শিশিরের আদ্র পর্ব ১৬
#Neel
মির্জা আব্বাস বলতে শুরু করল।
মির্জা – ঘটনা আজ থেকে এক প্রজন্ম আগে। চৌধুরী বাড়ির বড় ছেলে আহনাফ চৌধুরী, যে খেলা শুরু করেছিল। আমার বংশে , আমাদের বংশে ও একমাত্র মেয়ে ছিল আমার বোন। সকলের প্রান, সকলের কলিজা। কিন্তু কি হলো? সব শেষে সবাইকে কাঁদিয়ে চলে ই গেল না ফেরার দেশে। আমি, এমন এক হতভাগা ভাই , বোনের বিরহের কথা আমি বিন্দুমাত্র ও টের পাইনি।
আমি আর আহনাফ (আদ্রের বাবা) ছিলাম বন্ধু। কলেজ লাইফ থেকে ই বন্ধুত্ব। আহনাফ ছিল শান্ত, বুদ্ধিমান ,চতুর ও। শেষে একই ভার্সিটিতে উঠে বন্ধুত্ব আর ও গাঢ় হয়ে গেল। যেহুতু আমরা বন্ধু,সেই সুযোগ এ আহনাফ এর আমাদের বাসায় আনাগোনা ছিল। আমার একমাত্র বোন ছোটো থেকেই বডিং এ পড়াশোনা করতো। সে বার ছুটিতে বাসায় এলো । (রাইটার -নীল)আহনাফ ও ছিল সুন্দর মনের অধিকারী। যেকোনো মেয়েই ওর প্রতি ওর ব্যবহার এ আকৃষ্ট হতো। ভার্সিটিতে,কলেজে ওর পিছনে মেয়েরা জোঁকের মতো লেগে থাকতোই।এদের মধ্যে আমার ছোট বোন একজন। আমি জানতাম না আহনাফ আগে থেকেই কাউকে ভালোবাসত। জানব কি করে, আহনাফ চুপচাপ আর কথা কম বলত, সহজে কোন কিছু প্রকাশ করতো না।
একদিন আহনাফ বাসায় এলো , সেদিন বাসায় কেউ ছিলো না, ঐ সুযোগ এ আমার বোন আহনাফ কে প্রোপজ করে। কিন্তু আহনাফ আমার বোন কে রিফিউজ করে ।
এই ঘটনা টা যদি আহনাফ সেদিন ই আমার সাথে শেয়ার করতো , তাহলে আজ এ দিন দেখতে হতো না। আমি জানতাম না সে দিন কি হয়েছিল। সেদিন আমার বোন কাঁদতে কাঁদতে আমাকে সব বলেছিল।তারপর আমি আমার বোন কে নিয়ে আহনাফ এর কাছে যাই, দু হাত পেতে আমাদের বন্ধুত্ব রক্ষা করার কসম ও দেই , কিন্তু তুই ফিরিয়ে দিয়েছিলি আহনাফ চৌধুরী।তারপর ও বাসায় এসেই নিজের রুম বন্ধি করে ফেলে। তারপর আমাদের ছেড়ে চিরতরে চলে গেল। আমি ওকে বাঁচাতে পারি নাই।
এখন ও বলবে, চৌধুরীর দোষ নাই?
আহনাফ চৌধুরী – হা, আমার কোন দোষ নেই। ভুল একটা ই করেছিলাম, সেদিন তোকে তোর বোনের পাগলামি সম্পর্কে না বলে ।
সেদিন তোরা বাসায় ছিলি না, ঠিক আছে। কিন্তু তার ও সপ্তাহ আগে তোর বোন আমাকে প্রোপজ করেছিল। আমি সেদিন তোর বোন কে বোঝাই, সে ছোট মানুষ, আবেগের বশে এটা করছে। আমার প্রতি এটা শুধু মাত্র ই এটাকটিভিটি। আর কিছু নয়।
কিন্তু, সেদিন তোর বোন লিমিট ক্রস করে ফেললো। বাসার কেউ নেই, আমার সামনে ছিঃ ছিঃ বলতে ও আমার লজ্জা করে। বাধ্য হয়ে ওকে সেদিন চর দিয়েছিলাম।আর বলেছিলাম আমি অন্য কাউকে ভালোবেসি। সত্যি অর্থে আমার বিয়ে আগে থেকেই ঠিক করা ছিল বাবার বন্ধুর মেয়ের সাথে। আর ওকে আমি ভালোবাসতাম ছোট থেকেই। তুই তোর বোনকে নিয়ে এলি, আমি কি করে আমার ভালোবাসা বিসর্জন দিয়ে তোর বোনকে বিয়ে করতাম। বল একবার।
মির্জা – জানি না। তবে এর জন্য তুই দায়ী। তুই তারপর একবার ও খোঁজ নিয়েছিলি? কি হয়েছিল তার পর থেকে।বোন মারা গেল। সেই শোক আমার মা মেনে নিতে পারে নাই। সপ্তাহ পর মা মারা যায়। মা চলে যেতেই বাবা ও দূর্বল হয়ে পরে। বাবা ও আমাকে ছেড়ে চলে যায়। মির্জা বাড়ি শ্মশান ঘাটে পরিনত হয়। ঐ বাড়িতে আমি একা কত চিৎকার কান্না করেছি। কেউ ছিলো না, কেউ। শেষে মামা,সে এসে আমাকে জোর করে বাহিরে নিয়ে যায়।
তাও বলবি তোর দোষ নাই চৌধুরী?
আদ্র- উমম। এটুকু জানি আমি। তার পরে বলো? যেটা আমি তো জানি, কিন্তু দুনিয়ায় চোখে আড়াল করে রেখেছো?
মির্জা থমকে গেল। আমতা আমতা করে বলল – আ আর কি কি? আ আর কিছু নয় তো…
আদ্র – এরেএএএ আমার গার্ল গার্ড লিডার, মির্জা মেয়ের গলাটা দুখন্ড করে দে না। কত দিন রক্ত দেখি নাই।
মির্জা নাআআ বলে চিৎকার করে উঠলো। বলল- আমি বলছি, সব বলছি। প্লিজ আমার মেয়েকে কিছু করো না। আমার পাপের শাস্তি ওকে দিও না।
মির্জা – আমি ফিরে আসি ৫ বছর পর। এতো দিন এ আহনাফ বিয়ে করে ফেলেছে।১ টা ছেলে আছে ৪ বছরের। আর আহনাফ এর বউ গর্ভবতী ছিল। ২ য় বাচ্চা আসবার অপেক্ষায় সবাই। সেদিন রাতে, আহনাফ এর বউ যখন ইমার্জেন্সি তে, তখন আমি আমার সুযোগ পেয়ে যাই।
এই আহনাফ এই মেয়ের জন্য আমার বোন কে রিফিউজ করে তাই , সেদিন ডা কে কিনে নেই। শুরু করি মৃত্যু খেলা। সেদিন আহনাফের স্ত্রী ২ য় বার পুত্র সন্তানের জন্ম দেয়। আমি সেদিন ভুল করে ফেলেছিলাম। সন্তান টা কে কিছু না করে। তবে ডা কে আহনাফ এর স্ত্রীর শরীরে ভাইরাস ইনজেক্ট করার পারমিশন দেই। যার ফলে দেড় দুই ঘণ্টার মধ্যে ই ইন্টার্নাল ব্লিডিং হয়ে আহনাফ এর বউ মারা যায়।(রাইটার -নীল)
কিন্তু ডা সেদিন এর দোষ টা আহনাফ এর গাড়ে ফেলায়। আহনাফ এর বউ ২ য় বার বাচ্চা নেওয়ার যোগ্য ছিল না, ঠিকঠাক মতো খেয়াল রাখে নাই,তাই মারা গেছে।
আমি মনে করেছিলাম এতে আহনাফ এর পরিবারে ফাটল ধরবে। তাছাড়া আমি সেদিন ইমার্জেন্সি তে এব্রোড চলে গেছিলাম। তারপর খোঁজ নেই নি।
৯ বছর পর আবার ফিরলাম। ততদিনে আমি ও সংসার শুরু করেছি। বিয়ে করেছি মন্ত্রীর বোন কে।
ফিরে নিজের বাড়িতে এলাম। কিন্তু সেই হারানো ফিলিং আবার ও জেগে উঠলো। ঘুমোতে পারতাম না। আমার বোন যেন চিৎকার করে কাঁদত । ঐ আওয়াজ পেতাম। আবার ও চৌধুরী বাড়ির উপর নজর দিলাম।
কিন্তু, সেদিন আমি খুবই অবাক হয়েছি। আমি তো আহনাফ এর স্ত্রী কে মেরে ফেলছি। কিন্তু সেখানে আমি আহনাফ এর স্ত্রী কে জীবিত দেখে চমকে উঠি। প্রতিশোধ আবার ও জেগে উঠলো। সেদিন রাতে মি. চৌধুরী (আহনাফ এর দাদা) বাড়ি ফিরছিল।এই সেই , যার জন্য আমার বোন আহনাফ কে পায় নি। সেদিন ইচ্ছে করে গাড়ি ও রাস্তায় থামাতে বাধ্য করি। তারপর আমি সেখানেই দুজন বৃদ্ধ আর ড্রাইবার কে খুন করি। শান্তি পেয়েছিলাম, অনেক। ঐ ঘটনা আমি, মিথ্যা ছরিয়ে দেই আমার লোক দিয়ে। যে দূরবিত্ত রা খুন করেছে, টাকার লোভে।
কিন্তু, তুমি ছেলে, কীভাবে জানলে?
আদ্র – গার্ড, একে বন্ধি করো । তারপরের হিসাব আমি ও মিলাতে পারি নাই, এখন মনে হয় পেয়ে গেছি। মিসেস চৌধুরী(আদ্রের মা) আমাকে তারপরের ঘটনা বলবেন?
আদ্রের মা- বাবা তুই কি আমাকে কখনোই মা বলে ডাকবি না? আমার দোষ টা কি বলবি? তোর মাকে তো আমি খুন করি নি বরং আমি আমার জীবনটা তোদের নামে উৎসর্গ করেছি তাও আমাকে খুন করে ফেলবি ,বাবা।
আদ্র – তুমি কি আমার ডায়েরি পড়েছো?
আদ্রের মা- সেদিন আমি অশিকে তোমার রুম থেকে ভয়ে দৌড়ে বের হতে দেখি । তারপর তোমার রুমে যাওয়া খেয়াল করে তোমার পিছু নেই। আমি সেদিন তোমার ডায়েরিটা রাখতে দেখেছিলাম। তোমার অগোচরে আমি ডায়েরিটা নিয়েছিলাম, সব কিছু পড়েছি। খুব অবাক হয়েছি জানিস বাবা, তুই তো আমাকে মা বলেই মানিস না।
সেদিন তোর মা তোকে জন্ম দেওয়ার ঘন্টা দুইয়েক পর মারা গেল। ছোট্ট তুই মায়ের স্বাদ টা ও পেলি না। আমি আর তোর মা দুবোন আমরা জমজ। আইডেন্টিফাই জমজ। আমাদের বাহিরে থেকে দেখে কেউ ই বুঝতে পারবে না,আমরা আলাদা। তবে আমরা ভিতরে আলাদা। আমি ছোট থাকতে একটা অপারেশন এ মা হওয়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলি। কিন্তু আমার বোন নয়। আমি মামা বাড়ি থেকে পড়াশোনা করতাম।আর ও বাসায় থেকে।ও মারা গেল। আহনাফ পাগলের মতো হয়ে গেল। আমি একথা শুনে নিজ বাসায় ফিরি। আয়ান সেদিন আমাকে দেখে দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরলো। মা বলে ডাকলো। আমি যেন মা হওয়ার স্বাদ পেলাম। আহনাফ ও আমায় দেখে কিছুটা ঠিক হচ্ছিল। আমি আদ্র কে দেখবাল শুরু করলাম।
১ বছর তোদের মা হয়ে আমি খেয়াল রাখলাম। আহনাফ এর বয়স কি হয়েছিল তখন। আর অন্যদিকে আমি কখনো মা হতে পারব না, তাছাড়া আদ্র আর আয়ান আমি ছাড়া থাকতে পারবে না, তাই সবার পরামর্শ অনুযায়ী আমাদের বিয়ে হয়।
তখন থেকেই আমি তোদের মা হওয়া শুরু করি। কিন্তু হলাম কই।এখবর বড় রা জানলে ও ছোট রা কেউ জানতো না। আজ থেকে সবাই জানবে।মাসি মাসি ই থাকে। মাসি কখনো মা হতে পারে না।( বলেই কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন)
আদ্র ভাইয়া দৌড়ে মাই এর পা দুটো ধরে কান্না করে দিল।আর বলল- আমাকে মাফ করে দাও মা। আমি তোমার ছেলে। ছেলের উপর মা কখনো রাগ করতে পারে।
মাই চোখের পানি মুছে আদ্র ভাইয়া কে জড়িয়ে ধরে।
আদ্র- সেদিন তুই মির্জা শুধু আমার দাদাকে খুন করিস নাই সাথে আমার নানাকে ও খুন করেছিস। ভাবছিস এগুলো আমি কীভাবে জানলাম। আসলে আমি গত কয়েক বছর ধরে পুরোনো হিস্ট্রি চেক করেছি। আর হইলো ডা, ঐ ডা এর কাছ থেকে ই আমি সব কিছু খবর নিয়েছি আমার ভাবে। আদ্র ইস্টাইলে (বাঁকা হেসে)
মির্জা আব্বাস এর চোখ বড় বড় হয়ে গেল। অস্ফুট স্বরে বলল – তাহলে তুমি তুমি ই সেই। তুমি মা….
আদ্র – গার্ড, খেলা খতম। (চোখের ইশারায়) নিয়ে যাও ওকে। (গার্ড রা মির্জা আব্বাস কে নিয়ে গেল)
পরিস্থিতি স্বাভাবিক। মির্জা আব্বাস এর মেয়েকে তার আত্মীয় স্বজন এর কাছে ছেড়ে, সেখান থেকে আমরা সবাই বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম।
ভয় করছে। আদ্র ভাইয়া এতো টা হিংস্র। খুবই ভয়ংকর। আমার কল্পনা থেকে ও। এখনো মাকে জড়িয়ে ধরে আছি।
বাসায় আসতেই আরেক ঝটকা যে খাব তা কি করে জানতাম। আদ্র ভাইয়া মাইকে কি যেন বলল, তারপর গাড়ি নিয়ে চলে গেল।
বাসায় ঢুকেই নাহিদ ভাইয়া আর মোবাইল এর সে মেয়েটিকে দেখতে পেলাম। আরে এটা তো স্নেহা আপু। আদ্র ভাইয়ের মনের ভয় কেটে গেল। দৌড়ে গিয়ে স্নেহা আপুনি কে জড়িয়ে ধরলাম। পরিবারের সবাই তাদের সাদোরে গ্রহণ করে নিল। মনে মনে আদ্র ভাইয়াকে ধন্যবাদ ও দিলাম।
রাত ১১ টার উপর বাজে। বড়রা রুমে চলে গেল। ছোট রা বাসর ঘর সাজাচ্ছে। মনে মনে ফন্দি আটলাম। আমি তাদের সাথে থাকলে কম টাকা পাব। স্নেহা আর সুমাইয়া আপুকে ঘরে বসানো হয়েছে। এই তো সুযোগ। আমি সিঁড়ির উপর বসলাম। নাহিদ আর নিজাম ভাইয়া ঘরে যাবে ।
নাহিদ – ঘরে যেতে দিবি না? এভাবে বসে আসিছ।
আমি বললাম – টাকা দাও , ঘরে যাও। না হলে যেতে দিব না।
নিজাম আর নাহিদ ভাইয়া হেসে দিল। বলল – আজ তোর জন্য আমরা এতো বড় বিপদ থেকে বেঁচেছি। কত চাই?
বেশ না ৫০ হাজার। দুজন ২৫/২৫ করে দাও।
দাও।(হাত টা পেতে, বাচ্চা ফেইস করে)
নাহিদ আর নিজাম ভাইয়া একসাথে ৫০হাজার ?(চিৎকার করে)
তাদের চিৎকার শুনে সবাই রুম থেকে বেরিয়ে এলো। সাথে বড়রা ও। দরজার সামনে থেকে একজন বলে উঠল….
চলবে…