সুহার সংসার পর্ব ১
১.
বিয়ের ১২ বছর পর শুনতে হলো আমাকে আবিদের আর ভালো লাগে না, তার পাশে আমাকে আর মানায় না। আমার বয়স যখন ১৮ ছুঁই ছুঁই। তখন ই বিয়ের পিড়িতে বসি। প্রেম কি জিনিস তার ছোঁয়া পেয়েছিলাম আবিদের কাছ থেকেই। আমাদের এরেঞ্জ ম্যারিজ, এনগেজমেন্ট এর দিন আমাদের দুইজন কে ছাদে একা কথা বলতে দিয়েছিলো আমাদের দুইজনের পরিবার।
আমি আমার ছোট বোন কে সাথে নিয়ে ছাদে দাঁড়িয়ে ছিলাম গোলাপী এক কাতান শাড়ি মুড়িয়ে। আমার লিক লিকে শরীরের চেয়ে শাড়ির ওজন ই যেন বেশি ছিলো। হঠাত পায়ের শব্দ পেয়ে কলি দৌড়ে পালালো। একা একা দাঁড়িয়ে আমি ঠক ঠক করে কাঁপছিলাম।
সে এসে পাশে দাড়িয়েছে অনেক ক্ষণ, কিন্তু কোনো কথা নেই মুখে। হঠাৎ একটা হাত টেনে তার হাতের মুঠোয় পুরে নিলো। আমি হিমেল ঠান্ডা বাতাসেও কেমন করে কাপছিলাম,দর দর করে ঘামছিলাম। সে হো হো করে হেসে বলেছিলো,
মাত্র হাত ই ধরলাম, তাতেই এত কাপাঁকাপি!!! বুঝেছি তোমার জীবনে আমি ই প্রথম পুরুষ।
এই বলে সে হেচকা টেনে আমায় জড়িয়ে ধরলো। আমি ভয়ে আর সংকোচে আড়ষ্ট হয়ে রইলাম। আমার ঘাড়ে মুখ ডুবিয়ে আবিদ বলল, আর দেরি করব না, তাড়াতাড়ি এই লজ্জাবতীকে আমার ঘরে চাই।
আমি নিজেকে ছাড়াতে চাইলে আরো শক্ত করে ধরে বলল সত্যি বলবে? আমি এবার মুখ তুলে চাইলাম,
আমাকে পছন্দ হয়েছে তো?
আমি ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে রইলাম, তারপর নিজেকে ছাড়িয়ে দিলাম দৌড়, শেষ বারের মতোন তার দিকে পিছন ফিরে বললাম,
আমার রুমে আমি একাই থাকি, মানুষ চাইলে যেন ফোন দেয়। তারপর আর থামিনি, নিজের রুমে গিয়ে বাতি বন্ধ করে শুয়ে পড়লাম। আমি চাচ্ছিলাম না আমার মাঝে তার জন্য জেগে উঠা প্রথম ভালোবাসা আলোতে হারিয়ে যাক, ছড়িয়ে যাক।
এসব ভাবতে ভাবতে কখন আবিদ লাইট জ্বালালো ঘড়ির সময় দেখিনি। আমি উঠে হাত খোপা করে বসলাম। জিজ্ঞেস করলাম,
খেয়ে এসেছো? আবিদ ঘড়ি খুলতে খুলতে বলল, জানোই তো আমি রাতে খেয়ে আসি।
আমি উঠে এক গ্লাস পানি খেলাম, বাচ্চাদের রুমে গিয়ে চেক করলাম। ওরা ঘুমাচ্ছে। তারপর আবার পাশে এসে শুয়ে পরলাম। কিন্তু ঘন্টাখানেক হয়ে গেলো ঘুম আসছে না। আমি জানি আবিদ ঘুমায় নি, চ্যাটিং করছে কারো সাথে।
আস্তে করে ডেকে বললাম, ঘুমিয়ে পরেছো?
কোনো সাড়া না পেয়ে আমি লাইট জ্বালালাম। এবার হাতের ফোন টা বিরক্তিকর ভংগিমা তে রেখে আবিদ আমার দিকে ফিরে চাইলো।
কি সমস্যা? আমাকে কি কোনো ভাবেই শান্তি দিবে না।
আমি লজ্জায় পরে গেলাম, বললাম কি বলছো? সারাদিন ত কোনো কথা হয় না আমাদের রাতেও তুমি বিজি থাকো।
তোমার কি সমস্যা আমি বিজি থাকলে! তুমি তোমার সংসার নিয়ে বিজি না?
আমার সংসার কি তোমার সংসার না?
আবিদ এবার চটে গেলো, উঠে বালিশ নিয়ে হাটাশুরু করলো। আমি অসহায় ভংগিতে বললাম কোথায় যাচ্ছো?
সে দরজা টা ধরাম করে লাগানোর আগে বলে গেলো জাহান্নাম থেকে মুক্তি চাই।
মুক্তি! এখন আমার সংগ, বাচ্চাদের দায়িত্ব সব আবিদের কাছে জাহান্নাম, অথচ রাত জেগে কত কথা কত স্বপ্ন বুনেছিলাম দুজন। বিয়ের এত বছরেও আমি বুঝতে পারিনি আবিদের ছেলে বন্ধুর চেয়ে মেয়ে বন্ধুর সংখ্যা অনেক বেশি।
আমি পরে ছিলাম শশুর শাশুড়ী সংসার আর বাচ্চা নিয়ে। এই সংসারের মাঝে আমার আসল সংসার জলে ভেসে গেলো।
যেদিন টের পেলাম সেদিন ছিলো শনিবার, বাচ্চাদের নিয়ে আমি আউটিং এ বের হলাম। ওকে বার বার রিকুয়েষ্ট করেও আমরা এক সাথে যেতে পারিনি। বাসায় ফেরত আসার সময় জ্যামে বসে ছিলাম। দেখলাম রাস্তার আরেক পাশেই আবিদ কে হাগ করে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। আমি ফোনে বিজি কিন্তু এক হাতে মেয়েটার কোমড় আঁকড়ে রেখেছে।
আমার মনে হচ্ছিলো কেউ আমার শরীর খামছে ধরেছে। সেদিন বুঝলাম আমার সংসারে সব আছে আসল মানুষ টাই নেই।
২.
বিয়ের পর থেকেই আমি সংসারী হয়ে উঠি। শ্বশুর শাশুড়ির কখন কি লাগবে? এক মাত্র ননদকে বান্ধবী বানানো সব দায়িত্ব নিয়ে বেশ সুখেই ছিলাম। আবিদ ও আমার জন্য কত কিছুই না করেছে। কিভাবে বিশ্বাস করি তাহলে যে এখন আর আমাকে সে চায় না।
সেই কবেকার স্মৃতি অথচ আমার মন মস্তিষ্কে আঁকড়ে পরে আছে এখনো। এংগেজ মেন্টের পর থেকে আমাদের প্রতিদিন কথা হতো, সারাদিন তো টুক টাক চ্যাটিং চলতোই। সেই দিন গুলো ভীষণ সুন্দর ছিলো। একদিন আমি কলেজ থেকে ফিরছিলাম। গেইট থেকে বের হয়েই দেখি আবিদ গাড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
চোখে সানগ্লাস, বাহুতে বাহু ভাজ করে রাখা,এত সুন্দর লাগছিলো। আমার তো ভীষণ ভালো লাগছিলো এই ভেবে সবাই ওকে দেখছিলো আর বলাবলি করছিলো।
আমি কাছে যেতেই গাড়ির দরজা খুলে দিলো সে মুচকি হেসে। আমি গাড়িতে বসতেই স্টার্ট দিলো। আমি জিজ্ঞেস করলাম কোথায় যাচ্ছি আমরা? কিন্তু সে কিছু বলল না।
আমরা গিয়ে পৌছালাম ঢাকা থেকে একটু দূরে আশুলিয়ার একটা রিসোর্টে। আমাদের জন্য আগেই বুকিং দেয়া ছিলো সব কিছু। আমি তো পুরাই অবাক। বিয়ের আগে ওইটাই আমাদের প্রথম এক সাথে সময় কাটানো। রুমে ঢুকতে আমার খুব অসস্থি হচ্ছিলো, কি থেকে আবার কি হয়ে যায়। কিন্তু আবিদ আমাকে আশস্থ করেছিলো রুমে ঢুকার আগেই।
বিছানার উপরে একটা নীলরংগের জরজেট শাড়ি আর তার সাথে ম্যাচিং করে সবকিছু রাখা ছিলো। সারাদিন ক্লাস আর এখানে আসার জারনির ধকলে আমার অবস্থা খুব করুন ছিলো। আবিদ রুমে ঢুকা পরযন্ত আমার হাত ধরে রেখেছে,
মলি,যাও ফ্রেশ হয়ে এই শাড়ি টা পরে নাও, আমি অপেক্ষা করছি।
আমি শুধু ঘাড় নাড়িয়ে বাথরুমে ঢুকে গেলাম। কিন্তু বাথরুমে কি শাড়ি পরা যায়। আমি ভিতর থেকেই তাকে ডাকছিলাম,
শুনছেন? আবিদ, আপনি কি আছেন? কিন্তু কোনো সাড়া শব্দ নাই, তাই নিজেই বাহিরে আসলাম আর টুশ করে দরজা লক করে দিলাম। আমি বুঝতে পারলাম আমার রেডি হতে যেনো কোনো আনিজি ফিল না হয় তাই সে রুম টাই ছেড়ে দিয়েছে।
আমি শাড়ি পরে ঠোটে জাস্ট লাইট পিনক লিপ্সটিক দিলাম আর চোখে কাজল আর কিছু মাখতে ইচ্ছে হলো না। দরজার লক খুলে চুল শুকানোর জন্য বেলকনিতে দাড়ালাম। আজকের দিনের সমস্ত ঘটনা মনে করে একা একাই হাসছিলাম। হায় আল্লাহ তুমি আমাকে এত সৌভাগ্যের অধিকারী করেছো। আবিদের প্রতি দিন দিন এত দুরবল হয়ে উঠছিলাম।
হঠাৎ মনে পরলো বাসায় ত কিছু জানে না, সবাই নিশচয়ই টেনশন করছে অনেক। এসব ভেবে আমি ফোন হাতে নিতেই আবিদ পিছন থেকে জড়িয়ে ধরলো।
কাকে কল করা হচ্ছিলো।? আমি বিচলিত হয়ে বলি,
আবিদ বাসায় ত কেউ কিচ্ছু জানে না।
ওহ এই কথা, এইটা নিয়ে টেনশন করে আমাদের সময় টুকু নষ্ট করো না প্লিজ। আমি ঢোক গিলে বললাম,
কখন যাবো বাসায়? সে আমাকে তার দিকে ঘুরিয়ে বলল, আগে প্রাণ ভরে দেখতে দাও আমাকে। কাল রাতে ঘুমাতে পারছিলাম না এই ভেবে নীল শাড়িতে তোমাকে কেমন লাগছে এই ভাবনায়।
আবিদ আমার হাত টেনে বিছানায় নিয়ে বসিয়ে দেয়। কিন্তু সে নিজে বসে হাটু গেড়ে। তারপর বলতে থাকে,
জানো গোলাপী শাড়িতে তোমাকে কি যে সুন্দর লাগছিলো আমাদের এংগেজমেন্টের দিন!
আমি ঘাড় নেড়ে বলি নাহ জানিনা তো। শাড়ি টা গায়ে জড়িয়ে রাখতেই জান বের হয়ে যাচ্ছিলো এত ভারী। আবিদ হেসে উঠলো, বলল,
সে জন্যই আজকে জরজেট নিয়ে আসলাম। আমি অবাক হয়ে বললাম এত কিছু খেয়াল করলেন কখন? আবিদ মুচকি হাসে। তারপর অনেকক্ষণ আমার কোলে মাথা রেখে শুয়ে থাকে চুপ করে।
অনেক ক্ষণ কেটে গেলে আমি ডেকে উঠি, আবিদ আমরা বাসায় কখন যাবো? সবাই নিশ্চয় টেনশন করছে।
আবিদ আমার হাতে চুমু খেয়ে বলে আগে আমার সাথে চলো তো এক জায়গায়।
সত্যি বলতে আমার এত ভালো লাগছিলো আবার ভয় ও কাজ করছিলো। আমার হাত টেনে নিয়ে গেলো এক খোলা মাঠে। লাল নীল আলোতে সাজানো সাথে বেলুন দিয়ে একটা টেবিল সেট করা। এত সুন্দর লাগছিলো সেই সন্ধ্যা টা। টেবিলের উপরে একটা কেক রাখা।
আবিদ কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলে উঠে হ্যাপি বারথডে মাই উড বি ওয়াইফ।
আমি জাস্ট স্পিচলেস, এত সুন্দর একটা সন্ধ্যা আমার জন্মদিনের উপহার। আমি তখন ই নিজ থেকে তাকে জড়িয়ে ধরি। নিজেকে অনেক বেশি লাকী মনে হচ্ছিলো।
বাসায় আসতে আসতে পুরো সময় কত গল্প। বাসায় এসে খুব ভয় ও কাজ করছিলো। কিনতু বুঝলাম সে বাসার সবাই কে জানিয়েই এই কাজ করেছে। রাতে আবিদ মেসেজ পাঠালো, আরেকটা সারপ্রাইজ বাকি আছে। আমি তখন আগের ঘটনা গুলো হজম করতে বিজি ঠিক তখনই বাবা মা রুমে ঢুকলো।
আমার এত লজ্জা লাগছিলো, আর তখন ই জানতে পারলাম আবিদ আর দেরি করতে চাচ্ছে না, দুই সপ্তাহ পর ই আমাদের বিয়ে।
চলবে…….