মেয়েটার পড়ার টেবিলে বসে আছি। ও খুব আনন্দ নিয়ে আমাকে বলছে বাবা আমি ক্লাসে দ্বিতীয় হয়েছি। আমি মেয়েটার দিকে তাকিয়ে আমার বাবাকে খুঁজছি।
আমি আমার রহস্যময় বাবাকে জীবনের অনেকটা সময় চিনতে পারিনি। বাবার প্রতি অভিমান জমতে জমতে একটা সময় পাহাড় হয়েছিল।
যখন ক্লাস সিক্স থেকে সেভেনে উঠলাম দ্বিতীয় হয়ে। তখন খুব খুশি হয়ে বাবাকে রেজাল্ট দেখাতে গেলাম বাবা অন্যদিকে তাকিয়ে বলল প্রথম হলে আরও ভাল হত। মনটা খারাপ হয়ে গেল। বাবার ওপর রাগ আর জেদ হতে লাগল। এরপর থেকে বরাবরই প্রথম হতাম। এরপর আব্বাকে আর রেজাল্ট বলতামনা। অবশ্য আব্বা রেজাল্টের দিন সকালে গিয়ে স্কুলে বসে থাকত।
আব্বা যে স্কুলের শিক্ষক সে স্কুলে সিক্সে আমাকে ভর্তি করালনা যদি বাবার সুবাদে ভাল রেজাল্ট করি। আমাকে ভর্তি করাল তিন মাইল দূরে শহরের একটা ভাল মানের স্কুলে। পুরনো সাইকেল নিয়ে স্কুলে যেতে ভাল লাগতেছিলনা। আব্বাকে একটা নতুন সাইকেলের কথা বললাম। আব্বা তা শোনে অনেক রেগে গেলেন, বললেন এই সাইকেলের তো সব ঠিকঠাক আছে। যখন নষ্ট হবে তখন নতুন কিনে দিব। অযথা টাকা নষ্ট করার মানে হয়না। জীবনে কষ্ট না করলে বড় হতে পারবানা।
আমার স্কুলের পাশে সাইকেলের শোরুমটা। বাহির থেকে দেখি কত সুন্দর সুন্দর সাইকেল দেখা যায়।। প্রতিদিন স্কুলে যাওয়ার সময় একবার হলেও সাইকেলগুলোর দিকে তাকাই আর মনে মনে আব্বার ওপর রেগে যাই।
একদিন কয়েকজন স্কুলের বন্ধু মিলে শোরুমে ঢুকলাম। শোরুমে বাবার মত এক বয়স্ক লোক আমাকে ডেকে বলল আমাকে তুমি চিনবেনা আমি তোমার বাবার বন্ধু। তোমার বাবার সাথে তোমাকে একদিন দেখেছিলাম। ঐ যে সুন্দর সাইকেলটা ঐটা এক সপ্তাহ পর তোমার হবে। তোমার বাবা প্রায় এসে বলে আমার ছেলের জন্য একটা সুন্দর ও ভাল মানের একটা সাইকেল রাখিস। কয়েকমাস পর কিনব। আমি তোমার বাবাকে বলছিলাম সাইকেলটা নিয়ে যেতে । বলেছিলাম পরে টাকা দিও। । না সে বাকী রাখবেনা। গতকাল বলেছে এক সপ্তাহ পর নিয়ে যাবে। আব্বার ওপর থেকে সাইকেল না কিনে দেওয়ার অভিমান দুরে সরে যাচ্ছিল আর দু’চোখ আনন্দে ছলছল করেছিল।
একরার পাশের বাড়িতে ছেলে বিদেশ থেকে আসায় অনেক রান্না বান্না হচ্ছে। খাবারের গন্ধ ভেসে ভেসে আসছিল। তখন শীতকাল ছিল। বাবা আর আমি শীতের সকালের মিষ্টি রোদে উঠোনে বসে নতুন বই নাড়াচারা করি। বাবা বইয়ে ক্যালেন্ডার দিয়ে মলাট লাগাচ্ছিল। কিন্তু ইলিশ মাছের গন্ধটা আমার নাকে লেগেই আছে। আমি কেন জানি বাবাকে বলে ফেললাম বাবা ইলিশ মাছ অনেকদিন খাইনা। বাবা ধমক দিয়ে বলল আমাদের অন্য পাশের বাড়িটা দেখ তারা সপ্তাহে এক বেলা মাছ খেতে পারেনা। সবসময় নীচের দিকে তাকাবে তাহলে জীবনে আর আফসোস থাকবেনা। আমি সব শুনে মাথা নীচু করে দাড়িয়ে ছিলাম। ক্লাস ফাইবে পড়া একটা ছেলের কাছে এত বাস্তববাদী কথা মাথায় ঢুকছিলনা তখন।
রাতে পড়ার টবিলে বসে পড়তেছি। আবার সেই সকালের মত ইলিশ মাছের গন্ধটা নাকের কাছে ভেসে আসছে। আমি নাক বন্ধ করে কিছুক্ষন রইলাম। কিস্তু গন্ধ আর যাচ্ছেনা। আমি আস্তে আস্তে করে রান্না ঘরে গেলাম। দেখি মা ইলিশ ভাজে। আমাকে দেখে মা বলে তাড়াতাড়ি আয়। তোর বাবা আগে ইলিশ মাছের ডিমটা গরম গরম খেতে বলেছে তোকে। বাবা জানে আমি ইলিশ মাছের ডিম অনেক পছন্দ করি। আমি বাবার রুমের দরজায় গিয়ে দাড়িয়ে দেখলাম বাবা স্কুলের কাগজ পত্র নিয়ে বসেছে। ইচ্ছে করতেছিল বাবাকে জড়িয়ে ধরি একটু। কিন্তু তখন তো সব পরিবারে এখনকার বাচ্চাদের মত খুব সহজেই বাবাকে জড়িয়ে ধরার মত অভ্যাস আমাদের ছিলনা। বাবা আমাকে দেখে বলল কিছু বলবি? আমি বাবার দিকে তাকিয়ে বললাম না এমনি।
আমি যখন ক্লাস টেন এ পড়ি তখন মাকে বলে বন্ধুদের সাথে কাছাকাছি একটা জায়গায় পিকনিকে গেছিলাম। তখন মোবাইলের ব্যবহার খুব কম ছিল। ফিরতে ফিরতে অনেক রাত হয়েছিল। যখন বাসায় ফিরলাম, তখন আব্বা চরম রেগে গিয়ে একটা গালে চড় মেরেছিল। সেই রেগে বাসা থেকে বের হয়ে গেছিলাম। আব্বা সারারাত খুঁজে ভোরের দিকে আমাকে নদীর পাড়ে পেয়ে বাসা নিয়ে যায়। তারপরের দিন মা বলেছিল পাশের গ্রামে একটা ব্রীজ আছে সেই ব্রীজের নীচে নাকি একটা লাশ পাওয়া গেছে। সেইজন্য তোর বাবা খুব ভয় পেয়েছিল। তারপর প্রায় একমাস আমি বাবার সাথে কথা বলিনি।
এসএসসি পরীক্ষার আগে আমার বড় বোনের বিয়ে হলো।। আমার বোনের শশুর শাশুড়ী ঢাকা থেকে গ্রামে বেড়াতে এসে আমার বোনকে খুব পছন্দ করে ফেলে। আমার বোন তখন ইন্টার পাশ করেছে। ভর্তি পরীক্ষা বিভিন্ন জায়গায় দিবে। পড়াশুনার ক্ষতি হবে ভেবে, বাবা এত তাড়াতাড়ি আমার বোনকে বিয়ে দিবেননা । কিন্তু তারা তাদের বুয়েট থেকে পাশ করা ছেলের জন্য আমার বোনকে বউ করতে চায়। আমার আব্বাকে চাচারা সবাই বুঝাল, ছেলে ভাল জায়গা থেকে পড়াশুনা করেছে, ভাল চাকুরী করে, মেয়ে সুখে থাকবে। বাবা রাজী হলো একটা র্শত দিয়ে মেয়ের পড়াশুনা যেন শেষ করায় তারা। তো আমার বোনের বিয়ের দিন আব্বা সারাদিন সবকিছু সুন্দর করে গুছিয়ে অনুষ্ঠান শেষ করল। এমন কি সন্ধ্যেবেলা আমার বোনের বিদায়ের বেলাও আব্বা সবার সাথে সুন্দর করে কথা বলে বিদায় দিচ্ছে। আমি , আমার মা আর বোন তিনজনে গলা ধরাধরি করে কান্না করছি। আব্বার ওপর খুব রাগ হচ্ছিল যে এই লোকটা এত কঠিন কেন?
সবাই চলে যাওয়ার পর আব্বাকে কোথাও খুঁজে পাচ্ছিনা । খুঁজতে খুঁজতে পুকুর পাড়ে গিয়ে দেখি আব্বা বসে আছে। কাঁধে হাত দিতেই আব্বা বলে কে ? দেখলাম আব্বা কাঁদছে। বাবারা চোখের জল সন্তানদের দেখাতে চায়না। আমি সেদিন আব্বার পাশে কিছুক্ষন বসে ছিলাম। আব্বাকে আরও বুঝার চেষ্টা করলাম। যত বড় হচ্ছিলাম , আব্বাকে তত একটু করে বুঝতে শিখছিলাম।
আমি যেদিন খবর পেলাম বুয়েটে চান্স পেয়েছি সেদিন পাগলের মত ছুটে দৌড় দিয়ে আব্বার কাছে যাই। আব্বা তখন জমিতে আরও লোকজন নিয়ে কি কাজ যেন দেখাচ্ছিল। আব্বা আমাকে দেখে এগিয়ে এসে বলে কি হয়েছে বাবা ? এরকম করছিস কেন? আমি শুধু কান্না করছি বোবার মত। আব্বা আমাকে এসে জড়িয়ে ধরে ছিল। আর বলে কি হয়েছে বাবা? আমি খুব করে চাচ্ছিলাম আব্বা আমাকে একটু জড়িয়ে ধরে থাকুক। অনেকদিন আব্বা আমাকে ছোটবেলার মত জড়িয়ে ধরেনা।। আবার আব্বা বলে কি হয়েছে? আমি আব্বাকে যখন বললাম আব্বা আনন্দে কান্না করছে। আমি আর একবার আব্বার কান্না দেখলাম, আনন্দের কান্না। আনন্দের কান্না মনে হয় সব বাবারাই তাদের সন্তানদের দেখায়।
আজ আমি যতটুকু অর্জন করেছি আব্বার কারণে। একজন সত ও আর্দশ শিক্ষকের সন্তান হিসেবে আমি গর্বিত। আজ বাবা নেই কিন্তু আমার প্রতিটা কাজে বাবাকে খুঁজে পাই। বাবার জীবন আর্দশ আমার কাছে অতি মু্ল্যবান।
আমার মেয়ে আমার হাত ধরে টেনে বলে বাবা তুমি কি ভাবছ? বলনা, আমি ভাল রেজাল্ট করেছি। আমি অন্যদিকে তাকিয়ে মেয়েকে বললাম প্রথম হলে আরও খুশি হতাম। আমার মেয়ে আমার কাছে এসে কি জানি বলতে চেয়ে চলে গেল। আমি আবার আমার বাবার স্মৃতিতে ফিরে গেলাম।
# বাবা
রামিছা পারভীন প্রধান।