<<<<<<<<< চার হুনাফার কাহিনী >>>>>>>>>>>>>>>>>
আগের পর্বে আমরা জেনেছিলাম কুস ইবনে সাঈদা’র কথা – যে কিনা ইসলাম-পূর্ব আরবের মানুষ হয়েও মূর্তিপূজারী ছিল না, বরং এক আল্লাহয় বিশ্বাস করত ও কেবল তারই ইবাদত করত।
ইতিহাসগ্রন্থ ঘাঁটলে ঐ কুস ইবনে সাঈদা ছাড়াও আরো ৪ জন হানিফ (বহুবচন – হুনাফা) পাওয়া যায়। (“হানিফ” শব্দের অর্থ হলো “ফিরে যাওয়া”। হানিফ বা হুনাফা হলো তারাই যারা পৌত্তলিকতার যুগে পৌত্তলিকতার দিকে না গিয়ে বরং নিজের বিবেক-বুদ্ধি ব্যবহার করে ফিরে গিয়েছে এক আল্লাহর দিকে।) আসুন এই চার হুনাফা সম্পর্কে জানি।
ইবনে হিশাম বর্ণনা করেন – প্রিয়নবী মুহাম্মাদ(সা) এর জন্মের কয়েক বছর আগে (ধারণা করা যেতে পারে ১৫-২০ বছর আগে), কুরাইশরা একবার এক মহা উপাসনা উৎসব বা পূজার আয়োজন করে। বিশালকার আয়োজন আর অনেক লোকের জনসমাগম হবে – তাই তারা উৎসবটা মক্কার বাইরে আয়োজন করে। সমস্ত মক্কাবাসী যখন সেই মহাপূজা যোগ দিতে মক্কার বাইরে চলে গেল, তখন ৪ জন মানুষ মক্কায় রয়ে গেল। তারা কা’বার পাশে যখন একজন আরেকজনকে দেখল – তখন একে অপরের দিকে চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগল। একজন আরেকজনের দিকে তাকিয়ে বুঝে গেল যা বোঝার – এদের ৪ জনেই কেউই মূর্তিপূজাকে ঠিক বলে মনে করে না।
এই চার ব্যক্তি কারা ছিল? এদের নাম হলো – ওয়ারাকা ইবনে নোওফেল ইবনে আসাদ (ইনি খাদিজা(রা) এর চাচাত ভাই কিন্তু বয়সে প্রায় ৪০-৫০ বছর বড়), উবাইদিল্লাহ ইবনে জাহশ (ইনি মুহাম্মাদ(সা) এর ফুপাত ভাই), উসমান ইবনুল হুয়াইরিস, যাইদ ইবনে আমর ইবনে নুফাইল (উমার(রা) এর চাচাত ভাই কিন্তু ইনিও বয়সে তার চেয়ে প্রায় ৪০-৫০ বছর বড়)।
এই চারজন মিলে ঠিক করল – চলো, আমরা আমাদের মক্কাবাসীর কাউকেই বলব না যে আমরা মূর্তিপূজায় বিশ্বাস করি না। কিন্তু, আমরা জানি ওরা ভ্রান্ত ধর্মবিশ্বাসের উপর আছে, কারণ তারা ইব্রাহিম(আ) এর ধর্ম থেকে সরে এসেছে। আমরা কি পাথরের চারদিকে তাওয়াফ করব? আমরা কি এমন পাথরের নামে কুরবানী করব যা আমাদের ক্ষতি বা উপকার কিছুই করতে পারে না? কখনই না। বরং, চলো আমরা ইব্রাহিম(সা) এর অরিজিনাল ধর্মের খোঁজ করি। এরপর, সেই সত্যি ধর্মের খোঁজে তারা ৪ জন মক্কা থেকে বেরিয়ে পড়ে। এই ৪ ব্যক্তির ৪ টি ভিন্ন কাহিনী আছে।
১) ওয়ারাকা ইবনে নোওফেল: ইনি খ্রিষ্টান ধর্মের সন্ধান পান ও তা গ্রহণ করেন। ইনি হিব্রু ও এরামেইক ভাষা শিখে নেন এবং বাইবেল নিয়ে বিস্তর গবেষণা করেন। প্রিয়নবী মুহাম্মাদ(সা) এর প্রতি প্রথম ওহি আসার পর পর খাদিজা(রা) মুহাম্মাদ(সা) কে ওয়ারাকা’র কাছে নিয়ে যান (ধর্ম সম্বন্ধে ওয়ারাকার অগাধ জ্ঞানের কারণে) এবং ওয়ারাকা তখন মুহাম্মাদ(সা) কে রাসূল রূপে স্বীকার করেন তথা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন।
২) উবাইদিল্লাহ ইবনে জাহশ: এই ব্যক্তির ঘটনা দু:খজনক। ইনি প্রথমে খ্রিষ্টান ধর্মের সন্ধান পান ও তা গ্রহণ করেন। এরপর যখন প্রিয়নবী মুহাম্মাদ(সা) ইসলাম প্রচার শুরু করেন, তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন এবং উম্মে সালামা কে বিয়ে করেন। যখন মুসলিমদের ওপর অত্যাচার চরমে পৌঁছে, ইনি অন্য অনেক সাহাবার সাথে আবিসিনিয়ায় হিজরত করেন। কিন্তু, আবিসিনিয়ায় গিয়ে তিনি ইসলাম ত্যাগ করে আবার খ্রিষ্টান ধর্ম গ্রহণ করেন। এই ঘটনায় উম্মে সালামা তাকে ডিভোর্স দিয়ে মক্কায় ফিরে আসেন। পরবর্তীতে প্রিয়নবী মুহাম্মাদ(সা) উম্মে সালামাকে বিয়ে করেন।
উবাইদিল্লাহ ইবনে জাহশ এর ঘটনা থেকে আমরা একটা ফিকহ গ্রহণ করতে পারি। তা হলো – যে রাষ্ট্র শরীয়া আইন অনুযায়ী চলে না, সেই রাষ্ট্রে একজন মুসলিম তার ধর্ম ত্যাগ করে মুরতাদ হয়ে গেলে তার কোন শাস্তি হয় না। উবাইদিল্লাহ ইবনে জাহশ আবিসিনিয়ায় যেয়ে ইসলাম ত্যাগ করে খ্রিষ্টান ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন, এর জবাবে সেখানে অবস্থিত মুসলিমরা তাকে হত্যা করা তো দূরের কথা, তার চুল পর্যন্ত স্পর্শ করেনি।
৩) উসমান ইবনুল হুয়াইরিস: ইনিও খ্রিষ্টান ধর্ম গ্রহন করেছিলেন এবং খ্রিষ্টান হিসাবেই মারা গিয়েছিলেন। ইনি এই যে মক্কা ছেড়ে গিয়েছিলেন, আর কখনোই ফেরত আসেননি। বলা হয়ে থাকে – ইনি সম্রাট সিজার এর দরবারে যান। সেখানে তিনি অনুবাদকের চাকুরী পান এবং অর্থ ও খ্যাতিসহ বাকী জীবন অতিবাহিত করেন। আমাদের জানা নাই ইনি কখনো ইসলামের দাওয়াত পেয়েছিলেন কিনা।
৪) যাইদ ইবনে আমর ইবনে নুফাইল: এই ব্যক্তির ঘটনাটা সবচেয়ে বেশী আকর্ষণীয়। ইনি খ্রিষ্টান বা ইহুদি কোন ধর্মই গ্রহণ করেননি – কারণ তিনি দুইটার মধ্যে গলদ খুঁজে পাচ্ছিলেন। তিনি বিভিন্ন এলাকা ঘুরে সঠিক ধর্মের সন্ধান না পেয়ে আবার মক্কায় ফিরে আসেন। এসে মক্কাবাসীদের বলেন – এই যে মানুষ, সবাই শোন! এই পুরো শহরে একমাত্র আমি ছাড়া আর কেউই ইব্রাহিম(আ) এর ধর্মের উপর নেই।
আসমা বিনতে আবু বকর (যিনি আয়েশা(রা) এর প্রায় ২০ বছরের বড় বোন) থেকে বর্ণিত – তিনি বলেন যে, আমি ছোট থাকতে দেখেছি যে যাইদ কুরাইশ বাসীদের ভর্তসনা করেছেন মূর্তিপূজা করার জন্য, মূর্তিকে মাংস দেয়ার জন্য এবং জীবিত মেয়ে সন্তানকে কবর দেওয়ার জন্য। এমনকি কোন কুরাইশী তার মেয়েকে জীবন্ত কবর দিতে গেলে, যাইদ বাধা দিয়ে বলত – এই মেয়েকে আমার কাছে দাও। আমি একে দত্তক নিব, একে লালন-পালন করব।
নবুয়তীর পূর্বে, প্রিয়নবী মুহাম্মাদ(সা) যখন কিশোর ছিলেন, তখন যাইদের সাথে তার কথা হয়েছিল। মুহাম্মাদ(সা) তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন – তোমার মানুষজনের সাথে তোমার এমন বিরোধীতা কেন? যাইদ ইবনে আমর তখন জবাব দিতেন – ওরা মূর্তিপূজা করে যা আমি করতে পারব না। যাইদের এ জবাবে কিশোর মুহাম্মাদ(সা) তাঁর নিজের বিশ্বাসের সাথে মিল পেয়ে শান্তি অনুভব করেছিলেন।
যাইদ ইবনে আমর(রা) ইব্রাহিম(আ) এর ধর্মের উপর থেকেই ইন্তেকাল করেছিলেন, মুহাম্মাদ(সা) এর ইসলাম প্রচারের ৫ বছর আগে। এই যাইদ ইবনে আমর(রা) এর ছেলে সাঈদ ইবনে যাইদ সাহাবী ছিলেন। শুধু সাহাবীই ছিলেন না তিনি ছিলেন ১০ জন সাহাবী যাদেরকে জান্নাতের গ্যারান্টি দেয়া হয়েছে (যাদেরকে ‘আশারা মুবাশশারা বলা হয়) তাদের মধ্যে একজন।
সাঈদ ইবনে যাইদ একদিন রাসূলুল্লাহ(সা) এর কাছে এসে বলল – হে রাসূলুল্লাহ! আপনি তো জানেন আবার বাবা কেমন মানুষ ছিলেন এবং কোন্ ধর্মের অনুসারী ছিলেন। আখিরাতে তাঁর পরিণতি কি হবে?
রাসূলুল্লাহ(সা) জবাব দিলেন – “কিয়ামতের দিনে সে উত্থিত হবে একজন একক উম্মত হিসাবে (কোন নবীর উম্মত হিসাবে নয়)।“ ইসরা ও মি’রাজ থেকে ফিরে এসে রাসূলুল্লাহ(সা) আরো বলেছিলেন – “আমি যাইদ ইবনে আমর (রা) কে জান্নাতে দেখেছি। তাকে ১ টা নয়, বরং ২ টা বাগান দেয়া হয়েছে।“
[শেইখ ইয়াসির কাযির সীরাহ লেকচার পর্ব-৪ অনুসারে]