আমার এক চাচাতো ভাই আছে। ও হচ্ছে এক বাপের এক ছেলে। ওর ছয় বোন। ভাইটা সবার বড়। একদিন চাচা হুট করে ওকে বিয়ে করিয়ে দিয়েছেন। তখন অবশ্য ওর বিয়ের বয়সই হয়নি। ঠিকমতো কলেজে যায় না। বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেয়। মোবাইলে মেয়েদের সাথে কথা বলে। সেই জন্য মাত্র বিশ শেষ করে একুশে পড়েছে এমন ছেলেকে শখ করে বিয়ে করিয়ে বউয়ের দায়িত্ব দিয়ে দিয়েছেন।
বউটা বেশ ভালো, সুন্দর, নাদুস নুদুস, পুতুলের মত দেখতে।
বয়সও অল্প, ষোলো কী সতেরো হবে। মাস ছয়েক শ্বশুর বাড়ি থাকার পর মেয়েটা আর বাবার বাড়ি থেকে আসছে না। কল দিলে রিসিভ করে না। বাড়ি গেলে দেখা করে না। ছেলেটা আবার বউয়ের জন্য কাঁদতে কাঁদতে শেষ। অল্প বয়সী ছেলে, বউয়ের জন্য অস্থির হবে, এটাই স্বাভাবিক।
পরে আমার আব্বাসহ ওদের বাড়ি গিয়ে মেয়েকে তার না আসার কারণ জিজ্ঞেস করল।
দুইমাস অনেক চেষ্টা তদবিরের পর সে সবার সামনে এসে তার মুখ খুলল
এভাবে সে শ্বশুর বাড়ি থাকবে না। শাশুড়ি তাকে বউয়ের সম্মান দেয় না। তুই তোকারি করে। অনেকগুলো ননদ। সংসার শাশুড়ির, সেখানে তার একক কর্তৃত্ব চলে। তার পছন্দে খেতে হয়, পরতে হয়, চলতে হয়, বসতে হয়, শুতে হয়। আর এটা এভাবে যুগযুগ ধরে চলতেই থাকবে, কারণ তার ছোট ননদের বয়স তিনবছর। আগেরগুলোর বয়স যথাক্রমে ৫,৭,৯ ১১,১৪, ১৭।
ছোটমেয়েগুলো কোনো কাজ করে না। করার সুযোগও নেই। সবার লেখাপড়া আছে, খেলাধুলা আছে। ঘরের একমাত্র বউ হিসাবে তাকেই সব করতে হয়। অল্প বয়সী বড় ছেলের বউ মানে শাশুড়ির বয়সও কম। সে এই শাশুড়ির অধিনে গিয়ে একসাথে এভাবে সংসার করবে না। করবে না, মানে করবেই না। সবাই মিলে অনেক বুঝিয়েও তাকে শ্বশুর বাড়ি আনতে পারে না।
বছর তিনেক পর বাবার বাড়ি গিয়ে লক্ষীপুর মেয়েটার সাথে দেখা হলো, দুই হাত ভর্তি ক্রোকারিজের জিনিসপত্র, আরও কি কি জেনো।
আমাকে দেখেই হাসল
” আস্সালাম আপু। আমি রুমনের বউ।”
আমি দেখেই চিনতে পেরেছি। আগের চেয়ে বেশ সুন্দর হয়েছে। এখন আর আগের মতো বাচ্চা বাচ্চা লাগে না। তবে মেয়েটার প্রতি এক ধরনের বিরূপ মনোভাব সবার মতো আমারও আছে, তাই কথা বলতে ইচ্ছে করেনি। অথচ জোর করে আমাকে নিয়ে একটা রেস্টুরেন্ট বসাল
” আপা, বাসায় চলেন, কথা বলব, আপনি তো বেড়াতেই বের হয়েছেন। আজ না হয় আমার বাসায় বেড়ান।”
আমি অবাক হয়ে জানতে চাইলাম
” তোমার বাসা মানে?”
” ও আচ্ছা আপা, আপনি হয়তো জানেন না, আমরা কলেজ রোড ভাড়া থাকি। বেশি দিন থাকব না। বাড়ির কাজটা শেষ হলেই উঠে যাব।”
আমার কোনো কিছুই বোধগম্য হলো না। একবাবার এক ছেলের বউ, বাপের কত বড় বাড়ি, কত বড় ঘর। সে এখানে কলেজ রোড় কী ভাড়া থাকে! কেন ভাড়া থাকে?
আমার বাচ্চারা সাথে থাকায় আমি আর ওর বাসায় যাইনি।
বাড়ি গিয়ে আম্মার থেকে জানতে পারলাম। একই বাড়িতে হাত দশেকের ব্যবধানে রমন আট রুম দিয়ে দোতলা ফাউন্ডেশনের এক সুন্দর আধুনিক ঘর করছে।
এখনো কাজ শেষ হয়নি তাই ভাড়া থাকে।
তার বাবার এত বড় ঘর, ও একমাত্র ছেলে। বোনদের বিয়ে দিলে সবাই চলে যাবে, ওকে আলাদা ঘর করতে হলো কেন?
অল্প বয়সী মেয়েটা এমন কী কৌশল করেছে, যে রুমনকে আলাদা ঘর করতে হয়েছে, বাবা মাকে একা রেখে কিছুই বুঝতে পারিনি। অনেকগুলো প্রশ্ন আমার মাথায় ঘুরপাক খেয়ে, আবার মিলিয়ে গেছে।
গত বছর বাবার বাড়ি গিয়ে, ওদের বাড়ি বেড়াতে গেছি। ওরা আমাদের পুরনো বাড়িতে থাকে। ততদিনে রুমনের যমজ দুটো মেয়েও হয়েছে। আমরা ওর ঘরে গিয়ে বসে গল্প করছি, মেয়েটা ভীষণ মিশুক। আমাদের জন্য নাস্তার আয়োজন করল।
গল্প করতে করতে এবার আমাকে বলল
” আপা জানেন! এই পৃথিবীর একটা মানুষ আমাকে ভালো বলেনি। আমাকে পছন্দ করেনি শুধু আপনার ভাই ছাড়া। এই দশ বছর আমি যে কত যদ্ধ করেছি, না শুনলে আপনার বিশ্বাস হবে না।”
আমি হু হা করে চুপ করে আছি। আসলে ওর গল্পটা দীর্ঘায়িত হোক আমি চাইনি।
” জানেন আপা আমি এখন সবার চোখের মনি।”
এত অপছন্দের একজন মানুষ কীভাবে সবার চোখের মনি হয়েছে , জানার জন্য আমি এবার ঝেঁকে বসেছি।
গল্পটা এবার তানিয়ার মুখেই শুনুন।
“আমার শ্বশুর হচ্ছে আমার দাদার পরিচিত। বিয়েটা দাদাই দিয়েছেন। আমি মাত্র নাইনে উঠেছি, বাবার বড় মেয়ে, এত তাড়াতাড়ি আব্বার আমাকে বিয়ে দেয়ার ইচ্ছে ছিল না। অথচ দাদা কথা দিয়েছেন, উনার কথা ফিরানো যাবে না, কোনো কিছুর বিনিময়ে তাই বিয়েটা দেয়া।
আমার আব্বা হচ্ছে আমার দাদার একমাত্র ছেলে। আর দুটো ফুফু আছেন। উনাদের বিয়ে হয়ে গেছে। দাদার আর কোনো ছেলে সন্তান হয়নি। তাই দাদা আব্বাকে শখ করে অল্প বয়সে বিয়ে করিয়েছেন। আমাদের ব্যাবসা,বানিজ্য, জায়গা জমি, সব কিছুর অধিকার আমার দাদীর কাছে। আম্মা ত্রিশ বছর বউ হয়ে এসেও সংসারের অধিকার পাননি। আমার দাদী খেতে দিলেই কেবল আমার মা খেতে পারতেন। না দিলে নাই।
আমার দাদী শুতে যেতে বললে আমার মা ঘুমাতে পারতেন, না বললে নাই। ঘরে আসলে খাবার পাওয়া যেত, সে জন্য আমার বাবা সারা জীবন কোনো কাজ করেননি। বন্ধুদের নিয়ে তাস খেলে আর পাড়ার চায়ের দোকানে আড্ডা দিয়ে জীবন পার করে দিয়েছেন।
আমাদের বাড়ির সব কিছু আমার দাদার, দাদীর। আমার বাবার কিছু নেই।
আমার মায়ের প্রয়োজনীয় সব কিছু দাদা কিনে দিতেন। কারণ টাকা পয়সা সব তার কাছে ছিল।
মা কেবল ভালোবাসার জন্য বাবার কাছে যেতেন।
সারাটা জীবন আমার মা দাদীর সংসারে মাথা নিচু করে বেকার স্বামীর স্ত্রী এই খোটা শুনে জীবন পার করে দিয়েছেন। আমার বিয়ের কয়েক মাস আগে আব্বা খেজুর গাছে থেকে পড়ে পা ভেঙে ফেলেছেন। এখন তিনি হুইল চেয়ারে বসে থাকেন সারাক্ষণ। তিনটা সন্তান জন্ম দেয়া ছাড়া আমার আব্বার পুরো জীবনটাই অর্থহীন।
শেষ পর্যন্ত আমার বিয়েটাও দাদার পছন্দে হয়েছে। এখনো আমার মা দাদীর সিদ্ধান্তের জন্য মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকেন।
আমরা জানি, বিশ্বাস করি, স্বীকার করি আমার বাবার এমন অর্থহীন জীবনের জন্য আমার দাদী -দাদা যতটুকু না দায়ী এর চেয়ে বেশি দায়ী আমার মা।
তিনি যদি শাড়ির জন্য শ্বশুরের কাছে না গিয়ে স্বামীর কাছে যেতেন। কোনো সিদ্ধান্তের জন্য শাশুড়ির কাছে না গিয়ে স্বামীর কাছে যেতেন। বাধ্য হয়ে আমার আব্বা কাজ করতেন, সংসারের দায়িত্ব নিতেন, টাকা আয় করতেন। আমাদের জীবন এমন হতো না। এই বয়সে আমার বিয়ে হতো না। আমার মা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকতেন না। আমার বিয়ের সিদ্ধান্ত আমার দাদা নিতে হতো না। আমার আব্বা এত অল্প বয়সে অসহায় হয়ে হুইল চেয়ারে বসে থাকতেন না।
আমি এই বাড়িতে এসে দেখি, আমার কপালও আমার মায়ের কপালের চেয়ে একচুলও ভালো নয়, বরঞ্চ আরও খারাপ।
রুমন অল্প বয়সী ছেলে। লেখাপড়ায় মনোযোগী না দেখে শ্বশুর বিয়ে করিয়ে দিয়েছেন। বিয়ের পর নিয়ম করে রোজ রাতে সে বউয়ের কাছে আসে আর সারা দিন বাজারে আড্ডা দেয়। সংসার মার, কারণ ওনার মেয়েরা এখনো ছোট। ওদের লেখাপড়া বিয়ে শাদি সব মিলিয়ে জীবনের বহু পাড় ভাঙার, গড়ার বাকি আছে।
এদিকে মা আমাকে উনার মেয়েদের মতোই একজন মনে করছেন। পার্থক্য তারা লেখাপড়া করছে, আমি সংসারে কাজ করছি। সামান্য ত্রুটি হলে তিনি তুই তোকারি করে বকা দেন। আমি ভালো শাড়ি পরলে খুলে রাখতে বলেন, রুমন এখনো বেকার সব এক সাথে নষ্ট করলে কে কিনে দিবে। দুটো ডিম ভাজি করে তিন বছরের তাসপির প্লেটে যে টুকরো দেন, আমার প্লেটেও সে টুকরা দেন।
আমার ভাই এসে কিছু না খেয়ে চলে গেছে। কারণ শাশুড়ি বাড়িতে ছিলেন না।
আমার মনে হলো এভাবে তো চলতে পারে না। আমি শাশুড়ির অধিকার কেড়ে নিতে চাই না। তার নিজের হাতে গড়া সংসার তার কর্তৃত্ব চলবে এটাই স্বাভাবিক।
তাহলে আমি কি? আমার সংসার কোথায়?
চলে গেলাম বাবার বাড়ি। সবার বিপক্ষে গিয়ে নিজের অধিকারের জন্য যুদ্ধ করলাম।
এখন আপনার ভাই বিরাট কম্পিউটারের দোকানের মালিক। আমরা পনেরো লাখ টাকা খরচ করে ঘর করলাম। আমার সংসার আমি করছি, মার সংসার মা করছে। আমি একটু ভর্তাও তাদের ছাড়া খাই না। আপনার ভাই মাছ কিনলেও দুটো কিনে। একটা তাদের জন্য একটা আমাদের জন্য। মায়ের অসুখ হলে আমি সে ঘরের সব কাজ করে দেই।
আমি নিজের হাতে হাড়ি কিনলাম,পাতিল কিনলাম। নিজের পছন্দে ফার্নিচার বানালাম। আমার মেয়েরা আমার ঘরে পায়খানা করে, পেশাব করে, বমি করে। দাদীর সংসারে হলে নিশ্চয়ই সম্ভব হতো না। হয় ওরা বকা শুনতো নয় আমি।
নিঝুমকে আমি পছন্দ করে বিয়ে দিয়েছে। এখন রুমনের জীবনের এমন সুন্দর পরিবর্তনের জন্য সবাই আমাকে বাহবা দেয়।
না হয় আমার বাবার মতো রুমনও পাড়ার মোড়ের চা দোকানে বসে কেবল আড্ডাই দিতো।
আর বছর বছর আমাদের ছেলে মেয়ে হতো। আমি মায়ের সংসারে কেবল মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকতাম।”
ওর গল্প বলা যখন শেষ হলো তখন রাত আটটা। আমি এতক্ষণ একধরনের ঘোরের মধ্যে ছিলাম। হঠাৎ করে আম্মার ডাকে আমার সেই ঘোর কাটল।
জীবন মানুষকে কত কিছু শিখিয়ে দেয়। আর শেখার জন্য বয়স লাগে না। অল্প বয়সেও অনেকে অনেক কিছু শিখতে পারে, শেখাতে পারে।
এই প্রথম আমার আম্মা বলল
” তানিয়া মেয়েটা আসলে অনেক ভালো!”
#জীবনের গল্প
কামরুন নাহার মিশু