২২.
হানিমুনে গিয়েছে রুমকি আর পলাশ। এই কয়দিন মলি নিজের সংসার নিয়েই বিজি। তারপর ও হোয়াটস এপে ফাহাদ, রুমকি আর পলাশের সাথে গ্রুপ চ্যাট হচ্ছেই। মলির জীবন টা স্বাভাবিক করার জন্য ওরা অনেক এফোর্ড দিচ্ছে। এতটুকু জ্ঞান তিনজনের ই আছে যে ওর সংসার জীবন স্বাভাবিক না। তবে ওরা কেউ চাপাচাপি করেনা কি হয়েছে সেটা জানার। একদিন নিজেই সব শেয়ার করবে সেটাই ওরা আশা করছে।
এই কয়দিন মলি নিজেকে গোছানোর কথা ভাবছে খুব। ভাবছে জীমে যাবে কিনা। ওজন টা বেড়েই চলছে। আবার ভাবে নিজেই কোনো নিউট্রিশনিস্টের সাথে কন্সাল্ট করবে যেনো একটা ডায়েট চার্ট ফোলো করতে পারে। এই ব্যাপারে রুমকিকে বলবে একটা কিছু পরামর্শ এর জন্য। যেই ভাবনা সেই কাজ, রুমকি কিভাবে যেন মলির মনের কথা বুঝে যায়, সে কিছু বলার আগেই রুমকি একদিন বলে উঠে,
—- নেক্সট মান্থ ভাবছি পান্থপথে শিফট হবো।
— হঠাৎ? পান্থপথ কেন? মলি হোয়াটসঅ্যাপের চ্যাটে জিজ্ঞেস করে।
—- আমার আর পলাশের জন্য মাঝামাঝি একটা জায়গায় বাসা নিব ভাবছি যাতে দুজনের অফিসেই যাতায়াত করাটা ইজি হয়।
—- খুব ভালো তো, পান্থপথ তো আমার বাসার কাছেও হবে তাছাড়া আমার বাচ্চার স্কুল থেকে অনেক কাছে।
— হ্যা আমি সেটা ভেবেও খুব খুশি। এই মলি সকালে চলো হাঁটি এক সাথে।
—আল্লাহ কিভাবে সম্ভব? বাচ্চার স্কুলের জন্য অনেক সকালে বের হই। আর তারপর তো তোমার জব আছে কিভাবে কি করি। তারপর মলির মনের কথা গুলো বলেই ফেললো,
— তুমি জানো আমি ভাবছিলাম তোমাকে বলবো নিউট্রিশনিস্ট দেখিয়ে ডায়েট চার্ট নিবো কিনা। হাঁটার তো সময় নাই। মানে একা কিছু করতে ভালো লাগে না। ইন্সপায়ার্ড হই না আর কি।
রুমকি হেসে ফেললো, শোনো ৭ দিনএর মাঝে ৫ দিন ডায়েট করো, আর একদিন মোটামুটি খাবা আর বাকি একদিন যা ইচ্ছা খাবা। যাই খাও না কেনো হাঁটাহাটি মাস্ট ডিয়ার। বুঝলা? মানে ক্যালরি বার্ণ করা অনেক বেশি জরুরী।
চট করেই মলি হিসেব কষে ফেললো, শুক্রবার আর শনিবার যেহেতু পলাশ রুমকি আর ফাহাদের ছুটি তাই এই দুইদিন ডায়েট কম করবে আর বাকি ৫ দিন স্ট্রিক্ট ডায়েট মানে প্রোটিন খাবে কিন্তু কার্ব খাবে পরিমানে কম। আর তিতলিকে স্কুলে দিয়ে বসে থাকবে না। বাসায় ও আসবে না। এই টাইম টা হাঁটাহাটি করবে। পাঁচ ফুট দুই ইঞ্চির একটা মেয়ের ওজন প্রায় ৬৯/৭০ কেজি হতেই পারে না তাকে অবশ্যই ৫৫-৫৬ সর্বোচ্চ ৫৮ এর ঘরে আসতে হবে।
২৩.
দিন চলতে লাগলো, আবিদ কেয়ার কাছ থেকে তেমন কোনো রেস্পন্স না পেয়ে সে নিজেও দূরে সরে আসে। কিন্তু অনেক টা সময় বাসায় থাকার পর খেয়াল করলো বাচ্চাদের সাথে ভালো সময় কাটলেও মলির দেখা পাওয়া যায় না। আবিদের অবশ্য অভিযোগ এক জায়গাতেই, বাচ্চারা যেন বাবা মা এর সংগ সব সময় পায়।
প্রায় এক মাস পরের ঘটনা। আজকে দুপুরে বাসায় আসার পর থেকে আর অফিসে যায় নি আবিদ। বাচ্চারা বিকেলে ঘুম থেকে উঠেই মা কে খুঁজছিলো। বিশেষ করে তিতলি, আবিদ রুমে গিয়ে দেখলো তিতলির বেশ জ্বর। গায়ে হাত দিয়েই চমকে উঠে সে, অথচ মলির খোজ নেই। ফোনে কল করেও পাওয়া গেলো না। আবিদ জানে তিতলিকে মেডিসিন দেয়া লাগবে কিন্তু এসব কাজ তো সব সময় মলিই করে তাই তার জ্ঞান নেই বিশেষ এই ব্যাপারে।
কয়েকবার কল দিয়েও যখন পাওয়া যাচ্ছিলো না ঠিক তখন ই তিতলি হর হর করে বমি করে ভাসালো সমস্ত বিছানা। এদিকে তোতন ও ঘুম থেকে উঠে কিছু না বুঝেই কান্নাকাটি করে একাকার। আবিদের তখন দিশেহারা অবস্থা, ময়না কে ডেকে কুল পাচ্ছে না। এই প্রথম আবিদের মনে হলো বাচ্চাদের কে কিভাবে অসুখ বিসুখে মলি একা হাতে সামলায়। ইটস ভেরি টাফ, ভেরি মাচ টাফ। একি সাথে মলির ফোন না ধরাতেও মেজাজ খারাপ হচ্ছে। আসুক আজকে বাসায়। তারপর মলির এত উদাসীনতার কারণ জানতে হবে।
মলির ফিরতে ফিরতে রাত ৮.৩০ টা। ফোন টা সাইলেন্ট করা ছিলো তাই খেয়াল করেনি। বাসায় ঢুকেই আগে শাওয়ার নিতে বাথরুমে ঢুকলো। এর মাঝে ময়না আবিদ কে জানিয়েছে মলি ফিরেছ বাসায়। আবিদ হন্তদন্ত হয়েই মলির রুমে ঢুকলো। অপেক্ষা করতে করতে অধের্য হয়ে মলির ওয়াশ রুমের দরজায় নক করে বসলো সে।
মলি ভিতর থেকে খুব শান্ত গলায় বলল বেরুচ্ছি, ৫ মিনিট জাস্ট। কোমড়ে হাত রেখে রুমের এই মাথা ওই মাথা ঘুরতে ঘুরতেই দরজা খোলার শব্দে আবিদ ফিরে তাকালো। মলি মাত্রই গোসল করে বের হলো, আজকে প্রায় ১ ঘন্টা ১৫ মিনিট হেটেছে। তারপর রুমকির সাথে ফুচকা খেয়ে বাসায় আসলো। মন বেশ ফুরফুর মেজাজের। আবিদ খুব রেগে থাকা স্বত্তেও কেন জানি মলি কে দেখে কিছুই বলতে পারলো না। সদ্য গোসল করা নারী টি তার বউ তার বিশ্বাস হচ্ছে না। একি বাসায় থাকা সত্ত্বেও তাদের দেখা সাক্ষাৎ অনেক কম। এরি মাঝে মলি প্রায় ৫/৬ কেজি ওজন কমিয়েছে, নিচ্ছে নিজের ত্বকের যতন। মলি কে আগের মলি থেকে একদম ভিন্ন লাগছে।
কোথায় আবিদ মলিকে ডজন খানিক প্রশ্ন করার জন্য প্রস্তুতি নিয়ে এসেছে সেখানে গলা থেকে কথা বেরুচ্ছে না। মলিই শুরু করলো,
জরুরী কিছু? তুমি এভাবে নক করলে।
গলা কেশে আবিদ বলল, তিতলির বিকেল থেকে জ্বর তোমাকে ফোনে পাচ্ছিলাম না। আমি তো জানিনা কি কি মেডিসিন কি পরিমান দেয়া লাগে।
মলি শান্ত গলায় বলল, সিজন চেইঞ্জ হচ্ছে তো তাই হয়তো। আমি দেখে আসি কি হলো।
মলির শুধুমাত্র এত অল্প কথার পর আবিদ আর কিছুই বলতে পারলো না পিছন পিছন শুধু রুম থেকে বের হয়ে আসে।
অফিসে কাজের চাপ বেড়েছে, হাতে নতুন একটা প্রযেক্ট এসেছে। কাজের চাপের সাথে কফির চাহিদাও বেড়ে গেছে আবিদের। আগে কেয়া সব সময় কফি দিয়ে যেতো। এখনো দেয় কিন্তু একটা নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে। আবিদ ভাবছে অফিসে একটু বদল দরকার। নতুন করেই দুইটা মেয়ে কে নিয়োগ দিবে।
ভর দুপুর, আজ বাসা থেকে খাবার আনেনি আবিদ। তাই ভাবলো বাহির থেকে খাবার আনাবে। হঠাত করেই কেয়া ঢুকলো আবিদের রুমে, হাতে টিফিন কেরিয়ার। আবিদ তখন ফোনে বিজি। কেয়া অপেক্ষা করছিলো কখন আবিদের কথা বলা শেষ হবে। কথা শেষ হতেই এগিয়ে আসে কেয়া। টেবিলের ফাইল গুলো গুছিয়ে আবিদ কে টেনে ডিভানে বসায়। গলা ধরা কণ্ঠে কথা বলতে থাকে সে,
—- আমার কি অভিমান করার অধিকার ও নেই আবিদ? কথা গুলো বলতে বলতে কেয়া টিফিন ক্যারিয়ার খুলতে থাকে।
আবিদ চুপচাপ কেয়ার কান্ড দেখতে থাকে, মনে মনে মুচকি হাসে এই ভেবে কেয়া আবার ফিরে এসেছে। তবু আবিদ কঠিন কণ্ঠে বলে উঠে,
— এগুলো কি এনেছো? আমি ত বলিনি আনতে।
কেয়া অভিমানী কন্ঠে বলে উঠে,
— তোমার পছন্দের খাবার, বলতে হবে ক্যানো? আমার ইচ্ছে হয়না বুঝি? এই যে দেখো চিংড়ি মালাইকারী, চিকেন পোলাও আর চাইনিজ ভ্যাজিটেবল। বেশি কিছু ত আনতে পারিনি।
আবিদ আর কথা বাড়ায় না, খাবারে মনোযোগী হয়৷ কেয়াও খুব যত্ন করে খাওয়াতে থাকে। আবিদ বলে উঠে,
— সব রান্না অনেক মজা হয়েছে। তুমি রান্না করেছো?
— কেয়া হেসে উঠে,তো কে করবে? নিজ হাতেই রান্না করেছি, তোমার ভালো লেগেছে?
— হ্য ভালো লেগেছে বলেই ত প্রশংসা করলাম। তুমি ত জানোই মিথ্যা প্রশংসা আমি করতে পারিনা। আবিদ বিশ্ব জয়ের হাসি দিয়ে খাবার শেষ করে। অবশেষে কেয়া আবার ফিরে এসেছে, এইটাই অনেক।
খাবার খাওয়ার পর অনেক সময় পর্যন্ত তারা খুনসুটি করতে থাকে। রাতে এক সাথে ডিনার করবে এবং ডিনারের আগে কিছু শপিং করবে বলেও ঠিক হয় তাদের মাঝে। তাদের জীবন টা যেন এটাতেই সীমাবদ্ধ। আমোদ ফুর্তি শপিং খাওয়া দাওয়া এগুলো করেই এঞ্জয় করে চলছে।
২৪.
প্রায় ৭/৮ দিন পর রুমকির সাথে মলির দেখা হয়। তিতলির সিটি থাকাতে দেখা করাই হচ্ছিলো না। মলি বেশ বিজি হয়ে যায় এই কয়দিন। আজকে দেখা হউয়াতে দুইজনের মনের সমস্ত কথা যেনো ফুয়ারা হয়ে বের হচ্ছে। হালকা পাতলা শপিং করেই দুইজন একটু ঘড়ির দোকানের দিকে যাচ্ছিলো। সামনেই ফাহাদের জন্মদিন মলি ঠিক করেছে একটা ঘড়ি গিফট করবে। আর রুমকি ভাবছে একটা টাই গিফট করবে। ঘড়ি কেনা শেষ হলেই টাই পছন্দ করার জন্য ওই দিক টাই যাচ্ছিলো তারা। হঠাত ই মলি থেমে যায়। চোখ চলে যায় শো রুমের শেষ প্রান্তে একটা মিররের দিকে একটা কাপলের দিকে।
মলির চোখ অনুসরণ করেই রুমকি ও চোখ ঘুরালো, একটা কাপল, মেয়ে টা একটা হ্যান্ডসাম ভদ্রলোক কে টাই বেধে দিচ্ছে, হয়তো টাই চয়েজ করে দিচ্ছে। রুমকি কিছু বুঝে উঠার আগেই মলি বের হয়ে যাচ্ছে দেখে সেও মলির পিছন পিছন ছুটলো।
প্রায় আধঘন্টা যাবত একটা কফি শপে বসে আছে মলি আর রুমকি। মলি চুপচাপ চোখের জল ফেলছে কিছুই বলছে না। তারো ১৫ মিনিট পর ফাহাদ এসে জয়েন করলো তাদের।
কফির মগে দুই চুমুক দিয়ে মলি বলতে শুরু করলো,
— শো রুমে ওই কাপলের মাঝে ভদ্রলোক টা আমার হাসবেন্ড, আবিদ। তার সাথে যে মেয়ে টা ছিলো সে তার অফিসের ই স্টাফ, কেয়া। আজ প্রায় ২ বছর যাবত তাদের মাঝে সম্পর্ক, আমি সব জানি জেনেও আবিদ ও কেয়া থেমে নেই।
রুমকি অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে কথা গিললেও ফাহাদ যেনো খুব সাভাবিক। মলি ঠান্ডা গলায় বলতে লাগলো,
—- মেয়েটা সিংগেল মাদার,১০/১১ বছরের একটা ছেলে বাবু আছে তার। তাও সে কত স্মার্ট, ফিট আর আবিদের সাথে মানানসই। আমার মতোন ব্যাকডেটেড তো না। দুই সন্তানের জননী এই আমার পরিচয়, আমাকে আবিদ কখনো ছাড়বে না, কারণ সে চায় না তার বাচ্চারা ব্রোকেন ফ্যামিলির অংশ হোক। কিন্তু আমাকে আবিদ ওই অতটুকুই প্রাপ্য অধিকার হিসেবে দিয়েছে, যে আমি তিতলি তোতনের মা। আর কিছুই না।
— রুমকি চাপা চিতকারে বলে উঠে, তুমি মেনে নিলে কেনো? তুমি তাকে কিছু বলো নি?
—- আমি চেষ্টা করেছি, সবচেয়ে বেশি কষ্ট পেয়েছি আমার বাবার বাড়ি থেকে। তারা ভাবেন আমি বউ হিসেবে ঠিক না, কেমন বউ হলাম যে জামাই পর নারী আসক্ত হয়? এসব বলে ঢুঁকরে কেঁদে উঠে মলি।
রুমকি মলির হাত চেপে ধরে বলে,
— কেঁদো না প্লিজ, এখন কি করবে ঠিক করেছো। আবিদ ভাইয়ার সাথে কথা বলেছো সরাসরি? কি বলেন তিনি।
—ফাহাদ একটা টিস্যু মলির দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে তুমি সরাসরি কথা বলো, এভাবে কি হয় নাকি?
মলি ফাহাদের হাত থেকে টিস্যু নিয়ে বলল,
— বলেছি একবার না বহুবার বলেছি। কোনো লাভ নেই। আমার মাঝে আগের মতোন ভালোবাসা খুঁজে নাকি পায় না। আসলে ভালোবাসা বললে ভুল হবে, আকর্ষণ পায়না। মলি কথা গুলো বলে লজ্জায় চোখ নামিয়ে বলে প্লিজ বাদ দাও। এসব আমি বলে তোমার মুড অফ করে দিতে চাইনি। চলো বাসায় যাই সবাই। এমনিতেও অনেক রাত হয়ে গিয়েছে।
রুমকি আর ফাহাদ কথা খুঁজে পায়না মলি কে কিভাবে স্বান্তনা দিবে, কি বলবে তাকে। তারপর ও ফাহাদ বলে উঠে,
—– জীবন কি কারো জন্যে থেমে থাকে বলো? সবচেয়ে পজিটিভ দিক কি জানো? উনি তোমাকে ডিভোর্স দিতে চাচ্ছেন না, তার মানে দিন শেষে তোমার কাছেই ফিরে আসবেন বলে ঠিক করে রেখেছেন।
— রুমকি টেবিল চাপড়ে উঠে, এটার মানে কি। এভাবে তাই বলে মলি চুপ থাকবে সব সহ্য করবে? আমার ত ইচ্ছে হচ্ছে ওই মেয়ে কে, উফফ মেয়ে না মহিলা বুঝলা। মহিলা কে মাথার চুলের মুঠি ধরে দেয়ালে কয়েকটা বাড়ি দিতে। অসভ্য মেয়ে মানুষ।
মলি আর ফাহাদ রুমকির এক্সপ্রেশন দেখে হেসে ফেলে, মলি বলে উঠে প্লিজ বাদ দাও, কিন্তু ফাহাদের চোখে দ্যুতি খেলে উঠে। তারপর কি ভেবে বলে,
—- তোমাকে নিজেকে চেইঞ্জ করতে হবে মলি। চেইঞ্জ বলতে সব দিক থেকে আর সবচেয়ে বেশি চেইঞ্জ আনতে হবে নিজের কনফিডেন্সের ব্যাপারে। নিজেকে ছোট ভাবা বাদ দাও, তাহলে আবিদ কেন আমিসহ আরো অনেকেই দেখবা পটে যাবো। ফাহাদের বলা শেষ লাইন শুনে মলি আর রুমকি হেসে ফেলে।
চলবে…….