#রোগী কথন পর্ব ৮০
#নরমাল ডেলিভারির সাতকাহন এবং মা হওয়া
নরমাল ডেলিভারি প্রথম দেখেছিলাম ফিফথ ইয়ারে। কৌতূহল থেকেই এক সিনিয়র আপুকে বলেছিলাম, ডেলিভারির রোগী এলে আমাকে যেনো ডাকে। তখনো এ ব্যাপারে আমাদের হাতে কলমে শিক্ষা দেয়া শুরু হয়নি। ভয়াবহ সেদিনের অনুভূতি এখনো তরতাজা আছে। মনে পড়লে এখনো গা কাঁটা দিয়ে ওঠে। লেবার রুমে ঢুকতেই কেমন একটা ভীতিকর আবহে পড়ে গেলাম যেনো।
প্রসব যন্ত্রণায় কাতর মায়ের কষ্ট বর্ননা করি কী করে! দেখি ডেলিভারি টেবিলে মা চিত হয়ে শুয়ে দু পায়ের গোড়ালী শক্ত করে ধরে আছে। তাকে বলা হলো, ব্যাথা জাঁকিয়ে ওঠলে পেট শক্ত হয়ে যাবে তখন মুখ বন্ধ রেখে পুস দিবা অর্থাৎ কোঁৎ দিবা। ঢেউয়ের মতো একটু পর পর ব্যথা আসে। ব্যাথায় মা কুঁকড়ে যান। কান্নার শব্দ যেনো বাহিরে না যায়, এমন প্রানান্তকর চেষ্টাকে ব্যার্থ করে দিয়ে মায়ের বুকচেরা সুতীব্র চিৎকার আকাশ বাতাস ভারী করে তোলে।
মা দরদর করে মা ঘামতে থাকেন, ঘনঘন শ্বাস পড়ে। এত সময় লাগছে কেনো? ডাক্তারের কপালে সুক্ষ্ম ভাঁজ। বাচ্চার হার্টবিট দ্রুত থেকে দ্রুততর হয়। ব্যাথার ঢেউ একটার পর একটা আছড়ে পড়তে থাকে। মায়ের বুকফাটা চিৎকার, ফোসফাস দীর্ঘশ্বাস, রক্ত পানি, জন্মপ্রক্রিয়ার খাঁটি আদিমতম দৃশ্য সব মিয়ে লেবার রুমে তখন শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা! আমার সত্যি সত্যি শ্বাসকষ্টের মতো হয়। মাকে খুব মনে পড়ে, নতুন করে অনুভব করি। বৈচিত্র্যহীন আটপৌরে মাকে আমি নতুন করে আবিষ্কার করি। শ্রদ্ধায় ভালোবাসায় মন আর্দ্র হয়ে ওঠে। মনেমনে বলি, মা এত্তো কষ্ট করে আমাকে পৃথিবীতে এনেছিলে? মা!
এমন সময় হুড়োহুড়ি পড়ে যায়! বাচ্চার মাথা দেখা যাচ্ছে, মাথা দেখা যাচ্ছে। হ্যাঁ, হ্যাঁ জোরে জোরে পুস দাও, পুস দাও। এইতো লক্ষ্মী মেয়ে। আর একটু, আর একটুখানি সহ্য করো। আর কতক্ষন ম্যাডাম? আমি মনেহয় মরে যাবোওওও…ব্যাথার দমকে কথা শেষ করতে পারে না। এইতো এনাল গ্যাপিং হচ্ছে ; আর বেশি দেরি নাই। আফা দেখেন, বেটি কতটি হাগু করল, সারা বছরের পায়খানা জমায়ে রাখছিল আজকের জন্য। পরিস্কার করতে করতে খালা গজগজ করছে।
চুপ করো তো খালা, রোগীর পায়খানা হওয়া মানে লক্ষ্মণ ভালো, বাচ্চা ঠিকঠাক নামছে। নামতে নামতে রেক্টামকে চাপ দিচ্ছে। ফলাফল হাগু বের হয়ে আসছে, বুঝলা খালা? ত্যাক্তবিরক্ত খালার মুখ ব্যাজার। অবশ্য হাগুমুতু পরিস্কার করা আনন্দের কোনো ঘটনা হওয়ার কথা না। বাচ্চাটা এতক্ষণ ব্যথার সাথে সাথে কচ্ছপের মতো মাথাটা বাহিরে ভেতরে করলেও এখন আর পারছে না। ক্রাউনিং। অর্থাৎ বাচ্চার মাথা মায়ের যোনিপথে আঁটকে গেছে। এপিসমিওটমি ছাড়া উপায় নেই। জন্মপথ কেটে বাচ্চা বের করাকে এপিসিওটমি বলে। সাধারণত লোকাল ব্যথানাশক দিয়ে কাটার নিয়ম।
কিন্তু প্রসব বেদনার তীব্রতা এতই বেশি থাকে যে এসব কাটাকুটিতে ব্যথানাশক না দিয়েও কাটা যায়। আহা, একটা পিঁপড়ে কামড় দিলে কেমন লাফ দিয়ে ওঠি! আর সন্তান জন্মদিতে গিয়ে মা তার অঙ্গ প্রত্যঙ্গ ছিড়েখুঁড়ে এফোড় ওফোড় করে ফেলে কত অবলীলায়! কোনো রকম ওজর আপত্তি এমনকি ব্যথা নাশক ছাড়াই! মায়ের শরীর কী দিয়ে তৈরী, হ্যাঁ? কি দিয়ে? একসময় সুতীব্র চিৎকারে আকাশ পাতাল জানান দিয়ে সন্তান ভূমিষ্ট হলো। সন্তান কাঁদে, মাও কাঁদে। কে যে কার জন্য কাঁদে কে জানে। কান্না সংক্রামক। উপস্থিত অন্যদের চোখের ছায়া তাই বলে যায়।
অনেক কথা বল্লাম, নরমাল ডেলিভারি নিয়ে দুটো কথা বলে শেষ করছি- নরমাল ডেলিভারি হচ্ছে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম ডেলিভারি পদ্ধতি। তবে কিছু ব্যাপার অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে যেমন- বাচ্চার পরিমিত ওজন, নরমাল পজিশন, পেলভিস যথাযথ, প্রসব যন্ত্রণা ঠিকঠাক, গর্ভফুল জরায়ুমুখের কাছে না থাকা, অভিজ্ঞ ডেলিভারি পার্সন থাকা এবং হাসপাতাল কিংবা ফ্যাসিলিটিতে ডেলিভারি করানো। এসব পয়েন্ট ঠিকঠাক থাকলে নরমাল ডেলিভারিই হচ্ছে উত্তম পন্থা। সিজার যে লাগে না তা নয়, সেটা নিয়ে পরে লিখব।
সন্তান জন্মদানে মাকে এত্তো এত্তো কষ্ট সহ্য করতে হয়! নয় মাস রক্ত মাংস খাইয়ে সন্তানকে বড় তো করেই, জন্মপথ ছিড়েছুঁড়ে পৃথিবীতেও আনে, তারপরও সে সন্তান মাকে কষ্ট দেয়! বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসে! আহা সন্তান, যদি একটিবারের জন্য দেখতি তোদের জন্য আমরা মায়েরা বুকের ভেতরটায় কত কষ্ট, আনন্দ, ব্যথা আরো কত কী রেখেছি! নিজের জন্য খাবার, অক্সিজেন সাপ্লাই ঠিকঠাক রাখতাম না, পাছে তোর কম পরে যায়! আর সেই সন্তান কি না চোখ তুলে কথা বলে! নিয়ম সেখায়, আধুনিকতা কপচায় মায়ের সাথে!
আমার খুব ইচ্ছা করে, নারী পুরুষ নির্বিশেষে সকলকে সন্তান ধারনের ক্ষমতা দিয়ে দেই। সন্তানের সবটা কিভাবে জন্মদাত্রী ঘিরে রাখে তা সরেজমিনে একটু দেখে আসুক প্রিয় সন্তান। তারপর সামনে এসে কথা বলুক। দেখি তো কী কথা তারা আমাদের মায়েদের বলে!
রিপোষ্ট। খুব প্রিয় একটা লেখা। গায়ে হাত বুলিয়ে ছুঁয়ে ছুঁয়ে বারবার আদর করার মতো প্রিয়।
#Lady_in_Red