বরকে একটা ঘড়ি উপহার দিয়েছিলাম । বড় দুলাভাই আর আপা বেড়াতে এসে ওর হাতে ঘড়িটা দেখেই অনেক প্রশংসা করলেন ।
বড় আপা ভেতর ঘরে ডেকে নিয়ে খুব পিড়াপিড়ি করলেন দামটা জানার জন্য ,
– বল না রিনা কত পরল ঘড়িটা ।
বললাম ,
– আপু বুঝতেই তো পারছো নন ব্র্যান্ডেট, তোমার ধারণার থেকেও অনেক কম দামী । ওটা তোমাদের লেভেলের জিনিসই নয় ।
তবুও আমাদের কাছে দামের চেয়েও দামী ।
– আচ্ছা তা বেশ তো তুইই কি খালি তোর বর কে এটা সেটা গিফ্ট করিস না কি সেও কিছু দেয় তোকে ?
– তুমি তো জানো আপু আমাদের নুন আনতে পানতা ফুরায় দশা তাই আমরা একজন আরেকজনকে এমন কিছু উপহার দিতে চেষ্টা করি যেটা আমাদের পরষ্পর খুব জরুরি , একটুও বিলাসিতা নয় ।
নাইমের ঘড়ি পরা ছাত্রজীবন থেকেই অভ্যেস আগেরটা নষ্ট হয়ে যাওয়ায় বেচারা মোবাইল বের করে সময় দেখতো । বাসায় যখন থাকে ভুল করে হাত ঘুরিয়ে সময়
দেখত । ঐ যে বললাম অভ্যেস তাই প্রতিমাসের আমার বেতনের টাকা জমিয়ে জমিয়ে ঘড়িটা কিনে দিলাম ।
গতমাসে আমার জন্মদিনে ও আমাকে দুটো সুতির থ্রিপিস দিয়েছে আমার অফিস করতে বরাবরই দরকার হয় তো ।
– তাই বলে কি নিজের বোনের কাছেও বলা যায় না ঘড়িটার দামটা !
– সাতশ টাকা ।
– কি বলিস ! ঘড়িটার দাম মাত্র সাতশ টাকা ?
– হাঃ হাঃ হাঃ
আপুর এই কথা শেষ হতে না হতেই প্রচণ্ড অট্টহাসি শুনতে পেলাম , ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি বড় দুলাভাই ঘরের দরজায় কখন যেন এসে দাঁড়িয়েছেন আর আমাদের কথা শুনছেন , আপু আর আমি কেউ তা খেয়াল করিনি ।
দুলাভাইয়ের মুখে তখনও সেই তাচ্ছিল্যের হাসিটা ঘোরাফেরা করছে ।
উনি আবার শুরু করলেন :
– তাই তো বলি ! আমার শালীকার টাকায় যখন কেনা তখন ঐ রকম দামেরই হবে ।
হঠাৎ মনে হলো নাইম আবার শুনে না ফেলে !
বড় দুলাভাইকে নাইমের কথা জিগ্যেস করতেই বললেন :
– তোমার জামাই এখন মেয়েদের মতো টেবিল পরিষ্কার করছে ।
আমি মানা করতেই কি বলল জানো ,
” দুলাভাই , রাতের খাওয়ার পর টেবিলটা আমিই পরিষ্কার করি । আমরা দুজনেই তো বাড়ির বাইরে কাজ করি তাই ঘরের কাজে রিনাকে যতটুকু পারি সাহায্য করার চেষ্টা করি ।
আপু বলল ,
– শেখো শেখো , নাইমের থেকে , তুমি তো আমাদের বিয়ে বার্ষিকীর তারিখটাই মনে রাখতে পারো না ।
দুলাভাই আপুর সে কথায় ভ্রুক্ষেপ না করে বললেন :
– জানো রিনা , তোমার বড় আপু আমাকে যে ঘড়িটা দিয়েছিল সেটার দাম ছিল দেড় লাখ টাকা । আমি নিজেই তুলেছিলাম ট্যাগটা ।
– নাইম ততোক্ষনে সবার জন্য কমল পানীয় নিয়ে
এসেছে । সবাইকে গ্লাস দিয়ে বসল খাটের পাশের চেয়ারটায় , বলল,
– কি নিয়ে কথা বলছ তোমরা ?
আমরা ঘড়ি নিয়ে কথা বলছি , বলল দুলাভাই ।
– জানেন দুলাভাই ! আমার ভাবতেই অবাক লাগে যে আমার বউ তার নিজের উপার্জনের টাকায় আমাকে কিছু উপহার দিতে পারে । বলল নাইম ।
বড় আপু কি যেন ভাবছিল , খুব অন্যমনস্ক দেখাচ্ছিল তাকে । আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
– আমি খুব ভালো ছিলাম পড়াশোনায় । খুব শখ ছিল পড়াশোনা শেষ করে অন্তত কিছু একটা করব । নিজের পায়ে দাঁড়াবো পছন্দের মানুষের জন্য উপহার কিনব । কিছুই হলো না তোর দুলাভাই আমাকে অনেক নামি দামী জিনিস উপহার দেয় , আমার কোন অভাব সে রাখেনি ঠিকই তবে সেটা তার দৃষ্টিতে । এই যে বিয়ের পর আমার পড়াশোনা বন্ধ করে দিলো তখন থেকেই আমি অর্ধশিক্ষিত রয়ে গেলাম ! ছেলে হলো তারপর মেয়ে হলো তারা সবাই উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে পাড়ি জমালো । মানুষটা সারাদিন নিজের আয় উপার্জনের পিছু ধাওয়া করে । আমি তার কাছে শুধু একটু সময় আর একটু সঙ্গ উপহার চেয়েছিলাম । বড় আশা ছিল সে আমাকে মূল্যায়ন করবে । বাবুর্চির রান্না নয় আমার রান্নার স্বাদ চিনবে ।
আমি তাকে যা দেই তাও তারই টাকায় কেনা । উপহারের দাম নয় মূল্যটা বুঝতে হয় ।
এভাবে কখনই বড় আপুকে এর আগে বলতে শুনিনি । আজ যদি ও একটা কিছুর সাথে জড়িত থাকত অথবা শুধু যদি পড়াশোনাটাও শেষ করতে পারত তাহলে কখনই ওর মধ্যে এমন হতাশা , হীনমন্যতা আর একাকিত্ব কাজ করতো না । ওর একটা কথা বলার জায়গা থাকত সমাজে , একটা বন্ধুমহল বা একটা ভালো বা নতুন কিছু করার মতো কর্মস্পৃহা থাকত । ও যেসব পার্টিতে যায় সেজেগুজে তারা যে বড় বেশি মেকি । ঐ সমাজের নারীরা টাকার বিছানায় শুয়ে , দামী গাড়িতে চড়ে ওদের মেকি শো অফ নিয়ে মেতে থাকে । তাদের জামাইরা তাদের স্বাধীনতা , আত্মমর্যাদার ডানা ছেঁটে পঙ্গু করে দেয় , তাদের স্বপ্ন আর ভালো লাগাকে কেড়ে নিয়ে তাদের বাধ্য করে ছটফট করা ভুলে অলস , বোকা বন্দী পাখির মতো কর্মহীন উদ্দেশ্যেহীন জীবন বেছে নিতে । বিনিময়ে বউদের উপহার দেয় টাকা দিয়ে কেনা মেকি ফাঁকির ভেলকিময় এক জীবন ।
(শেষ )
#উপহার
#রেজওয়ানা_ফেরদৌস ।