“স্বামীর প*রকী*য়ার প্রমাণ পেয়ে ফাঁ*সি নিয়েছে বাড়ির বউ। কিন্তু মা*রা যায়নি। আল্লাহ তায়ালার অশেষ কৃপায় সঠিক সময়ে মেয়ে অানিসা আর পাশের বাসার এক কাকিমা এসে বাঁচিয়ে নিয়েছে।”
খবরটা মুহূর্তের মধ্যেই পুরো মহল্লায় ছড়িয়ে পড়েছে। সব মানুষজন ছিহ্ ছিহ্ করছে। একেকজন তো বাড়ি বয়ে এসে বিভিন্ন বাণীও শুনিয়ে গেছে বউকে।
এইতো পাশের বাসার জলিল কাকার বউ এসে বলে গেল, “স্বামীর অন্য মেয়ের সাথে সম্পর্ক আছে তাই বলে কী ম*রতে যেতে হবে না-কি? পুরুষ মানুষের এরকম একটু-আধটু দোষ থাকেই। মানিয়ে নিতে না পারলে আবার কিসের বউ? আমরা কী কম কষ্ট করে সংসার করেছি? অনেক কষ্টে দিন কেটেছে তবুও এমন ঢং করে মরতে যাইনি।”
আবার আরেকজনকে টিটকারি করে বলতে শোনা যাচ্ছে, “কীভাবে গলায় দড়ি দিয়েছিল গো? এখনো বেঁ*চে আছে কী করে?”
সবকিছুই নিশ্চুপ হয়ে শুনছে লিজা। কিছু বলার মতো শক্তি পাচ্ছে না। কিছু বলতে গেলেই কাশি উঠে যাচ্ছে। তাই চুপচাপ বিছানায় শুয়ে আছে।
ওর সেবার করার মতো একটা মানুষকেও আশেপাশে দেখা যাচ্ছে না। সম্পূর্ণ বাড়িটাই এখন প্রতিবেশিদের দিয়ে ভরা। বাড়ির মানুষজন বলতে শুধু পাশের বাসার সেই কাকিমা যিনি লিজার জন্য লেবুর শরবত বানাচ্ছেন আর ওর ননদ ঈশিতা।
লিজার দশ বছর বয়সী মেয়েটা বিছানায় মায়ের হাত ধরে বসে বসে কাঁদছে। কাঁদতে কাঁদতে চোখ-মুখ লাল করে ফেলেছে একেবারে। হিচকি উঠে গেছে।
লিজা মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে মনে মনে বলে, “তোর জন্যই তো আমার এ পদক্ষেপ নেওয়া। সব ঠিক করে দেব আমি। দেখবি আবার আমরা ভালোভাবে, শান্তিতে বাঁচতে পারবো। রোজ রোজ আমাদের ঝগড়া দেখে তোর যাতে কাঁদতে না হয় তার জন্যই তো আমার এত কষ্ট পাওয়া, তোকে এতটা কষ্ট দেওয়া।”
আবারো মেয়ের চোখ জোড়া মুছিয়ে দিল লিজা। ওর স্বামী আয়মানকে বেশ খানিকক্ষণ আগেই খবর দেওয়া হয়েছে। তার এতক্ষণে অবশ্যই চলে আসার কথা কিন্তু এখনো আসেনি। রাস্তায় যদি জ্যামও থাকে তবুও চলে আসার কথা।
মনের ভেতরের রাগটা হঠাৎ করেই বেড়ে গেল লিজার। ভেবেছে আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করেই চলে যাবে বাপের বাড়ি। মেয়েকে নিয়ে এবাড়ি থেকে চিরতরে বিদায় নেবে। গত কয়েকদিন ধরে অনেক সহ্য করেছে আর না।
ঘন্টা দুয়েক বাদেই লিজা একদম সুস্থ অনুভব করছে। যা করার তার এখনি করতে হবে। রাত আটটা বাজে। এই রাতের বেলায়ই চলে যাবে সে। আর এক মুহূর্তও এখানে থাকবে না। আয়মান এখনো বাড়িতে আসেনি। ওই মহিলার সাথেই আছে নিশ্চয়ই। এতক্ষণে পরিবারের মানুষজনেরা এসেও লিজাকে বিভিন্ন কথা শুনিয়ে গেছে। শেষে এল লিজার শাশুড়ী। তিনি পান চিবাতে চিবাতে বললেন, “গলায় দড়ি দেওয়ার আগে আমাদের সম্মানের কথা একবারো ভাবলি না। পুরো পাড়ার মানুষ জেনে গেছে? সম্মান তো আমাদেরই গেছে।”
লিজা আর এবার চুপ করে থাকতে পারলো না। বেশ তেজ নিয়েই বললো, “আপনার ছেলে অন্য মহিলা নিয়ে ফূর্তি করলে মান-সম্মান যায় না আপনাদের? সব দোষ শুধু ছেলের বউদের। ছেলেদের কোনো দোষই নেই তাই-না?”
লিজার শাশুড়ী আর কোনো কথা না বলে কটমটে চাহনি নিক্ষেপ করে কী যেন বিড়বিড় করতে করতে চলে গেল।
লিজা সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে বিছানা থেকে উঠে একটা ব্যাগ নিয়ে ওর আর আনিসার কিছু কাপড়চোপড় গুছিয়ে নিল। ভাইকে ফোন করে জানিয়ে দিয়েছে। সে বাসস্ট্যান্ডে এসে দাঁড়াবে।
ব্যাগ গুছিয়ে একপাশে রাখতেই দেখে ঈশিতা রুমে এসেছে। অনেকটা ইতস্তত করছে সে।
লিজা নিজেই বললো, “কিছু বলবি ঈশু?”
“তুমি চলে যাবে ভাবী?”
লিজা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, “না গিয়ে কী আর উপায় আছে? আমার আত্মসম্মানের জন্য হলেও আমাকে যেতে হবে। নিজের কথা বাদই দিলাম, আমার মেয়েটার জন্য হলেও যেতে হবে আমাকে। এরকম পরিবেশে কীভাবে বড় হবে আমার মেয়েটা?”
“তুমি ইচ্ছা করে সবাইকে দেখানোর জন্য ফাঁসি নিয়েছিলে। তাই-না ভাবী? আমি দেখেছি তুমি নিজে থেকেই চেয়ার থেকে নেমে দরজা খুলে দিয়েছিলে। কেউ ফাঁসি নিলে তো মরতে চায়। কিন্তু তুমি তো চাওনি। তবে একটু সময় ঝুলে ছিলে। চেয়ারটা পায়ের কাছ থেকে ফেলে দাওনি।”
ঈশিতার কথায় লিজা হাসলো শুধু। আসলেই সে এসব ইচ্ছা করে করেছে। বিয়ের শুরুতে এমনকি কয়েকদিন আগে পর্যন্তও আয়মান তাকে ভীষণভাবে ভালোবাসতো। কিন্তু বেশ অনেকদিন ধরে পরিবর্তন লক্ষ্য করে লিজা। বাড়িতে দেরি করে আসা, ফোন করলে সবসময় ওয়েটিংয়ে পাওয়া, ছোটোখাটো বিষয় নিয়ে ঝগড়া এসব একটু বেশিই ভাবাতো লিজাকে। তাই সে সরাসরিই আয়মানকে প্রশ্ন করে যে এসবের মানে কী?
আয়মান সরাসরি উত্তর দিয়ে দেয়, “আমার জীবনে এখন অন্য কেউ আছে। তোমাকে আর আমার জীবনে দরকার নেই। তুমি চাইলে এভাবেও আমার জীবনে থাকতে পারো। নামেমাত্র বউ হয়ে। আবার চাইলে ডিভোর্স দিয়ে চলেও যেতে পারো।”
তারপর থেকেই শুরু হয় অবহেলা, অত্যাচার। মাঝেমাঝে তো মারধরও করতো। লিজা এতদিন ডিভোর্সের কথা ভাবেনি শুধুমাত্র মেয়েটার কথা চিন্তা করে। কিন্তু যেখানে নিজের সম্মান নেই সেখানে বাকিটা জীবন থাকবে কী করে? মেয়েকে সে একাই মানুষ করতে পারবে।
আগের কথা ভাবতেই চোখের কোণে অশ্রু জমে লিজার। একফোঁটা গড়িয়েও পড়ে। লিজা একহাতে চোখের পানি মুছে ঈশিতাকে উদ্দেশ্য করে বললো, “বুঝলি ঈশু? এটা তোর ভাইয়ের জন্য একটা ছোট্ট পরীক্ষা ছিল। ভেবেছিলাম সে আমাকে এখনো একটু হলেও ভালোবাসে। কিন্তু না। আমি ভুল ছিলাম। তাকে কিন্তু খবর দেওয়া হয়েছিলো অনেক আগে। কিন্তু সে আসেনি। যে আমার মৃত্যুর খবর শুনেও অন্য মহিলা নিয়ে মেতে থাকতে পারে সে আর যাইহোক আমাকে ভালোবাসে না৷ তাহলে এই মূল্যহীন সম্পর্ক রেখে কী লাভ? শুধুমাত্র কী ভাত-কাপড় দিলেই দায়িত্ব পালন হয়? একটু ভালোবাসাই তো চেয়েছিলাম। কতদিন হয়ে গেল আমার মেয়েটাকে সে আদর করে মা ডাকে না। আসার সময় একটু চকলেটও নিয়ে আসে না। আমার মেয়েটা লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদে। আমাকে, আমার মেয়েকে দেওয়ার মতো একটু ভালোবাসাও তার কাছে অবশিষ্ট নেই। তুই চাইলে সবাইকে বলে দিতে পারিস।”
ঈশিতা কান্না করে দিয়ে বললো, “না ভাবী, আমি কাউকে বলবো না। তুমি একবারের জন্য চলে যাবে আমাদের ছেড়ে?”
লিজা দৃঢ়ভাবে বললো, “গেলে একেবারেই যাবো। আর ফিরে আসবো না।” বলেই আনিসাকে জামা পড়িয়ে তৈরি করে দিল। নিজে বোরকা পড়ে ব্যাগ নিয়ে বেরোতে যাবে এমন সময় ওর চাচী শাশুড়ি এসে বললো, “এখন আবার কী নতুন নাটক করেছো? মান-মর্যাদার তো আর কিছু বাকি রাখলে না।”
“আপনাদের মান-সম্মান যাতে আর না যায় সে ব্যবস্থাই তো করছি। আপনাদের ছেলে আসলে বলে দিয়েন যে আমি বাপের বাড়ি চলে গেছি আর সেটা একবারের জন্যই।” বলেই লিজা একহাতে ব্যাগ আর আরেক হাতে আনিসার হাত ধরে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে। কেউ তাকে আটকায় না। শুধুশুধু আটকিয়ে কী হবে? আপদ বিদায় হলেই তো বাঁচে সবাই।
লিজা গেটের সামনে আসতেই দেখলো আয়মান এসেছে।
আয়মান লিজাকে এমনভাবে দেখে বলে, “কোথায় যাচ্ছো তুমি? আর ফোনে কে যেন বলছিল ফাঁসি নিয়েছো। সুস্থ আছো এখন?”
লিজা শান্তস্বরে বলে, “আমার সুস্থতার কথা তোমার না ভাবলেও চলবে মিস্টার আয়মান চৌধুরী। চলে যাচ্ছি আমি তোমাকে মুক্তি দিয়ে। ডিভোর্স পেপার পেয়ে যাবে। আর চিন্তা করো না কাবিনের টাকা দিতে হবে না। অবশ্য আমি আগে ডিভোর্স দিলে তো এমনিতেও দিতে হবে না। কাবিনের দশ লাখ টাকা দিতে হবে ভেবেই তো এতদিন নিজে থেকে ডিভোর্সটা দাওনি। তোমার চিন্তা কমিয়ে দিলাম। আর চিন্তা করো না। আমার মেয়েকে নিয়ে আমি খুব সুখেই থাকবো। অন্তত আত্মসম্মান নিয়ে বেঁচে থাকতে পারবো। তুমিও তোমার প্রেমিকা নিয়ে সুখে থেকো। যতোই হোক তুমি আমার বাচ্চার বাবা, তোমাকে তো আর বদদোয়া দিতে পারি না।”
“তুমি যাচ্ছো যাও। কিন্তু আমার মেয়েকে নিয়ে কোথায় যাচ্ছো।”
লিজা তাচ্ছিল্য হেসে বললো, “তোমার মেয়ে? হাসালে। হতে পারো তুমি জন্মগতভাবে বাবা। কিন্তু আমার মেয়েরও হয়তো লজ্জা হয় তোমাকে বাবা বলে পরিচয় দিতে। আমার মেয়ের দিকে হাত বাড়ানোর চেষ্টাও করবে না।”
আয়মান কিছু বলতে যাচ্ছিলো তার আগেই ওর ফোনে ওর প্রেমিকা কণিকার কল আসে আর ও তার সাথে কথা বলতে বলতে ঘরে চলে যায়। একবারো ফিরে তাকায় না লিজা, আনিসার দিকে।
লিজাও গেট খুলে বেরিয়ে যায় বাপের বাড়ির উদ্দেশ্যে। শেষবার বাড়িটাকে ভালোভাবে দেখে যায়। নিজ ইচ্ছায় আর কখনো আসবে না এ বাড়িতে।
——————
সেই ঘটনার আজ ছয় বছর পেরিয়ে গেছে। আয়মান প্রেমিকার ধোঁকায় নিঃস্ব হয়ে গেছে। কণিকা তাকে ঠকিয়ে সব টাকা-পয়সা নিয়ে গায়েব হয়ে গেছে। তীব্র অনুশোচনায় পুড়ছে আয়মান। লিজার কাছে যাওয়ার আর সাহস করেনি। কীভাবেই বা যাবে? লিজা বাড়ি ছাড়ার একমাসের মাথায়ই তাদের ডিভোর্স হয়ে গেছে।
অন্যদিকে লিজা মেয়ে নিয়ে বেশ সুখেই আছে। বাপের বাড়ি থাকে না লিজা। আলাদা বাসা নিয়েছে। পড়াশোনা কমপ্লিট করেছিল ঠিকই কিন্তু আয়মান চাকরি করতে দেয়নি তখন কিন্তু ডিভোর্সের পর চাকরি যোগাড় করেছে। বলতে গেলে অনেক সুখেই আছে। সম্মানের সাথে বেঁচে আছে। আয়মান নামের কালো অধ্যায়টাকে জীবন থেকে মুছে দিয়েছে। মাঝেমাঝে মনে পড়লে কেঁদে ভাসায় না উল্টো নিজের মনকে আরো শক্ত করে।
সমাপ্ত
আত্মসম্মান
লেখনীতে- সুমনা ইসলাম