অমুক তার বউ বাচ্চা নিয়ে গত রাতে খুব ভালো একটা রেস্টুরেন্টে খাওয়া দাওয়া করেছেন। ফেইসবুকে সেই খাওয়া দাওয়ার ছবি দেখে আমার স্ত্রী বিনুর খুব মন খারাপ হলো।
আমি বলছি না যে, তাদের খাওয়া দাওয়ার ছবি দেখে বিনুর খুব হিংসে হয়েছে। আমি বলছি বিনুর খুব মন খারাপ হয়েছে কারণ অনেকদিন হয়ে গেল আমরা এমন করে কোথাও খেতে যেতে পারছি না। হাসি হাসি মুখ করে ছেলেমেয়ে আর পরিবারের ছবি ফেইসবুকে দিতে পারছি না। চেক ইন দিতে পারছি না। আমাদের সংসার চালাতে হয় খুব হিসেব করে। আমার খুব কম বেতনের চাকরি। এই বেতন দিয়ে সংসার চালাতেই যেখানে ভীষণ কষ্ট হয় সেখানে রেস্টুরেন্ট-ফেস্টুরেন্টে গিয়ে খাওয়া দাওয়ার চিন্তা করাটাও অন্যায়।
বিনুর নাকি খুব মন খারাপ হয়। খুব মন খারাপ। বিনু মন খারাপ করে বসে থাকে। আমি বিনুর দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে হাসি। হাসবোই তো।
কেন হাসছি তা বলছি আপনাদের।
এবার আসুন দেখি, চেক ইন না দিয়ে, ছবি না তুলেও আমার আব্বা আবদুল মজিদ পাটোয়ারী কীভাবে আমাদের সবার মন ভালো করে দিতেন শুধু পাতলা মসুর ডাল খেয়ে।
বাসায় রান্না বান্নার অবস্থা তেমন একটা ভালো না। পাতলা মুসর ডাল আর করলা ভাজি। ছোট ভাই শাহেদ আম্মার মুখের উপর বলে দিল আজ তার খাওয়া লাগবে না। আমারও খিদে নেই। ওমা, ছোটবোন সাথীও দেখি আমতা আমতা করতে করতে বলল, আমি করলা ভাজি খাব না।
আমাদের এমন অবস্থা দেখে আব্বা সবাইকে কাছে ডেকে বসালেন। বললেন, তোমাদের আজ খাওয়ার দরকার নাই। আজ তোমরা সবাই মিলে আমার খাওয়া দেখবে। দেখ, আমি কেমন করে খাই।
আব্বা প্রথমে শুরু করলেন করলা ভাজি দিয়ে। ভাতের সাথে খুব করে করলা ভাজি চটকে নিলেন। সেই চটকানো ভাত গোল্লা করে মুখে দিলেন। আব্বা ভীষণ আরাম করে খাচ্ছেন। আমরা সব ভাইবোন আব্বার দিকে তাকিয়ে আছি। আজ আব্বা খুব আওয়াজ করে চাবাচ্ছেন। মনে হচ্ছে কত শত মাছ মাংস খাচ্ছেন। শাহেদ আব্বার দিকে হা করে তাকিয়ে আছে। এবার আব্বা প্লেটে বেশি করে ডাল নিলেন। আম্মাকে বললেন একটু লেবু কেটে দিতে। আম্মা লেবু দিলেন। আব্বা সেই লেবু ডালের সাথে ভালো করে কচলালেন। আব্বার প্লেট ভর্তি লেবু কচলানো ডাল। আব্বা সুরুৎ সুরুৎ আওয়াজ করে চুমুক দিয়ে ডাল খেতে খেতে শাহেদের দিকে চোখ ইশারা করে বলল, কী রে খাবি নাকি একটু ডাল?
আব্বার খাওয়া দেখে আমাদের সবার জিভে পানি এসে গেল। শাহেদ বলল, মনে হচ্ছে আজ ডাল খুব মজা হয়েছে। আমি খাব।
সাথী বলল, আমিও খাব। একে একে আমরা সবাই আব্বার সাথে করলা ভাজি আর ডাল দিয়ে বেশ মজা করে ভাত খেতে শুরু করলাম। বিথী চুমুক দিয়ে খেতে গিয়ে ডাল হাত ভিজে গড়িয়ে কনুইয়ের দিকে যাচ্ছিল। বিথী জিহবা দিয়ে সেই ডাল চাটছে আর আব্বার দিকে তাকিয়ে হাসছে। আব্বাও হাসছেন। আব্বার হাসি দেখে আমার একটুও মনে হয় নি তিনি কষ্টে আছেন। ওহ, আমার আব্বা সেই ডাল খাওয়ার দৃশ্য কোন ছবি তুলে রাখেন নি। তখন কী আর এই ফেইসবুক-টেইসবুক ছিল নাকি! করলা ভাজি আর ডাল দিয়ে ভাত খাওয়ার দৃশ্য ছবি না তুলেও যতটুকু আবেগ, ভালোবাসা আর তৃপ্তি পেয়েছি তা ছিলো সত্যিকারের। এখন হাজারটা চেক ইন দিয়ে, ছবি তুলে সেই তৃপ্তি পাওয়া যাবে কী না আমার সন্দেহ আছে।
বেনারসী পল্লী থেকে শাড়ি কিনে ছবি দিয়েছে। গাজীপুর রিসোর্টে গিয়ে চেক ইন দিয়েছে। বার্গার কিং এর ইয়া বড় বড় বার্গারের ছবি দিয়েছে। থাইল্যান্ডে নীল পানির সমুদ্র সৈকতে কী সুন্দর করে শুয়ে রোদ পোহানোর ছবি। এত এত এবং এত কিছু আমি দেখছি আর দেখছি। দেখতেই পারি। তারাও ছবি দিতেই পারে। তাদের ভালো লাগার ছবি তারা দিয়েছেন। এতে অবশ্যই, অবশ্যই এবং অবশ্যই খারাপ কিছু দেখছিও না এবং বলছিও না ।
হ্যাঁ, আমি ছবি দিতে পারি নি। আমি পারছি না। আমার সামর্থ্যে নেই। তাই বলে আমি কেন মন খারাপ করে বসে থাকব। আমার কী কোনো অর্জন নেই? আমার কি কোন সুখ নেই?
অবশ্যই আছে। এবং অবশ্যই আছে। কিন্তু আমি আমার সবকিছুকে ম্লান মনে করে অন্যেরটা বিশাল করে দেখছি। আমার এই দেখাটা দিন দিন যেমন আমার অর্জনগুলোকে লুকিয়ে ফেলছে।
ওই যে আমার আব্বা, নিজের ঘরের করলা ভাজি আর ডাল কে যদি অন্যের খাওয়া মোরগ পোলাওয়ের সাথে তুলনা করে হা হুতাশ করতেন তবে ওইদিন না খেয়ে আমরা সবাই উপোষই থাকতাম।
আমি কেন ভাবছি না যে সবাই কখনো পরিপূর্ণ্ সুখী না। বেনারসী শাড়ি কেনা, অমুক জায়গায় চেক ইন দেওয়া সুখী সুখী চেহারার মানুষগুলোরও কোনো না কোন অপূর্ণতা আছে। অপূর্ণতার ছবি নেই, চেক ইন নেই বলে আমরা দেখি না। অপূর্ণতার কষ্ট থাকবেই তবে আমার যা আছে তা আমার সুখ। এই সুখটা শুধু আমার। আর আসার এই সুখটাকে ষ্পর্শ করার জন্য, শুধু আমার মতো হওয়ার জন্য হাজারো মানুষ হা-হুতাশ করছে যার ছবি আমার আড়ালেই রয়ে গিয়েছে। হয়তো……
হয়তো এই মানুষগুলোর অনেক হাসি মুখের ছবি আর চেক ইন দেখে আমি আমার সুখগুলো এড়িয়ে যাচ্ছি। আমি আমার সুখগুলোকে অবহেলা করছি।
নিজের অর্জিত সুখ কে কখনো অবহেলা করতে নেই।
—সুখ
——রুহুল আমিন