পৈত্রিক সম্পত্তির স্বত্বাধিকারী – একটি সামাজিক সমস্যা
বেশ কয়েক বছর আগের ঘটনা। আমার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু হঠাৎ করে উধাও হয়ে গেল তার গ্রামের বাড়ি থেকে। অনেক খুজা খুজির পর পুলিশ তার মৃতদেহ উদ্ধার করল তার গ্রামের একটা পাট ক্ষেত থেকে। তার ঘনিষ্ঠ জনেরা তাকে হত্যা করে লুকিয়ে রেখেছিল ঐ পাট ক্ষেতে। আমার বন্ধুটার আপরাধ – গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিল পৈত্রিক সম্পত্তির মালিকানা নিতে। নিয়তির নির্মম পরিহাস। সম্পত্তি নিয়ে ফেরার কথা ছিল ঢাকায়। কিন্তু ফিরল লাশ হয়ে।
বন্ধুর মৃত খবরটি পত্রিকায় প্রকাশের পর আমার নজরে পড়ল। পত্রিকায় ছবি দেখে নিশ্চিত হলাম ও ছিল আমার বন্ধু।
খুব নীরিহ এবং ভদ্র ছিল আমার এ বন্ধুটি। পড়ত সিভিল ইন্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টে। ওর সাথে দেখা হত বুয়েটের করিডোরে প্রতিনিয়ত। বুয়েট থেকে বের হয়ে একটা ভালো চাকুরি করত মাদারিপুরে। স্ত্রী এবং ছেলে মেয়ে সহ ছিল ছোট্ট একটা সুখের সংসার।
মূর্খজনেরা হয়তো বলবেন, কি দরকার ছিল পৈত্রিক সম্পত্তির উপর লোভ করার। অথবা বলবেন, সামান্য একটু সম্পত্তির জন্য নিজের জীবনটা গেল। হ্যা, এটা সত্য, আমার বন্ধু পৈত্রিক সম্পত্তি দখল নেওয়ার জন্য তার জীবন দিয়েছে। কিন্তু কেউ কি বলেছেন অপরাধীদের স্বাস্তি চাই। অথবা বলেছেন বন্ধ হোক এই ধরনের হত্যা। অথবা কেউ কি এমন কিছু করেছেন যাতে করে আমার বন্ধুর মত ভবিষ্যতে আর কাউকেই এরকম লাশ না হয়ে ফিরতে হয়? এরকম প্রশ্ন মনে হয় আমার মত আরো অনেকের কাছেই আসার কথা প্রতিনিয়ত। কিন্তু হতাশ হই এর প্রতিকার না পেয়ে। ঠিক কিনা?
তবে এটা সত্য যে এ প্রশ্নগুলো, যুগে যুগে প্রশ্ন হিসেবে থেকে যাচ্ছে। বিশেষ করে আমাদের দেশে। সমাধান দিচ্ছেন না কেউ? আর সমাধানের উপায়ই বা কি? হ্যা, অবশ্যই এর সমাধান বা প্রতিকার আছে।
পৈত্রিক সম্পত্তি মানুষের জন্মগত এবং মৌলিক একটি অধিকার।
জাতি, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র এবং দেশ ভেদে এর অধিকার গড়ে উঠেছে সেই প্রাচীন যুগ থেকে। স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা কোরান শরীফের সূরা নিসার মাধ্যমে প্রতিস্ঠিত করেছেন নর নারীর এই অধিকার। অথচ আমরা মানুষ রূপি এই প্রানীগুলো সৃষ্টি কর্তার বিধানকে অমান্য করে, একে অপরকে প্রাপ্য সম্পত্তি থেকে শুধু বন্চিত করে ক্ষান্ত হচ্ছি না। বরন্চ, তাদের জীবন কেড়ে নিয়ে পৃথিবী থেকে অকালে বিদায় করে দিচ্ছি। আমার বন্ধু হচ্ছে তার জাল জ্বলন্ত একটা উদাহর।
গত বছর আমার এক জুনিয়র বন্ধু বেড়াতে এসেছিল কানাডায়। বন্ধুটা পেশায় বাংলাদেশের একজন নাম করা আর্কিটেক্ট। বেশ দাপটের সাথে নিজের আর্কিটেক্ট ফার্ম পরিচালনা
করে। ঢাকায় দাপটের সাথে জীবনে যাপন পরিচালনা করলেও দেশের বাড়িতে গিয়ে পৈত্রিক সম্পত্তির দখল নিতে পায় ভীষন ভয়! আমার এবন্ধু দেশে থাকে। তার হলো এই অবস্থা! আর আমরা যারা বিদেশে থাকি? তাদের যে কি করুন অবস্থা একটু আন্দাজ করুন। আমরা যারা দেশের বাইরে থাকি, আমাদেরকে বলা হয়, বিদেশে থাক, দেশের সম্পত্তি দিয়ে কি করবা? আরে! আল্লাহ কি বলছেন বিদেশে থাকলে সম্পত্তির ভাগ পাবে না? অথবা একজনের আর্থিক অবস্থা ভাল হলে সে পৌত্তিক সম্পত্তির ভাগ পাবে না? কুরআনে বলা আছে সঠিকভাবে বন্টন করার কথা। আর এ বন্টনের সুস্পষ্ট নীতিমালাও দেয়া আছে।
আমাদের দেশে, পৈত্রিক সম্পত্তি থেকে বেশি বন্চিত হয় মেয়েরা। বন্চিত করে একই পিতামাতার ছেলেরা অর্থাৎ নিজের ভাইয়েরা।
মেয়েরা পিতার সম্পত্তির ভাগ নিতে আসলে, অনেক ভাইকে বলতে শুনা যায়, “বাপের সম্পত্তি নিতে এসেছিস ,” তোর উপর আল্লার গজব পড়বে”। আল্লাহর গজব তো ওদের উপর পড়ার কথা যারা বোনকে তার প্রাপ্য সম্পত্তি থেকে বন্চিত করছে। কোরআনে এরকম শাস্তির কথাও সুস্পষ্ট করে বলা আছে।
এখন দেখা যাক, এ ব্যাপারে রাস্ট্রের দায়িত্ব কি? আমি এখন যে দেশে বসবাস করছি সে দেশ, কানাডার প্রসংগে আসি। কানাডা সরকারের কড়া নিয়ম, মৃত্যুর আগে সম্পত্তি কিভাবে ভাগ বটোয়া হবে তা উইল করে রেখে যেতে হবে। আর উইল হতে হবে লিখিত এবং উইলের স্বাক্ষি থাকতে হবে কমপক্ষে একজন। অনেকে উকিলের মাধ্যমে উইল করে থাকেন। আর উইলে যা লেখা থাকবে সম্পত্তি ঠিক একইভাবে বন্টন করা হবে। এর বিন্দুমাত্র নড়চড় হবে না।
আর কেউ যদি উইল না করে মারা যায়, তাহলে, সরকার ঐ মৃত ব্যক্তির সম্পত্তির মালিকানা নিয়ে নিবে মৃত্যুর পর। আর সঙ্গে সঙ্গে কেটে নিবে শতকরা এক ভাগ সম্পত্তির সমপরিমান মূল্য। তারপর সরকার নিয়োগ করবে একজন উকিল। আর এই উকিল খুজে বের করবে মৃত ব্যক্তির ওয়ারিশদের। ১% সম্পত্তির মূল্য, উকিলের খরচ এবং অন্যান্য খরচ বাদ দিয়ে বাকি সম্পত্তি বন্টন করা হবে ওয়ারিশদের মধ্যে। মানুষের মৃত্যুর তো কোনো ঠিক ঠিকানা নেই। সুতরাং এ সমস্ত ঝামেলা থেকে রেহাই পাবার জন্য কানাডিয়ানরা সব সময় উইল রেডি করে রাখে।
আমাদের দেশেও পৈত্রিক সম্পত্তির সুষ্ঠ্য বন্টনের একটি সুনির্দিষ্ট নিয়ম থাকা উচিৎ বলে আমি মনে করি। আর নিয়মের মধ্যে অবশ্যই একটা সময় সীমা থাকা উচিত। যে সময়ের মধ্যেই পৈত্রিক সম্পত্তির ভাগ বটোয়া সম্পূর্ণ করতে হবে। যুগের পর যুগ অথবা বংশ পরম্পরা পৈত্রিক সম্পত্তি ভাগ হবে না, এটা কোনো নিয়মের মধ্যেই পড়ে না। বরন্চ দীর্ঘদিন ধরে ভাগ বটোয়া না হওয়ায়, অনিয়মেরই জন্ম দেয়। যার পরিনাম হতে পারে একজনের মৃত্যু। ঠিক আমার বন্ধুর মতো।
আমরা যারা, পিতা বা মাতা তাদেরই ভূমিকা কি? পিতা বা মাতা হিসেবে আমরা প্রতিদিন দেখছি ভাই এবং বোনের হানিহানি। চাচাতো ভাইদের সাথে বল্লম যুদ্ধ। যার পরিনতিতে কারো মৃত্যু বা জেল এবং জরিমানা। আর এগুলো হচ্ছে পৌত্রিক সম্পত্তি নিয়ে। সম্পত্তির সুস্ঠ বন্টন নিয়ে।
আমাদের আশে পাশের প্রতিদিনের ঘটনায় আমরা কি পেরেছি আমাদের সন্তানদের ঐ সমস্ত হানাহানি থেকে মুক্তি দিতে? সুতরাং এখনই সময়। মৃত্যুর পর সম্পত্তির ভাগাভাগি সন্তানদের উপর ছেড়ে না দিয়ে, মৃত্যুর আগেই সেই ভাগাভাগির কাজটা করে যান। তৈরি করে রেখে যান সন্তানদের ওযারিশনামা অর্থাৎ আপনার সম্পত্তির বন্টননামা। এতে আপনার সন্তানেরা থাকবে শান্তিতে আর পরপারে আপনার আত্মাও পাবে একটু স্বস্তি।
আপনার সামান্য প্রচেষ্টায় সুস্থতা পাক একটা সামাজিক ব্যাধি। এতটুকু প্রচেষ্টা আমার।
ভালো থাকুন। সুস্থ্য থাকুন। এ কামনা করি।
হাসিব খন্দকার