আমার ছোট্ট সোনা মেয়েটা তিন বছর পর্যন্ত ‘মা’ শব্দটি পর্যন্ত বলতে পারত না। অথচ তার থেকে গুনে গুনে ১৪ মাসের ছোট ভাইটা সারাক্ষণ অনর্গল কথা বলেই যেত। অর্থবহ পূর্ণ বাক্যে।
বাড়ির সাবাই ছোট ছেলেটাকে নিয়েই মেতে থাকে। আমি তখন মেয়েকে নিয়ে দিশেহারা।
আমার মেয়ে হুমাইরা খুব সুস্থ, সুন্দর, স্বাস্থ্যবান মিষ্টি একটা বাচ্চা। সবার সব কথার সাথে রেসপন্স করে, হাসে, খায়, ভাইয়ের সাথে মারামারি করে দুষ্টামি করে। কিন্তু কথা বলে না। একটু ভুল বললাম, কথা বলে। তবে অর্থহীন কী সব স্বর বের হয় তার গলা দিয়ে কোনো ভাষা বিশেষজ্ঞও সে কথার মানে উদ্ধার করতে পারবে বলে মনে হয়নি।
একটা কথা প্রচলিত আছে ” বোবার কথা বোবার মা বুঝে।”
অথচ মা হয়েও আমি সেটা বুঝতে পারিনি। পরপর দুইবাচ্চার মা হয়ে সাথে বেবি ব্লুজ, পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশনে তো আমি তখন মরিমরি অবস্থা। সে সময়ে আবার নতুন যুদ্ধ শুরু হলো মেয়েকে কথা শেখানো।
অামি যতটা বিচলিত ঘরের কেউ তার বিন্দু পরিমানও বিচলিত নয়। সবার একটাই কথা
” কারো কারো কথা শিখতে দেরি হয়। চিন্তার কিছু নেই। হুমাইরারও দেরি হবে।”
তারপরও অভাগী মায়ের তো চিন্তা পিছু ছাড়ে না। আর কত দেরি হবে, তিনবছর তো হয়ে গেছে আর কত!
সৌভাগ্য হলো সেই সময় আমাকে ঘরের কাজ করতে হয়নি। ছেলেটা তার জেঠিদের কাছেই সারাক্ষণ থাকে। আমি চব্বিশঘণ্টা নাওয়া খাওয়া বন্ধ করে হুমাইরাকে কাউন্সেলিং করি নিজে নিজে।
ওকে আমার মুখোমুখি বসিয়ে ‘মা’ ‘মা’ ‘মা’ এটা টানা কয়েশবার জোরে জোরে উচ্চারন করি। ও নিষ্পলক আমার মুখের দিকে চেয়ে থাকে। ছটপট করে না, বিরক্ত হয়ে উঠে চলে যায় না। কিছুক্ষণ বিরতি দিয়ে আবার শুরু করি। এভাবে দিনের পর দিন চলতে থাকে আমার নিজের সাথে নিজের যুদ্ধ। ইনশাহআল্লাহ পারবে, আমার মেয়েকে পারতেই হবে!
একদিন হঠাৎ আমাকে অবাক করে দিয়ে আমার মুখে মুখে সেও বলল ‘মা’।
আমি মনে হয় একজীবনে এমন সুন্দর, সুরেলা শব্দ আর শুনিনি। বিশ্ব জয় করে ফেলার মতো অানন্দে আমি লাফাতে লাফাতে সারা বাড়ি মাথায় তুলেছি।
সে থেকে শুরু। এটা হলো আমাদের মা মেয়ের খেলা। আমি পনেরো মিনিট ওকে একটা শব্দ অনুশীলন করাতাম। কিছুক্ষণ পরেই হুমাইরা সে শব্দটা বলা শুরু করত। মাস তিনেকের মধ্যেই সে প্রায় শত শত শব্দ শিখে ফেলেছে। তখন আর বেশি সময় লাগেনি। দুই এক মিনিটেই একটা শব্দ শিখে ফেলত। ওর একটা শব্দ শেখা আর আমার এক একটা পৃথিবী জয় করার অানন্দ অনুভব করা।
এবার শুরু করলাম বাক্য শেখানে। সেটা খুব সহজেই শিখে ফেলেছে। প্রথম বাক্য শিখেছে
” আমি মাকে ভালোবাসি।”
সত্যি মেয়েটা আমাকে এমন ভালোবাসে যার তুলনা হয় না। একদিন সময় করে তার ভালোবাসার গল্প লিখব।
আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। সাড়ে তিন বছর চুপ করে থাকা মেয়েটা চব্বিশঘণ্টা কথা বলে। সবার সাথে বলে। অনেক সুন্দর করে গুছিয়ে গল্প করে। কথার পিঠে কথা বলে।
কথা যেহেতু দেরি করেই শিখেছে। তাই আমি হুমাইরাকে স্কুলে খুব তাড়াতাড়ি দেইনি। ৫ বছর ৪ মাসে নার্সারিতে দিয়েছি।
যদিও সে কথা বলতে পারে, পূর্ণবাক্য বলতে পারে। মনে হয় খুব স্মুথলি কথা বলে না। একটু ভেঙে ভেঙে কষ্ট করে বলে।
নতুন শ্রোতার কাছে তেমনই মনে হয়। আমাদের কাছে অবশ্য নয়।
মেয়ের স্কুলে এক অভিভাবক আমাকে বলল
” হুমাইরার কথা বলতে মনে হয় খুব কষ্ট হয়।”
কথাটা খট করে আমার বুকে লাগল। আসলে কি তাই? কই এভাবে তো কখনো ভাবিনি। আবার ওকে স্মুথলি কথা শেখানোর অনুশীলন শুরু করলাম। যে জড়তা ছিল সেটাও ঠিক হয়ে গেল খুব দ্রুতই।
আমাকে অবাক করে দিয়ে আমার সেই মেয়ে স্কুলে কবিতা আবৃত্তিতে তৃতীয় স্থান অর্জন করল।
স্কুলে ভর্তি হলো, মাত্র বর্ণমালা শিখল। আরও শিখবে। হঠাৎ করে স্কুল বন্ধ হয়ে গেল অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য।
ঘরে বসিয়ে আমি পড়াতে পড়াতে আলহামদুলিল্লাহ, সে এখন নির্ভুলভাবে বাংলা পড়তে ও লিখতে জানে।
বাসায় কোনো ব্ল্যাক বোর্ড বা হোয়াইট বোর্ড নেই। তারা ভাই বোন প্রথম প্রথম দেয়ালে লিখত, আঁকত। সেটা শুধু আমার রুমে আর অন্য কোথাও অনুমতি ছিল না।
একটা সময় আমার দেয়াল ভরে যায় তাদের পেন্সিলে আঁকা চিত্রকর্মে। বাধ্য হয়ে চক কিনে আমার রুমে একটা কফি রঙের দুই পাল্লার আলমারি আছে, ওটাতে ওদের লেখার অনুমতি দিলাম।
আমার বাচ্চারা মোড়ায় বসে সেখানে ছবি আঁকে, পড়া লেখে, গল্প লেখে।
একদিন লক্ষ্য করলাম ভুল উচ্চারনে সে তার দাদুকে নিয়ে একটা অর্থপূর্ণ পূর্ণাঙ্গ গল্প লিখে ফেলল। গল্পের চরিত্রের ও নামকরন করল। সবাই অবাক হলেও অামি তেমন অবাক হইনি। কারণ আমি ওকে কথা শেখার আগ থেকে বিভিন্ন গল্প পড়ে ঘুম পাড়াতাম। আমার গল্পগুলো ওকে পড়ে শুনাতাম।
সেই থেকে শুরু। আমি প্রায় ওকে টপিকস সিলেক্ট করে গল্প লিখতে বসিয়ে দেই। সে লাইনের পর লাইন সাজিয়ে কয়েক পাতার একটা অর্থপূর্ণ গল্প লিখে ফেলে।
আমি মুগ্ধ হই। ওর মাঝে সম্ভাবনা দেখতে পাই। আমি নিরবে সৃষ্টকর্তার কাছে ওর জন্য দোয়া করি। এর ফাঁকে ওকে নির্ভুলভাবে যুক্তবর্ণসহ লেখা শিখিয়ে ফেলি
ঈদের দিন রাতে সবাই জেগে আড্ডা দিয়েছে। অথচ আমার মেয়ে একটা গল্প লিখেছে। সেটা এই শুক্রবারের জাতীয় দৈনিক ইত্তেফাকের কচি-কাঁচার আসরে প্রকাশিতও হয়েছে।
আমার আত্মবিশ্বাস আরও বেড়ে যায় ওকে নিয়ে। ঘন্টাদুয়েক আগে চোখে পড়ল ‘বইঘর’ আ্যাপে একটি গল্প প্রতিযোগিতার আয়োজন করছে ‘বাবা দিবস’ উপলক্ষ্যে।
আমি আনন্দিত হয়ে মেয়েকে দুপুরে না ঘুম পাড়িয়ে গল্প লিখতে বসিয়ে দিয়ে নিজে একটু ঘুমিয়ে নিলাম।
ঘুম থেকে উঠে দেখলাম।
মেয়ে খুব সুন্দর একটা গল্প লিখে ফেলেছে নিজে নিজে।
আনন্দে আমার চোখে পানি চলে এলো। ভাবলাম আপনাদের সাথে আমার আনন্দটা শেয়ার করি। গল্পটা ‘বইঘরে’ পাঠাব। তাই আর আপনাদের কাছে সেটা শেয়ার করলাম না।
আমার মন বলছে ইনশাহআল্লাহ আমার মেয়েটা একদিন অনেক বড় গল্পকার হবে। সবাই আমার ছোট্ট সোনার জন্য দোয়া করবেন।
#আমার মেয়টা
কামরুন নাহার মিশু