#শিমুল ফুল
পর্ব ২৮
#জাকিয়া_সুলতানা_ঝুমুর
পুষ্পকে কোলে নিয়ে শিমুল আলতো গলায় গেয়ে উঠে,
“তুমি আমার কাছে যুদ্ধে জয়ী সাত রাজার ধন,শত বাধা ডিঙ্গায় পাইছো তোমায় মনের মতো মন।
আমার মনের জ্যোৎস্না আমি কাউকে দেবো না।তোমায় গাইথা রাখছি মনের মাঝে নিজেও জানো না।”
পুষ্প মুগ্ধ হয়ে শিমুলের গলার গান শুনে।শিমুলের বুকে মাথা রেখে শিমুলের বুকের উথাল-পাতাল ঠিক টের পাচ্ছে।পুষ্প মাথা নিচু করে শিমুলের বুকের কাছের গেঞ্জি আঁকড়ে ধরে।শিমুল হেটে পুষ্পকে বিছানায় নিয়ে যায়।পুষ্পকে লজ্জা পেতে দেখে তার খুব ভালো লাগছে।পুষ্পর নরম মনের ভয়ানক তাপে শিমুল তখন ছন্নছাড়া।আদুরে চোখ দিয়ে পুষ্পকে দেখে।যে চোখের দৃষ্টি পুষ্পর শরীরে শিহরণ জাগাতে সক্ষম।
শিমুল পুষ্পর চোখের দিকে তাকিয়ে আছে।পুষ্প তাকাতে পারে না।হাত দিয়ে শিমুলের মুখ অন্যদিকে ফিরাতে চাইলে শিমুল হাত ধরে বললো,
“কি?”
পুষ্প মাথা নেড়ে বললো,
“না।”
শিমুল পুষ্পর নরম গালে তার দাড়িযুক্ত গাল ঘসে জড়ানো গলায় বললো,
“কি না?”
“না।”
শিমুল মুচকি হাসে।পুষ্পর গালে হাত ভুলিয়ে দিলে পুষ্প চোখ বন্ধ করে নেয়।শিমুলের এতোদিনের ধৈর্যের বাধ ভেঙে যায়,না না ভাঙ্গে না শিমুল নিজেই ভেঙে দেয়।নিষিদ্ধ ইচ্ছাদের পাখা মেলে উড়তে দেয়।নিজে ডুবে যায় পুষ্পতে।পুষ্প শিমুলের পাগলকরা ছোঁয়ায় দিশা হারায়।শিমুল তখন পুষ্পকে নতুন রূপে আবিষ্কার করতে ব্যস্ত।নিজের সবটা ভালোবাসা উজার করে পুষ্পকে নতুন রূপে রাঙ্গিয়ে তুলতে সেকি চেষ্টা!নিজেকে নতুন রূপে পুষ্পর সামনে নিয়েই এলো,পুষ্প অবাক হয়ে শিমুলের পাগলামি দেখে।শিমুল আজ সত্যিই পাগল।পাগলামি আজ সীমাহীন।পুষ্পর কাঁপা ঠোঁটে কিছু বলতে চেয়েও বলা হয় না।শিমুলের আধো আধো পাগলের প্রলাপ শুনে পুষ্প লজ্জায় মুখ লুকায়।ফিসফিস করে শিমুলকে বলে,
“না প্লিজ না।”
শিমুল পুষ্পর কথা শুনেনা,সে নিজের অধিপত্য প্রসার ঘটাতেই ব্যস্ত।তার নিঃশ্বাস তখন রুমের পরিবেশ অশান্ত করে দিচ্ছে।শুধু নিঃশ্বাসই রুম অশান্ত করে না শিমুলের মুখের জড়ানো গলায় পাগল করা কথাগুলো পুষ্পকে অশান্ত করে দেয়।পুষ্পর চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ে।শিমুল শান্ত বাচ্চার মতো শুয়ে পড়ে।
কিছুক্ষণ পরে শিমুল নিভু নিভু গলায় পুষ্পকে বলে,
“কি খবর পুষ্পরানী?”
শিমুলের এমন কথায় পুষ্প চোখ খুলে তাকায়।শিমুলের চুলে হাত রেখে বলে,
“আপনি ভীষণ খারাপ মানুষ।”
“তাই নাকি?”
“ভীষন খারাপ।”
“আচ্ছা।”
“আসলেই খারাপ।”
“প্রতিটা পুরুষই তার ব্যাক্তিগত নারীর সানিধ্যে আসলে খারাপ হয়ে যায়।”
“এতো খারাপ হতে হয় না।”
“হয় তো।চৈত্রের খরায় মরে যাওয়া গাছে ফুল ফুটেছে।শিমুল ফুল।”
শিমুলের কথা শুনে পুষ্প ঠোঁট উল্টে বললো,
“আর একটাও বাজে কথা বলবেন না।”
“আরে বাজে কথা কি?আর এভাবে আপনি আপনি করছো কেন?প্রমোশন থেকে ডিমোশন করে দিলে ব্যাপার কি?”
পুষ্প কথা বলেনা।হাত দিয়ে মুখ ঢেকে নেয়।এই মুখ আর শিমুলকে দেখানো যাবে না।শুধু শিমুল কেন অন্য কাউকেই দেখানো যাবে না।সারা অঙ্গে শিমুল লেপ্টে গেছে যেন অন্য কেউ দেখলেই বুঝে যাবে।শিমুল কিছুক্ষন পুষ্পকে দেখে বললো,
“এই জন্যই বলি তোমার নাম পুষ্প না রেখে লাজুকলতা রাখার দরকার ছিলো।”
পুষ্পর নিজেকে কেমন পূর্ণ পূর্ণ লাগে।সুখে চোখে পানি চলে আসে।সে টলমল চোখে শিমুলকে দেখে।
শিমুল সেদিকে তাকিয়ে আস্তে করে বললো,
“আমি খুব সরি ফুলরানী।”
পুষ্প শিমুলের বুকে হাত রাখে।শিমুলের মুখে হাসি দেখে পুষ্পর মনটা ভরে যায়।শিমুলের কানে নিজের ঠোঁট ছুঁয়িয়ে বলে,
“তুমি এতো পাগল কেন?”
“তোমার বর যে এইজন্য।”
“হুম।”
“তুমি যে আমার সুখের রানী তা জানো?”
পুষ্প শিমুলের মুখের দিকে তাকিয়ে বললো,
“আগে জানতাম না এখন তোমার সুখী চেহারা দেখে কিছুটা উপলব্ধি হচ্ছে।”
“কিছুটা না আমার সব সুখ আল্লাহ তোমার মাঝেই দিয়েছে।তোমাকে পেয়ে আমি পূর্ণ।তোমাকে আমার করে দেয়ার জন্য আল্লাহর কাছে লাখ লাখ শুকরিয়া।”
পুষ্প কিছু বলেনা।শিমুলের আদুল বুকে চুপচাপ শুয়ে থাকে।আল্লাহ স্বামী-স্ত্রী দুজনকেই দুজনের পরিপূরক হিসেবে সৃষ্টি করেছেন।একজন আরেকজনের সুখের খোরাক।পুষ্প তার ফুসফুস ভরে শিমুলের ঘ্রাণ নেয়।
ভোর সকালে পুষ্প উঠে যায়।বিছানায় শিমুল বেঘোরে ঘুমাচ্ছে,শিমুলের দিকে তাকিয়ে পুষ্পর রাতের দৃশ্য চোখে ভেসে উঠে।লাজুক হেসে বাথরুমে ছুটে।ফ্রেস হয়ে নামায পড়ে।মোনাজাতে সবার আগে শিমুলের জন্য দোয়া আসে।এমন স্বামী দেয়ার জন্য বারবার আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করে।নামায শেষ করে আবার বিছানায় শুয়ে থাকে।ক্লান্তিতে চোখ বন্ধ হয়ে আসছে।কিন্তু শুয়ে থাকলে তো চলবেনা।যেকোনো সময় শিমুল জেগে যাবে।পুষ্প এই লোকের সামনে পড়তে চায় না।ধীর পায়ে হেটে দরজা খুলে বেরিয়ে যায়।ফুলি তখন রান্নাঘরে নাস্তা বানাতে ব্যস্ত।পুষ্পকে দেখে হাসে।এই ফুলি মেয়েটাকে পুষ্পর পছন্দ হয়েছে,খুবই দিলখোলা।দুজনে এটা সেটা বলতে বলতে নাস্তা রেডি করে।রাবেয়া এসে পুষ্পকে দেখে খুশী হয়,পুষ্পর মাথায় হাত ভুলিয়ে বলে,
“তোমার এতো সকালে উঠতে হবে না,প্রথম প্রথম একটু দেরী করে উঠলেও আমি বকা দিবো না।”
পেশকারা এসে এই কথাটা শুনে নেয়।
“কোন নবাবজাদি বিয়ে করিয়ে এনেছো যে দেরী করে উঠবে?”
“আম্মা…”
“তুমি চুপ থাকো।এই মেয়ে তোমার আম্মা কি কোন তাবিজ টাবিজ দিয়েছে নাকি?সকালে নাস্তার সাথে মিলিয়ে দেয়ার ধান্ধায় আছো?”
পুষ্প অবাক হয়ে বললো,
“তাবিজ?”
“কেনো তাবিজ চিনো না?তাবিজ করে শিমুলকে যেভাবে পাগল করেছো।”
পুষ্প অবাক হয়ে তার শাশুড়ীর দিকে তাকায়।রাবেয়া তার শাশুড়ীকে এটা সেটা বলে থামায়। পেশাকারা গিজগিজ করতে করতে চলে যায়।
পলাশ কলেজে যাওয়ার পথে দেখে নিধি রেস্টরুমে বসে আছে।উঁকি দিয়ে দেখলো আর কেউ আছে কিনা কাউকে দেখতে না পেয়ে টুপ করে ঢুকে দড়জা আটকে দেয়।হঠাৎ করে পলাশ আসাতে নিধি চমকে তাকায়।পলাশ এসে সোজা নিধির দু’পা আঁকড়ে ধরে।
“নিধি আমি জানি আমি তোমার অযোগ্য।কিন্তু এভাবে কথা না বলে কষ্ট দিও না।আমার সহ্য হয়না।প্লিজ।”
নিধির বুকের তোলপাড় পলাশ দেখে না।তার বুকের রক্তক্ষরণ কারো চোখে পড়ে না।অসাধারণ ব্যক্তিত্বের পলাশের এমন ভেঙে পরা দেখে নিধি অবাক হয়।হাত দিয়ে জোড় করে পলাশের বাধন থেকে মুক্ত হয়।
“কি করছেন মাথা ঠিক আছে?”
“কথা বলো।যা ইচ্ছা তাই বলো কিন্তু এভাবে চুপ থেকো না।”
“কথা বললে কি হবে?সব কি আগের মতো হবে?আমার নিষ্পাপ ভালোবাসা ফিরিয়ে দিতে পারবেন?”
পলাশ চুপ করে নিধিকে দেখে।নিধি আবার বলে,
“কিছুই আর আগের মতো হবে না।আর আপনিও আমার সামনে এভাবে আসবেন না।চলে যান।আর বিরক্ত করলে আমি কলেজ থেকে চলে যাবো।”
পলাশ ছলছল চোখে নিধিকে দেখে।তার জন্য চলে যাবে?উঠে দাঁড়িয়ে বললো,
“আর কথা বলতে আসবো না।বেশী সমস্যা হলে বলো চাকরী ছেড়ে দেবো।”
সে আস্তে করে বেরিয়ে আসতে গেলে নিধি হাত ধরে আটকায়।পলাশ কিছু বুঝে উঠার আগেই নিধি পলাশের বুকে ঝাপিয়ে পড়ে ফিসফিস করে বললো,
“আমি আর সইতে পারছি না পলাশ।বুকে প্রচন্ড ব্যাথা করে,এই।যন্ত্রনায় মরে যাচ্ছি।আমাকে প্লিজ মুক্তি দাও।বাঁচতে দাও।”
পলাশ নিধিকে শক্ত করে নিজের বুকে মিশিয়ে নিতে চায়।অন্যের বউ বুকে নেওয়া পাপ সেটা পলাশ জানে তবুও আজকে সে পাপ করতেই রাজি।অনেক বছর ধরে যার ছোঁয়া পেতে মন উচাটন তার ছোঁয়া পেয়ে পলাশের নাকের পাটাতন ফুলে চোখ দিয়ে পানি পড়ে।নিধির ঘাড়ে মুখ লুকিয়ে নিধির মতো করেই ফিসফিস করে বললো,
“আর জ্বালাব না।জীবনের তরে মুক্তি দিলাম।”
শিমুল সকালে ঘুম থেকে উঠে পুষ্পকে পায় না।মনে মনে হাসে,পুষ্প যে লজ্জায় কাছে আসছে না এটা বেশ বুঝতে পারছে।তারপর গলা উঁচিয়ে পুষ্পর নাম ধরে ডাকে।পুষ্প তখন সোফায় বসে তার শাশুড়ীর মাথায় তেল দিচ্ছিলো।ফুলিকে বললো,
“ফুলি তোমার ভাইয়া কেন ডাকে দেখে আসো তো?”
ফুলি দৌড়ে যায়।পায়ের শব্দ শুনে শিমুল ভাবে পুষ্প এসেছে হাসিহাসি মুখে তাকিয়ে দেখে ফুলি দাঁড়িয়ে আছে।
“ভাইজান কিছু লাগবো?”
শিমুল হাসিহাসি মুখ নিমিষেই গম্ভীর করে বললো,
“চা লাগবে।”
“আচ্ছা।”
শিমুল দরজা থেকে উঁকি দিয়ে দেখে পুষ্প তার মায়ের মাথায় তেল দিয়ে দিচ্ছে।ফুলি চা নিয়ে আসে।
“তোর ভাবীকে গিয়ে বল আমি ডাকছি।”
ফুলি গিয়ে বললো,
“ভাবী ভাইয়া ডাকে।জলদি যান।”
রাবেয়া মুচকি হেসে উঠে যায়।মাথার চুল হাতখোপা করতে করতে বলে,
“আমি রুমে যাই একটু কাজ আছে।শিমুল কেনো ডাকে দেখো গিয়ে।”
শাশুড়ী যে বুজতে পেরেই চলে গেছে এটা দেখে পুষ্প লজ্জা পায়।আস্তে আস্তে রুমের দিকে এগিয়ে যায়।শিমুল পুষ্পকে দেখে হাসে।এগিয়ে এসে কাছে দাঁড়ায়।
“কই ছিলেন ম্যাম?”
“এই এখানেই।”
শিমুল পুষ্পর মাথা থেকে পা পর্যন্ত দেখে বললো,
“সব ঠিকঠাক?”
পুষ্প মাথা নেড়ে হ্যাঁ জানায়।
“সত্যিই?”
পুষ্প আস্তে করে বললো,
“জ্বী।”
শিমুল পুষ্পকে নিয়ে বিছানার এক কোনায় বসে,
“তুমি ভালো আছো?”
পুষ্প শিমুলের দিকে তাকায়।মাথা নেড়ে বললো,
“ভালো।”
শিমুল বিছানায় হেলান দিয়ে বসে।পুষ্পর লজ্জালজ্জা চেহারার দিকে তাকিয়ে তাকে আরো লজ্জা দিতে বললো,
“পুষ্প কাল রাতে কি হয়েছিলো?” আমার ঠিক মনে পড়ছেনা।তোমার মনে আছে?”
শিমুলের এমন কথা শুনে পুষ্প চোখ বড়ো বড়ো করে তাকায়।
“রাতে কিছু হয়নি।আমরা ভাত খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।”
শিমুল হাত দিয়ে মাথার চুল টেনে ধরে বললো,
“ওই শিমুল ফুল টুল নাকি…..”
পুষ্প শিমুলের মুখের কথা না শুনেই রুম থেকে চলে যায়।এই ছেলে তাকে মেরেই ফেলবে।
চলবে…..।
❝আপনারা গঠনমূলক মন্তব্য করেন না দেখেই তো লেখার আগ্রহ পাই না।❞