
সকালে ঘুম থেকে উঠার পিক মেয়েদের
- কঠিন কষ্টের গল্প
- অনেক কষ্টের গল্প
- শিক্ষনীয় কষ্টের গল্প
- শিক্ষনীয় গল্প facebook
সকালে ভাবী যখন টেবিলে নাস্তা দেয় তখন বাবা ভাবীর দিকে তাকিয়ে বললো,
~বউমা, তোমার গালে এটা কিসের দাগ?
বাবার কথা শুনে ভাবী কিছুটা চমকে গেলো। পাশে থাকা আয়নার দিকে তাকিয়ে ভাবী হাসতে হাসতে বাবাকে বললো,
-বাবা, আমার ঘুমের মধ্যে হাত পা ছোঁড়াছুড়ির অভ্যাস আছে৷ গতকাল রাতে ঘুমানোর সময় কয়েল জ্বালাইনি। রাতে হয়তো গালে মশা বসেছিলো আর আমি হয়তো ঘুমের মাঝে মশা মারার জন্য নিজের গালে নিজেই থাপ্পড় মেরেছিলাম। এটা সেই থাপ্পড়েরই দাগ!
ভাবীর কথা শুনে বাবা কিছুটা অবাক হয়ে বললো,
~পাগলি মেয়ে বলে কি! এখন থেকে মনে করে সবসময় কয়েল জ্বালিয়ে ঘুমাবে। কেমন?
ভাবী বাবাকে উদ্ভট মিথ্যা গল্প বলে বুঝাতে পারলেও আমি ঐ দাগের আসল কারণটা ঠিকই বুঝতে পেরেছিলাম। আমি নিচের দিকে তাকিয়ে খেতে খেতে বাবাকে বললাম,
— বাবা, এই ধরণের মশা খুব বিপজ্জনক। কয়েলের সামান্য বিষে এইসব মশা মরে না।
আমার কথার ইঙ্গিতটা ভাবী ঠিকই বুঝতে পেরেছিলো। তাই কিছু না বলে মাথা নিচু করে চুপচাপ অন্যমনস্ক হয়ে রইলো…
|
|
ভাইয়া ভাবীর সংসারের বয়স ৪ বছর। প্রথম প্রথম সব কিছু ঠিকঠাক ছিলো। কিন্তু হুট করে মা মারা যাবার পর থেকেই ঝামেলা শুরু হলো। এখন ভাবী সামান্য একটু ভুল করলেই ভাইয়া ভাবীর গায়ে হাত তুলে। অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে। ভাবীর সহ্য করার ক্ষমতা অসীম । জোরে জোরে থাপ্পড় খাওয়ার পরেও তার কান্নার আওয়াজ রুমের বাহিরে আসে না। দাঁতের সাথে দাঁত চেপে সব কষ্ট সহ্য করে নেয়।
ছাদের একটা কোণে বসে এইসব কথা ভাবছি আর সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়ছি। ভাবী কখন যে ছাদ থেকে কাপড় নিতে এসেছে আমি খেয়াল করি নি। সিগারেট হাতে ভাবী আমাকে দেখে ধমক দিয়ে বললো,
– বা বা বা খুব ভালো। মাত্র ভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছিস এখনি সিগারেট ধরেছিস। কয়েকদিন পর তো মদ গাঁজা এইসব ও খাওয়া শুরু করবি!
আমি হাতে থাকা সিগারেটের আগুনটা নিভাতে নিভাতে বললাম,
— তাও ভালো আমি তো শুধু সিগারেট খাই। ভাইয়ার মত তো প্রতিদিন কারো রক্ত চুষি না!
ভাবী আমার দিকে অসহায়ের মত তাকিয়ে বললো,
– পিয়াস, তোর এইসব খোঁচা দেওয়া কথা গুলো আমার সহ্য হয় না।
আমি ভাবীর চোখে চোখ রেখে বললাম,
— রোজ রোজ যে মার খাও সেটা সহ্য হয়?
আমার কথা শুনে ভাবী কিছু না বলে চুপচাপ নিচে চলে গেলো। আর আমি পকেট থেকে আরেকটা সিগারেট বের করে তাতে আগুন ধরালাম….
|
|
অনেকক্ষণ ধরে খেয়াল করছি ভাবী আমার রুমে এসে আলনা থেকে গোছানো কাপড় নামিয়ে আবার গুছিয়ে আলনায় রাখছে। টেবিলের গোছানো বইপত্র গুলো আবার গোছাচ্ছে। ভাবীর এইসব কাজ কর্ম দেখে আমি কিছুটা অবাক হয়ে ভাবীকে বললাম,
— ভাবী, তুমি কি আমায় কিছু বলবে?
ভাবী আমার পাশে বসে আমতা আমতা করে বললো,
– পিয়াস, তোর কাছে হাজার খানিক টাকা হবে? আমি কয়েকদিন পর তোকে দিয়ে দিবো। তোর ভাইয়া আজকে একটু রেগে ছিলো তাই আর টাকা চাই নি।
আমি কিছু না বলে ভাবীর হাতে ১৫০০ টাকা দিলাম। ভাবী টাকাটা নিয়ে তাড়াহুড়ো করে নিচে গেলো। আমি কিছুটা কৌতূহল বসত চুপিচুপি ভাবীর পিছনে গেলাম। নিচে গিয়ে খেয়াল করি ভাবী তার ছোট ভাইকে টাকাটা দিচ্ছে আর বলছে,
— ” তোর দুলাভাইয়ের কাছ থেকে নিলাম। তোর টাকা লাগবে শুনে তোর দুলাভাই তো হাসতে হাসতে দুই হাজার টাকা দিলো। সেখান থেকে তোকে দিলাম ১৫০০, আর আমি ৫০০ রেখে দিলাম। “
ভাবীর কথা শুনে আমি হাসছি আর ভাবছি,
-হায়রে মেয়ে মানুষ। স্বামী স্ত্রীকে পায়ের নিচে ফেলে রাখলেও স্ত্রী তাকে মাথায় তুলে রাখে। স্বামী হাজার অন্যায় করলেও সেটা কারো কাছে বলে না বরং নিজের স্বামীকে সবার কাছে বড় করে তুলে যতই নিজে ছোট হোক…
|
|
বিকালের দিকে আমি আর বাবা বেলকনিতে বসে আছি। বাবা পত্রিকা পড়ছে আর বলছে, “এই দেশে কিছুই হবে না। দেশটা পঁচে গেছে, নষ্ট হয়ে গেছে। চারদিকে শুধু খুন-আহাজারি ধর্ষণ আর নির্যাতন! “
এমন সময় ভাবী এসে বাবাকে বললো,
-বাবা, আমি একটা জব পেয়েছি। মোটামুটি টাইপের খুব ভালো একটা জব।
ভাবীর কথা শুনে আমি হাসতে হাসতে বললাম,
— তুমি জব পেয়েছো সেটা এমন আসামীর মত শুকনা মুখে বলছো কেন?
আমার কথা শুনে ভাবী নিচু গলায় বললো,
– মামুন ( আমার বড় ভাই) সেটা মেনে নেয় কি না বুঝতে পারছি না।
বাবা তখন মুচকি হেসে ভাবীকে বললো,
— চিন্তা করিস না মা। মামুনকে আমি বুঝিয়ে বলবো…
|
|
রাতে খাবার টেবিলে বাবা যখন ভাইয়াকে ভাবীর চাকরির বিষয়ে কথা বলে। ভাইয়া রেগে গিয়ে বাবাকে বললো,
-আমি কম টাকা ইনকাম করি না কি যে আমার বউকে চাকরি করতে হবে?
বাবা তখন বললো,
~চাকরি কি মানুষ শুধু টাকার জন্য করে? সংসারে আমরা শুধু ৩ জন। কাজের লোক আছে দুইজন। বউমা চাকরি করলে সমস্যা কি? তুই হাজার হাজার টাকা ইনকাম করলেও বউমাকে কি কখনো ৫০০ টাকা দিয়ে বলেছিস, এটা তুমি খরচ করো। মেয়েটা আজ একটা চাকরি পেয়েছে। করলে দোষের কি?
বাবার কথা শুনে ভাইয়া আরো রেগে গিয়ে বললো,
– আমি চাই না আমার বউ চাকরির নাম করে অফিসের কলিগদের সাথে গিয়ে ঢলাঢলি করুক।
ভাইয়ার এমন নিম্নমানের কথা শুনে নিজেকে আর কন্ট্রোল করতে পারলাম না। জীবনে এই প্রথমবার ভাইয়ার চোখে চোখ রেখে বললাম,
— তুমিও তো চাকরি করো। তারমানে তুমিও নিশ্চয়ই তোমার অফিসের মেয়ে কলিগদের সাথে ঢলাঢলি করো? তা না হলে এমন নিম্নমানের চিন্তা তোমার মাথায় আসার কথা না।
আমার মুখ থেকে এমন কথা শুনে ভাবী আমার গালে থাপ্পড় মেরে কাঁদতে কাঁদতে বললো,
– খুব বড় হয়ে গেছিস তুই তাই না? বড় ভাইকে যা তা বলছিস।
আমিও তখন চোখের পানি আটকে রেখে ভাবীকে বললাম,
— তোমাদের মত মেয়েদের না গলা টিপে মেরে ফেলা উচিত। কারণ তোমাদের মত কিছু মেয়ে আছে যারা স্বামীকে মাথায় করে রাখে; যার ফলে ভাইয়ার মত কিছু কাপুরুষ সেটার সুযোগ নেয়। ভাইয়া যখন প্রথম তোমার গালে থাপ্পড় মেরেছিলো তোমার উচিত ছিলো সেদিনই ভাইয়ার বিরুদ্ধে নারী নির্যাতনের মামলা করা। তাহলে হয়তো ভাইয়া তোমাকে দ্বিতীয় বার থাপ্পড় মারার আগে একটু হলেও ভাবতো…
বাবার দিকে তাকিয়ে বাবাকে বললাম,
— তুমি দেশ নষ্ট হয়ে যাবার কথা ভাবছো অথচ তোমার অজান্তে যে তোমার ঘরটা নষ্ট হয়ে গেছে সেটা একবারও ভাবো নি…
|
|
আমি আর শ্রাবণী ভার্সিটির ক্যাম্পাসের একটা কোণে বসে আছি। আমি শ্রাবণীকে তখন বললাম,
— আচ্ছা, আমি বিয়ের পর কখনো যদি তোমার গালে থাপ্পড় মারি তখন তুমি কি করবে?
আমার কথা শুনে শ্রাবণী বললো,
– আমি তোমার নাক বরাবর ঘুষি মারবো। অন্যায় করলে বুঝিয়ে বলবে, আমি শুধরে নিবো। শুধু শুধু মারবে কেন?
আমি শ্রাবণীর কথা শুনে হাসতে লাগলাম। আর ওর হাতটা শক্ত করে ধরে মনে মনে ভাবতে লাগলাম, আমিও চাই আমার স্ত্রী এমন হোক। ভাবীর মত অন্যায় সহ্য না করে অন্যায়ের প্রতিবাদ করুক…
#প্রতিবাদ
#আবুল_বাশার_পিয়াস
২.অনেক কষ্টের গল্প
এই নিয়ে দ্বিতীয়বার গুনলাম।
এগারো হাজার আটশো। আমি জানতাম এখানে এগারো হাজার আটশো টাকায় আছে। তারপরও পর পর দুইবার গুনলাম। আরও দুই হাজার টাকা লাগবে। অফিসে এসেই আদনান স্যারের কাছে গেলাম। যদিও আগের পাঁচ শ টাকা এখনো শোধ করা হয়নি। তারপরও গিয়ে বললাম, স্যার হাজার দুয়েক টাকা লাগবে। প্রতি মাসে পাঁচ শ করে ফেরত দিব।
কী ব্যাপার নুরু মিয়া, সকাল সকাল টাকা ধার চাইছ?
একটা কাজ আছে স্যার।
সেটা তো বুঝলাম। তুমি তো কাজ ছাড়া এক টাকাও খরচ করো না। তবে কাজটা কী?
মেয়ের জন্য একটা ফোন কিনব স্যার। স্মার্ট ফোন। মেয়েটা কলেজে ভর্তি হয়েছে। পড়ালেখার নানা কাজ এই ফোন ছাড়া নাকি হয় না। মাঝে মাঝে ফোনেও ক্লাস হয়। মেয়ের মামা মোবাইল একটা দিয়েছিল বটে কিন্তু অনেক পুরনো। এটা চলে তো ওটা চলে না। মেয়েটা পেরেশান হয় ঠিকই কিন্তু আমার আয় রোজগার জানা আছে বলে মুখ ফুটে কিছু বলে না। মেয়ের মা কয়েকদিন ধরে বলছিল। স্মার্ট ফোন কেনার মতো এত গুলো টাকা একসাথে জোগাড় করা বেশ কঠিন। গত কয়েক মাসে মোটামুটি কিছু টাকা জমিয়ে ফেলেছিও। ভালো কথা। কিন্তু আমার হাতে এখন নগদ টাকা তো নেই নুরু। লাঞ্চের সময় বাইরে গেলে বুথ থেকে কিছু টাকা তুলব। তখন না হয় নিও।
ঠিক আছে স্যার। তখন দিলেই হবে। আদনান স্যারের কাছ থেকে ফিরে অপেক্ষা করতে লাগলাম কখন লাঞ্চের সময় হবে। টাকাটা বের করে আরেকবার গুনতে ইচ্ছে হলো। যদিও গুনে কোনো লাভ নেই সেটা আমি জানি। ওখানে এগারো হাজার আটশো টাকায় আছে। এদিকে মেয়েটা দুই তিনবার মিসকল দিয়েছে। মিসকল দেওয়ার কারণও আছে। ভেবেছিলাম, সকালে অফিসে এসে আদনান স্যারের কাছ থেকে টাকা নিয়ে ঘণ্টা দুয়েকের জন্য ছুটি নিব। মেয়েটাকে তেমন করে বলেও রেখেছি। কথা ছিল অফিসে এসে হাতের কাজ গুছিয়ে আমি ফোন দিব। আমি ফোন দিলেই দুই মেয়ে এবং তার মা বাসা থেকে বেরিয়ে পড়বে। রায়েরবাগ থেকে মতিঝিল। সেই মতিঝিল একটা মোবাইল শোরুম থেকে আমরা ফোনটা নিব। এদিকে হাতের কাজ গুছিয়ে ফেললেও টাকা যোগাড় হয়নি। ভেবেছিলাম একটু পর মেয়েদের ফোন দিয়ে বলব দুপুরের পর বাসা থেকে বের হতে। কিন্তু তার আগেই মেয়েটার দুই দুইবার মিসকল দিয়ে দিয়েছে। আমি জানি মেয়েরা এই নিয়ে খুব উত্তেজিত। অনেকদিন এতো দাম দিয়ে আমার বাসায় কিছু কেনা হয়নি। মেয়েদের সাথে মেয়ের মাও ভীষণ খুশি। মেয়ের মা খুশি কারণ এখন সে মাঝে মাঝে বাড়িতে ভিডিও কল দিতে পারবে বলে। তাছাড়া সে শুনেছে, স্মার্ট ফোনের মাধ্যমে নাকি টাকা ছাড়াও কল দেওয়া যায়। এই শুনে সে মহা খুশি। গতকাল বন্ধের দিন আমি আর বড় মেয়ে শিখা এই ফোন একবার দেখে গিয়েছি। মেয়েটা একটু লাজুক প্রকৃতির। কিনব না কিন্তু দাম ধর দেখতে শো রুমে যেতে একটু ইতস্তত করছিল। আমি জোর করলাম। বললাম, দামি জিনিস। একটু আগে থেকে দেখে শুনে কিনলে ঠকবো না। তাছাড়া আমাদের তো আর জানা শোনা নেই। আগে থেকে দেখে শুনে দাম ধর একটু দেখে আসলে সুবিধা হয়। আমার কথায় মেয়েটা রাজি হলো। মতিঝিলে দুই চারটা শো রুম ঘুরে দেখলাম। আমাদের বাপ-বেটিকে দেখে দোকানিরা দামি দামি ফোন দেখায়। ফোনের নানা সব ফাংশান বলে। এসব আমার জানা নেই। মেয়েটা কিছু কিছু জানে বটে। ওইটুকুই ভরসা। কিন্তু দামি ফোন দেখে মেয়েটা কেমন যেন জড়োসড়ো হয়ে থাকে। আমাকে কানে কানে ফিসফিস করে বলতে থাকে, আব্বু এখানে দেখার দরকার নাই।
আমি বুঝতে পারি মেয়ে দাম নিয়ে ভয় পাচ্ছে। দোকানের বাইরে এসে বাপ-মেয়ে শলাপরামর্শ করি। আবার দোকানে যাই। হাজার দশেকের মধ্যে মোবাইল খুঁজি। মেয়েটার কাজ হবে এমন মোবাইল হাজার দশেকে পাওয়া মুশকিল। মেয়েটার মন খারাপ হয়। আমি জানি বার বার এই দোকান সেই দোকান ঘুরতে তার লজ্জা হচ্ছে। তারপরও সেই লজ্জা আমার কাছে লুকিয়ে রেখে মেয়েটা বলে, আব্বু আমরা না হয় আর কিছুদিন পর ফোনটা কিনি। মেয়েটার কথা আমার বুকের ভিতরটা তোলপাড় করে। এত আশা নিয়ে, এইটুকু পথ এসে ফোন কেনা হবে না ভাবতেই আমার কেমন যেন বুকটা ফেটে যেতে চাইছে। মনে মনে ভেবে রাখলাম আজ ফোন পছন্দ করেই তবে ফিরব। হাজার দুই তিনেক টাকা বেশি লাগে লাগুক। মেয়েকে নিয়ে আবার ঘুরতে লাগলাম। শেষে এই তের হাজার আটশো টাকা দামের ফোনটা আমাদের খুব পছন্দ হলো। সেই পছন্দ নিয়ে বাপ-মেয়ে বেশ খোশ মেজাজে বাড়ি ফিরলাম। আমার ছোট মেয়েটা পড়ে ক্লাস সিক্স। সেও বায়না ধরল ফোন কেনার সময় সাথে যাবে। এদিকে মেয়ের মাও দেখলাম যেতে রাজি। ভাবলাম, ভালো একটা ফোন যখন কিনছি তবে সবাই গিয়ে না হয় কিনি। সেই থেকে বাড়িতে ঈদ লেগে আছে। গতকাল অনেক রাত পর্যন্ত দেখলাম দুই মেয়ে ফিসফিস করে এই ফোন নিয়ে কী সব বলছে। মেয়েদের খুশি দেখে আমার ভীষণ ভালো লাগে। হাজার দশেক টাকা আগেই জমানো ছিল। রাতে মাটির ব্যাংকটা ভাঙলাম। ভেবেছিলাম বাকি টাকা এখানে পাওয়া যাবে। কিন্তু পেলাম দুই হাজারের কাছাকাছি। এদিকে মেয়েদের কথা দিয়ে রেখেছিলাম আজই ফোন কিনব। সুতরাং রাতেই ভেবে রেখেছি, অফিসে এসে আদনান স্যারের কাছ থেকে বাকি দুই হাজার টাকা ধার নিয়ে ফোনটা কিনে ফেলব। বাসায় জানিয়ে দিয়েছি দুপুরের পর রওনা দিতে। এদিকে আমি অপেক্ষা করতে লাগলাম কখন লাঞ্চের সময় হবে। বড় স্যারের কাছ থেকে আগে আগে লাঞ্চের পর থেকে ছুটি নিয়ে রেখেছি। এখন টাকাটা হাতে পেলেই হলো। মতিঝিলের ট্রাভেল এজেন্সির এই অফিসে আমরা লোকজন বলতে জনা দশেক। বড় স্যারের পর ওই আদনান স্যার। বড় স্যার ধার দেনা পছন্দ করে না। এদিকে আদনান স্যার ছাড়া বাকি সবার হাতের অবস্থা ঠিক আমার মতো। বিপদে আপদে ওই আদনান স্যার আমাদের অনেকের ভরসা। আজও তাই। তাছাড়া আমার মতো অফিস পিয়নকে টাকা পয়সা ধার দিতে অনেকে ভয় পায়। আমিও খুব একটা বিপদে না পড়লে ধারদেনা পছন্দ করি না। আমার অল্প বেতন আর শিখার মায়ের সেলাই কাজের টাকা দিয়ে টেনে টুনে দিন যায়। এই নিয়ে আমরা খুশি। কিন্তু হঠাৎ করে এই ফোনের টাকা জোগাড় করতে এবার বেশ বেগ পেতে হচ্ছে।
লাঞ্চের সময় কিছুটা পেরিয়েছে। আদনান স্যার একটু আগে বের হয়েছেন। আমাকে বলে গেলেন লাঞ্চ করে আধা ঘণ্টার মধ্যে ফিরে আসবেন। আমার টাকার কথা তার মনে আছে। যাওয়ার সময় আমাকে আশ্বস্ত করায় আমি কিছুটা সাহস পেলাম। এদিকে মেয়েদের বলে দিলাম রওনা দিতে। এতক্ষণে এসেও গিয়েছে বোধহয়। শিখা জানে কোথায় দাঁড়াতে হবে। তাছাড়া আমি বলে দিয়েছি যে দোকানটায় ফোন পছন্দ করে রেখেছি সেখানে গিয়ে ফোনটা দেখে রাখতে। আমাকে যেহেতু মিস কল দিয়েছে তবে নিশ্চিত হলাম পৌঁছে গিয়েছে।
লাঞ্চের সময় ঘণ্টাখানেক পেরিয়ে গেল। আদনান স্যার এখনো আসেন নি। আমি একটু বিচলিত হয়ে পড়লাম। এদিকে মা-মেয়েরা এসে দাঁড়িয়ে আছে। বড় মেয়েটা দুইবার ফোন দিয়ে জানতে চাইলো আমার আসতে দেরি হবে কি না। তারা নাকি বেশ কিছুক্ষণ ওই দোকানেই ছিল। এখন বাইরে এসে দাঁড়িয়ে আছে। ফোন না কিনে দীর্ঘ সময় একটা দোকানে দাঁড়িয়ে থাকা বেশ অস্বস্তির। আদনান স্যারকে ফোন দিলাম। তিনি ফোন ধরছেন না। এমন হওয়ার কথা নয়।
সময় আরো কিছু পেরিয়েছে। আমার ভীষণ মন খারাপ হচ্ছে। আমার অফিস থেকে মিনিট সাতেক হাঁটলে সেই মোবাইল ফোনের দোকান। এদিকে আদনান স্যার আসবে আসবে করে আমি কোথাও নড়তে পারছি না। এখন মনে হচ্ছে কোথাও পালিয়ে যাই। মেয়েটার সামনে গিয়ে দাঁড়াতে কষ্ট হচ্ছে। আমি জানি, কিছু টাকা জোগাড় হয় নি শুনলে মেয়েটা হাসি হাসি মুখ করে বাড়ি যাবে। ফোনের কথা একবার তুলবে না। মেয়েটা তখন অন্য একটা গল্প জুড়ে দিবে। সেই গল্প শুনে আমার হাসি পাবে। খুব হাসি। মেয়েটা লাজুক হলেও ভীষণ ভালো গল্প বলে। এতো গল্প তার মাথায় কোথা থেকে আসে আমি বুঝি না। আমার শুনতে ভালো লাগে। মাঝে মাঝে আমার যখন খুব মন খারাপ হয় তখন মেয়েটার কাছে গিয়ে বসি। মেয়েটা খুব বুঝতে পারে। আমাকে মন খারাপের কোনো কারণ জিজ্ঞেস না করে গল্প বলা শুরু করে। মাঝে মাঝে সেই গল্প শুনে আমি হাসি। বাচ্চাদের মতো করে হাসি। আমার হাসি দেখে বউ বলে আমি নাকি পাগল। কিন্তু আমি জানি আজ আমার গল্প শুনতে ভালো লাগবে না। একটুও না। আজ গল্প বললেও আমার মন ভালো হবে না। তাই আমি বসে আছি। মনে মনে ভাবলাম আর কিছুক্ষণ দেখি। আদনান স্যার এসে পড়লে সব সমাধান হয়ে যাবে। মা-মেয়ে না হয় কিছুক্ষণ অপেক্ষা করুক। আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে আমি রওনা দিলাম স্ত্রী এবং মেয়েরা যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেখানে। যাওয়ার আগে লাজ লজ্জা ফেলে দু-একজনের কাছে দুই হাজার টাকা ধার চাইলাম। কেউ পারল না দিতে। মোবাইল ফোনের দোকানের কাছে এসেই দেখলাম দোকান থেকে একটু আড়ালে মা-মেয়েরা দাঁড়িয়ে আছে। দূর থেকে তাদের দেখে আমার পা যেন আটকে গেল। আমি তাদের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি কিন্তু পা দুটি যেন অসাড় হয়ে আছে। নিজেকে টেনে নিতে খুব কষ্ট হচ্ছে। আমাকে দেখতেই বড় মেয়েটা দ্রুত পায়ে কাছে এসে বলল, আব্বু আজকে ফোন নিতে হবে এমন কোনো কথা নেই। আমরা না হয় দুদিন পরে নিই। চলো আজ আমরা কিছুক্ষণ পাকে ঘুরে বাসায় ফিরি।
আমি কিছু একটা বলতে গেলাম কিন্তু গলাটা কেমন যেন আটকে আসল। মেয়েরা অনেক কিছু বুঝতে পারে। আমার আজকের সীমাবদ্ধতার কারণও নিশ্চয় মেয়েটার জানা হয়ে গিয়েছে। জানা হয়ে গিয়েছে বলেই হয়তো আমারে কাছে কোনো কৈফিয়ৎ জানতে চেয়ে আমাকে কষ্ট দিতে চাইছে না মেয়েটা।
মতিঝিল থেকে আমরা সবাই হাঁটা ধরলাম গুলিস্থান পাকের দিকে। ভাবলাম সেখানে কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে বাসে করে সবাই রায়েরবাগ ফিরে যাব।
কিছু দূর আসতেই দেখি আদনান স্যার ফোন দিয়েছেন। ফোন ধরতেই বলল, নুরু মিয়া তুমি কোথায়?
আমি বাসায় যাচ্ছি স্যার।
এখন আছো কোথায় তুমি?
দিলকুশা।
তুমি ওখানেই দাঁড়াও। আমি এসেই বলছি কী হয়েছে।
পাঁচ মিনিটের মধ্যে আদনান স্যার এসে হাজির। এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, তুমি তো দেখলে আমি লাঞ্চে গেলাম। মাত্র খেতে বসেছি অমনি বাসা থেকে ফোন এলো আমার ছোট মেয়েটা রুমে আটকা পড়েছে। কিছুতেই লক খুলতে পারছে না। এদিকে মেয়েটার আছে শ্বাস কষ্ট। ভয়ে সেই শ্বাস কষ্ট বেড়েছে। আমি কিছু না ভেবে রওনা দিলাম বাসার দিকে। জ্যামের কারণে অর্ধেক পথ গেলাম দৌড়ে। এই ছাড়া উপায় নেই। আমার খুব আদরের মেয়ে। মেয়ের কথা ভেবে কাঁদছি আর দৌড়চ্ছি। শেষে আমি গিয়ে দরজার তালা ভেঙ্গে মেয়েকে বের করলাম। এত কিছুর মধ্যে তোমার টাকার কথা বেমালুম ভুলে গিয়েছিলাম নুরু। সবকিছু শান্ত হতেই তোমার কথা মনে পড়ল। ভেবেছিলাম আসব না। কিন্তু আমি চাই না আজ তোমার মেয়ের একটুও মন খারাপ হোক।
আমি বললাম, সমস্যা নেই স্যার। আরেক দিন নিব। আরেক দিন মানে? আমি আবার আসলাম ফোন কিনতে আর তুমি বলছ আরেক দিন। চলো কোথায় ফোন দেখেছিলে। আদনান স্যারের জোরাজুরি তে আমরা সবাই আবার ফিরে গেলাম সেই দোকানে। ফোন নিয়ে আদনান স্যার সব টাকা তার কার্ড থেকে পরিশোধ করে দিয়ে বলল, আজ এই ফোন আমার শিখা মায়ের জন্য আমার পক্ষ থেকে উপহার। এই টাকা তোমাকে শোধ করতে হবে না।
আমি খুব না করলাম কিন্তু আদনান স্যার বলল, এটা আমি খুশি হয়ে দিচ্ছি। তোমার মতো ভালো মানুষের মেয়েকে কিছু দিতে পারলে আমার ভালো লাগবে। তুমি না করলে আমি কষ্ট পাব।
আদনান স্যারের কথা উপর কিছু বলার সাহস আমার হলো না। ফোন কিনে আদনান স্যারের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমরা রওনা দিলাম বাসার দিকে। মতিঝিল থেকে একটা সিএনজি নিলাম। জানি খরচ একটু বেশি হবে। তারপরও নিলাম। সিএনজিতে মেয়েটা লুকিয়ে কাঁদছে। আমি জানি মেয়েটা খুশিতে কাঁদছে। মেয়েটা চুপচাপ। অন্য সময় হলে কিছু একটা নিয়ে মেয়েটা গল্প করত। আজ করছে না। ছোট মেয়েটা একবার ফোনটা বের করে দেখতে চাইলো। শিখা কপাট রাগ দেখিয়ে বলল, হাত দিবি না এখন। এই ফোন এখন ধরা যাবে না।
বাসায় ফিরে সবাই নেড়েচেড়ে ফোনটা দেখলেও এই ফোন দিয়ে কোথাও ফোন করতে দিবে না মেয়েটা। শিখার মা বলল, তোমার মামাকে একটা ভিডিও কল দাও। অনেকদিন দেখি না ভাইটারে।
শিখার এক কথা আজ কোথাও ফোন দেওয়া যাবে না। সবকিছু কাল থেকে হবে। আমরাও আর জোর করলাম না। মেয়েটা যেমন চায় করুক। তার খুশি আমাদের খুশি।
পরদিন সকালে আমি অফিসে এসেছি একটু দেরিতে। পথে ভীষণ জ্যাম ছিল। এরই মধ্যে মেয়ে দুইবার ফোন দিয়েছে। আমি অফিসে এসে বড় স্যারের একটা কাজ করছিলাম অমনি আদনান স্যার ডাক দিয়ে তার মোবাইল ফোনটা আমার হাতে দিয়ে বলল, তোমার তো আবার বাটন ফোন। শিখা আমার ফোনে ভিডিও কল দিয়েছে। নতুন ফোন দিয়ে তোমার সাথে নাকি প্রথমে কথা বলবে। এই কারণে অন্য কারো সাথে এখনো কথা বলেনি। কথা বলো নুরু মিয়া।
ফোন হাতে নিতে দেখলাম আমার শিখা মেয়েটার মুখ। মেয়েটা কাঁদছে। আমিও যেন কেমন বাচ্চা হয়ে গেলাম। আমি কাঁদছি। ভিডিও কলে আছি অথচ আমরা বাপ-মেয়ে কোনো কথা বলছি না। দুজন দুজনের কান্না দেখছি। মেয়ের সেই কান্না দেখে আমার মনে হচ্ছে আমি কোনো এক সুখের গল্প শুনছি। মুখে না বললেও মেয়ের সেই গল্প ঠিকই আমি শুনতে পাচ্ছি।
আমাদের বাপ-মেয়ের মধ্যে কোনো কথা না হয়ে সেই ভিড়িও কল শেষ হলো। বুঝলাম মেয়েটা কেন গতকাল রাতে আমার ফোন থেকে আদনান স্যারের ফোন নাম্বার নিয়েছিল। আমি একটু আড়ালে হাতের কব্জি দিয়ে দুচোখ মুছে আদনান স্যারের দিকে ফোনটা দিলাম। স্যার আমার হাত থেকে ফোন নিতে নিতে বলল, পৃথিবীতেও কিছু স্বর্গ সুখ আছে নুরু মিয়া। আজ তোমাদের বাপ-মেয়েকে দেখে মনে হলো আমি সেই স্বর্গ সুখ দেখছি।
—তেরো হাজার আটশো
——রুহুল আমিন
৩.শিক্ষনীয় কষ্টের গল্প
আব্বার কালো কোটটা আজ ধোয়া হয়েছে। আব্বার একটাই কোট। ত্রিশ বছর আগে আব্বার বিয়েতে নানাজান এই কোট বানিয়ে দিয়েছিলেন। ত্রিশ বছর ধরে আব্বা নিজ হাতে এই কোট ধোয়ার কাজটি করেন। শীতের শুরুতেই আব্বা এই ধোয়ার কাজটি সেরে ফেলেন। তবে মাঝের এক বছর হুট করে আব্বার জন্ডিস ধরা পড়ে। ভীষণ খারাপ রকমের জন্ডিস। জন্ডিস ভালো হতে হতে পুরো শীত এসে গেল বলে আব্বা সেই কোট ধোয়ার কাজটি আর করতে পারলেন না। এই নিয়ে আব্বার সেই কি আক্ষেপ !
আমি বলি, এভাবে বুঝি কেউ কোট ধোয়?
আব্বা বললেন, বাপজান এই সাবান দিয়ে ধোয়ার চেয়ে আর কোন ভালো ধোয়া আছে? লন্ড্রিতে এক কোট ধুয়ে পঞ্চাশ টাকা রেখে দেয়। তার চেয়ে আমার এই সাবান দিয়ে এক ধোয়ায় বছর পার। পঞ্চাশ টাকার কাজ এক তিব্বত সাবানেই শেষ।
হ্যাঁ, ত্রিশ বছর হতে চললো আব্বা এই কোট আগলে রেখেছেন। বিয়ের সময় নানাজানের কাছ থেকে এই কোট উপহার পেয়ে আব্বা ভীষণ খুশি হয়েছিলেন। তখন নতুন জামাইকে সাফারি স্যুট দেওয়ার একটা রেওয়াজ ছিলো। আব্বা নাকি সাফারি স্যুটের বদলে এই কোট নিয়েছিলেন। আব্বা করেন সরকারি কেরানির চাকরি। আম্মাও সুযোগ পেলেই আব্বার এই কোটের গল্প জুড়ে দেন। আম্মা হাসতে হাসতে বলেন, প্রথম প্রথম গরমেও তোর আব্বা মাঝে মাঝে এই কোট পরে অফিসে যেতেন।
আব্বার বিয়ের বছর তিনেক পর আমাদের এলাকার এক ছোট চাচা আসলেন আব্বার এই কোট ধার চাইতে। উনি নাকি বিসিএসের ভাইভা দিবেন। আব্বা শুনে মহাখুশি। পারলে এই কোট আবার নতুন করে ধুয়ে দেন। কোটের তিন বোতামের একটা ছেঁড়া ছিল। সেই বোতাম আব্বা তুলে রেখেছিলেন আলমারিতে। সেটা আলমারি থেকে বোতাম খুঁজে বের করে কোটে লাগিয়ে দিলেন। সেই কোট পরে ঐ চাচা ভাইভা দিলেন এবং চাকরিও হয়ে গেল। সেই থেকে এই কোটের প্রতি আব্বার নাকি মায়া আরো বেড়ে গেল। আব্বা আরও বেশি যত্ন নেয়া শুরু করলেন।
একবার হলো কী, আব্বার এই কোটের হাতায় কে যেন নেইল পলিশ লাগিয়েছে। এই দেখে আব্বা ভীষণ মন খারাপ করলেন। মন খারাপ করেই অফিস গেলেন। অফিসের কেউ একজন বুদ্ধি দিলো কেরোসিন দিলে নেইল পলিশের দাগ উঠবে। ঐদিন আব্বা সকাল সকাল অফিস থেকে বাসায় ফিরলেন। বাসায় এসে কেরোসিনের বোতল খুঁজে দেখে বোতলে তেল নেই। আব্বা এই বোতল নিয়ে দোকানে গেলেন। তেল নিয়ে এসে এই নেইল পলিশের দাগ তুললেন।
চৈত্র মাসের শেষের দিক। আমি একটা চাকরির ইন্টারভিউ দিতে যাব। আব্বা কোটটা বের করে আমাকে পরিয়ে দিলেন। আমাকে হিসফিস করতে দেখে বললো, গরম লাগছে বুঝি?
আমি কিছু একটা বলার আগেই আব্বা বললো, ব্যাটা একটু গরম লাগলে লাগুক। এই কোট বিসিএস জেতা কোট। হেলাফেলা করিস না। এটা পরে ইন্টারভিউ দিয়ে দেখ কেমন লাগে।
ছোট বেলা থেকে দেখে আসছি শীতের সময় আব্বা এই কোট ছাড়া তেমন একটা ভারী জামা কাপড় পরেন না। বছরের পর বছর শীতের কাপড় উনি এই এক কোট দিয়েই পার করে দিলেন। এমনও হয়েছে আব্বা প্রায় লুঙ্গির সাথে এই কোট পরে বাজারে গিয়েছেন।
হ্যাঁ, আমি বড় হয়েছি। খুব ভালো চাকরি বাকরি করি। ভালো আয় রোজগার করি। এখন অনেককিছু বুঝতে পারি। বুঝতে পারি বলেই একদিন আব্বাকে বললাম, আব্বা এবার নতুন একটা কোট বানিয়ে দেই?
আব্বা আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি একটা হাসি দিয়ে বলেন, এটা দেখতে বুঝি খুব খারাপ লাগে রে?
আমি আমতা আমতা করে বললাম, এটা অনেক পুরনো হয়ে গেল তাই বলছিলাম…
আব্বার তার গায়ে থাকা সেই পুরনো কোটটার পকেটে হাত ঢুকিয়ে একটা বড় নিঃশ্বাস নিলেন। তারপর সেই নিঃশ্বাস ছেড়ে দিয়ে বললেন, ব্যাটা, পুরনো অনেক কিছু চাইলেও পাল্টানো যায় না। এই পুরনোর মাঝে অনেক কিছু আটকে আছে। বলতে পারিস এটা আমাদের একটা অবলম্বন। আমাদের মত নিম্ন মধ্যবিত্তরা এই অবলম্বন এড়াতে পারে না। আমিতো খুব ছোট একটা কেরানীর চাকরি করতাম। শার্ট প্যান্ট হাতে গোনা। দুটো শার্ট মাত্র। তাও আবার অনেক পুরনো। কোটটা পরে এই পুরনো জামা এড়াতে চাইতাম। আমি জানিনা আর কারো এমন হয় কিনা। এই কোটে আমার খুব সাহস হয়। এই কোট পরলে নতুন একটা শার্ট কিনতে না পারার, অনেক দিনের পুরনো শার্ট পরার কষ্টটা কেমনজানি লুকিয়ে রাখতে পারতাম। রোজ দিন একই শার্ট পরে অফিস যাওয়ায় কেমন একটা অস্বস্তি হতো। শার্টের উপর এই কোট পরলে সেই অস্বস্তিটা কমে যেত।
কথাগুলো বলে আব্বা কিছুক্ষণ থেমে আবার বলা শুরু করলেন। আব্বা বললেন, হ্যাঁ এই জিনিসিটা শুরুতে আমার খুব শখেরই ছিলো তা বলতে পারিস। সময়ের সাথে সাথে আস্তে আস্তে এটা আমার নিম্ন মধ্যবিত্ত জীবনের অবলম্বন হয়ে গেল। প্রতি বছর টাকা খরচ করে শীতের জামা কেনার সাহস আমার কখনও ছিলনা। তাছাড়া তোদের তখন বাড়ন্ত শরীর। প্রতি বছরই শীতের জামা নতুন করে কেনা লাগে। এছাড়াও আমার যে আরও অনেককিছু প্রয়োজন। সেই প্রয়োজন ভুলে নিজেরটা আমি কখনোই চাইনি। সময় পেরুতে থাকে। মধ্যবিত্ত জীবনের নানাবিদ চাওয়া পাওয়ার তাগিদ দিন দিন বেড়েই গেল। তখন এই কালো কোটটা এড়িয়ে অন্যকিছু কেনা বিলাসিতা হয়ে যায়। আমাদের বিলাসিতা করার সাহস কোথায়। প্রতি বছর এক জিনিস ব্যবহার করতে করতে এই কোট কেমনজানি খুব আপন আপন লাগে। এখন হয়তো একটু আধটু বিলাসিতার সুযোগ আছে কিন্তু ঐ যে, আপন করে নেয়া অবলম্বন কি ছুঁড়ে ফেলতে পারি। মানুষ কি চাইলে তার অবলম্বন ছুঁড়ে ফেলতে পারে? প্রতিটা অবলম্বনের কাছে আমাদের কিছু দায় থাকে। মায়ার দায়, ভালোবাসার দায়। এই দায় এড়িয়ে যাওয়া ভীষণ কঠিন। কষ্ট হয়, সত্যিই ভীষণ কষ্ট হয়। থাকুক না আপন হয়ে। এই অবলম্বনের মাঝে যে আমার সীমাবদ্ধতার অনেক, অনেককিছু জড়িয়ে আছে।
আমি আব্বাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছি। কেন কাঁদছি জানিনা। আব্বার গায়ে থাকা কালো কোটটা থেকে একটা গন্ধ আমার নাকে এসে লাগছে। এই গন্ধ আমার কেনজানি ভীষণ চেনা। আমার শৈশব, কৈশোর আর যৌবনের প্রতিটি অধ্যায়ের গন্ধ যেন এই কোটের গায়ে মিশে আছে। এই কোটের গায়ে মিশে থাকা গন্ধ আমার কাছে ভালোবাসার দায়। আমিও এই দায় আগলে রাখতে চাই অনন্তকাল।
—কালো কোট
——রুহুল আমিন
৪. শিক্ষনীয় গল্প facebook
আব্বার কালো কোটটা আজ ধোয়া হয়েছে। আব্বার একটাই কোট। ত্রিশ বছর আগে আব্বার বিয়েতে নানাজান এই কোট বানিয়ে দিয়েছিলেন। ত্রিশ বছর ধরে আব্বা নিজ হাতে এই কোট ধোয়ার কাজটি করেন। শীতের শুরুতেই আব্বা এই ধোয়ার কাজটি সেরে ফেলেন। তবে মাঝের এক বছর হুট করে আব্বার জন্ডিস ধরা পড়ে। ভীষণ খারাপ রকমের জন্ডিস। জন্ডিস ভালো হতে হতে পুরো শীত এসে গেল বলে আব্বা সেই কোট ধোয়ার কাজটি আর করতে পারলেন না। এই নিয়ে আব্বার সেই কি আক্ষেপ !
আমি বলি, এভাবে বুঝি কেউ কোট ধোয়?
আব্বা বললেন, বাপজান এই সাবান দিয়ে ধোয়ার চেয়ে আর কোন ভালো ধোয়া আছে? লন্ড্রিতে এক কোট ধুয়ে পঞ্চাশ টাকা রেখে দেয়। তার চেয়ে আমার এই সাবান দিয়ে এক ধোয়ায় বছর পার। পঞ্চাশ টাকার কাজ এক তিব্বত সাবানেই শেষ।
হ্যাঁ, ত্রিশ বছর হতে চললো আব্বা এই কোট আগলে রেখেছেন। বিয়ের সময় নানাজানের কাছ থেকে এই কোট উপহার পেয়ে আব্বা ভীষণ খুশি হয়েছিলেন। তখন নতুন জামাইকে সাফারি স্যুট দেওয়ার একটা রেওয়াজ ছিলো। আব্বা নাকি সাফারি স্যুটের বদলে এই কোট নিয়েছিলেন। আব্বা করেন সরকারি কেরানির চাকরি। আম্মাও সুযোগ পেলেই আব্বার এই কোটের গল্প জুড়ে দেন। আম্মা হাসতে হাসতে বলেন, প্রথম প্রথম গরমেও তোর আব্বা মাঝে মাঝে এই কোট পরে অফিসে যেতেন।
আব্বার বিয়ের বছর তিনেক পর আমাদের এলাকার এক ছোট চাচা আসলেন আব্বার এই কোট ধার চাইতে। উনি নাকি বিসিএসের ভাইভা দিবেন। আব্বা শুনে মহাখুশি। পারলে এই কোট আবার নতুন করে ধুয়ে দেন। কোটের তিন বোতামের একটা ছেঁড়া ছিল। সেই বোতাম আব্বা তুলে রেখেছিলেন আলমারিতে। সেটা আলমারি থেকে বোতাম খুঁজে বের করে কোটে লাগিয়ে দিলেন। সেই কোট পরে ঐ চাচা ভাইভা দিলেন এবং চাকরিও হয়ে গেল। সেই থেকে এই কোটের প্রতি আব্বার নাকি মায়া আরো বেড়ে গেল। আব্বা আরও বেশি যত্ন নেয়া শুরু করলেন।
একবার হলো কী, আব্বার এই কোটের হাতায় কে যেন নেইল পলিশ লাগিয়েছে। এই দেখে আব্বা ভীষণ মন খারাপ করলেন। মন খারাপ করেই অফিস গেলেন। অফিসের কেউ একজন বুদ্ধি দিলো কেরোসিন দিলে নেইল পলিশের দাগ উঠবে। ঐদিন আব্বা সকাল সকাল অফিস থেকে বাসায় ফিরলেন। বাসায় এসে কেরোসিনের বোতল খুঁজে দেখে বোতলে তেল নেই। আব্বা এই বোতল নিয়ে দোকানে গেলেন। তেল নিয়ে এসে এই নেইল পলিশের দাগ তুললেন।
চৈত্র মাসের শেষের দিক। আমি একটা চাকরির ইন্টারভিউ দিতে যাব। আব্বা কোটটা বের করে আমাকে পরিয়ে দিলেন। আমাকে হিসফিস করতে দেখে বললো, গরম লাগছে বুঝি?
আমি কিছু একটা বলার আগেই আব্বা বললো, ব্যাটা একটু গরম লাগলে লাগুক। এই কোট বিসিএস জেতা কোট। হেলাফেলা করিস না। এটা পরে ইন্টারভিউ দিয়ে দেখ কেমন লাগে।
ছোট বেলা থেকে দেখে আসছি শীতের সময় আব্বা এই কোট ছাড়া তেমন একটা ভারী জামা কাপড় পরেন না। বছরের পর বছর শীতের কাপড় উনি এই এক কোট দিয়েই পার করে দিলেন। এমনও হয়েছে আব্বা প্রায় লুঙ্গির সাথে এই কোট পরে বাজারে গিয়েছেন।
হ্যাঁ, আমি বড় হয়েছি। খুব ভালো চাকরি বাকরি করি। ভালো আয় রোজগার করি। এখন অনেককিছু বুঝতে পারি। বুঝতে পারি বলেই একদিন আব্বাকে বললাম, আব্বা এবার নতুন একটা কোট বানিয়ে দেই?
আব্বা আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি একটা হাসি দিয়ে বলেন, এটা দেখতে বুঝি খুব খারাপ লাগে রে?
আমি আমতা আমতা করে বললাম, এটা অনেক পুরনো হয়ে গেল তাই বলছিলাম…
আব্বার তার গায়ে থাকা সেই পুরনো কোটটার পকেটে হাত ঢুকিয়ে একটা বড় নিঃশ্বাস নিলেন। তারপর সেই নিঃশ্বাস ছেড়ে দিয়ে বললেন, ব্যাটা, পুরনো অনেক কিছু চাইলেও পাল্টানো যায় না। এই পুরনোর মাঝে অনেক কিছু আটকে আছে। বলতে পারিস এটা আমাদের একটা অবলম্বন। আমাদের মত নিম্ন মধ্যবিত্তরা এই অবলম্বন এড়াতে পারে না। আমিতো খুব ছোট একটা কেরানীর চাকরি করতাম। শার্ট প্যান্ট হাতে গোনা। দুটো শার্ট মাত্র। তাও আবার অনেক পুরনো। কোটটা পরে এই পুরনো জামা এড়াতে চাইতাম। আমি জানিনা আর কারো এমন হয় কিনা। এই কোটে আমার খুব সাহস হয়। এই কোট পরলে নতুন একটা শার্ট কিনতে না পারার, অনেক দিনের পুরনো শার্ট পরার কষ্টটা কেমনজানি লুকিয়ে রাখতে পারতাম। রোজ দিন একই শার্ট পরে অফিস যাওয়ায় কেমন একটা অস্বস্তি হতো। শার্টের উপর এই কোট পরলে সেই অস্বস্তিটা কমে যেত।
কথাগুলো বলে আব্বা কিছুক্ষণ থেমে আবার বলা শুরু করলেন। আব্বা বললেন, হ্যাঁ এই জিনিসিটা শুরুতে আমার খুব শখেরই ছিলো তা বলতে পারিস। সময়ের সাথে সাথে আস্তে আস্তে এটা আমার নিম্ন মধ্যবিত্ত জীবনের অবলম্বন হয়ে গেল। প্রতি বছর টাকা খরচ করে শীতের জামা কেনার সাহস আমার কখনও ছিলনা। তাছাড়া তোদের তখন বাড়ন্ত শরীর। প্রতি বছরই শীতের জামা নতুন করে কেনা লাগে। এছাড়াও আমার যে আরও অনেককিছু প্রয়োজন। সেই প্রয়োজন ভুলে নিজেরটা আমি কখনোই চাইনি। সময় পেরুতে থাকে। মধ্যবিত্ত জীবনের নানাবিদ চাওয়া পাওয়ার তাগিদ দিন দিন বেড়েই গেল। তখন এই কালো কোটটা এড়িয়ে অন্যকিছু কেনা বিলাসিতা হয়ে যায়। আমাদের বিলাসিতা করার সাহস কোথায়। প্রতি বছর এক জিনিস ব্যবহার করতে করতে এই কোট কেমনজানি খুব আপন আপন লাগে। এখন হয়তো একটু আধটু বিলাসিতার সুযোগ আছে কিন্তু ঐ যে, আপন করে নেয়া অবলম্বন কি ছুঁড়ে ফেলতে পারি। মানুষ কি চাইলে তার অবলম্বন ছুঁড়ে ফেলতে পারে? প্রতিটা অবলম্বনের কাছে আমাদের কিছু দায় থাকে। মায়ার দায়, ভালোবাসার দায়। এই দায় এড়িয়ে যাওয়া ভীষণ কঠিন। কষ্ট হয়, সত্যিই ভীষণ কষ্ট হয়। থাকুক না আপন হয়ে। এই অবলম্বনের মাঝে যে আমার সীমাবদ্ধতার অনেক, অনেককিছু জড়িয়ে আছে।
আমি আব্বাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছি। কেন কাঁদছি জানিনা। আব্বার গায়ে থাকা কালো কোটটা থেকে একটা গন্ধ আমার নাকে এসে লাগছে। এই গন্ধ আমার কেনজানি ভীষণ চেনা। আমার শৈশব, কৈশোর আর যৌবনের প্রতিটি অধ্যায়ের গন্ধ যেন এই কোটের গায়ে মিশে আছে। এই কোটের গায়ে মিশে থাকা গন্ধ আমার কাছে ভালোবাসার দায়। আমিও এই দায় আগলে রাখতে চাই অনন্তকাল।
—কালো কোট
——রুহুল আমিন