শিমুল_ফুল
২৬
জাকিয়াসুলতানাঝুমুর
পলাশ বিছানায় শুয়ে ছাদের দিকে তাকিয়ে থাকে।শিমুল তার চার বছরের ছোট।বড়ো ভাই আগে বিয়ে করার কথা থাকলেও পলাশ বিয়েতে কখনো রাজি হয়নি তার তো নিধিকে ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করতে ইচ্ছা করেনি।শিমুলের বিয়েতে আজকে কেন জানি খুব লজ্জা লাগছিলো।শিমুল কতো খুশী মনে শপিং করেছে,ফুল কিনে নিজ হাতে বাসর সাজিয়েছে।এসব দেখে নিজের অজান্তেই পলাশের বুকটা পুড়েছে,সে মোটেই শিমুলকে হিংসা করেনি বরং এসব দেখে বারবার নিজের প্রতি ঘৃণার পরিমানটা বেড়েছে,সে যে কাপুরুষ ছিলো এটা বারবার মনে পড়ে।
নিধির সাথে বিয়ে হলেও কি পলাশ এমন খুশী হতো?খুশী তো হতোই কিন্তু শিমুলের মতো তা প্রকাশ করতে পারতো না।এই শান্ত স্বভাব,লাজুকতা এগুলোর সুযোগ নিয়েই শওকত হাওলাদার নিধিকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে।নিধি এখন পলাশকে দেখেও কথা বলেনা।আচ্ছা নিধি কেন এই কলেজেই জয়েন করেছে?পলাশের থেকে বদলা নিতে?নিধিকে দেখলে যে কি পাগল পাগল তা পলাশ আর তার আল্লাহ জানে।মেয়েটা তার সাথে কথাও বলেনা।
আজকে পলাশের ইচ্ছা করছে ম/রে যেতে।এতো কষ্ট আর কতোদিন সয়ে যাবে?পুরুষ বলে কাউকে কখনো পলাশের বুকের পাহার-সম কষ্টের কথা বলা হয়নি।তেতিশ বছরের এই ছেলেটাও যে মাঝরাতে ফুপিয়ে কাঁদে এটা কেউ দেখেনি।নিধিকে দেখে পলাশের মনে হয়েছে ঠিক আগের নিধি,একবারো মনে হয়না বিয়ে হয়েছে।
কিন্তু তার আব্বা তাকে বলেছিলো নিধির বিয়ে উনি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে দিয়েছে।নিধির বিয়ের দিন রাতে পলাশ যেভাবে কেঁদেছিলো কেউ দেখলে ভাবতো ছেলেটা বুঝি পাগল।সে নিধিকে পায়নি এই পুতুলটা আর কখনো তার হবার না পুতুল এখন অন্যকারোর কিন্তু নিধি এখন তার সামনে কলেজে চাকরি করবে।কথা বলা যাবে না,ভালো করে দেখাও যাবে না,তার কি কষ্ট হবেনা না?
পলাশের নাকের পাটাতন ফুলে ঠোঁট মৃদু কেঁপে ওঠে,বোবা কান্নায় চোখ দিয়ে পানি পড়ে বালিশ ভিজে যায়।মোবাইল হাতে নিয়ে নিধির কলেজ ড্রেস পড়া ছবিটা দেখে,কিছুক্ষণ দেখার পরে মোবাইল স্কিনেই ভেজা ঠোঁট ছুঁয়িয়ে দেয়,গালের সাথে ছবিটা মিশিয়ে ফিসফিস করে বললো,”আমি কেন একজীবনে আমার ভালোবাসাকে পেলাম না?
এই একলা ঘরে কেন নিধি নেই?আমার বুকে কেন নিধি ঘুমায় না?”
এই প্রেমিকের এমন সব প্রশ্নের উত্তর কে দেবে?পলাশ উত্তরের আশা করে না।হাত দিয়ে বালিশ খামচে চুপচাপ চোখের পানি ফেলে।যাকে পাওয়া যাবেনা তার প্রতি কেন এতো ভালোবাসা?বিধাতা কেন তার সাথে প্রণয়ের সুতো বেধে দেয়?এতো কষ্ট পাওয়ার জন্য?
সুইটি তার নানীর থেকে ঘুমের ট্যাবলেট এনেছে।শিমুলের রুমে দেওয়ার জন্য দুধ রেডী করে।দুধের গ্লাসে ট্যাবলেট মিশিয়ে দেয়।কিছুতেই দুজনের বাসর করতে দেবে না।ধীর পায়ে রুমের দিকে এগিয়ে যায়।শিমুল তো রুমে ঢুকে গেছে,দরজায় টোকা দিবে এমন সময় রাবেয়া আসে।পুষ্পর হাতের ট্রে নিজের হাতে নিয়ে বলে,
“কি করছো?”
রাবেয়াকে দেখে সুইটি আমতা-আমতা করে বললো,
“নানু বলেছিলো এগুলো দিতে।”
সুইটির ক্ষোভের কথা রাবেয়ার অজানা না।এই মেয়েকে কোনভাবেই বিশ্বাস করা যাচ্ছে না।উনি তো নিজ হাতে যা যা প্রয়োজন সব শিমুলের রুমে রেখে এসেছে তাহলে আবার কেন?
“সব দেয়া হয়েছে।”
সুইটি ভ্যাবাচেকা খেয়ে বললো,
“অহ জানতাম না।”
রাবেয়ার হাত থেকে দুধের গ্লাস নিতে নিতে বলে,
“তাহলে এটা ফেলে দেই?”
রাবেয়া মনে মনে হাসে।এই পুচকি তাকে ঘোল খাওয়াবে?
“ফালাবে কেন?তুমি খাও।”
সুইটি চমকে বললো,
“না না মামি আমি খাব না।”
কিন্তু রাবেয়াও ছাড়ার পাত্রী না।জোড় করে সুইটিকে দুধটা খাইয়ে মাথায় হাত ভুলিয়ে বলে,
“রুমে যাও অনেক রাত হয়েছে।”
সুইটি মাথা নিচু করে চলে যায়।মনে মনে ভাবে,কাকে ঘুম পাড়াতে আসলাম আর এখন কিনা নিজেই ঘুমাবো?একবার না পারিলে দেখে নিবো শতবার,তাও এই মেয়েকে বাড়ি ছাড়া করবই।শিমুল পুষ্পর সাথে কি করছে এটা ভেবে সুইটি দিশেহারা।
পুষ্প মাথা নিচু করে রাখে।শিমুলের গায়ের পারফিউমের ঘ্রানে কেমন মাথা ঘুরে যাচ্ছে।তার মনে হচ্ছে এই রাত না আসলেই ভালো হতো।শিমুল মাথা নিচু করে পুষ্পর মুখের দিকে তাকিয়ে বললো,
“সত্যি করে বলবে তুমি কি ভয় পাচ্ছো?”
পুষ্প কথা বলেনা।শিমুলের হাসি,গলার স্বর সবকিছুই যেন লজ্জা মাখানো।শিমুল পুষ্পর ডান হাতের উল্টো পিঠে চুমু খায়।শিমুলের ছোঁয়া তো এই প্রথম না তারপরেও পুষ্প যেন নতুন করে শিমুলের উষ্ণ আদরের পরশ পেয়ে মৃদু কাঁপে।
“আমার দিকে তাকাও না।বউ সাজে মন ভরে দেখি।”
আচ্ছা এমন করে বললে কি তাকানো যায়?যায় না।পুষ্পও তাকাতে পারে না।শিমুল মুচকি হাসে।পুষ্প ভয় পাচ্ছে এটা স্পষ্টই বুঝা যাচ্ছে।শিমুলও ছাড়ার মানুষ না।হাত দিয়ে মুখ উঁচু করে বললো,
“আমাকে দেখো।”
পুষ্প বললো,
“দেখছি।”
“মন ভরে দেখো।”
“হুম।”
শিমুল পুষ্পর কোলে শুয়ে পড়ে।
“আমার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না ফুলরানী আমার ঘরে।”
পুষ্প শিমুলের চুলে হাত রেখে বললো,
“আমারো বিশ্বাস হচ্ছে না।”
“এখন থেকে যখন তখন তোমাকে দেখতে পারবো।”
“হুম।”
পুষ্প মুগ্ধ নয়নে শিমুলের খুশীভরা মুখ দেখে।তার মতো সামান্য পুষ্পকে পেয়ে শিমুল এতো খুশী এটা ভাবলেই সুখে পুষ্পর চোখ ভিজে উঠে।শিমুল হাত দিয়ে পুষ্পর গাল ধরে বললো,
“আমি জানি তুমি আমার ভালো বউ হবে।হবে না?”
“জ্বী।”
“ভালোবাসি বউ।”
“আমিও।”
“তাহলে এতো ভয় আর লজ্জা পাচ্ছো কেন?”
পুষ্প শিমুলের চোখে চোখ রাখে।সত্যিটাই বলে,
“জানিনা।কিন্তু আজকে কেন জানি ভয় লাগছে।”
শিমুল হাসে।
“আমি এমন কিছুই করবোনা যেটা ভয়ের মতো হবে।আমাকে ভরসা হয় না?”
“হয়।”
শিমুল উঠে বসে বললো,
“ফ্রেস হবেনা?চলো।”
পুষ্প ধীরপায়ে গিয়ে ড্রেসিংটেবিলের সামনে দাঁড়ায়।আস্তে আস্তে সব গহনা খুলতে থাকে।আয়নায় আড়চোখে শিমুলকে দেখে।শিমুল বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসে আছে পূর্ণদৃষ্টি পুষ্পর দিকে।পুষ্প তাকিয়ে হাসলে শিমুল এগিয়ে আসে।পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে কাধে মুখ ঠেকিয়ে বললো,
“আমি হেল্প করি?”
পুষ্প শিমুলের দিকে ফিরে বললো,
“আচ্ছা।”
পুষ্প হাতগুলো শিমুলের সামনে এগিয়ে দেয়।শিমুল চুপচাপ চুড়ি খুলে দেয়।শাড়িতে লাগানো সেফটিপিন খুলে দিলে পুষ্প ড্রেস পাল্টে একটা হলুদ সুতির শাড়ি পড়ে।পুষ্প বাথরুম থেকে বেরিয়ে দেখে শিমুল বিছানায় একটা বালিশে হেলান দিয়ে শুয়ে আছে।পুষ্প ধীর পায়ে বিছানার কাছে এসে দাঁড়ায়।শিমুল মুগ্ধ নয়নে পুষ্পকে দেখে,মেয়েটাকে আজকে বেশিই সুন্দর লাগছে,তার হয়েছে বলেই হয়তো।হাত বাড়িয়ে কাছে ডাকলে পুষ্প বিছানায় বসে।শিমুল পুষ্পর হাত ধরে নিজের কাছে নিয়ে বুকে মিশিয়ে নেয়।শিমুল এখন চাইলেই পুষ্পর সাথে ইন্টিমেন্ট হতে পারে।পুষ্পর দেহের প্রতি ভাজে ভাজে ছুঁয়ে দিতে পারে।কিন্তু শিমুল এমন করবেনা।প্রথম রাত নিয়ে মেয়েদের অনেক ভয় থাকে।পুষ্প কি আতংকে আছে এটা শিমুল খুব বুঝতে পারছে।পরিবার ছেড়ে এসে পুষ্প মানসিকভাবে বিধস্ত।শিমুল এখন ঘনিষ্ঠ হলে হয়তো পুষ্প মুখে কিছু বলবেনা কিন্তু মনে মনে হয়তো ভাববে শিমুলের ঘনিষ্ঠ হতে এতো তাড়া!এটাই কি শিমুলের প্রধান চাহিদা?পুষ্পর সুপ্ত মনে কষ্ট জমা হবে।পুষ্পর বাহুডোরে শিমুল কোন ভয়ের কারণ হয়ে যেতে চায় না বরং কোন ভয় ছাড়া ভালোবাসার চাদরে জড়াতে চায়।আজকের রাতটা এভাবে বুকে নিয়েই কাটুক সারাজীবন তো পড়েই আছে।এতোবছর অপেক্ষা করতে পেরেছে এই দু-তিন দিনও পারবে।শিমুল নিজেকে একটু মিষ্টি শাস্তি দিতে চায়,পুষ্পল
কে একটু একটু করে নিজের দিকে ধাবিত করে পাগল বানাতে চায়।শিমুল শুয়ে পুষ্পকে বুকে নেয়।শিমুলের মনে হলো প্রিয় মানুষকে বুকে জড়িয়ে ধরার মতো শান্তির আর কিছু নেই।বরাবরের মতো পুষ্পকে মনে হলো তুলোর বস্তা।আর এই তুলোর বস্তা বুকে নেয়াতে শিমুলের মনে হলো,তার বুকটা সুখে সুখে কানায় কানায় পূর্ন হয়ে গেছে।মাথা নিচু করে পুষ্পর কপালে চুমু দিয়ে বললো,
“আজকে সারারাত তোমাকে দেখবো।মন ভরে দেখবো।এতো কষ্ট করে যে পাখিকে পুষ মানাতে পেরেছি তাকে আজকে দেখেই মন ভরাবো।”
পুষ্প অবাক হয়ে বললো,
“সত্যি?”
শিমুল পুষ্পর নাকের সাথে নাক ঘষে বললো,
“সত্যি।”
পুষ্পর কাছে শিমুল এক পাগল প্রেমিক।সে ভাবতেও পারেনি শিমুল তাকে বুঝে কিছুটা সময় দিয়ে দিবে।এই ব্যাপারটায় পুষ্পর মনে শিমুলের জন্য শ্রদ্ধা আরো বেড়ে যায়।সেও শক্ত করে শিমুলকে জড়িয়ে নেয়।বুকে নাক ঘষে ফিসফিস করে বললো,
“তুমি এতো ভালো কেন?”
শিমুল পুষ্পর নরম ঠোঁটে আলতো করে একটা কাঁমড় দিয়ে বললো,
“তোমার বর যে তাই।”
পুষ্প শিমুলের দিকে তাকিয়ে শিমুলের হালকা কালচে ঠোঁটে স্ব-ইচ্ছায় ডুব দেয়।শিমুল হাসে, প্রেয়সীর প্রেম ডুবে সামিল হতে নিজেও সাড়া দেয়।পুষ্পর নরম শরীরটা হাত দিয়ে নিজের বুকের উপর তুলে নেয়।পুষ্প শিমুলের দিকে তাকিয়ে হাসে।শিমুল হাসে না,তার চোখে মুখে এখন রাজ্যের তৃষ্ণা,এ তৃষ্ণা মিটবে কিভাবে?
চলবে…….
❝অনেকে বলবেন এমনো পুরুষ হয়?তাহলে আমি বলবো আপনাদের কারো এমন মনমানসিকতার সমপন্ন পুরুষের সাথে পরিচয় হয়নি।❞