না , আমার শ্বশুরবাড়ী আমার বাবার কাছে কোনও যৌতুক চান নি , আমার শ্বশুর আমার বাবা কে শুধু বলেছেন আপনার মেয়ে যেন ভাল থাকে তার নিজের জন্য ফার্নিচার তো বাবা হিসেবে আপনি দিয়েই দেবেন সে তো আমরা জানি ই আর সমাজে মুখরক্ষার ব্যাপার তো আমার – আপনার দুজনের ই আছে । মেয়ে শরীর ভর্তি গয়না , দামী কাপড়চোপড় , বর এর জন্য দামী পোশাক বাবারবাড়ী থেকে নিয়ে গেলে তার ই তো সন্মান বাড়বে আর তার ফ্যামিলি কে ও সবাই বড় করে দেখবে কী বলেন বেয়াই সাহেব ! সেদিন বাবা কোনও কিছু বলতে পারেন নি শুধুমাত্র আমার মুখের দিকে তাকিয়ে ।
তিন বছরের সম্পর্ক মারুফের সাথে তবু সেদিন আমি বাবা কে বারবার বলেছি বিয়েটা ভেঙে দিতে কারণ আমার ছোট তিন ভাই আছে , তাদের লেখাপড়া তাদের ভবিষ্যৎ তো আমাকেও ভাবতে হবে, আমি স্বার্থপরের মতো নিজের ভালোবাসার জন্য নিজের ফ্যামিলিকে পথে বসাতে পারি না । কিন্তু আমি বাবার খুব আদরের মেয়ে তাই সেদিন বাবা কোনও ভাবেই চান নি আমার বিয়েটা ভেঙে যাক তাই ইন্ডিরেক্টলি চাওয়া তাদের সকল উপকরণ দিয়ে , আটশো বরযাত্রী খাইয়ে আমাকে বিয়ে দেন । তবে কষ্ট লেগেছিল মারুফ হাসানের কথা ভেবে । তিন বছর ধরে যে মারুফ কে ভালোবেসে এসেছি সে একটিবারের জন্য ও তার বাবার অন্যায় আব্দারের প্রতিবাদ করলো না বরং প্রতিটা ক্ষেত্রে সে তার ফ্যামিলির সাথে মৌন সম্মতি জানিয়েছে ।
আমরা ভেবেছিলাম হয়তো ফার্নিচার আর গয়না পেলেই তারা আমাকে সঠিক মর্যাদা দেবে কিন্তু ভুল । যারা একবার কারও কাছে চেয়ে খেতে পারে তাদের চক্ষুলজ্জা বলে কিছু থাকে না , যতোই তাদের থাকুক অন্যের টা চেয়ে খাওয়াটা তাদের রক্তে মিশে থাকে ।
বিয়ের দুমাস পরেই জ্যৈষ্ঠ মাস উপলক্ষে সিজনাল যত ফল আছে সাথে বড় বড় কয়েকপদের মাছ , পিঠা , পায়েস সব পাঠাতে হয় আমার বাবাকে । তবে সেসময় আমাকে না জানিয়েই আমার শ্বাশুড়ী আমার মা কে এসব পাঠানোর কথা বলে যেন অন্তত একশজনের হিসেবে করে এসব পাঠানো হয় ।
কদিন পরে রমজানের ঈদ । আমাকে আমার শ্বাশুড়ী ডেকে স্পষ্ট বলে দিলেন ঈদ উপলক্ষে ছেলের শ্বশুরবাড়ির পক্ষ থেকে যেন সবার ঈদের পোশাক আর ঈদের সব বাজার দেয়া হয় কেননা এটা ই তাদের বংশের রেওয়াজ । তিনি আরও বললেন , শোনো শিরিন তোমার ফ্যামিলি যে ধাঁচের তাদের রুচি ও তো সেই রকম ই হবে তাই তোমার বাবা কে বলে দিও যেন কিছু কিনে না পাঠায় বরং সবমিলে পঞ্চাশ হাজার নগদ টাকা দিলেই হবে , তোমার হাভাতে বাবা এর বেশী তো দিতেও পারবে না । বড়োলোকের ছেলে পেয়ে মেয়েকে গছিয়ে দিয়েছে ছোটোলোকেরা ।
খুব কষ্ট হচ্ছিল আমার । আমাকে প্রতিনিয়ত শুনতে হয় আমি হাভাতে ,ফকিন্নি ঘরের মেয়ে অথচ সেই হাভাতে ঘর থেকে আসা ফার্নিচার , ফ্রিজ , এসি , ওয়াসিং মেশিনে জ্বলজ্বল করছে তাদের বাড়ী আর এখন পঞ্চাশ হাজার টাকা চাইছে ঈদ শপিং এর জন্য । কিন্তু আমি কী করে বাবা কে বলবো ! এতো টাকা খরচ করে আমাকে বিয়ে দিলেন এমনকি বিয়ের পর ও ওদের বাড়ীর হাজারও রেওয়াজ মানতে গিয়ে বাবা কে অনেক টাকা ধার করতে হয় যা এখনও পরিশোধ হয়নি । বিয়ের ছমাস ও হলো না এখন কী করে আবার এতো টাকা দেবে আর আমি বা কী করে চাইবো ! কান্নায় বুক ফেটে যাচ্ছে । মারুফ কেন কোনও প্রতিবাদ করছে না ! ও তো আগে থেকেই জানতো আমার ফ্যামিলি কন্ডিশন এমন কী আমি ওর সাথে সম্পর্ক করতে চাই নি শুধুমাত্র ওরা বড়োলোক বলে । কিন্তু এখন মনে হচ্ছে আমি ই কোনও ভিখিরি ফ্যামিলি তে বিয়ে করেছি ।
আমি সেদিন খুব কাঁদলাম আর শেষ পর্যন্ত অনেক ভেবে সিদ্ধান্ত নিলাম , নাহ একদম ই না ওদের এই লোভ , ওদের ভিখিরিপনা কে আর প্রশ্রয় দেয়া যাবে না , প্রয়োজনে আমি সংসার করবো না , আমি চলে যাবো এই সংসার ছেড়ে , নিজে চাকরী করে নিজের লাইফ গড়বো । তাই বাবাকে আমি কিছুই জানাইনি । কিন্তু বাবা আমার ছোট ভাই অরূপ আর লাবু কে নিয়ে সেদিন সন্ধ্যায় হঠাৎ ই আমার শ্বশুরবাড়ী হাজির । বাবার হাতে অনেক শপিং ব্যাগ দেখে বুঝতে বাকি রইলো না যে আমাকে না জানিয়ে এ বাড়ীর জন্য ঈদের কেনাকাটা করে এনেছেন ।
সবাই সেদিন বাড়িতেই ছিল । আমার শ্বশুর আমার আব্বা কে বসতে দিলেন । খুব সৌজন্যের সাথে জিজ্ঞাসা করলেন , বেয়াই সাহেব কী এইবাড়ির জন্য ঈদের কেনাকাটা করে এনেছেন ! আমাকে তিনি প্যাকেটগুলো থেকে কাপড়গুলো বের করতে বললেন । আমি এক এক করে বের করছি আর তাদের সবার এক্সপ্রেশন খেয়াল করছি । কষ্টে বুক ফেঁটে যাচ্ছিল তবু শক্ত থাকলাম । হঠাৎ ই আমার ননদ বলে উঠলো , ছিঃ এসব কাপড় তো এ বাড়ীর ঝি – চাকর রা ও পরে না । আমার আব্বা মাথা নীচু করে ফেললেন । আমার শ্বাশুড়ী বললেন , এতো ফকিন্নি দশা আপনাদের তো মেয়ে বড়োলোক ঘরে পাঠালেন কেন ! আপনার মতো কোনও ভিখিরি বাড়িতেই বিয়ে দিতেন । অরূপ রাগে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল কিন্তু আব্বা ওর হাত চেপে থামিয়ে রাখলেন । অরূপ এর কিছু বলতে চাওয়া টা এই ফ্যামিলি কিছুতেই মানতে পারছিল না তাই আমার শ্বশুর ওকে সরাসরি বাড়ী থেকে বেড়িয়ে যেতে বললেন আর রাগে লাবু , অরূপ দুজন ই বেড়িয়ে গেল । আব্বা ও উঠে যাচ্ছিলেন তখন আমার শ্বাশুড়ী বললেন , শুনুন আপনার মেয়েকে যদি এ বাড়ীর বউ হয়ে থাকতেই হয় তবে আমাদের আচার , রীতি মেনে ই থাকতে হবে । কাল সন্ধ্যার আগে ই আপনারা ঈদের রীতি টা পূরণ করবেন , বিশদ আপনার মেয়ের কাছেই জেনে নেবেন , এবার আপনি আসতে পারেন ।
আমার ধৈর্যের অনেক পরীক্ষা নেয়া হয়েছে আর নয় , আমি সাথে সাথেই জবাব দিলাম । আমার আব্বা একটি টাকা ও আর আপনাদের জন্য দেবে না । লজ্জা করে না ভিখিরীর মতো কারও কাছে চাইতে ! ছিঃ ! এ বাড়ীর বউ হয়ে থাকতেও আমি লজ্জা বোধ করি । আর এক মুহূর্ত ও নয় । আমি এক্ষুনি চলে যাচ্ছি আপনাদের মতো ফকিন্নিদের সংসার ছেড়ে । মারুফ তোমাকে আমি ভুল চিনেছিলাম । এতো নোংরা , লোভী ফ্যামিলির ছেলে তুমি আর নিজেও চরম লোভী , আমার মতো মেয়ের যোগ্য ই তুমি বা তোমার ফ্যামিলি নও । তোমার মতো আত্নসন্মানবোধহীন মানুষের সাথে থেকে নিজের জীবন আর আমার ফ্যামিলির সন্মান বিলিয়ে দেবো না আমি । আমি যাচ্ছি আর কিছুদিনের মধ্যে ডিভোর্স লেটার টা পেয়ে যাবে আর রেডী হও আমার বাবার দেয়া প্রতিটি জিনিস এ বাড়ী থেকে নিয়ে যাবার ব্যবস্থা ও করছি ।
ওরা খুব চাইল আমাকে আটকাতে কিন্তু আমি তো ওদের বলীর স্বীকার হবো না । দুর্বল মেয়েদের মতো এই লোভীদের দ্বিতীয়বার বিশ্বাস করে নিজের জীবন টা অন্তত আমি দিব না । আমি নিজেকে সন্মান করি ।
আত্নসম্মান
রানু মাহবুব ।