলাম। বাহ্যিক কোনো অনুভূতি রইলো না। যা রইলো তা কেবলই অস্পষ্ট এক চিন্তা। কেমন অসীম সেই চিন্তার ব্যাপ্তি!
তারপর একদিন খুব অন্যরকম এক ঘটনা ঘটলো। ক্যালেন্ডারের পাতায় বোধ করি তখন এগারোই সেপ্টেম্বর। বারের কথা খেয়াল নেই। সকালের নাস্তাটা শেষ করে ঘন্টা দুই হলো বই খোলে বসেছি। অব্যবহৃত মুঠো ফোনটা মৃতের মতো পড়ে আছে পাশে। হঠাৎ করেই মৃত ফোনে প্রাণ সঞ্চার হলো। ফোনের স্ক্রিনে মামানির নাম দেখে কুঁচকে গেল ভ্রু। কয়েক মুহূর্ত চুপচাপ বসে থেকে ফোন তুললাম। প্রায় সাথে সাথেই ওপাশ থেকে চির মমতাময়ী শীতল আদর ভেসে এলো। পৃথিবীর সকল প্রশ্রয় নিজের কন্ঠে ঢেলে প্রশ্ন ছুঁড়লেন মামানি,
‘ কতদিন আসিস না। কেমন আছিস রোদু? কী হয়েছে? শুভ্র কিছু বলেছে?’
আমি উত্তর দিতে গিয়েও থমকে গেলাম। তীক্ষ্ণ মস্তিষ্ক হঠাৎ বুঝতে পারল সেই মমতাময়ী আর আগের মতো নেই। কিছু একটা বদলেছে। খুব অন্যরকম কিছু ঘটে গিয়েছে। বুকের ভেতর সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো গর্জন হলেও সামলে নিলাম। মৃদু কন্ঠে বললাম,
‘ অক্টোবরের তিন তারিখ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা না? তাই একটু পড়ছিলাম। তেমন কিছু না।’
মামানি শঙ্কিত হলেন। সন্দেহী কন্ঠে বললেন,
‘ রোদু মা? আমাকে মিথ্যা বলিস না। কী হয়েছে আমায় বল। আমি জানি কিছু একটা হয়েছে। তোরা আমায় স্পষ্ট করে বলছিস না। কী হয়েছে মা? লুকিয়ে রাখিস না।’
‘ সত্যিই কিছু হয়নি মামানি। কী হবে, বল তো?’
মামানি আত্মস্থ হলেন না। উৎকন্ঠিত হয়ে পড়লেন। অস্থির কন্ঠে বললেন,
‘ কিছু হয়নি? তাহলে আমার শুভ্র যে…. ‘
তারপর সব চুপ। ফোনের ওপাশে পিনপতন নীরবতা। আমি কয়েক সেকেন্ড কান খাড়া করে থেকে মামানিকে ডাকলাম। মামানি সাড়া দিলেন না। বুঝলাম, লাইন কেটে গিয়েছে। কথার মাঝে আচমকা লাইন কেটে যাওয়ায় কিছুটা আশ্চর্য হলাম। ফোন হাতে মিনিট খানেক চুপচাপ বসে থাকার পরও যখন দ্বিতীয় কল এলো না। তখন নিজ থেকেই কল করলাম। আমাকে বিস্মিত করে দিয়ে ওপাশ থেকে কল কেটে দেওয়া হলো আর পরমুহূর্তেই ব্লক। আমার নাম্বারটা মামানির ব্লক লিস্টে, ব্যাপারটা আবিষ্কার করেই স্তম্ভিত হয়ে গেলাম আমি। হঠাৎ নিজের চোখ-কানকে বিশ্বাস করতে পারলাম না। তারপর কেটে গেল কিছু নীরব মুহূর্ত।
আমি স্তব্ধ হয়ে বসে রইলাম। আবার, আবার, বারবার চেষ্টা করার পরও যখন এই নির্দয়তার উত্তর মিললো না। ভীষণ দুপুরের তৃষ্ণার্ত কাকের মতোই তীব্র কন্ঠে ডেকে উঠল কর্কশ বাস্তবতা। তখন গিয়ে সম্বিৎ ফিরে পেলাম আমি। ফাঁকা হয়ে যাওয়া ঝপসা মস্তিষ্ক নিয়ে আপুকে ডাকলাম। আর ঠিক সেই সময়টাতে মনে পড়ে গেল শুভ্র ভাইয়ের কথা।
উনি! উনি করছেন এমন? এতোটা নির্দয় তার পদচারণ! মাতৃতুল্য অনুভূতিটির সাথেও এমন বিশ্রী খেলা খেলতে পারছেন উনি? মামানি যে আমার কত কাছের, কত আপন, উনি জানেন না? সপ্তাহ দুইয়ের থিতিয়ে আসা রাগ, ক্ষোভ, বিষণ্ণতা সবই যেন তড়াক করে জ্বলে উঠল এবার। রাগে কাঁপতে থাকা শরীর নিয়েই আপুর নাম্বার থেকে মামানিকে ফোন লাগালাম। ফোনটা বাজতে বাজতে হঠাৎ কেটে গেল। তারপর শোনা গেল সবচেয়ে বিষাক্ত এক ধ্বনি, ‘আপনার ডায়ালকৃত নাম্বারে এই মুহূর্তে সংযোগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।
অনুগ্রহ করে একটু পর আবার চেষ্টা করুন।’ আমি স্তব্ধ হয়ে বসে রইলাম। নিজেকে সামলে নেওয়ার শেষোক্ত শক্তিটুকুও নিঃশেষ করে উপলব্ধ হলো একটিই সত্যবাণী, ‘শুভ্র ভাই কৌতুক করার মানুষ নন। উনি বিচ্ছেদ চান। কৌতুকের বিচ্ছেদ নয়। আসল বিচ্ছেদ। আর এই ছিল বিচ্ছেদের প্রথম নিদর্শন।’ আপুর ফোনটা ফিরিয়ে দিয়ে ঝিম ধরে বসে রইলাম আমি। মস্তিষ্কের নিউরনে নিউরনে ছুটে গেল সুতীক্ষ্ণ তেজ। বিশ্রী একটা অপমানে দগদগে হয়ে উঠল গা।
শুভ্র ভাই নিজ স্বার্থে মামানির সাথে আমার বিচ্ছেদ ঘটাতে পারেন, এ কথা আমার বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হলো না। শুভ্র ভাই আমার সাথে এমন নিষ্ঠুর হতে পারেন, আমি বিশ্বাস করতে পারলাম না। অবুঝ মন, বোবা অভিমানে ফুঁসে ফুঁসে উঠল। শুভ্র ভাইকে ঝাঁঝাঁলো কিছু কথা শুনাতে ইচ্ছে হলো। মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে দিতে ইচ্ছে হলো। ভীষণ কষ্টে ক্ষতবিক্ষত করে ফেলতে ইচ্ছে হলো। কিন্তু সেই ইচ্ছেকে প্রশ্রয় দিতে গিয়ে নিজের আত্মসম্মান খোয়াতে আমি পারি না।
না পারি তার কাছে ছুটে যেতে। সুতরাং, আমার ঝুলিতে একটিই সুযোগ রয়ে গেল। তাকে ঘৃণা করা, ঘৃণা করা আর ঘৃণা করা। নিজের শান্তির জন্য তাকে ঘৃণা করা। আমি আমার সমস্ত মস্তিষ্ক দিয়ে তাকে ঘৃণা করলাম। কিন্তু মন? যে মনে তার শ্রদ্ধায় ভেজা বিশাল সাম্রাজ্য। যাকে আমি অসম শ্রদ্ধায় লালন করি। তাকে কী মনের ভুলেও ঘৃণা করা সম্ভব?
শুনেছিলাম, শুভ্র ভাইয়ের ফ্লাইট পঁচিশ তারিখ সন্ধ্যেবেলা। চব্বিশ তারিখ বিকেলে তিনি ময়মনসিংহ ছাড়বেন। গোছগাছ সমাপ্ত। আম্মু বেশ কয়েকবার তাকে দাওয়াত টাওয়াত দিয়েছেন। প্রতিটিবারই তিনি বিনম্র শ্রদ্ধায় ফিরিয়ে দিয়েছেন সকল নিমন্ত্রণ। তার তখন আকাশসম ব্যস্ততা। একমাত্র ফুপুর আদর নেওয়ার সময় নেই। মামানিও বুঝি খুব ব্যস্ত ছিলেন? নয়তো একটাবারও কেন এমুখো হলেন না? রাগ, অভিমান ছাপিয়ে ভীষণ অপমানে চুপসে গেল মন। বারবার মনে হতে লাগল, আমি পরিত্যক্তা। শুভ্র ভাই আমায় চাইছে না বলে মামানির কাছে আমারও কোনো মূল্য থাকবে না, থাকছে না। এটা কেমন কথা? এটা কেমন স্বচ্ছ বিচার? আমি এতোটা তুচ্ছ, কী করে?
নারীরা বুঝি তুচ্ছ হয় এতোটাই? আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। নিজের প্রতি তীব্র ঘৃণা নিয়ে বেঁচে থাকা যে কত কষ্টের তা এই প্রথম উপলব্ধি করলাম। তারপর এলো আরও একটি দিন। শুভ্র ভাইয়ের সাথে আমার দেখা হয়ে গেল আচমকা। ক্যালেন্ডারের পাতায় তখন আঠারোই সেপ্টেম্বর। ভীষণ বর্ষা। সারাটা দিন থেকে থেকে বৃষ্টি। ময়মনসিংহের রাস্তাগুলোতে হাঁটু পানি জল। সেই ভয়াবহ বর্ষার দুপুরেই খবর এলো মিথি আপুকে মেডিকেলে আনা হয়েছে। কালরাত থেকে প্রচন্ড ব্যাথা। নরমাল ডেলিভারি হবে কি-না বুঝা যাচ্ছে না।
বাবা-মা খবর পেয়েই ছুটে গেলেন। প্যাঁচপ্যাঁচে কাঁদা আর এক আষাঢ় বৃষ্টি ঠেলে আমি যখন মেডিকেলে গিয়ে পৌঁছালাম তখন প্রায় বিকেল। চারদিকে নিভে আসা গোধূলি আলো। ভেজা ছাতা গুটিয়ে, আধভেজা কামিজ আর ল্যাপ্টানো কাজল নিয়ে যেই না হাসপাতালের বারান্দায় পা রাখলাম। ঠিক তখনই কোথা থেকে ছুটে এলেন শুভ্র ভাই। গায়ের জামাটা আধভেজা। চুলে-মুখেও মুক্তো মুক্তো জল। শীর্ণ গালের দাড়িগুলোতে মৃদু মোলায়েম ভাব। শুভ্র ভাই বারান্দায় দাঁড়িয়েই ফোন কানে নিলেন। অর্ধসিক্ত শার্টের উপরের দুটো বোতাম খুলে দিয়ে চুল ঝাড়তে ঝাড়তে শুধালেন,
‘ মিথি কয় তলায় রে আলিফ? মেটারনাল ইউনিট কোনদিকে? গ্রাউন্ড ফ্লোরে?’
আমি বারান্দার এক কোণে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম। শুভ্র ভাই ফোনটা পকেটে পুড়ে চোখ তুলে চাইতেই যেন চমকে উঠলেন। থমকালেন। সেকেন্ডের জন্য যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল ধারালো, বিষণ্ণ দুটো চোখে। তারপর নিশ্চুপ রাতের মতোই ঝুপ করে থেমে গেল সব স্পন্দন। একদম নিস্তরঙ্গভাবে চোখ সরালেন। বুক ফুলিয়ে শ্বাস নিয়ে আমাকে পাশ কাটালেন। ঠিক সেই মুহূর্তে বোধহয় বলার মতো কিছু ছিল না আমার। উচিতও ছিল না বোধহয়। তবুও কী মনে করে উনার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। বললাম,
‘ সমস্যা কী আপনার?’
শুভ্র ভাই উত্তর না দিয়ে শান্ত চোখে চাইলেন। ধারালো অথচ শান্ত চোখে খেয়াল করলেন আমার মুখের প্রতিটি কম্পন। তারপর জিজ্ঞাসু চোখে চেয়ে রইলেন, উত্তর দিলেন না। নিজের ভেতরের প্রচন্ড এলোমেলো রাগ, ক্ষোভগুলোকে গোছাতে না পেরে হতাশ কন্ঠে বললাম,
‘ আপনি আমার থেকে এক্চুয়েলি কী চাইছেন, শুভ্র ভাই?এতো মানসিক চাপ কেন দিচ্ছেন? মামানির ফোনে আমার নাম্বার ব্লক লিস্টে রাখাটা নিশ্চয় আপনার কাজ? এটা কোন ধরনের নিচু মানসিকতা?’
শুভ্র ভাই কয়েক মুহূর্ত নিশ্চুপ থেকে স্বাভাবিক শীতল কন্ঠে বললেন,
‘ যে নিচু মানসিকতায় তাসনিমের কাছে আমার মায়ের নাম্বার থাকাটা বাহুল্য ও উদ্ভট মনে হয়। সেই নিচু মানসিকতায়। মায়ের ফোনে ছেলের প্রাক্তনের ফোন নাম্বার থেকে কী কাজ? প্রাক্তনকে ফেলে নতুনকে গ্রহণের প্রস্তুতি নেওয়া উচিত না?’
আমি স্তব্ধ চোখে চেয়ে থেকে বললাম,
‘ মামানির সাথে আমার সম্পর্কটা আপনার জন্য তৈরি হয়নি, শুভ্র ভাই। তাঁর আর আমার সম্পর্কটা একদম ভিন্ন, আদুরে। সেই আদুরে সম্পর্কটাকে কেন টানছেন এখানে?’
শুভ্র ভাই পকেটে হাত ঢুকিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালেন। চোখে-মুখে বিরক্তি ফুটিয়ে প্রচন্ড নিরাসক্ত কন্ঠে বললেন,
‘ ফোনটা আম্মুর। যা করার আম্মুই করেছে। এসব নিয়ে ঘাটাঘাটি করার সময় বা ইচ্ছে কোনটাই আমার নেই।’
ব্যস! কথাটুকু শেষ করেই পাশ কাটিয়ে চলে গেলেন শুভ্র ভাই। আমি ফ্যালফ্যাল করে তার চলে যাওয়া দেখলাম। আমার পুরো দুনিয়াটা হঠাৎ করেই অসহনীয় হয়ে উঠল। পরিচিত শুভ্র ভাইয়ের অপরিচিত এই রূপ আমি বিশ্বাস করতে পারলাম না। রাগ, অভিমান, ক্ষোভ সকল অনুভূতি ছাপিয়ে অদ্ভুত এক বিতৃষ্ণায় ভরে গেল মন। বলতে হয়, মরে গেল মন। যে প্রশ্রয়ের সাগরে সর্বদা ভেসেছি। যে সাগর কেবল ভালোবাসাময় মুক্তো দিয়েছে। সেই সাগরের এই পরিবর্তিত রূপ ভেতর ভেতর ভেঙে দিচ্ছিল আমায়।
তারথেকেও গুড়িয়ে দিচ্ছিলো আমার আত্মবিশ্বাস। আত্মগরিমা। বেশ কিছুক্ষণ ঠাঁই দাঁড়িয়ে থেকে শরীর ঝাড়া দিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। নিজেকে এতোটা দুর্বল, অসহায় দেখে তেঁতো হয়ে এলো মন। তবুও শরীর নামক শক্ত খোলসটাকে আরও একটু শক্ত করে মেটারনাল ইউনিটের দিকে গেলাম। কেবিনের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই কাজিনদের হৈ-হুল্লোড়ে কান ঝালাপালা হওয়ার জোগাড় হলো। মিথি আপুর মেয়ে হয়েছে। আমাদের চমৎকার এই কাজিন রাজ্যে এই প্রথম এক রাজকন্যা এসেছে। আনন্দে থৈ থৈ চারপাশ। ঠোঁট ভর্তি মিষ্টি-মিঠাই হাসি। শুভ্র ভাই মুখ বাড়িয়ে বাবুর দিকে চাইতেই মিথি আপুর দুর্বল কন্ঠে কানে এলো,
‘ আমার মেয়েটা কেমন পরির মতো সুন্দর হয়েছে দেখেছিস? ছোটবেলায় প্রোপোজাল একসেপ্ট না করায় এমন পরি মেয়ের মামু হয়ে গেলি। আফসোস কর।’
শুভ্র ভাই হাসলেন। মিথি আপুর মাথায় চাটি মেরে খুব সাবধানে আঙুল ছোঁয়ালেন বাবুর গালে। বাচ্চাদের মতো বিস্ময় চোখে চেয়ে থেকে বললেন,
‘ বাচ্চাটা এতো ছোট কেন? কোলে নিলে হাতের ফাঁক গলে পড়ে যাবে না?’
শুভ্র ভাইয়ের প্রশ্নে হেসে ফেললেন সবাই। মিথি আপু প্রশ্রয়ের হাসি হেসে বললেন,
‘ মাত্র কয়েক ঘন্টা বয়স ওর। আর কত বড় হবে?’
শুভ্র ভাই এর আগে কখনো সদ্য জন্মানো শিশু দেখেনি বলেই হয়তো বিস্ময় চাহনিটা তার বিস্ময় হারালো না। আগের মতোই বিস্মিত মুগ্ধতা নিয়ে চেয়ে রইল বাবুর মুখে। চয়ন ভাইয়া ফোঁড়ন কেটে বললেন,
‘ অতিশীঘ্রই বিয়ে করে ফেলো। তারপর প্রেকটিক্যালি বুঝতে পারবে, হাতের ফাঁক গলে পড়ে যাবে কী যাবে না। বিয়ে ছাড়া এসব কঠিন কঠিন বিষয় বুঝা সম্ভব না।’
শুভ্র ভাই কৃত্রিম আফসোস নিয়ে বললেন,
‘ ভেবেছিলাম চিরকুমার থাকবো। এখন মনে হচ্ছে, আপনাদের এই কঠিন কঠিন বিষয় বুঝার জন্য হলেও শ্বশুরকে ফাঁকি দিয়ে ঘটনা একটা ঘটিয়ে ফেলা উচিত ছিল।’
আলিফ ভাই মুখ গুঁজ করে বললেন,
‘ তোমার ঘটনা পরে ঘটিও শুভ্র ভাই। আপাতত চয়ন ভাইকে ঘটনা ঘটাতে বলো। আমরা তাকে বাবা হওয়ার সুযোগ দেওয়ার জন্য আমাদের গোটা বোনটাকে দিয়ে দিলাম। আর উনি কৃতজ্ঞতা স্বরূপ সারিন্দাতে একটা ট্রিট পর্যন্ত দিতে পারছেন না। এটা হয়?’
চয়ন ভাইয়া হৈ হৈ করে উঠে বললেন,
‘ তোমার এক বোনকে পালতে গিয়েই বুঝে ফেলেছি তোমাদের পালা কত কষ্ট। ভাই-বোন তো নও ব্রিটিশ সাম্রাজ্য! এতো শোষণ তো ব্রিটিশরাও করেনি ভাই। তবু আমি তোমাদের চার হাজার টাকা দিতে চেয়েছি। এটা আমার মহত্ত্ব। তোমাদের উচিত আমার মহত্ত্বে খুশি হয়ে টাকাটা নিয়ে নেওয়া অথচ তোমরা নিচ্ছ না।’
রাতুল ভাইয়া মুখ ফুলিয়ে বললেন,
‘কেন নিচ্ছি না সেটা বলুন। আমরা আপনাকে অত্যন্ত ভালোবাসি বলেই আপনাকে সাথে নিয়ে সারিন্দায় যেতে চাইছি। আমাদের সাথে যাবেন, খাবেন, চলে আসবেন। এতে এতো রি-অ্যাক্ট কেন করছেন বলুন তো?’
শুভ্র ভাই তার অর্ধসিক্ত চুলে আঙ্গুল চালাতে চালাতে হাসলেন। কেবিনের সফেদ আলোয় ঝিলিক দিয়ে উঠল তার বাম পাশের বাঁকা দন্ত। শার্টের কলার ঝাঁকিয়ে পানি ঝাড়ার চেষ্টা করে বললেন,
‘ সিম্পল সারিন্দায়ই তো যেতে বলছে চয়ন ভাই। জীবন তো দিতে বলেনি। তবু কেন মানছেন না বলুন তো? আমিও ভাগ পাই। সম্পর্কে আপনার শালা হই। আমরা বোন দিয়ে দিয়েছি। আপনার উচিত প্রাণ দিয়ে দেওয়া। আমরা দয়ালু বলে প্রাণ না নিয়ে ট্রিট নিচ্ছি। আপনার তো উচিত আমাদের মহত্ত্বে আপ্লুত হয়ে যাওয়া।’
শুভ্র ভাইয়ের কথায় আরেক দফা হৈ হৈ পড়ে গেল। আলিফ ভাইয়া কেবিনের ফ্লোরে বসে তীব্র অনশনের ঘোষণা দিয়ে ফেললেন। আমি কিছুক্ষণ কেবিনের একপাশে দাঁড়িয়ে থেকে বেরিয়ে এলাম। সঙ্গে নিয়ে এলাম মাইগ্রেন নামক নতুন উপসর্গ।
মাইগ্রেনের তীব্র ব্যথা নিয়েও দীর্ঘ এক রাত কেবল নিজেকে নিয়ে ভাবলাম আমি। সিদ্ধান্ত নিলাম, সব ভুলে পড়াশোনায় মনোযোগ দেব। অক্টোবরের তিন তারিখ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা। হাতে থাকা পনেরোদিন চুটিয়ে পড়াশোনা করব। কেবলমাত্র মনের জোরে চারটা দিন টানা পড়াশোনা করলাম আমি।
পড়তে পড়তে যখন মাথাব্যথাটা অসহ্য হয়ে উঠতো তখন জলের কলের নিচে মাথা দিয়ে বসে থাকতাম। মাথা ব্যথাটা একটু থিতিয়ে এলে আবারও পড়াশোনায় ডুব দিতাম৷ এভাবে চারটা দিন কাটলেও পঞ্চম দিনটা আর কাটলো না। সেদিন দুপুর। মাইগ্রেনের ব্যথায় অস্থির হয়ে বই রেখে ওয়াশ রুমে গিয়েছি মাথায় পানি ঢালব বলে। এমন সময় হৃদপিন্ড ঠান্ডা করে দেওয়া সেই গমগমে কন্ঠস্বর। আমি চমকে পানির কলটা বন্ধ করে কান খাড়া করলাম।
প্রথমে মনের ভুল ভাবলেও পরমুহূর্তেই ভুল কেটে গেল। ভুল নয়, শুভ্র ভাই সত্য সত্যই এসেছেন। আম্মুর সাথে কথা বলছেন। আমি তাড়াহুড়ো করে ঘরে এসে মাথা মুছলাম। দরজার কাছে এসে দাঁড়াতেই আম্মুর সজল কন্ঠস্বর কানে এলো। আমি কিছু বুঝতে না পেরে আনমনেই চমকে উঠলাম। কেঁপে উঠল শরীর। থেমে গেল হৃদপিণ্ড। শুভ্র ভাই কী আমাদের ডিভোর্স বিষয়ক আলোচনা করতে এসেছেন? নয়তো হঠাৎ এলেন কেন? আম্মুই বা কাঁদছে কেন? একটু পরই দৃশ্যপটে ছোট ফুপ্পির আগমন হলো। তার স্থূল শরীরটা সোফায় মেলে দিয়ে খুব মন খারাপ করা কন্ঠে বললেন,
‘ এমন কলিজার টুকরো ছেলেগুলো বিদেশ ভুঁইয়ায় চলে গেলে কী মন টিকে? সাবধানে থেকো বাবা। তোমাকে নিয়ে তোমার বাবা-মার কত গর্ব। হুট করে কোনো বিধর্মী জাপানিজ মেয়েকে বিয়ে টিয়ে করে বসো না। জাপানিজ মেয়েগুলো ফাজিল আছে। ভালো ভালো ছেলেদের বশ করে ফেলে।’ .
শুভ্র ভাই হেসে ফেললেন। তার সুদর্শন মুখটিতে মৃদু বিমর্ষতা খেলে গেল যেন। বললেন,
‘ দেশে যে বশীকরণ রেখে যাচ্ছি। সে বশীকরণ কাটানোর মতো বশীকরণ শক্তি তাদের নেই। আপনি চিন্তা করবেন না আন্টি। আপনাদের দেশী ছেলে সবসময়ই দেশীই থাকবে।’
ছোট ফুপ্পি যেন খুব সন্তুষ্ট হলেন।আদিবা-জারিফকে ডেকে শুভ্র ভাইয়ের মতো হতে হবে এমন কিছু বক্তব্য ঝাড়লেন। মিথি আপুর বাবু হওয়া উপলক্ষে তখনও বাসায় মেহমান। ঘনিষ্ঠ আত্মীয় স্বজনের ভিড়ে হৈ হৈ করছে বসার ঘর। শুভ্র ভাই একে একে সবার থেকে বিদায় নিলেন। তখন গিয়ে আমার মনে পড়ল আজ চব্বিশ তারিখ। শুভ্র ভাইয়ের বিদায় বার। ঠিক তখনও শুভ্র ভাই এই দেশে থাকবে না তা নিয়ে খুব একটা ভাবনা হলো না আমার। কোনো অনুভূতি হলো না। একটা মানুষ দেশে না থাকা মানে যে পৃথিবী সমান শূন্যতা তা তখনও উপলব্ধি করতে পারলাম না। ছোট ফুপ্পি আমাকে দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ধমকে উঠলেন,
‘ কী রে? তুই ওখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? শুভ্র চলে যাচ্ছে, কথা টথা বল। আবার কবে না কবে দেখা হবে কে জানে?’
ফুপ্পির কথাটা শুভ্র ভাই এবং আমার দুজনের কানেই গেল। কিন্তু শুভ্র ভাই আমার দিকে ফিরে চাইলেন না। আমিও কোনোরকম প্রত্যুত্তর করলাম না। প্রচন্ড অভিমানে ঘরের দরজাটা টেনে দিয়ে বিছানার উপর গিয়ে বসলাম। তারপর ধীরে ধীরে উঠে গিয়ে দাঁড়ালাম বারান্দায়। প্রায় অনেকক্ষণ পর শুভ্র ভাই বেরিয়ে এলেন। তার সাথে বেরিয়ে এলেন বাড়ির সবাই।
মায়েরা, ফুপিরা কান্নাকাটি অব্যহত রাখলেন। শুভ্র ভাই তাদের ছেলে ভুলানোর মতো হাজার কথা বুঝালেন। তারপর আমাকে ছেড়ে, এই বাড়ি ছেড়ে, এই শহর ছেড়ে যাওয়ার জন্য গাড়িতে গিয়ে বসলেন। আমার অভিমানিনী সুপ্ত মন অবচেতনেই আশা করেছিল, শুভ্র ভাই আসবেন। নিজ থেকে, নিজ ইচ্ছেয় আমার সাথে কথা বলবেন। একটু বকবেন। একটু প্রশ্রয় দিবেন। আর একটু ভালোবাসবেন। কিন্তু তিনি এলেন না। আমার কোমল, অভিমানিনী মনটাকে বিশাল নৈরাশ্যে ছুঁড়ে ফেলে সত্যি সত্যিই চলে গেলেন৷ আমি সেই বারান্দাতেই দাঁড়িয়ে রইলাম।
পশ্চিমাকাশে সূর্য ডুবলো। রাত নামলো। তবুও কোথাও একটা বিশ্বাস ছিল, এক্ষুনি কোনো চমৎকার ঘটে যাবে। শুভ্র ভাই ফিরে আসবেন। আমাকে ধমকে উঠে বলবেন, ‘ তোর বাপ আর তুই মিলে জীবনটা ভাঁজ ভাঁজা করে ফেলছিস রে রোদু৷ জীবনটা আর জীবন নাই টোটাল ডিম ভাঁজা হয়ে গিয়েছে। দেশ থেকে বেরিয়ে যাব তবুও অশান্তি। তোরা হলি মূর্তিমান অশান্তি।’ কিন্তু তিনি এলেন না। সত্যি সত্যিই এলেন না। রাত পেরিয়ে আবারও নতুন এক ভোর এলো। কমলা আলোয় খিলখিলিয়ে উঠল বারান্দার পাঁচিল, গ্রিলে ঝুলানো আমি-তুমির শূন্য খাঁচা। সেই সাথে আমার শূন্য মন!
রোদ শুভ্রর প্রেমকথন সম্পূর্ণ গল্পের লিংক
https://kobitor.com/rodsuvro/
[ কাল প্রায় সম্পূর্ণ লিখে ফেলেও আবার কেটে ফেলেছি। নতুন করে লিখতে বসেও কেটেছি বারবার। কিছুতেও মনঃপূত হচ্ছিল না। হয়নি এখনও। ঘটনাপ্রেক্ষিতে সত্য অনুভবগুলো তুলে আনতে পারিনি। ঠিক করে সাজাতে পারিনি। অগোছালো লাগছে। তার একটি কারণ হলো আমার অসুস্থতা। প্রচন্ড মাইগ্রেনের ব্যথা ঠেকাতে ঘুমের টেবলেট নিয়েছি। মাথাটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। বমি পাচ্ছে। লেখা গোছাতে পারছি না। কথা দিয়েছিলাম বলে এমনি দিলাম পর্বটা। বারবার চোখে-মুখে পানি দিয়ে সন্ধ্যা থেকে লিখছি। প্রেমিক-অপ্রেমিকের গল্পটা লিখতে পারিনি এই অসুস্থতার জন্যই। দুঃখিত। রি-চেইক করা হয়নি।]