মন শুধু মন ছুঁয়েছে
(ছোট গল্প)
সাল ১৯৯০।
আমি তখন ক্লাস নাইনে পড়ি। স্কুল থেকে বাসায় ফিরে দেখি হুলুস্থুল কাণ্ড। আম্মা ভীষণ কান্নাকাটি করছেন। আমার চাচি এবং পাশের বাসার খালাম্মারা আম্মার পাশে বসে আম্মাকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন। জানতে পারলাম নানী খুবই অসুস্থ। মেঝ মামা ফোন করে জানিয়েছে। তারপর থেকেই আম্মা খুব কান্নাকাটি করছেন।
পরেরদিন আব্বা আমাকে আমার ভাই এবং আম্মাকে নানাবাড়ি মাগুরার বাসে তুলে দিলেন। বিকাল চারটায় নানা বাড়ি পৌঁছে দেখলাম নানি খুবই অসুস্থ। তার স্যালাইন চলছে। মাগুরা থেকে ডাক্তার এসে দিনে ২ বার করে দেখে যান। আত্মীয়-স্বজন বন্ধু-বান্ধব যে যেখানে ছিল সবাই এসে এসে নানীকে দেখে যাচ্ছে। নানীর সুস্থতার জন্য নানা খতমে ইউনুস পড়াচ্ছেন, সবাই যে যার মতো করে আল্লাহর কাছে নানির সুস্থতার জন্য দোয়া করছে। বাড়ি ভর্তি আত্মীয়স্বজন গমগম করছে, সবারই একটাই চাওয়া আল্লাহর কাছে আল্লাহ যেন আমার নানিকে সুস্থ করে দেন ।
আমার নানাবাড়ি মাগুরা জেলার মধুমতি নদীর তীরে একটা গ্রামে। নানা একজন খুবই সম্মানিত ধনী ব্যক্তি ছিলেন। নানার বাড়িটা ছিল বিশাল। আত্মীয়-স্বজন বন্ধুবান্ধব নিয়ে নানার ছিল বিশাল পরিবার। নানা সকলেরই বিপদে আপদে সাহায্য করতেন। তাই নানার বিপদে সবাই ঝাপিয়ে পড়তো তাকে সাহায্য করার জন্য। সে কারণে নানির অসুস্থতার কথা শুনে যে যেভাবে পেরেছে সবাই এসেছে নানা কে এই বিপদে একটু মানসিক সাহায্য করার জন্য। এ কারণে নানির এই অসুস্থতার মধ্যেও বাড়িতে একটা উৎসব উৎসব ভাব ছিল। সবাই আমরা গ্রুপে গ্রুপে ভাগ হয়ে দোয়া ইউনুস পড়তাম। নানীর জন্য দোয়া করার পাশাপাশি মাঝে মাঝে নিজেদের কথা গুলো শেয়ার করতাম , খুনসুটি করতাম, হাসাহাসি করতাম আবার নানীর জন্য কান্নাকাটি ও করতাম।
বাড়ি ভর্তি এত মানুষের আনাগোনা, এত কোলাহল, তারপরও বড় খালার অনুপস্থিতিটা সবার আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে দাঁড়ালো। বড় খালা রাজশাহী থাকেন। খালু সেখানকার সাব রেজিস্ট্রার । খালুর ছুটি সংক্রান্ত জটিলতার কারণে খালা নানীর এত বড় অসুস্থতার খবরেও আসতে পারছেন না। মেজো মামার সাথে খালার কথা হয়েছে , খালা জানিয়েছেন , দুএক দিনের ভিতরেই উনার বড় ছেলে মুরাদের পরীক্ষা শেষ হবে তখন তিনি মুরাদকে সাথে নিয়ে চলে আসবেন।
যাইহোক, দুইদিন পর , ডাক্তারের চিকিৎসায়, মা খালা মামিদের সেবায়, আত্মীয় পরিজনদের দোয়ার বরকতে আল্লাহর রহমতে নানী একটু একটু করে সুস্থ হতে লাগলেন। সবার মনের আশঙ্কা আস্তে আস্তে কাটতে লাগলো। নানি ও স্যালাইনের বদলে একটু একটু করে তরল জাতীয় খাবার মুখে খেতে লাগলেন। একটু একটু কথাও বলতে লাগলেন। সবার মনেই স্বস্তি ফিরে এলো। আমাদেরও নানাবাড়িতে স্বাভাবিক জীবন ফিরে এল।
পরেরদিন পুকুরে গোসল করার সময় ছোট খালা জানালো আজ বড় খালারা রাজশাহী থেকে আসছে। কথাটা শুনেই মামাতো বোন শিউলি জিজ্ঞেস করল,
_ কার সাথে আসছে? মুরাদ ভাইয়ের সাথে?
ছোট খালা উত্তর দিলেন,” হ্যাঁ”।
শিউলি মুখ বাকা করে বলল, ” মুরাদ ভাই যে দুষ্ট উনাকে আমার ভাল্লাগেনা ।উনি খুব মারামারি করেন”।
আমি পুকুরের উপর বাঁকা হয়ে উঠে যাওয়া একটা নারকেল গাছে বসে শিউলি আর ছোটো খালার কথা শুনছিলাম। আমারও মনে পড়ল , মুরাদ ভাইয়ের দুষ্টুমির কথা। সব সময় কারো না কারো পিছনে লেগে থাকা ওনার স্বভাব। সবাইকে চটিয়ে মজা পান। কাউকে শান্তিতে থাকতে দিতে চান না। খালা সব সময় উনাকে নিয়ে তটস্থ থাকতেন। একবার তো আমাকে মেরে সারাদিনের জন্য হাওয়া হয়ে গিয়েছিলেন।
আমার নানাভাই তার সব নাতি-নাতনির ভিতরে আমাকে একটু স্পেশাল আদর করতেন। নানাভাই হাট থেকে ফেরার সময় প্রতিদিন সব নাতিনাতনীর জন্য মিষ্টি নিয়ে আসতেন। সবার জন্য একটা বড় প্যাকেট যেটা আমার নানীর হাতে দিয়ে বলতেন সবাইকে ভাগ করে দাও। আর আমার জন্য থাকতো স্পেশাল প্যাকেট। সাথে স্পেশাল স্পেশাল মিষ্টি। আমার স্পেশাল প্যাকেটের প্রতি সবারই খুব নজর থাকতো। আমিও ছোটবেলায় অনেক লক্ষ্মী ছিলাম। সবাই কে দিয়েই খেতাম। কিন্তু মুরাদ ভাইয়ের সেই ভাগ করে দেয়াটা পছন্দ নয়। সে পুরো প্যাকেটটাই দাবি করে বসতো। প্রায় দিনই সে আমার প্যাকেটটা টান মেরে নিয়ে চলে যেত। একদিন আমার খুব রাগ হল, আমি তাকে প্যাকেটটা দিতে চাইলাম না। খুব জোরাজুরি করার পরও সে যখন প্যাকেটটা আমার হাত থেকে নিতে পারল না, তখন সে আমাকে দুই গালে দুইটা থাপ্পড় মেরে খুব জোরে একটা ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল। ধাক্কা খেয়ে পড়ে উঠানে থাকা বালতির সাথে লেগে আমার কপাল অনেকখানি কেটে গেল। আমার কপাল থেকে রক্ত বের হতে দেখে সে ঝেড়ে দৌড় দিয়ে এই যে গেল সারাদিনে আর তার কোন খবর পাওয়া গেল না।
আরেকদিনের কথা , মামাতো ভাই শরীফের সাথে খড়ের গাদায় কুস্তা কুস্তি করতে করতে শরীফের মুখটা খড়ের গাদায় চেপে ধরল। শরিফের যখন প্রায় দম যায় যায় অবস্থা তখন কেউ একজন দেখতে পেয়ে চিৎকার দিয়ে বড় খালাকে ডাকতে শুরু করলো। বড় খালার কথা শোনে সে শরীফ কে ছেড়ে দিয়ে দৌড়ে পালিয়ে গেল। তা না হলে সেদিন যে কি অঘটন ঘটত আল্লাই জানে। এরকম আরো বহু ঘটনা রয়েছে। সেজন্য বড় খালা বেশি গ্রামে আসতে চাইতেন না। তার এই একগুঁয়ে তেজী মেজাজের জন্য সবাই তাকে একটু ভয় ভয় করেই চলে। আর আমি তো সেইদিন আমার কপাল কাটার পর থেকে তাকে একটুও দেখতে পারিনা। তার নাম শুনলে আমার মেজাজটা গরম হয়ে যায়। যতটা পারি এড়িয়ে চলার চেষ্টা করি।
ছোট খালা বললেন ,”আরে শোন ,এখন সে অনেক বড় হয়েছে। এখন সে রাজশাহী মেডিকেল কলেজের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র ।এখন কি আর আগের মত পাগলামি করবে নাকি?”
শিউলি মুখটা বাঁকা করে বলল ,”তুমি দেখো , মানুষের স্বভাব এত সহজে বদলায় না । কুকুরের লেজ যেমন সোজা হয় না।”
আমি বললাম ,”খালা শিউলি ঠিকই বলেছে তুমি দেখে নিও স্বভাব কখনো বদলায় না। এসেই দেখবে সবাইকে বিরক্ত করা শুরু করে দিবে , কাউকে আর শান্তিতে থাকতে দেবেনা ।এই দুটো দিন তো শান্তিতে ছিলাম।”
বিকালবেলা আম্মা আমাকে ডেকে বললেন,” তুই তোর নানীর কাছে একটু বস । এখানে আনারের রস করা আছে, একটু একটু নানীর মুখে দিবি ।আমি ততক্ষণে আসরের নামাজটা শেষ করে আসি”। আমি নানীর কাছে বসে ছোট্ট একটা চামচ দিয়ে একটু একটু করে নানিকে আনারের রস খাওয়াতে লাগলাম। একটু পরেই বাইরে হট্টগোল শুরু হয়ে গেল। কেউ একজন দৌড়ে এসে নানীকে জানিয়ে গেল বড় খালারা এসেছে। একটু পরেই বড় খালা হন্তদন্ত হয়ে নানীর ঘরে আসলেন। আমি নানিকে আনার খাওয়ানো বাদ দিয়ে একপাশে দাঁড়িয়ে গেলাম। বড় খালা নানীর পাশে বসে নানীকে জড়িয়ে ধরে অঝোরে কাঁদতে লাগলেন। নানি দুর্বল গলায় তাকে সান্তনা দিয়ে বললেন ,”আমার কিছুই হয়নি , আল্লাহর রহমতে আমি এখন ভালো আছি”। বেশ কিছুক্ষণ পর বড় খালা নিজেকে সংযত করলেন। নানি বড় খালাকে খালুর কথা , সব বাচ্চাদের কথা সবার কথা জিজ্ঞেস করলেন ,”সবাই কেমন আছে।” বড় খালা বললেন ,” সবাই ভালো আছে”।
নানি বললেন ,”কই আমার ডাক্তার ভাই কই ? ডাক তাকে।”
বড় খালা দরজার বাইরে মুখ বের করে তাকে ডাকলেন।
একটু পরে যে ঘরে ঢুকলো তাকে দেখে আমি চমকে উঠলাম। লম্বা শ্যামলা বর্নের সুঠামদেহী এক যুবক ঘরে এসে ঢুকলো। তার পোশাক-আশাক এবং তার দাঁড়ানোর ভঙ্গি নির্দ্বিধায় বলে দেয় সে এক বিশাল ব্যক্তিত্বের অধিকারী। তার চোখ মুখ থেকে বুদ্ধির দীপ্তি ছড়াচ্ছে। আমার দেখা আগের সেই রোগা ছিপছিপা দুষ্ট প্রকৃতির মুরাদ ভাইয়ের সাথে এই মুরাদ ভাইয়ের যেন কোন মিলই নেই। উনি নানীর পাশে বসে নানীর মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করলেন ,”কেমন আছ নানু”।
_আমার ডাক্তার ভাই এসে গিয়েছে আমিতো এখন থেকে ভালোই থাকব ইনশাআল্লাহ। আমার চিকিৎসা তো এখন থেকে তুমি করবে।
_, নানি আমি এখনো পুরো ডাক্তার হইনি । আমি এখন হাফ ডাক্তার, কয়েক দিন পরে ফুল ডাক্তার হব। তখন আপনার চিকিৎসা আমি করব ইনশাআল্লাহ। কথা শুনে নানী হেসে ওনাকে জড়িয়ে ধরলেন।
বড় খালা আমার দিকে তাকিয়ে নানীকে জিজ্ঞেস করলেন ,”ও কে’? নানি উত্তর দিলেন,”ও সাফিয়ার মেয়ে চৈতি”।
_”ওমা,! ও আমাদের চৈতি? কত বড় আর কত সুন্দর হয়ে গেছে।”খালা কাছে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। আমার কাছে তিনি আব্বা-আম্মা ভাইয়ের কথা জিজ্ঞেস করলেন।
খালার সাথে কথা বলতে বলতে হঠাৎ খেয়াল করলাম একজোড়া চোখ আমার দিকে তাকিয়ে আছে। সেই চোখের দৃষ্টি এতটাই স্বচ্ছ আর এতটাই তীব্র যে আমি সাথে সাথে চোখ নামিয়ে নিলাম। দৃষ্টির তীব্রতা এতই গাঢ় ছিল যে তা আমার বুকের ভিতর হাতুড়ি পেটাতে শুরু করল। আমার কানের পাশে লক্ষ-কোটি মৌমাছির গুঞ্জন শুরু হয়ে গেল। এরপর খালার আর কোন কথাই আমার কানে ঠিকমতো ঢুকছিল না। সম্বিৎ ফিরে এলো নানির কথায়, “যাও নানু ভাই হাত মুখ ধুয়ে কিছু খেয়ে নাও অনেক দূর থেকে এসেছো’।
সে নানীর পাশ থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “ঠিক আছে । আমি হাত মুখ ধুয়ে কিছু খেয়ে নিচ্ছি আর ততক্ষণ আপনি বিশ্রাম নেন আবার এসে আমি দেখে যাব”। সে দরজার কাছে এগিয়ে গিয়ে ঠিক বাইরে বের হওয়ার আগ মুহূর্তে ঘাড় বেঁকিয়ে আরেকবার তার সেই তীব্র দৃষ্টিতে আমাকে এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিয়ে বেরিয়ে গেল।
রাতের খাবারের সময় আম্মাকে খুঁজতে খুঁজতে রান্নাঘরে হাজির হলাম। বড় মামি রান্নাঘরে কাজ করছিলেন। আমাকে ডেকে হাতে একটা বাটি ধরিয়ে দিয়ে বললেন,”যা তো মা,এই বাটিটা ওখানে তোর মামারা যেখানে খেতে বসেছে দিয়ে আয়। মুরাদ আবার মাছ খায় না সেজন্য ওর জন্য একটু ডিম ভুনা করেছি ,দিয়ে আয়।”
আমার নানা বাড়িতে বিশাল লম্বা বারান্দায় এমাথা থেকে ওমাথা পাটি বিছিয়ে ছেলেরা খেতে বসতো একসাথে ২০ থেকে ২৫ জন। আমি বারান্দায় এসে দেখলাম বারান্দার ঠিক মাঝখানে বড় মামা আর ছোট মামার মাঝে বসে সে খাচ্ছে। আমি খুব সন্তর্পণে বাটিটা সামনে রাখতেই আবার সেই তীব্র দৃষ্টির আঘাতে জর্জরিত হলাম। বুকের ভিতর ড্রাম ঢোল তবলা একসাথে বেজে উঠলো। ঘুরে দাঁড়িয়ে যখন ছুট দিব সেই মুহূর্তে বড় মামার বজ্রকন্ঠের হুংকার (উনি নরমালি হুংকার দিয়েই কথা বলতেন), “এটা কার জন্য”।
আমি কোনমতে বলতে পারলাম,’যে মাছ খায় না মামী বলেছে এটা তার জন্য”। আমার কথা শুনে সে মুখ নীচু করে মুচকি মুচকি হাসতে লাগল। কিন্তু বড় মামার আবার হুংকার,” আরে বলবিতো কে মাছ খায় না”। কিন্তু এই কথার উত্তর দেয়ার জন্য আমি আর সেখানে দাঁড়িয়ে নেই ।
এর পরের দুই দিন আমি একটু লুকিয়ে লুকিয়ে থাকলাম। পারতপক্ষে তার সামনে পড়তে চাই না বলে খুব সাবধানে চলাফেরা করতাম। তবে আড়াল থেকে তার উপর ঠিকই নজর রাখতাম। খেয়াল করলাম সে তার সমস্ত কাজের ফাঁকে এদিক-ওদিক তাকিয়ে কি যেন খোঁজেন মাঝে মাঝে। “উনি কি আমাকে খুঁজেন”? এটা ভেবেই আমি শিহরিত হয়ে যাই মনে মনে।
দুদিন পর ছোট খালা, খালাতো বোন ,মামাতো বোন সবাই মিলে ঠিক করলাম আজকে আমরা নদীর পাড়ে বেড়াতে যাব। সেই উদ্দেশ্যে বিকালে সাজুগুজু করে সবাই রওনা হলাম। নদীর পাড়ে এসে দেখলাম সেখানে আগে থেকেই ছোট মামা ,আমার মামাতো ভাইরা সহ সেও আছে। আমাদেরকে দেখে সবাই হই হই করে উঠলো। হঠাৎই তার চোখে আমার চোখ পড়ে গেল। আজকে তার চোখের দৃষ্টি তে ছিল প্রশ্ন ,”কোথায় ছিলে এই কয়েকদিন? দেখি নি কেন? “আমি শিহরিত হলাম।
নদীর পাড়ে আমরা অনেক হৈ চৈ করলাম , নৌকায় করে ওপারে গেলাম আবার এপারে আসলাম খুবই ভালো একটা সময় কাটালাম। ফিরার সময় সে ছোট খালাকে বললো ,”খালা আপনারা আসার আগে একটুও ভালো লাগছিল না, আপনারা আশায় আনন্দটা দ্বিগুণ হয়ে গেল।,”
খালা উত্তর দিলেন,” তাহলে আসার সময় আমাদেরকে নিয়ে আসলে না কেন একসাথেই আসতাম”।
সে বলল ,আপনাদের কি কখনো খুঁজে পাওয়া যায়? আপনারা কে কোথায় থাকেন বুঝাই যায়না”। বলে আমার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসতে লাগল।
বাজারের সামনে দিয়ে ফেরার সময় ছোট মামা বলল, “তোরা যা আমি সবার জন্য সিঙ্গারা পাঠিয়ে দিচ্ছি।’ছোট খালা বললেন,” চৈতি তো সিঙ্গারা খায়না কবুতরের চপ থাকলে পাঠিয়ে দিয়েন”। মামা বললেন, “এখানে কবুতরের চপ হয়না”।
বাড়ি ফিরে এসে পুকুর ঘাটের সিঁড়িতে বসে আমাদের আবার একটা আড্ডা জমে গেলো। আস্তে আস্তে সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হলো। আকাশে একটা বড় চাঁদ উঠল। বেলি ফুলের ঘ্রাণে পরিবেশটা মৌ মৌ করে উঠলো। কিছুক্ষণ পর ছেলেদের দলও আমাদেরকে খুঁজতে খুঁজতে পুকুর পাড়ে চলে আসলো। মামাতো ভাই হারুন একটা প্যাকেট এগিয়ে দিয়ে বললো ,”এই-যে চৈতি আপার জন্য মুরাদ ভাই মাগুরা থেকে কবুতরের চপ এনেছে, এই নাও।”
আমি চট করে উনার দিকে তাকিয়েই চোখ নামিয়ে নিলাম। আমার শরীরের ভিতর দিয়ে হাজার ভোল্টের কারেন্ট পাস করে চলে গেল। উনি দূরে একটা নারকেল গাছে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে একদৃষ্টে আমার দিকেই তাকিয়ে আছেন।
পরের দিন নানী অনেকটা সুস্থ বোধ করাতে তাকে ধরাধরি করে বারান্দায় এনে বসানো হলো। নানীকে অনেকটা সুস্থ দেখে বাড়ির সবার মনে স্বস্তি ফিরে এলো।
সকালে খাওয়ার সময় আমার ভাই ইফতি বলল, “তোমরা জানো ? কালকে আমাদের স্কুলের মাঠে বিবাহিত এবং অবিবাহিতদের ভিতর ফুটবল ম্যাচ অনুষ্ঠিত হবে।”বিবাহিতদের ক্যাপ্টেন হচ্ছে বড় মামা আর অবিবাহিতদের ক্যাপ্টেন হচ্ছে মুরাদ ভাই। এবং খেলার পরে বিশাল খাবার-দাবারের আয়োজন করা হয়েছে। সেই উপলক্ষে কয়েকটা খাসি কেনা হয়েছে।”
পরের দিন নির্দিষ্ট সময়ে আমরা দল বেঁধে মাঠে পৌঁছে গেলাম। আমরা ঠিক করে নিয়েছি আমরা বিবাহিতদের সাপোর্ট করব। কারণ বিবাহিতদের ক্যাপ্টেন হচ্ছে বড় মামা। আমরা সবাই বড় মামাকে অনেক ভালোবাসি তাছাড়া বড় মামা ফুটবলার হিসেবে টুর্নামেন্ট জিতে অনেক প্রাইজ পেয়েছে। আস্তে আস্তে মাঠে মানুষের ভিড় বাড়তে লাগলো। বড় মামার দলে রয়েছে অন্যান্য মামারা এবং খালুরা। আর মুরাদ ভাইয়ের দলে রয়েছে মামাতো ভাই এবং খালাতো ভাই রা। খেলা শুরুর আগে সবাই এসে আমাদের কাছে দোয়া চেয়ে গেল। ভিড়ের ভিতরে সে এক ফাঁকে সবার অগোচরে এসে আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল,” দোয়া করো”। আবারো সেই বুকের ভিতর ঢোল, তবলা, হারমোনিয়াম বেজে উঠলো। তার সাহসে আমি পুরোপুরি হতভম্ব হয়ে গেলাম।
যাই হোক খেলা শুরু হয়ে গেল। মাঠে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই চলছিল। প্রথম ৩০ মিনিটের ভিতর কোন পক্ষই গোল দিতে পারছিল না। তুমুল লড়াই চলছিল বল নিয়ে। সবাই বিবাহিত দলের জন্য দোয়া করতে লাগলো। কিন্তু আমার কানে বারবার একটা কথাই প্রতিধ্বনিত হতে লাগলো ,”দোয়া করো”,” দোয়া করো”।
খেলা শুরুর ৩৫ মিনিটের মাথায় এবং পরে ৪১ মিনিটের মাথায় বড় মামার দল দুইটা গোল দিয়ে দিল। সবাই উল্লাসে ফেটে পড়ল। কিন্তু আমার মনটা অনেক খারাপ হয়ে গেল। হাফটাইমের ঘোষণা দেওয়া হল।
হাফটাইমের পর খেলোয়াড়রা আবার যখন মাঠে নামলো উত্তেজনা তখন চরমে। ২_০ গোলে অবিবাহিতরা পিছিয়ে আছে। আমি এবার মন থেকে তার জন্য দোয়া করলাম। হাফটাইমের পর চার গোল দিয়ে অবিবাহিতরা এই ম্যাচে জিতে গেল। তিন গোল দিলো মুরাদ ভাই নিজেই। সে যে কি উত্তেজনাময় খেলা হল বলে বোঝাতে পারবো না। শ্রেষ্ঠ খেলোয়াড়ের পুরস্কার পেল সে । সবাই মুরাদ ভাইকে কাঁধে করে নাচাতে লাগলো।
পরের দিন পুরো বাড়িটাই উৎসবে মেতে উঠলো। বাইরের উঠানে বড় করে শামিয়ানা টাঙানো হল।অনেকগুলো খাসি জবাই করা হল। বড় বড় পাতিলে রান্না হল।বাগাট থেকে দই এর অর্ডার দিয়ে স্পেশাল দই আনানো হলো। এসবই করল ছেলেরা। তারা মেয়েদেরকে কিছুই ছুঁতে দিল না। তারা বলল ,”তোমরা তো সবসময়ই করো আজকে তোমরা বসে থাকো আমরা তোমাদেরকে রান্না বান্না করে খাওয়াবো”। এবং যখন খাওয়ার সময় হলো মেয়েদেরকে বসিয়ে ছেলেরা পরিবেশন করতে শুরু করল। খাওয়া শেষ এর দিকে মুরাদ ভাই দইয়ের পাতিল নিয়ে হাজির ।সবাইকে দই পরিবেশন করছিল। যখন সে দইয়ের পাতিল নিয়ে আমার কাছে হাজির হলো তখন আমার পাশ থেকে শিউলি বলে উঠলো ,” মুরাদ ভাই চৈতি কিন্তু দই খায়না”। তখন সে শিউলিকে জিজ্ঞেস করলো,” তাহলে সে কি খায়?”শিউলি উত্তর করলো,”সে রসমালাই খায়”। মুরাদ ভাই “ও আচ্ছা “বলে চলে গেল।
সন্ধ্যার দিকে আমরা যখন ছোট খালার রুমে বসে গল্পগুজবে মশগুল তখন মামাতো ভাই হারুন এসে বলল তোমরা সবাই পুকুর ঘাটে আসো। ওখানে একটা ঘটনা ঘটেছে। আমরা সবাই পরিমরি করে পুকুর ঘাটে চলে এলাম। সেদিন চাঁদটা তার পূর্ণতা নিয়ে আকাশে ঝুলে ছিল। জ্যোৎস্নার জোয়ারে ভেসে যাচ্ছিল চারিদিক। বেলীফুল তার মুগ্ধতার আবেশ নিয়ে সুবাস ছড়াচ্ছিল চারদিকে। সে এক নৈসর্গিক পরিবেশ।
আমরা পুকুর ঘাটে পৌঁছে দেখলাম ছেলের দল আগের থেকেই সেখানে হাজির। আমরা পৌঁছানোর সাথে সাথে খালাতো ভাই মনসুর বড় দুই টা পাতিল এগিয়ে দিল। ছোট খালা জিজ্ঞেস,”কি আছে এতে?”
মনসুর উত্তর দিল,”রসমালাই”।
_”মুরাদ ভাই চৈতি আপুর জন্য মাগুরা থেকে নিয়ে এসেছে।”
আমি ভীষণ লজ্জায় পড়ে গেলাম। আমাকে উদ্ধার করল ছোট খালা। বলল,”এগুলো এখন কিভাবে খাব”
ছোট মামা বলল ,”কলার পাতা কাটা আছে সবাই কলার পাতায় করে খাব”।
যাই হোক সে যে কি আনন্দ বলে বোঝাতে পারবোনা। আমরা সবাই কলার পাতায় করে রসমালাই খেলাম। খাওয়া-দাওয়া শেষে আবার কতক্ষণ আড্ডা চলল। আড্ডার এক পর্যায়ে হারুন বলল একটা গান হলে কেমন হয়। আমরা সবাই ওকে হাততালি দিয়ে উৎসাহ জানালাম। হারুন তার মিষ্টি গলায় গান শুরু করলো
“আমার হাড় কালা করলাম রে…..”গানটা পরিবেশ কে আরো মোহনীয় করে তুলল,।
এরপর বাচ্চা মামা গাইল ,”আমি যে কে তোমার তুমি তা বুঝে নাও……”
খালাতো বোন তুহিন গাইল,”চিরদিনই তুমি যে আমার যুগে যুগে আমি তোমারি…..”
মামাতো বোন শিউলি গাইল,”দুই ভুবনের দুই বাসিন্দা বন্ধু চিরকাল ,,,রেললাইন বহে সমান্তরাল…”
বাপ মা মরা ফিরোজা খালা গাইল,”জলে ভাসা পদ্ম আমি ….ও আমার সহেলি …..আমার নাইকো কোথাও কোনো ঠাই….”
তারপর সবাই মিলে মুরাদ ভাইকে চাপাচাপি করতে লাগলো একটা গান গাওয়ার জন্য। কিন্তু সে কিছুতেই গান গাইবে না। অনেক অনুরোধের পর তাকে কোনমতে রাজি করানো গেল। কিন্তু তিনি শর্ত জুড়ে দিলেন। তার পর আমাকেও গান গাইতে হবে। আমি রীতিমতো আঁতকে উঠলাম। না না করতে করতে আমি ওখান থেকে পালিয়ে যেতে চাইলাম। কিন্তু সবাই আমাকে জোর করে ধরে বসিয়ে দিল। ছোট খালা বলল,” তোর সমস্যা কোথায় তুই তো বাসায় গান শিখিস , আমাদের আজকে শোনাবি”।
মুরাদ ভাই গান শুরু করলেন,
মন শুধু মন ছুঁয়েছে
ও সেতো মুখ খুলেনি
সুর শুধু সুর তুলেছে
ভাষা তো দেয়নি……
চোখের ও দৃষ্টি যেন
মনের ও গীতিকবিতা
বুকের ও ভালোবাসা
যেথায় রয়েছে গাঁথা
আমিতো সেই কবিতা পড়েছি
মনে মনে সুর দিয়েছি
কেউ জানেনি…….
গানের কথা , গানের সুর , আজকের এই চাঁদনী রাতের মায়াবী পরিবেশ সবকিছু মিলে মিশে আমাকে আরো স্বপ্নীল করে তুলল। আমি হারিয়ে গেলাম কোন দূর অজানায়। গানে এতটাই মগ্ন ছিলাম যে কখন যে গান শেষ হয়ে গেছে বুঝতেই পারিনি। সবাই যখন বলল ,” এবার চৈতির পালা ” তখনই আমি বাস্তবে ফিরে এলাম।
আমি গাওয়া শুরু করলাম। চিত্রা সিং এর এই গানটি…
“দুটি মন আর নেই দুজনার
রাত বলে আমি সাথী হবো যে…..
গানটা আমি এত দরদ দিয়ে , এতো ভালো করে গাইলাম যে ,এত ভালো করে আমি কখনো আমার স্কুলের ফাংশন গুলোতেও গাইনি। গান শেষ করে একবার তার দিকে তাকিয়ে দেখি সে অদ্ভুত ঘোরলাগা দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। কয়েক সেকেন্ডের দৃষ্টি বিনিময়েই আমরা বুঝে গেলাম একজন আরেকজনের মনের অবস্থা। সে রাতে আমার ভাল ঘুম হলো না বারবার মনের ভেতরে গানের কথাগুলো ঘুরপাক খাচ্ছিল। জানি তার অবস্থাও আমারই মত।
সারাটা রাত প্রায় না ঘুমিয়েই কাটিয়ে দিলাম। সকালের দিকে একটু তন্দ্রা এল। সেই কাকভোরে আম্মা রুমে ঢুকে ডেকে বললেন তাড়াতাড়ি কাপড় গুছিয়ে নাও আজকেই আমাদের রওনা দিতে হবে। আম্মার কথায় আমার তন্দ্রা ছুটে গেল । আমি সটান বিছানায় উঠে বসে জিজ্ঞেস করলাম,” কেন আজকেই কেন?”
আম্মা উত্তর দিলেন,”আগামী পরশু থেকে অনির্দিষ্টকালের হরতাল। আজকে না গেলে কালকে রাস্তায় অনেক ভিড় হবে। তাই তাড়াতাড়ি উঠে জামা কাপড় গুছিয়ে নাও সকাল সকাল রওনা হতে হবে।” অবশেষে ভারাক্রান্ত হৃদয়ে জামা কাপড় গুছিয়ে রওনা দেয়ার জন্য প্রস্তুত হলাম।
বাসস্ট্যান্ডে আমাদেরকে এগিয়ে দেওয়ার জন্য মেজ মামা, ছোট মামা আর সে এসেছে। আমি বাসে উঠে জানালার পাশে একটা সিট পেয়ে বসে পড়লাম। বাইরে চোখ পরতেই তার সাথে চোখাচোখি হয়ে গেল। মুখে তার বিষাদের ছায়া খেলা করছিল । অনেক না বলা কথা তার চোখের ভাষায় ফুটে উঠছিল। শুধু একটা হাত তুলে সে আমাকে বিদায় জানালো। তখনই গাড়িটা ছেড়ে দিল। সবকিছু পেছনে ফেলে দুরন্ত গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে গাড়ি। আমি সিটে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করলাম। মনের এক নিভৃতে কোনে বেজে উঠলো…
যখনি তোমার চোখে
আমার মুখ খানি দেখি
স্বপনও কুসুম থেকে
হৃদয়ে সুরভি মাখি
তুমি কি সেই সুরভি পেয়েছো
স্বপনের দার খুলেছ
কেউ জানেনি
মন শুধু মন ছুঁয়েছে……..
সমাপ্ত