#শিমুল ফুল পর্ব ৩
#জাকিয়া_সুলতানা_ঝুমুর
পুষ্পর কেমন ছটফট লাগলো।চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করে কিন্তু ঘুম আসেনা।রাতে ঠিকঠাক ভাতও খেতে পারেনি।শিমুলের মাতাল চোখের তিরতিরানো বাতাস যেন তাকে আঁকড়ে ধরে আছে।এই মাতাল বাতাসের তোড়েই কিনা পুষ্পের সারা শরীর অবস হয়ে আসে।চোখ ঝিমঝিম করে যন্ত্রণা বেড়ে যায়।অবুঝ মনটা কেন জানি চাইছে শিমুলের সানিধ্য,একটু চোখের দেখা।আজকেও কি শিমুল বেপরোয়া আবদার নিয়ে দেখা করতে বলবে?নিজের মনের সুপ্ত অভিলাসে পুষ্প নিজেই লজ্জিত হয়,শিমুল তাকে কখনোই বলেনি ভালোবাসে,পুষ্প কিনা এসব ভেবে ফেলেছে।
এইতো আজকে সকালেও কতো ঘৃনা করতো এই রাগী ছেলেটাকে।কিন্তু এখন মনের দেয়ালে শিমুল লেপ্টে গেছে,শিমুল শিমুল জপে পুষ্পর ঠোঁটে হাসি ফুটে।এসব ছাইপাঁশ ভাবতে ভাবতেই পুষ্প ঘুমাতে পারে না।পুষ্পর নাকের পাটাতন ফুলে উঠে,এ কোন জ্বালা হলো?এতো খারাপ লাগছে কেন?শিমুল কি তাকে তাবিজ টাবিজ করলো নাকি?ভেতরটা জ্বলছে যে!পুষ্প অন্ধকারে ডাগর চোখ মেলে তাকিয়ে থাকে।তার মন বলছে আজকেও সর্বনাশা মানুষটা আসবে,এই কারনেই পুষ্প ঘুমাতে পারে না।বিছানায়।ছটফট করে।
মজিব হাওলাদারের এক ছেকে এক মেয়ে।যুগ যুগ ধরে রা,জনীতি করে আসছে।গ্রামে দাপট বেশ কড়া।ছেলের নাম শওকত হাওলাদার,মেয়েটার নাম আসমা।গ্রামে যেমন দাপট দেখায়, ঘরের মানুষকেও তেমনি শাসনে রাখে।মজিব হাওলাদারের স্ত্রী পেশকারা বেগম বেশ অহংকারী আর রাগী ধরনের মহিলা।উনি যা বলে তাই সবাইকে শুনতে হয়,বিশেষ করে শওকত হাওলাদারের স্ত্রী রাবেয়া।রাবেয়া নিজেও এখন শাশুড়ি হবার সময় হয়ে গেলো কিন্তু পেশকারার কথার তেজ এখনো কমেনি,কথার তোড়ে কাঁদায় ক্ষনে ক্ষনে।আসমার বিয়ে হয়েছে শহরে।আসমার এক মেয়ে এক ছেলে।মেয়ে সুইটি বয়স একুশ এবার অনার্সে পড়ছে।ছেলে রাতুল এবার টেনে পড়ে।আজকে বিকালে সবাই গ্রামে বেড়াতে এসেছে।সুইটি শিমুলকে পছন্দ করে,শুধু পছন্দ বললে ভুল হবে মারাত্মক ভালোবাসে।শিমুলকে কখনো বলা হয়নি কিন্তু সুযোগ পেলেই যখন তখন শিমুলের গা ঘেষে দাঁড়ায়।প্রেমিকার মতো লেপ্টে যায়।আজকে দুপুরে এসে যখন শিমুলকে পেলো না সুইটির মন বিষন খারাপ হয়েছিলো।বিকেলে বাইকের শব্দ শুনেই দৌড়ে বাহিরে গিয়ে শিমুলকে পায় আর অমনি ঝাপ্টে বুকে পড়ে।
শিমুলের ফুরফুরে মন মূহূর্তেই থমথমে হয়ে যায়।এই লজ্জাহীন মেয়েটাকে তার এই জন্যই পছন্দ না।যেন শিমুল তার প্রেমিক লাগে যখন তখন বুকে ঝাপিয়ে পড়তে হবে।মেয়েরা থাকবে লজ্জা গায়ে মেখে আর এই মেয়ে?অসহ্য।নেহাৎ তার দাদা বুবু,আর আব্বার জন্যই সুইটিকে কিছু বলে না,উনাদের আবার চোখের মনি হলো সুইটি।
শিমুল সুইটিকে টেনে সরায়।মুখটা গম্ভীর করে বললো,
“ক্লান্ত লাগছে সর।”
সুইটি শিমুলের সাথে হাটতে হাটতে বললো,
“সেই কখন এসেছি তুমি কই ছিলে?”
শিমুল উত্তর দেয় না।গলা ছেড়ে তার মা রাবেয়া কে ডাকে,
“আম্মা আম্মা।ঠান্ডা পানি দাও।”
রাবেয়া ফ্রিজ থেকে পানি এনে দেয়।শিমুল বিরক্তিতে গলা তিতো করে বলে,
“আম্মা আমি এখন রেস্ট নিবো,আমাকে কেউ যেন না ডাকে।”
রাবেয়া ছেলের কথার মানে বুঝে,সুইটিকে শিমুল একদমই পছন্দ করে না।সুন্দরী হলে কি হবে লাজ লজ্জাহীন মেয়ে পছন্দ করার মতোই না।রাবেয়ার নিজেরও পছন্দ না।শিমুল হনহন করে রুমে চলে যায়।সুইটি কাঁদোকাঁদো গলায় বললো,
“শিমুল ভাই এমন কেন মামিমা?”
রাবেয়া হেসে বললো,
“আরে সারাদিন এখানে সেখানে যায় ক্লান্ত হয়ে পড়ে।বুঝিস না?কালকে ভালো করে কথা বলবে।”
সুইটির মুখে হাসি ফুটে,এবার শিমুলকে মনের কথা বলতেই হবে।
সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত নামে শিমুলের বুকটা প্রিয়তমার কাছে যাওয়ার জন্য চিনচিন করে।বিছানা আঁকড়ে পড়ে থেকেও রেহাই পায় না,শরীর মন দুটুই বিষিয়ে গেছে,অসহ্য দহনে মনে তোলপাড় হয়।চোখগুলো খুঁজছে প্রিয় মুখটা,প্রিয় চোখগুলো যেই চোখ আজকে তার অন্তর খুচিয়ে খুচিয়ে প্রেমে পড়া মনটাকে আরোও কাতর করে দিয়ে গেছে।নিঃশ্বাস করে দিয়েছে বেশামাল।মোবাইল হাতে নিয়ে পুষ্পর ছবিগুলো দেখে,কিন্তু তৃষ্ণা মিটে না বরং বাড়ে।মেয়েটা চোখ দিয়েই এভাবে খুন করে দিলো,মন দিয়ে খুন করলে শিমুলের অবস্থা কি হবে?শিমুল মোবাইলের স্কিনে চুমু খায়।নিজেকে শান্ত করতে স্কিনে কিছুক্ষণ ঠোঁট লাগিয়েই রাখে।
আচ্ছা ছবিতে চুমু খেলে কি মানুষটা বুঝতে পারে?পারেনা হয়তো।পারলে পুষ্প লজ্জায় আর কখনোই শিমুলের সামনে আসতো না শিমুল যে প্রচুর অগোছালো কথা বলে ছবির সাথে,আদরে আদরে ভরিয়ে দিতে চায় ছোট্ট বাবুইকে।শিমুল মোবাইল একপাশে রেখে চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকে।কোনভাবেই ঘুমাতে পারে না,চোখের পাতায় ঘুম আসে না।এতোদিন নিজেকে সামলালেও আজকে যেন পুষ্পর তাকানোতে তার মনটা অসুস্থ হয়ে গেলো।রাত দুইটার দিকে উঠে বসে।প্রেমে পড়লে মানুষ পাগল পাগল কাজগুলোই করে শিমুলও তাই করলো,কালো গেঞ্জি গায়ে চাপিয়ে সিগারেট লাইটার হাতে বেড়িয়ে পড়লো নিঃশব্দে।শিমুলদের বাড়ি থেকে পুষ্পদের বাড়ি আসতে বিশ মিনিট লাগে।শিমুল এসে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে।পুষ্পের মোবাইল নেই কিভাবে যোগাযোগ করবে?
মিনিট পাচেক পায়চারি করে ভাবে।হাতের সিগারেট ফেলে পুষ্পর রুমের জানালায় টোকা দেয়।জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে আবারো কয়েকবার টোকা দেয়।ফিসফিস করে ডাকে,”পুষ্প এই পুষ্প”
পুষ্প সজাগ ছিলো,জানালায় টোকা শুনে বিছানায় উঠে বসে।জানালার টোকাগুলো যেন বলছে ‘শিমুল এসেছে’।পুষ্প কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকে।তখনি শিমুলের ফিসফিস করা ডাক শুনতে পায়,পুষ্প লাইট জ্বালায় না।তাদের বিল্ডিংটা টিনের চালা,লাইট জ্বালালে বুঝা যায়,পুষ্পর মা রোকসানা বেশ চালাক চতুর মহিলা সন্দেহ করে বসবে।পুষ্প অন্ধকার হাতরে জানালার কাছে যায়,খুট করে স্টিলের জানালার একটা পার্ট খুলে দেখে ভরা জ্যোৎস্না গায়ে মেখে শিমুল দাঁড়িয়ে আছে।ফর্সা গায়ে চাঁদের আলোয় দাঁড়ানো পুরুষটাকে পুষ্পর মনে হলো,শিমুল খুব সুদর্শন,নজরকাড়া শরীর, কাটাকাটা চেহারা।শিমুল পুষ্পকে দেখে জানালা ঘেষে দাঁড়ায়।ফিসফিস করে বলে,
“একটু বাহিরে আয়।”
পুষ্পর মাথা নাড়িয়ে বলে,
“এতো রাতে বাহিরে আসবো না।”
শিমুলের ঠোঁট নাড়িয়ে খুব আস্তে বললো,
“প্লিজ।”
পুষ্প শিমুলের চোখে চোখ রাখে,এতো কাতর স্বরে কেন অনুরোধ করছে?তারপর মন্ত্রমুগ্ধের মতো জানালা আটকে দরজা খুলে বেরিয়ে পড়ে।মা বাবা জানতে পারলে জ্যান্ত পুতে ফেলবে এই ভয়টা বুকে নড়ে উঠে।অজানা টানে ধীরপায়ে গিয়ে শিমুলের সামনে দাঁড়ায়।পুষ্পকে দেখে শিমুল চোখে হাসে।শিমুল চুপচাপ অনেকক্ষন সামনের এলোচুলের মেয়েটাকে মন ভরে দেখে।পুষ্পকে ছুঁয়ে দেয়ার পাগলা ইচ্ছা হাতের নখে গিয়ে শিরশিরানি দেয়,শিমুল দুই হাত ট্রাউজারে ঢুকিয়ে ফেলে।মেয়েটা কি বুঝে সামনে দাঁড়ানো শক্ত সামর্থ্য ছেলেটার ভেতরটা প্রেমের আগুনে জ্বলছে?বাবুইটা তাকাচ্ছেনা কেন?শিমুল খুব আস্তে করে বললো,
“আমার দিকে তাকা?”
পুষ্প মাথা নেড়ে না করে।ওই চোখজোড়ায় নেশার ছড়াছড়ি,যেখানে তাকালেই পুষ্পর নরম মন দিশেহারা হয়ে পড়ে।নিচের দিকেই তাকিয়ে থাকে।
শিমুল নিচু স্বরেই ধমকে উঠে,
“এতো রাতে এসেছি তাকাবিনা কেন?তাকা”
পুষ্প তাকায়।আজকে তার সাথে এগুলো কি হচ্ছে?কল্পনার বাহিরের কাজগুলোই আজকে হচ্ছে।এই যে শিমুলের চোখে অন্য কথার মনের ব্যাথার ছড়াছড়ি তা কি পুষ্প বুঝে না?খুব বুঝে,মেয়েদের এগুলো শিখাতে হয় না এমনিতেই শিখে যায়,পুরুষের চোখের কথা বুঝে নেয়।ছোট্ট পুষ্প শিমুলের চোখের বিবস হওয়া কথা আর নিতে পারেনা মাথা নিচু করে বললো,
“কেন ডেকেছেন?”
শিমুল কোন কথা বলেনা,সে কথার তালে তালে নড়াচড়া করা ঠোঁটগুলো দেখতেই ব্যস্ত।তারপর হঠাৎ আবিষ্কার করলো তার পাগলা মনের অন্য কিছু ইচ্ছা হচ্ছে,শিমুল নিজেকে সামলে পিছু হটে বললো,
“ঘরে যা,”
এটা বলে হনহনিয়ে রাস্তায় নেমে পড়ে,পুষ্প পিছন থেকেই অপলক দেখে,”শিমুলের চোখের ভাষা কি সত্যি?”
কিন্তু এর পরের দিনের চিত্রে পুষ্পর মনটা বিষিয়ে গেলো,চোখে জ্বমলো পানি।শিমুল খুবই সুন্দরী একটা মেয়েকে বাইকে নিয়ে কোথাও যাচ্ছে।মেয়েটা খিলখিল করে হাসছে আর পিছন থেকে শিমুলকে দুই হাতে আঁকড়ে ধরে আছে।আঁকড়ে ধরার ভঙ্গিমাটা খুবই বাজে।কিন্তু শিমুলের মুখেও যে হাসি!পুষ্পর ছোট্ট কচি ফিনিক্স পাখির মতো তুলতুলে মনটা ভেঙ্গে গেলো।ঠোঁট কেঁপে উঠে মনে মনে বারবার বললো,”চোখের ভাষা কি সবটাই মিথ্যা ছিলো?সবটা”
চলবে….