অনেক দূর থেকে ফজরের আজান কানে আসতেই চোখের পানি মুছে নিলাম ৷ আমার বিয়ের দেড় বছর হয়ে গেছে কিন্তু এখনো স্বামীর সাথে একটা কথা বলতে পারি নি ৷আমাকে বিয়ে করে চলে গেছে আমেরিকা ৷আকাশের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিলাম ৷অতঃপর নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ালাম ৷
নামাজ শেষ করে রান্না ঘরের দিকে পা বাড়ালাম ৷বড্ড মাথা ব্যাথা করছে তাই চুলায় গরম পানি বসালাম চা বানাতে ৷ চা বানিয়ে নিজের ঘরে এলাম আবারো ৷ বিছানায় বসে চা খাচ্ছিলাম হঠাৎ চোখ পড়লো একটা ছবির ওপর ৷মূহুর্তেই ভুলে গেলাম মাথা ব্যাথার কথা ৷ছবিটা হাতে তুলে নিলাম ৷আমার চোখে জল রাশি জমা হয়েছে ৷ ছবিটা আর কারো নয় আমার স্বামীর ৷হাত বুলিয়ে দিলাম তার ছবিতে ৷তাকে কখনো ছুয়ে দেখা হয় নি ৷আচ্ছা আমি কি কখনো তাকে ছুতে পারবো নিজের হাতে ৷আমার বুকটা ভারী হয়ে গেল ৷
আচ্ছা সেও কি আমার কথা ভাবে ৷সেও কি আমার কথা ভেবে রাত জাগে ৷এই যে আমি তার অপেক্ষায় শত শত রাত পার করে দেই ৷এই যে আমি গাড়ীর আওয়াজ পেলেই ছুটে যাই সে আসবে বলে ৷কিন্তু সে আসে না একবারও ৷সেও কি আমার কথা ভাবে ৷সেও কি আমার কাছে আসতে চায় ৷আচ্ছা সে যদি জানতে পারে আমার রাত জাগার কারন সে তাহলে কি করবে ৷ আর ভাবতে পারলাম না কারন আমার হাতের কাপটা নিচে পরে গেছে ৷ তার কথা ভাবতেই আমার শরীর এতটা কাপঁতে ছিল যে চায়ের কাপটা হাত থেকে পরে গেছে ৷
আমার নাম রাই ৷আমার বয়স আঠারো বছর ৷মামা আর মামির কাছে আমি বড় হয়েছি ৷ আর আমার স্বামী আবরার খান জয় ৷ সে পেশায় ব্যবসায়ী ৷আর বাকিটা আস্তে আস্তে জানতে পারবেন ৷
আবরার ছবিটা খুব যত্ন করে শাড়ীর আচঁল দিয়ে পরিষ্কার করলাম ৷ ছবিটা বিছানার পাশে রেখে ভাঙ্গা কাচ গুলো পরিষ্কার করে নিলাম ৷ হঠাৎ করে একটা কাচ আমার হাতে ঢুকলো ৷ হাতের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলাম ৷মনে পরে গেল অতিতের কথা ৷
আমার তখন ১০ বছর বয়স ৷আমি গ্রামের সাধারন একটা পরিবারের মেয়ে ৷আমার মা ক্যান্সারে মারা গেছে যখন আমার দশ বছর ৷মা মারা যাওয়ার পর বাবা আবারো বিয়ে করে ৷সৎ মা আমাকে একদম দেখতে পারতো না ৷আমার বাবার গ্রামের বাজারে কাপড়ের দোকান ছিল অনেক বড় ৷বাবা সারাদিন পর বাড়ীতে আসলেই সৎ মা আমার নামে মিথ্যা বলে বিচার দিত ৷আমার নিষ্ঠুর বাবা সত্য মিথ্যা যাচাই না করেই আমাকে শাস্তি দিত ৷আমার কষ্ট সহ্য করতে না পেরে মামা আমাকে তার কাছে নিয়ে আসেন ৷আমার মামা গ্রামের চেয়ারম্যান ৷গ্রামে মামার মোটামুটি ভালোই দাপট আছে ৷মামা আমাকে অনেক ভালোবাসতো ৷কিন্তু মামি আমাকে একদম দেখতে পারতো না ৷আমাকে দিয়ে বাড়ীর সব কাজ করাতো ৷ এভাবেই দিন যাচ্ছিলো ৷ আস্তে আস্তে আমি বড় হতে লাগলাম ৷
আমার যখন প্রায় সতেরো বছর তখন এক বৈশাখী ঝড়ের মতো আবরার আমার জীবনে আসে ৷আবরার এসেছিল তার বন্ধুদের সাথে বেড়াতে আমাদের গ্রামে ৷আবরারকে আমি চিনতামও না ৷সবই ঠিকঠাক ছিল কিন্তু এক কাল বৈশাখী ঝড় আমার জীবনটা এলোমেলো করে চলে গেল ৷
এই রাই কোথায় গেলি ৷মামির গলার আওয়াজ শুনে রান্নাঘর থেকে দৌড়ে তার কাছে গেলাম ৷আমি যেতেই মামী বলল
হ্যা রে নাবাবের বেটি এত সময় লাগে আসতে ৷
রাই নিচু স্বরে বলল মামী আসলে আমি খাচ্ছিলাম তাই ৷
হ্যা সারাদিন শুধু গেলা আর অন্ন ধ্বংস করা তাই না ৷এই নে টাকা আজ স্কুল থেকে আসার সময় এই ঔষুধ গুলো নিয়ে আসবি ৷
ঠিক আছে মামী রাই বলল ৷
একটু পরেই রাই স্কুলে চলে গেল ৷স্কুল শেষ করে ঔষুধ কিনে নেয় রাই ৷কিন্তু তার পরেই মুষলধারে বৃষ্টি নামে ৷রাই তিন ঘন্টা দাড়িয়ে থাকে একটা দোকানের পাশে ৷ঐ দিকে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে এসেছে ৷রাই কোনো কুল না পেয়ে এবার দৌড় দেয় বৃষ্টিতে ৷ এদিকে মেঘে চারিদিকে অন্ধকার ছেয়ে গেছে ৷কোথাও কোনো মানুষের চিহ্ন নেই ৷রাই দৌড়াতে দৌড়াতে একটু দুরেই একটা কুড়ে ঘর দেখতে পেল ৷রাই ঐ ঘরটার দিকে দৌড়ে গেল ৷রাই ঘরটায় প্রবেশ করতেই তার মুখে ভয় এসে জমা হলো ৷কারন ঐ ঘরে একটা ছেলে বসে আছে খড়ের পাশে ৷ছেলেটাও রাইকে দেখে কিছুটা ঘাবড়ে গেল ৷এদিকে রাইয়ের ভিজে যাওয়া শরীরে লেপ্টে যাওয়া জামার দিকে তাকিয়ে ছেলেটির নাজেহাল অবস্থা ৷রাই যে তাকে ভয় পাচ্ছে ছেলেটা বুঝতে পেরে বলল
আমাকে ভয় পেতে হবে না ৷আমিও তোমার মতো বৃষ্টিতে আটকে গেছি পুচকি ৷ বৃষ্টি থামার আগে তুমি চাইলে এখানে বসতে পারো ৷ছেলেটাকে রাইয়ের খারাপ মনে হলো না ৷রাই ছেলেটার থেকে অনেক দুরে বসলো ৷রাইকে স্বাভাবিক করার জন্য ছেলেটা বলল তোমার না কি ?
রাই কাপাঁ গলায় বলল আমার নাম রাই ৷আপনার কি নাম ?
ছেলেটা জবাব দিল আমার নাম আবরার খান জয় ৷
আপনাকে তো কখনো দেখি নি ৷আপনি কি এলাকায় নতুন ৷
আসলে আমি আমার বন্ধুর বাড়ীতে বেড়াতে এসেছি ৷একটু দরকারে বেড়িয়ে ছিলাম ৷কিন্তু দেখ বৃষ্টির জন্য আটকে গেলাম ৷তুমি কেন আটকে গেলে বৃষ্টিতে ৷
স্কুল শেষ করে মামার ঔষুধ কিনতে দেরি হয়েছে ৷
ও তুমিতো শীতে কাপঁছো ৷তুমি আমার এই শার্টটা পড়তে পারো ৷
না থাক লাগবে না ৷
আরে নাও ৷ভালো লাগবে ৷
রাই শার্টটা নিল ৷এমনিতেও তার শীত লাগছিল অনেক ৷
এমন অনেক কথা হলো রাই আর আবরার মাঝে ৷কথা বলতে বলতে দুইজন যে কখন ঘুমিয়ে গেছে তা বুঝতেই পারলো না ৷আর এটাই ওদের কাল হয়ে দাড়ালো ৷
শ্রাবন আধারে তুমি
লেখিকা আফরিন ইসলাম
পার্ট :১
চলবে…