“শিশির বিন্দু”
সূচনা পর্ব
(নূর নাফিসা)
.
“বিন্দু, আজ ভার্সিটিতে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। ছেলেপক্ষ আসবে।”
“মা, কি শুরু করেছো বলোতো! তিন চারদিন আগে না মাত্র দেখে গেলো! সামনে পরীক্ষা আমার। ক্লাস এতো মিস করলে চলবে!”
” দু একদিনে কিছু হবে না। পরীক্ষা দেড়ি আছে আরও। উনারা মনে হয় আজ আংটি পড়িয়ে যাবে।”
” এক দেখাতেই তোমাদের মনে লাড্ডু ফুটে উঠেছে!”
“কিহ!”
“না, কিছু না।”
অনার্স ফাইনাল ইয়ারে পরীক্ষা দিবে এবার বিন্দু। পরীক্ষা শুরু হতে পনেরো বিশ দিনের মতো বাকি আছে। গত সপ্তাহে ছেলে পক্ষ এসে দেখে গিয়েছিলো বিন্দুকে। পছন্দ হয়েছে তাদের। ছেলে ইতালি থাকে। কাজের পাশাপাশি পড়াশোনার শেষ ধাপও সেখানেই সম্পাদিত হয়েছে। বিয়ের পর আবার চলে যাবে। সেখানে সবকিছু গুছিয়ে আবার একেবারের জন্য দেশে চলে আসবে। তাই বিয়ের জন্য ছেলের বাবা তাড়াহুড়ো করছেন। বিন্দুর বাবা মা-ও গত পরশু দেখে এসেছেন। তাদেরও পছন্দ হয়েছে। বাড়ি তাদের বাড়ি থেকে বেশি দূরে না। এলাকার এ প্রান্ত আর ওপ্রান্ত! পূর্ব পরিচিতই তাদের। আজ উনারা আসবেন তাই বিন্দুর মা মারিয়া মর্তুজা নিষেধ করলো ভার্সিটিতে যেতে। বিন্দু কথামতো থেকে গেলো বাড়িতে। মায়ের সাথে কাজে হাত লাগালো সে এবং তার ভাবি।
তারা দুই ভাই এক বোন। বড় ভাই বিভোর কোম্পানিতে কম্পিউটার অপারেটর হিসেবে কাজ করে এবং বিবাহিত । আর ছোট ভাই মুগ্ধ কিছুদিন পর এসএসসি পরীক্ষা দিবে। বাবা সাদিক মর্তুজার একটি মুদি দোকান আছে। আর মা মারিয়া মর্তুজা গৃহিনী।
কাজকর্ম শেষ করে বিন্দুকে তৈরি করে দিলো তার ভাবি ইতি। গোলাপি রঙের একটি লেহেঙ্গা পরিধান করেছে বিন্দু। কপালে ছোট সাইজের একটা টিকলি পড়েছে, কানে দুল আর হাতে ব্রেসলেট। দুপুরে মেহমান এলে খাওয়াদাওয়ার পর বিন্দুকে নিয়ে যাওয়া হলো তাদের সামনে। এবং বসানো হলো ছেলের পাশাপাশি! এই আইডিয়াটা ছিলো ছেলের ছোট বোন শীতুলের! বিন্দুর খুব অসস্তি লাগছে এখানে বসে। এ রুমে আসার পর এক পলক তাকিয়েছিলো শিশির নামক ছেলেটার দিকে। এক পলকেই চোখাচোখি হয়ে গেছে আর খুব লজ্জা পেয়েছে বিন্দু! কেননা শিশিরের চাহনি কেমন যেন মারাত্মক ছিলো! ঠোঁটের উপর লেগেছিলো স্পষ্ট ও মনোমুগ্ধকর এক ফালি হাসি! ইশ! অন্যকে লজ্জায় ফেলতে এভাবে হাসে কেউ! এখন কিভাবে আছে কে জানে! বিন্দুর আত্মা ধুকপুক শব্দ করে যাচ্ছে! দৃষ্টি তার নিচের দিকে আছে। শিশিরের মা আফসানা ফেরদৌসি বিন্দুর অন্যপাশে বসে থাকা শীতুলকে উঠিয়ে দিয়ে নিজে বসে পড়লেন। বিন্দুর সাথে টুকটাক কথা বলে তিনি নিজ হাতে এক জোড়া বালা পড়িয়ে দিলেন। অত:পর শিশিরের কাছে আংটি দিলেন পড়িয়ে দেওয়ার জন্য। অন্যদের কথায় বিন্দু হাত বাড়িয়ে দিলো ঠিকই কিন্তু তার হাত প্রচন্ড কাপছে। মনে হচ্ছে যেন সে বস্ত্রহীন হয়ে মাঘের শীতে আক্রান্ত! তার কম্পন দেখে শিশির হাতটা স্পর্শ করলো এবং সকলের দৃষ্টির অগোচরে একটু চেপে ধরলো যাতে কম্পন থেমে যায়। যেটা শুধু বিন্দু উপলব্ধি করতে পারলো। হাত চেপে ধরায় বিন্দু এক পলক শিশিরের দিকে তাকিয়েছিলো। আবার সাথে সাথেই নিচের দিকে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। কেন জানি মনে হচ্ছে লোকটা তাকে স্বাভাবিক থাকার জন্য ইঙ্গিত দিচ্ছে। কিন্তু সে-ও তো চাইছে স্বাভাবিক থাকতে, পারছে না তো! শিশির বিন্দুর হাতে রিং পরিয়ে দিলো। অত:পর বিন্দুকে দেওয়া হলো। বিন্দু কাপা কাপা হাতে কোনো মতো আঙুলের অর্ধেক নিতেই বাকিটা শিশির নিজে পড়ে নিলো।
এনগেজমেন্ট সম্পন্ন হতেই রায়হান মোল্লা সাদিক মর্তুজার সাথে কথা বলে দু সপ্তাহপর বিয়ের দিন পাকা করতে চাইলেন। কিন্তু দু সপ্তাহ পর তো বিন্দুর পরীক্ষা! তাই তিনি দিন পিছিয়ে দেওয়ার জন্য বললেন। কিন্তু এদিকে শিশির চলে যাবে, তাই সময় এতো পিছিয়ে দিতে পারবে না। আলাপ-আলোচনার একপর্যায়ে এক সপ্তাহ পরেই বিয়ের দিন ধার্য করা হলো। বাড়ি থেকে লোকজন যাওয়ার পর হাফ ছেড়ে বাচলো বিন্দু! খুব অসস্থি লাগছিলো তার! সবচেয়ে বেশি অসস্তিকর ছিলো ওই শিশিরটা! কিভাবে তাকায়! কিভাবে হাসে! কিভাবে এতো সুন্দরকরে মিষ্টিভাষায় নির্ভয়ে সকলের সাথে কথা বলে! ওফ্! আরেক ভাবি আছে লজ্জা দিয়ে যাওয়ার জন্য! কতক্ষণ এসে বকবক করে গেলো, “বিন্দুরে, বেশ মানিয়েছে তোর সাথে। ওফ্ফ! কি হ্যান্ডসাম! দুজন যখন একসাথে যখন বসেছিলি না, বেস্ট কাপল মনে হয়েছে তোদের! যেন নববিবাহিতা ছিলি তোরা! তুই তো লজ্জায় লুতুপুতু! আর শিশির যেন তোর লজ্জা আড়াল করে রেখেছিলো অন্যদের কাছে! আমি কিন্তু দেখেছি, তখন তোর হাত চেপে ধরেছিলো না! কাউকে বুঝতেই দেয়নি! বেশ ইন্টেলিজেন্ট, বিয়ে না হতেই আগলে রাখা শুরু করেছে তোকে! বিয়ের পর না জানি সর্বদা সবার দৃষ্টি থেকে লুকিয়ে রাখে! ”
আপ্রান চেষ্টা করে ইতিকে রুম থেকে বের করতে পেরেছে বিন্দু। বকবক শুরু হলে যেন আর থামে না সহজে! দরজা লাগিয়ে আয়নার সামনে দাড়িয়ে বিন্দু নিজেকে দেখলো একবার। হাতের বালা জোড়ায় হাত বুলিয়ে কোমল স্পর্শ করলো এবং রিংটাতে মুচকি হেসে ঠোঁটের ছোয়া দিলো। গহনা পড়নে রেখেই পোশাক পাল্টে মাগরিবের নামাজ আদায় করে নিলো। অত:পর বই নিয়ে পড়তে বসলো। এমন সময় পাশে থাকা ফোনটা বেজে উঠলো। বিন্দু হাতে নিয়ে দেখলো রিজু কল করেছে। বিন্দু রিসিভ করেই বললো,
– ইতর! বান্দর! আজ ভার্সিটি যাসনি কেন! পরীক্ষার ক’দিন বাকি আছে তা তোর জানা আছে! মাসে মাসে প্রাইভেটের বেতন কিভাবে দেয় আংকেল আন্টি সেই খেয়াল তোর আছে!
– ওই ওই, বরাবরের মতো নিজের বাবা-মাকে আংকেল আন্টি বলা বন্ধ কর। নতুবা খুব শীঘ্রই আমি আংকেল আন্টির কাছে নালিশপত্র পাঠিয়ে দিবো। ভার্সিটি আসোনি তুমি, আর আমাকে উল্টো শাসাও!
– হুহ্, ইট’স মাই আউট স্ট্যান্ডিং প্ল্যান সুইটহার্ট! যা বলার আমি বলে ফেলেছি, এখন রিপিট করতে আসিস না।
– তা আর করছি না। কারণ তো আমার জানাই আছে!
– কিসের কারণ!
– না, মানে আমি তোর বাসায় আসতে চলেছি আগামী সপ্তাহে।
– কেন? কেন?
– কেন আবার! এতো খুকি হয়ে গেলে তুমি! তাহলে শুনো শুনো, বিয়ে গো বিয়ে। বিন্দু পাখিটার বিয়ে, তাও আবার শিশিরের সাথে! ওফ! ভাবতে পারছি না আমি, নামের এতো মিল হয়ে যায় কিভাবে! শিশির-বিন্দু! ওয়াও, এমাজিং!
– ওই! এসব কে বললো তোকে!
– তুই না বললেই কি, অন্য কোনোভাবে আমি জানতে পারবো না বুঝি!
– তেমন কোনো রাস্তা দেখছি না আমি! ক্লিয়ার বল।
– হুহ! ভার্সিটিতে আসতে না দেখে বিকেলে কল করেছিলাম। তোকে পাইনি ইতি ভাবি ফোন রিসিভ করেছে। আর তখন ভাবিই বললো, তুমি নাকি তোমার মিস্টারের সাথে বসে আছো। আমার সাথে কথা বলার মতো সময় তোমার হাতে নে!
– রিজু! এতো বানিয়ে কথা বলতে পারিস কিভাবে! ভাবি নিশ্চয়ই এভাবে বলেনি! তুই খুটিয়ে খুটিয়ে ভাবির মুখ থেকে কথা বার করেছিস!
ওদিকে রিজু অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো। তাই বিন্দু বললো,
– আমি পড়তে বসেছি! তোর জন্য আমার গুরুতর ডিস্টার্ব হচ্ছে! স্যার কি করিয়েছে আমাকে ইনবক্সে দিয়ে দে। আল্লাহ হাফেজ।
বিন্দু সাথে সাথেই কল কেটে দিলো। রিজু আবার কল করলো। বিন্দু রিসিভ করে বললো,
– আবার কি!
– ওরে ওরে বিন্দু পাখি! আপাতত পড়াশোনা একটু কম করো। আর আমাকে কিছু ইনফরমেশন দাও। ভাবির কাছে সব শুনতে পারিনি। তোর ছয় সাত বছরের কোন দেবরটেবর আছে নাকি! লাইন ধরার সুযোগ হবে?
– তোকে বিরিয়ানির পাতিলে ফেলে তারপর রান্না করবো! ফোন রাখ!
রিজু হাসতে লাগলো। আর বিন্দু এদিকে কল কেটে দিলো। কয়েক সেকেন্ড অতিবাহিত হতেই আবার ফোনটা বেজে উঠলো! বিন্দু রিসিভ করেই জোর গলায় বললো,
– রিজু!!! জবাই করে ফেলবো তোকে! বারবার বলছি আমি পড়তে বসেছি আর আমার ডিস্টার্ব হচ্ছে! চুপচাপ নোট সেন্ট কর ইনবক্সে!
ওপাশ থেকে নরম কণ্ঠ ভেসে এলো,
– শিশির বলছি।
– কিসের শি..!
বিন্দু সাথে সাথেই ফোন কান থেকে নামিয়ে স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখলো অচেনা নাম্বার! সে জ্বিভে কামড় দিয়ে কপাল চাপড়ালো! “ওফ্ফ বিন্দু, তুই না দেখেই ফোন রিসিভ করেছিস কেন! তাছাড়া উনি ফোন নম্বর পেল কোথায়!” তার ভাবনার ছেদ ঘটিয়ে ওপাশ থেকে বললো,
– হ্যালো? কেউ কি শুনতে পারছে আমার কথা?
বিন্দু ফোন কানে দিয়ে আমতা আমতা করে বললো,
– জ..জ্বি। আসসালামু আলাইকুম।
– ওয়ালাইকুম আসসালাম। খুন করার সাহস আছে তোমার মাঝে? থাকলে আজ থেকে দূর করে দাও। আমি কিন্তু জেলখানাকে ভীষণ ভয় পাই। তুমি কাউকে জবাই করলে তো কারাগারে আমাকেই বন্দী হতে হবে!
বিন্দুর লজ্জা লাগছে খুব! নিজের উপর রাগও হচ্ছে! ফোন নম্বর না দেখেই বকবক শুরু করেছে! এখন কি ভাবছে উনি! বিন্দু জোরপূর্বক নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে বললো,
– না, আসলে তেমন কিছু না। ফ্রেন্ড বারবার কল দিয়ে দুষ্টুমি করছিলো। তাই বলছিলাম। খেয়াল করিনি আপনার নম্বর থেকে কল এসেছে।
– আমার নম্বর কি সেভ করা না-কি!
– না, মানে ফ্রেন্ডের নম্বর থেকে যে কল আসেনি সেটা খেয়াল করিনি।
তাকে ইতস্তত করতে পেরে শিশির হেসে উঠলো। আর এদিকে বিন্দু লজ্জায় লুতুপুতু! শিশির বললো,
– অহ আচ্ছা। যাক ভয় থেকে বেচে গেলাম। তাছাড়া ফ্রেন্ডদের এমন হুমকি দিলে নোট পাবে কি করে!
– হুমকি দিলেই কাজ দ্রুত আদায় হয়।
– তাই নাকি! আমাকে এভাবেই কাজ করানোর প্ল্যান করছো, রাইট?
বিন্দু কোনো উত্তর দিলো না। কি উত্তর দিবে! লোকটা যেই ধাচের কথা বলে যাচ্ছে যেন ইচ্ছে করেই তাকে লজ্জায় ফেলতে চাইছে। কোনো প্রতুত্তর না পেয়ে শিশির বললো,
– যাক, বেশি সময় নষ্ট করছি না তোমার। একটা কথা বলার জন্যই এসময় কল করা। কথাটা হচ্ছে এই, জীবনের প্রথমবার শ্বশুরবাড়ি গেলাম। আর প্রথমবারই শ্বশুরবাড়ি থেকে চুরি করে এলাম। তাও আবার বউয়ের ফোন নম্বর। একটু আধটু প্রেম করার জন্য। আশা করি এমন চুরি হওয়াতে বউয়ের কোনো ক্ষতি হয়নি! আর যদি হয়েও থাকে বিয়ের পর পুষিয়ে দিব। রাগ করলে নাকি?
বিন্দু লজ্জিত কণ্ঠে বললো,
– উহুম।
– তুমি যে কতোটা লক্ষ্মী আর লজ্জাবতী সেটা তোমাকে এক পলক দেখাতেই বুঝে গেছি। সরি, পড়ার সময় ডিস্টার্ব করার জন্য। আর সময় নষ্ট করছি না। আল্লাহ হাফেজ।
– আল্লাহ হাফেজ।
কলটা কেটে বিন্দু দীর্ঘনিশ্বাস ফেললো! “কথা বলার কি ভয়ংকর স্টাইল! এভাবে কথা বলতে হয়! বর্ণে বর্ণে লজ্জায় ফেলে! ইশ! তখন আমার বকবকানিতে কি না কি মনে করছে! কে জানে সেটা! ওফ্ফ বিন্দু, তুই তোর এই অভ্যাস পাল্টাবি কবে! আজ বন্ধুদের সাথে এমন বকবক করছিস, না জানি অন্যের উপরও এই প্রক্রিয়ার চালান শুরু করে দিস!”
.
.
এটি একটি অনিয়মিত গল্প….
সুতরাং কেউ আকুল অপেক্ষা করবে না।😜
মাঝে মাঝে লিখবো, হুট করে পোস্ট করে দিবো আর আপনারা টুপ করে বোনাস সরূপ পড়ে ফেলবেন….☺
হ্যাপি রিডিং…. 💞