রোদ শুভ্রর প্রেমকথন পর্ব ৬
লেখনীতে – নৌশিন আহমেদ রোদেলা
দুপুর ১২ টা। মার জোড়াজুড়িতে পা বাড়াতে হলো মামুর বাসার দিকে। বাঙালির হোম কোয়ারেন্টাইনের এক অন্যরকম ধরন। বাবা-মা, ভাই-বোন সবাই একসাথে। সো রান্নার আমেজটাও অন্যরকম। তাইতো সকাল সকাল কাচ্চি বিরিয়ানি রান্না করে মার মনে পড়েছে ভাইয়ের কথা। তার একমাত্র ভাইয়ের একমাত্র ছেলের কতো প্রিয় খাবার এটা! তাকে না দিয়ে খাওয়া যায়? একদম না। তাই বাটি ভর্তি বিরিয়ানি নিয়ে আমাকেই যেতে হলো শুভ্র ভাইয়ের বাসায়। আমাদের বাসা থেকে হেঁটে গেলে ১০/১৫ মিনিটের দূরত্ব। খুব বেশি তো নয়! মামুর ফ্ল্যাটের সামনে দাঁড়িয়ে কলিংবেল বাজাতেই দরজা খুলে দিলো মামানি। আমাকে দেখে সে ভীষণ খুশি। হাত থেকে বাটিটা নিয়ে বাথরুমে ঢুকে গোসল সারতে বললো আমায়। বাইরে থেকে এসেছি যদি করোনা থাকে তো? এই মা জাতিকে কখনো “না” শব্দটা বলে আটকানো সম্ভব নয়। তাই আমাকেও গোসল করতে হলো। আর গায়ে জড়াতে হলো মামানির একটি রঙচঙা ভাজ ভাঙা নতুন শাড়ি। গোসল করে বের হতেই মামানি বলে উঠলো,
রোদ মা? যা না তোর শুভ্র ভাইকে একটু ডেকে তোল।১২ঃ৩০ টার বেশি বাজে। এখনও কেউ ঘুমায় বল?এতোক্ষণে ঘুম থেকে উঠলে খাবে টা কখন? বাপ ছেলে একরকম হয়েছে। জ্বালিয়ে খেলো আমায়। যা না মা একটু ডেকে তোল।
মামানির কথায় এবারও মানা করতে পারলাম না।একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে শহীদ হওয়ার জন্য বাঘের খাঁচার দিকে রওনা হলাম। শুভ্র ভাইয়ার রুমে ঢুকেই আমি অবাক। ঘরের মধ্যে কেউ নেই। ওয়াশরুমেও নেই।তাহলে গেল টা কই? অদ্ভুত! কপাল কুঁচকে পেছনের দিকে তাকাতেই কারো সাথে ধাক্কা খেলাম। শুভ্র ভাই! আজ বুঝতে পারছি উনি ঠিক কতোটা লম্বা। আমার থেকে ডাবল তো হবেনই। কপালে এসে পড়া চুলগুলো কানের কাছে গুঁজতে গুঁজতে এদিক ওদিক তাকাচ্ছি। কি অস্বস্তিকর ব্যাপার! কি যে বলবো বুঝতেই পারছি না। উনি আমার সামনে থেকে সরে গিয়ে বিছানায় বসতে বসতে বললেন,
এমন সঙ সেজেই রাস্তা দিয়ে আসা হলো নাকি? বাহ্! পৃথিবীর অর্ধেক মানুষ তো জেনেই গেছে নিশ্চয় যে তোর লম্বা লম্বা চুল আছে? একটা কালো পেড়ে শাড়িও আছে। আর পিঠের ঠিক মাঝ বরাবর একটা কালো তিলও আছে। তাই না?
উনার কথায় অবাক হলাম আমি। আমার পিঠে যে তিল আছে এটা তো আমারও জানা ছিল না আর উনি জেনে গেলেন? কিভাবে? আচ্ছা পুরো পৃথিবীর মানুষের কি আর কোনো কাজ নেই যে আমার পিঠের তিল খুঁজতে রাস্তায় চলে আসবে। আজিব! আমি মুখ কাঁচুমাচু করে বলে উঠলাম,
পৃথিবীর সব লোক কি রাস্তায় আমার পিঠের তিল খোঁজার জন্য দাঁড়িয়ে ছিল শুভ্র ভাই? তাছাড়া এখন কোয়ারেন্টাইন চলছে। রাস্তায় আর্মিরা ছাড়া আর কেউ নেই বললেই চলে।
ওহহো অসাধারণ! তার মানে আর্মিদের জানিয়ে এসেছিস?
আশ্চর্য! আমি কেন জানাতে যাবো শুনি? এই শাড়িটা মামানির। এখানে এসেই পড়েছি।
ওহ মাই গড! তুই আমার বাসায় এসেই আম্মুর শাড়ি দখল করে নিলি? এখন নিশ্চয় আমার রুম দখল করতে এসেছিস। কি সাংঘাতিক মেয়েরে তুই!
আমি আপনার রুম দখল করতে যাবো কেন? (রাগী গলায়)
তাহলে কি আব্বু আম্মুর রুম দখল করবি? কি সর্বনাশের কথা! এই শোন, এই বাড়িতে চারটি বেডরুম আছে। একটা আব্বু আম্মুর দখলে। একটা গেস্টদের জন্য ওখানে তোর প্রবেশ নিষেধ। আর একটা দিদার আত্মার জন্য। মাঝ রাতে বসে বসে তসবি পড়ে তো। শী নিড প্রাইভেসি। আর অবশেষে এলো আমার রুম। এটাই একমাত্র রুম যেখানে তুই আক্রমন করতে পারিস। আই ওন্ট মাইন্ড। বুঝলি না? আমি হলাম মহৎপ্রাণ ব্যক্তি।
আপনি একটা ছাগলের প্রাণ যত্তসব আজাইরা। মনে মনে কথাটা বললেও মুখে প্রকাশ করলাম না মোটেও। এই বলদের সাথে কথা বলা মানেই ঝগড়া। কোনো রকম মুখ কাঁচুমাচু করে বলে উঠলাম,
আমি কারো রুম দখল করতে আসি নি শুভ্র ভাই।আপনাকে বিরিয়ানি দিতে এসেছিলাম জাস্ট। আপনি আপনার মহৎপ্রাণ হৃদয় নিয়ে রুমে আরাম করুন। আমি আসছি।
কিসের আসছি? দাঁড়া এখানে। তোর সাথে খুব ইম্পোর্টেন্ট কথা আছে আমার।
কককি কথা?
এই তুই তো দেখি সাংঘাতিক মেয়ে। আমাকে নিয়ে ফেসবুকে উথাল পাথাল শুরু করে দিয়েছিস? আর আমি কতো নিরীহ প্রাণী কিচ্ছুটি জানি না। সেদিন পুষ্পিতা না বললে তো জানতামই না। জান্নাত নামের একটা মেয়েও বললো রোদ আপু তো অসাধারণ লেখে৷ ভাইয়া ইউ হেভ টু রিড ইট। আমি তো হতবাক৷ এই এই তুই আমার নামে কোনো ষড়যন্ত্র করছিস না তো?পাবলিক দিয়ে পিটুনী টাইপ? এভাবে মারতে পারিস নি তাই এখন অন্য পথ ধরেছিস? বুঝি তো। সব বুঝি!সেদিনও আম্মুর হাতে পাত্রীর ছবি ধরিয়ে দিয়েছিলি। মা তো প্রায় বিয়ে করিয়েই ফেলেছিল আমার! আমি যদি হার্ট অ্যাটাক করে মরে যেতাম তখন কি হতো?
এই সিম্পল একটা বিষয়ে হার্ট অ্যাটাক করে মরে যাবেন? বিয়েই তো করতেন। ফাঁসি তো আর চড়তেন না। আমি তো জাস্ট মামানিকে হেল্প করছিলাম। উনিই তো বলেছিলেন আমায় আমি যেন খুবই মিষ্টি একটা মেয়ে খুঁজে বের করি। (মুখ ফুলিয়ে)
আহারে আসছে মামানি ভক্ত! এক থাপ্পড়ে সব দাঁত ফেলে দিবো। আমার বিয়ে আমার মাথা ব্যাথা নেই; তুই এতো লাফাচ্ছিস কেন শুনি? তুই তো পুষ্পিতাকেও পাত্রী দেখতে বলে দিয়েছিস। বেয়াদব মেয়ে।
এই রাত্রী পাত্রী ঠিক কি কি বলেছে আপনাকে? (রাগী গলায়)
কি আর বলবে যা সত্য তাই বলেছে। পুষ্পিতা বললো, “জামাইবাবু রোদের মাথার তার ছিড়ে গেছে। ও আপনার জন্য পাত্রী খোঁজছে।” শুনেই আমার হার্ট অ্যাটাক হওয়ার উপক্রম। কি সাংঘাতিক মেয়ে রে তুই! হাত ধোয়ে আমার পিছে পড়ে আছিস! দুনিয়ার সবাইকে আমার কথা বলে বেড়াচ্ছিস। মারাত্মক!
আমি শুকনো ঢোক গিলছি আর এদিক ওদিক তাকাচ্ছি। আর এই রাত্রির চৌদ্দ গোষ্ঠী উদ্ধার করছি।শালী হারামখোর! উনি আবারও বলে উঠলেন,
এভাবে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থেকে কি প্রমাণ করতে চাস তুই নির্দোষ?
উনার কথায় দাঁত কেলিয়ে জোড় পূর্বক হাসি দিলাম। মনে মনে দোয়া দোরুদ পড়ছি। ব্যাটা বিয়ে তো একদিন করতেই হবে। তো আজ করলে কি এমন ক্ষতি হবে শুনি? এমন ভাব করছে যেন আমি তার মহাক্ষতি করে দিচ্ছি। আরে পাত্রীই তো খুঁজচ্ছিলাম। তবু পেলাম টা কই? এই হারামি রাত্রীকে বললাম। সে আমায় বাঁশ খাইয়ে দিলো। ওই জান্নাতকে বললাম সে আমায় জোড়পূর্বক ভাবি বানিয়ে দিলো। কিছু বলতে গেলেই ভাবি ডাকে। কেমনডা লাগে? আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অসহায়ের মতো নখ খুঁটছি। উনি এবার উঠে দাঁড়িয়ে শার্টের হাতা ফোল্ট করতে করতে বলে উঠলেন,
আমি খেতে যাচ্ছি। আলমারিতে আমার দু’টো শার্ট আর দু’টো প্যান্ট আছে। ওগুলো ধোয়ে দিয়ে যাবি। এটাই তোর পানিশমেন্ট। এসে যদি দেখি ধোওয়া হয় নি, তাহলে কঠিন মাইর।
আমি কাঁদো কাঁদো ফেইস নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। উনি যেতে নিয়েও আবার ফিরে এসে বলে উঠলেন,
আর হ্যাঁ। যাওয়ার সময় চুলটা বেঁধে যাবি। দেখ এমনি মানুষ করোনায় আতঙ্কিত। তোর এই পেত্মীর মতো চেহারা দেখিয়ে মানুষকে আর আতঙ্কিত করে দিস না। একটু দয়া কর (হাত জোড় করে)
কথাটা বলেই বেরিয়ে গেলেন উনি। ইচ্ছে তো করছে ব্যাটাকে ধরে এই ব্রক্ষ্মপুত্রের পানিতে চুবিয়ে মারি। আমি পেত্মী? তুই পেত্মী, তোর বউ পেত্মী, তোর বউয়ের চৌদ্দগোষ্ঠী পেত্মী। নিজের মা-ই যদি পর হয়ে যাই তাহলে ভাগ্যে তো কাপড় ধোওয়ায় থাকবে। আমার থেকে আমার মায়ের কাছে তার ভাতিজা প্রিয়। একমাত্র ভাতিজা বলে কথা! শালা বজ্জাত! তোকে আমি খুন করবোই করবো। দেখে নিস। রাগে গজগজ করতে করতে আলমারি খুলতেই অবাক হলাম আমি। উপরের তাকেই একটা কাঁচের বক্স আর তাতে একটা হলুদ কাগজ আটকানো। সেখানে লেখা “just for puchki” লেখাটা দেখেই অবাক হলাম আমি। আমার জন্য! ঝটপট বক্সটা খুলে দেখি লাল, নীল, হলুদ, সবুজ, বেগুনি আর কালো রঙের ১২ টা করে কাঁচের চুড়ি।চুড়িগুলো দেখেই খুশিতে নাঁচতে ইচ্ছে করছে আমার। চুরিগুলোর পাশেই গুঁজা একটা সাদা কাগজ। তাতে লেখা,
“কেউ কিনে দিলো না। সে কোথায়? কেউ বলো তাকে কিনে দিতে – 5 January 2020। এতো আহাজারি কেন তোমার? যাও দিলাম কিনে।”
লেখাটা পড়ে আমি স্তব্ধ। এটা ৫ জানুয়ারিতে করা আমার পোষ্ট! এখনও মনে আছে? ঠিক তখনই মামানি ডেকে উঠলো আমায়। হঠাৎ ডাকায় চমকে ওঠে হাত থেকে পড়ে গেলো কাঁচের বাক্সটা। তারপরই তুমুল ঝনঝন শব্দ। সারা ঘরময় ছড়িয়ে গেল কাঁচ আর চুরির টুকরো। মামানি এসে হতবাক। “এসব কি? চুড়ি কোথা থেকে?” আমি থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে আছি। কান্না পেয়ে যাচ্ছে আমার। ঠিক তখনই মামানির পেছন থেকে শুভ্র ভাইয়া বলে উঠলেন,
তোমার পুত্রবধূর জন্য কিনেছিলাম। তোমাদের আদরের দুলালি ভেঙে দিলো সব।
ইশশ!! এভাবে বলছিস কেন? ও কি ইচ্ছে করে ভেঙেছে? কবে আসবে বউ তার জন্য দরদ উতলে পড়ছে। সর এখান থেকে।
যাচ্ছি তো। কিন্তু ওর পায়ে কাঁচের টুকরো বিঁধলো কি না দেখো। (যেতে যেতে)
মামনি আমায় নিয়ে ড্রয়িংরুমের সোফায় বসিয়ে দিলেন। হাতে পায়ে চেইক করে চলেছেন ক্রমাগত। কোথাও লেগেছে কি না? আমি ফ্রিজড হয়ে বসে আছি। আমি কি শুভ্র ভাইয়ের দেওয়া এমন গিফ্টে শকড্? নাকি চুড়িগুলো ভেঙে যাওয়ায় কাতর?
#রোদবালিকা
রোদ শুভ্রর প্রেমকথন সম্পূর্ণ গল্পের লিংক
https://kobitor.com/rodsuvro/