(সত্য ঘটনার ছায়া অবলম্বনে)
আমার দাদী মায়মুনা ছিলেন বড় অভাগী। সৃষ্টিকর্তা তার ভাগ্যে লিখেছিলো সতীন কাঁটা, তাই সব কিছু ভালো থাকলেও তার সতিনের সাথেই জীবন পাড় করতে হলো।
নাসিরপুরের জমিদারের মেয়ে মায়মুনার বিয়ের জন্য পাত্রের খোঁজ করা হচ্ছে। ঘটক এসেছে পাত্রের তালিকা নিয়ে। আশে পাশের দুই তিনজন জমিদারের ছেলের নাম থেকে চোখ সরিয়ে জমিদার সাহেব নওপাড়া গ্রামের কাজী বাড়ীর বিএ পাশ ছেলে আফসারুলকে পছন্দ করলেন।
বাইর মহলের কানাঘুষা ভিতর বাড়ী পর্যন্ত পৌঁছালো। মায়মুনার আম্মা জমিদার সাহেবের কাছে জানতে চাইলেন, কোন জমিদার পরিবারে কেন মেয়ের বিয়ে ঠিক করলেন না? জমিদার সাহেব কারো কোন প্রশ্নের উত্তর দিলেন না। তার হিসাব খুব সহজ। তিনি বুঝতে পারছেন এ দেশে জমিদার প্রথা আর বেশী দিন টিকবে না। এ সব জমিজমা করে খেতে শিক্ষিত ছেলের প্রয়োজন হবে। তার ছেলেরা কেউ লেখাপড়া করেনি। তাই উচ্চ বংশীয় মধ্যবিত্ত পরিবারের শিক্ষিত ছেলেকে একমাত্র মেয়ের জামাই করবেন বলে মন স্হির করেছেন। কিন্তু হিসাবটা যত সহজ ভেবেছিলেন বাস্তবে বিষয়টা তত সহজ হলো না।
আফসারুলের সাথে ধুমধাম করে মায়মুনার বিয়ে হয়ে গেলো। তিনদিন শ্বশুড় বাড়ীতে থেকে মেয়ে জামাই ফিরানিতে আসলো। জমিদার সাহেব আফসারুলকে এ বাড়ীতেই থেকে যাওয়ার প্রস্তাব দিলেন। মধ্যবিত্ত পরিবারে পিতার আদর্শে বেড়ে উঠা আফসারুল ‘ঘর জামাই’ হওয়াকে মেনে নিতে পারেনি। শ্বশুরের বিশাল সম্পত্তির অংশীদারিত্বও তাঁকে তার নীতিবোধ থেকে এক চুল বিচ্যুত করেনি।
জমিদার সাহেব জামাইর উপরে চাপ সৃষ্টি করার জন্য বললেন, তাহলে আমার মেয়ে তোমার সাথে যাবে না।
আফসারুল দৃঢ় স্বরে বললো, আমার স্ত্রী যদি তার পিতার সিদ্ধান্ত মেনে নেয় আমার কিছু বলার থাকবে না। আমি মায়মুনার মুখ থেকে তার সিদ্ধান্ত জানতে চাই।
পাশের ঘর থেকে মায়মুনার ডাক পড়লো। মায়মুনা হাঁপুস নয়নে কাঁদছে। তার আম্মা তার মাথায় হাত দিয়ে বললেন, যাও মা। মনে রেখো বিয়ের পরে স্বামীর ঘরই তোমার আপন ঘর।
মায়মুনা জমিদার সাহেবের সামনে আসলো। জমিদার সাহেব জানতে চাইলেন, তোমার কি সিদ্ধান্ত?
মায়মুনা থর থর করে কাঁপছে। তার বালিকা জীবনে কখনো এমন কঠিন সময় আসবে সে স্বপ্নেও ভাবেনি। সে মাটির দিকে তাকিয়ে বললো, আব্বাজান, আপনি আমাকে স্বামীর ঘরে যেতে দিন।
মায়মুনার এই সাহসিকতার জন্য আফসারুল সারাজীবন তাকে শ্রদ্ধা করেছে। স্বামীর গভীর ভালোবাসা পেলেও মায়মুনার জন্য বাবার বাড়ীর দরজা ছিলো চির দিনের জন্য বন্ধ।
অল্পদিনেই মায়মুনা শ্বশুর বাড়ির সবার মন জয় করে নিয়েছিলো। ঘরে বাইরে সবার মুখে মুখে একটাই কথা, জমিদারের মেয়ে হলেও তার একটুও দেমাগ নেই।
মা মরা ছেলে আফসারুলের জীবনকে ভালোবাসায় পরিপূর্ণ করে দিয়েছিলো মায়মুনা। এলোমেলো সংসারটাকে আবার প্রাণবন্ত করে তুললো সে। শ্বশুড় আব্বার জীবনেও ফিরে এসেছে সব নিয়ম। মায়মুনা হয়ে উঠেছে সকলের নয়নের মণি।
দিন মাস বছর গড়িয়ে যেতে লাগলো। সন্তানের মা ডাক শুনার জন্য মায়মুনা অস্হির হয়ে উঠলো। কিন্তু এ আশা আর তার পূরণ হয় না। বিয়ের বছর পাঁচেক পরে শ্বশুরের মৃত্যুতে ঘরটা আরো খালি হয়ে গেলো।
ডাক্তার, কবিরাজ, পীর-ফকির, পানি পড়া, তাবিজ-কবজ কোন কিছুই বাদ দিলো না কিন্তু বিয়ের সাত বছর পাড় হলো আফসারুল-মায়মুনার কোন সন্তান হলো না। আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী বহুদিন নানা কথা বলাবলি করলেও আফসারুলের মধ্যে কোন হাহুতাশ দেখা যায়নি। কিন্তু ইদানীং আফসারুলও যেন মায়মুনাকে কিছু বলতে চায়।
মায়মুনা বুদ্ধিমতি মেয়ে; স্বামীর মনের কথা বুঝতে পারলো। তাই নিজেই আগ্রহ নিয়ে স্বামীকে বিয়ে দিয়ে সতীন ঘরে আনলো। নতুন বৌর ঘরে স্বামীকে ঢুকিয়ে দিয়ে নিজের ঘরে এসে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো। দূরে কোথাও চলে যেতে ইচ্ছা করছে কিন্তু কোথায় যাবে! তার যে যাওয়ার আর কোন জায়গা নেই।
মাস দুয়েকের মধ্যে ছোট বৌ আম্বিয়া সন্তান সম্ভবা হলো। মায়মুনা বড় বোনের মত আম্বিয়ার যত্নআত্তি করে। আম্বিয়াও তার খুব ভক্ত। তাকে ‘বুজি’ বলে ডাকে। আম্বিয়ার সন্তান হবে মায়মুনার আনন্দ যেন ধরে না। কে বলবে আম্বিয়া তার সতীন!
আম্বিয়ার কোল জুড়ে এলো ফুটফুটে এক ছেলে। আত্মীয় স্বজনের কুপরামর্শে আম্বিয়ার ধারণা হলো মায়মুনা তার সন্তানের ক্ষতি করবে। তাই মায়মুনাকে সে বাচ্চার কাছেই আসতে দেয় না।
আতুর ঘরে মায়মুনা ঢুকতে গেলে আম্বিয়া বললো, বুজি, বাচ্চার এখনো নাভি পড়েনি। তুমি রান্নাবান্না কত কাজ করেছো, তোমার কাছ থেকে বাচ্চার ‘ছুঁত’ লাগতে পারে। মায়মুনা ভাবে সত্যিইতো তাই। বাচ্চার নাভি পড়ে গেলো। এখন আম্বিয়া বলে, এত ছোট বাচ্চা তুমি ঠিকমত কোলে নিতে পারবে না।
মায়মুনা কয়েকদিনেই বুঝে গেলো আম্বিয়া চায় না সে তার ছেলের কাছে যাক। সে বুঝে উঠতে পারছে না আম্বিয়া কেন এমন করছে। বাচ্চা হওয়ার আগেওতো আম্বিয়া সারাক্ষণ তার সাথেই থাকতো। যখন প্রসব ব্যাথা তীব্র হলো তখন মায়মুনাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আম্বিয়া কাঁদতে কাঁদতে বলেছিলো, বুজি, আমি মনে হয় বাঁচবো না। আমি মরে গেলে তুমি আমার বাচ্চাটারে তোমার নিজের বাচ্চা মনে করে মানুষ করবা। সেই আম্বিয়ার এই ব্যবহারে সে মনে খুব কষ্ট পেলো। সে যে আফসারুলের ছেলেকে নিজের ছেলের মত ভালোবাসে এ কথা কেউ বুঝলো না।
অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই মায়মুনা খুব অসুস্হ হয়ে পড়লো। কোন খাবারে রুচি নেই। কেমন যেন বমি বমি ভাব হয়। একদিন রান্না ঘরের দরজায় মাথা ঘুরে পড়ে গেলো। আফসারুল প্রায় জোড় করে তাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলো। ডাক্তার পরীক্ষা করে জানালেন, মায়মুনার সন্তান হবে।
অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি আম্বিয়ার ছেলের এক বছর হওয়ার আগেই মায়মুনারও একটি ছেলে হলো। মায়মুনা সেই সন্তানকে বুকে চেপে ধরে আনন্দের আবার একই সঙ্গে দুঃখের কান্না কাঁদল। ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, বাবারে, আসলিই যখন আর কয়টা দিন আগে আসতে পারলি না?
*****
গল্পঃ সতীন কপাল
লেখকঃ কাজী তাসমীন আরা আজমিরী
বনানী, ঢাকা।
ভালো লাগলে অবশ্যই আমার বাকি গল্পগুলো পড়বেন।
আপনারাই আমার লেখার অনুপ্রেরণা