শ্বশুর বাড়িতে সাধারণ দোকান থেকে কেনা এক কেজি মিষ্টি আর ফুটপাত থেকে কেনা এক কেজি আপেল নেওয়ার দরুন আমার স্ত্রীর দুই ভগ্নিপতি অর্থাৎ আমার দুই ভায়রাভাই আমাদের উদ্দেশ্যে অনেকটা তাচ্ছিল্যের স্বরেই বলে উঠলো,
-বাহ! নিশির জামাইতো পুরো মিঠাই ব্রান্ডের সবচেয়ে দামী মিষ্টিটা নিয়ে এসেছে এই জন্যইতো আব্বা আম্মার আমাদের এই সাধারণ দই রসগোল্লা কখনোই পছন্দ হয়নি বরং তাঁরাতো মারুফের ঐ ব্রান্ডের মিষ্টিটাই সাদরে গ্রহণ করলো। আমরা বোধহয় আব্বা আম্মাকে আমাদের এই সাধারণ দই রসগোল্লা দিয়ে কোনোদিনই খুশি করতে পারবো না।
দুই ভায়রাভাইয়ের এহেন তাচ্ছিল্যমাখা কথোপকথনের সাথে নিশির দুই বোনও খানিকটা মুখ লাগিয়ে বললো,
-তোমরা আর কীভাবে খুশি করতে পারবে বলোতো? তোমরা বাবা মায়ের জন্য যদি বসুন্ধরা সিটি থেকে সবচেয়ে দামী মিষ্টিটাও এনে দাও তবুও তাঁরা খুশি হবেনা। কারণতো একটাই আর তা হলো আমরা নিজেদের পছন্দ অনুযায়ী বিয়ে করেছি আর নিশিকে বাবা মা তাঁদের পছন্দে বিয়ে দিয়েছে। এটাই হলো দোষ বুজছো?
নিশির বড় দুবোনের কথা শুনে স্বভাবতই আমি আর নিশি চুপ হয়ে গেলাম। কারণ এখানে তাঁরা আমাদের মুখের উপর যে কথাগুলো বললো তাতে পাল্টা যুক্তি দেখানোর কোনো অপশনই আমার কাছে নেই। তৎক্ষনাৎ আমার শাশুরী আমাদের বসে থাকার রুমে প্রবেশ করতেই সবাই চুপ হয়ে গেলো। কারণ তাঁরা জানে আমার শাশুরীর সামনে এসব বলা মানে নিজেদের পায়ে কুড়াল মারার অনুরূপ। শাশুরী আম্মা রুমে প্রবেশ করেই সকলের উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,
-এই তোরা সবাই খাবার টেবিলে আয় খাবার রেডি করেছি। তোদের আব্বাও অপেক্ষা করছে।
পরমুহূর্তেই শাশুরী মা আমার দিকে তাকিয়ে খানিকটা মুচকি হেসে বললেন,
-আর তোমার পছন্দের বেগুন দিয়ে ইলিশ মাছটা কিন্তু খুব ভালো করে রান্না করেছি। তাড়াতাড়ি আসো!
শাশুরী মায়ের কথায় আমি তাকে পাল্টা হাসি ফেরত দিলেও আড়চোখে আমার দুই ভায়রাভাই আর নিশির দুই বোনের দিকে তাকাতেই বুঝতে পারলাম তাঁরা এই বক্তব্যে বেশ ক্ষুব্ধ এবং বিরক্ত। নিশির বড় বোন নীলা বিরক্তিমাখা কন্ঠে আমার শাশুরীকে বলে উঠলো,
-আচ্ছা মা! তোমার কী জামাই শুধু ঐ একটাই? তোমার কী আর দুটো জামাইয়ের দিকে নজর পরে না?
শাশুরী মা কিছুটা অবাক নয়নে নীলার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
-কেনো কী হয়েছে?
-কী হয়েছে মানে? তুমি তোমার ছোট জামাইয়ের পছন্দমতো সবকিছু রান্না করে দাও আমাদের জামাইয়ের কী কোনো পছন্দ নেই?
-তো আমি কী কারো অপছন্দের কিছু রান্না করি নাকি? তোদের জামাইয়ের যদি কোনো পছন্দ থাকে তাহলেতো বললেই পারিস আমি ওদের পছন্দমতো রান্না করে দিবো। এতে আবার হিংসার কী আছে?
শাশুরী মায়ের কথায় স্বভাবতই নীলা চুপ হয়ে গেলো তবুও তাঁর মুখে তখনো একটু বিরক্তির আভা ছড়িয়ে ছিলো।
নীলা আর মিলা দুজনেই নিজের পছন্দসই বিয়ে করেছিলো যাকে বলে লাভ ম্যারেজ। নিশির মুখে যতটুকু শুনেছি যে আমার শ্বশুর মশাই ওদের তিনবোনের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনোদিনই যাননি। তাই নীলা আর মিলা যখন নিজেদের ভালোবাসার কথা আমার শ্বশুর মশাই কে জানায় তখন তিনি আর তাতে উচ্চাবাচ্য না করে তাঁদের পছন্দসই বিয়ে দিয়ে দেন। এদিকে নিশিকে আমার শ্বশুর ছোট মেয়ে হওয়াতে বড় দুজনের থেকে একটু বেশিই ভালোবাসতেন। আমার স্ত্রী নিশি পড়ালেখাতে বেশ মনোযোগী হওয়াতে সেভাবে প্রেমের দিকে আগবাড়ায়নি। নিশির সাথে আমার বিয়েটাও হয় বেশ অদ্ভুতভাবে।
আমি কলেজে ওঠার পর থেকেই স্বেচ্ছায় রক্তদান করতাম তাই একদিন আমার বন্ধু তারেক আমাকে বলে যে অতিদ্রুত এক মুমূর্ষু ব্যাক্তিকে রক্ত দিতে হবে। আমি তখন রাজি ছিলাম না কারণ আমি গত আড়াইমাস আগেই একজনকে রক্ত দিয়েছিলাম আর চারমাস পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত রক্ত দেওয়া ঠিক নয় কেননা এতে শরীরে রক্তশূণ্যতা দেখা দিতে পারে। তবুও তারেকের অনেক জোরাজুরি আর রোগীর মুমূর্ষু অবস্থা বিবেচনা করে সেদিন আমার শ্বশুরকে এক ব্যাগ রক্ত দিয়েছিলাম যদিও তিনি তখনও আমার শ্বশুর হননি। আমার রক্ত দেওয়ার সময় না হওয়া সত্ত্বেও আমি রক্ত দেওয়াতে তারেক আমার সম্বন্ধে যত ভালো কিছু ছিলো তার সবকিছুই সে তাঁদের সাথে শেয়ার করেছিলো। আমার বন্ধুর মুখে আমার এতো গুণগান শুনে তাঁরাও আমার প্রতি বেশ দুর্বল হয়ে গিয়েছিলো। তখন আমি সবে পড়ালেখা শেষ করে একটি বহুজাতিক কোম্পানিতে ছোটখাঁটো মানের চাকুরী জুটিয়ে নিয়েছিলাম।
সেদিন থেকেই আমার শ্বশুর শাশুরীর সাথে আমার সম্পর্কটা অনেকটা আপনজনের ন্যায় হয়ে গিয়েছিলো। সত্যি বলতে আমি বহু জায়গায় রক্ত দিয়ে অনেক মানুষের প্রাণ বাঁচিয়েছিলাম কিন্তু প্রায় সবাই কৃতজ্ঞতা স্বরূপ অল্প কিছুদিনের জন্য আমার খোঁজখবর নিয়ে চিরতরে হারিয়ে যেত। যদিও আমি এসবের জন্য কখনোই রক্ত দিতাম না বরং মানবতার খাতিরে নিঃস্বার্থভাবে মানুষকে রক্ত দিতাম।
একদিন আমার শ্বশুর মশাই আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন,
-তো বিয়ে করবে কবে?
-জ্বী আংকেল বাড়িতে মেয়ে দেখা হচ্ছে।
-তুমি যদি কিছু মনে না করো তবে তোমার বাবার নাম্বারটা আমাকে দাও। তাঁর সাথে আমি কথা বলতে চাই।
আমি তখন কিছু না ভেবেই আমার বাবার নাম্বারটা তাকে দিয়েছিলাম। এরপর আমার শ্বশুর বাবার সাথে কী কথা বলেছিলেন তা আমার জানা নেই কিন্তু এর পরদিনই আমার বাবা মা সহ কিছু আত্মীয়স্বজন বরিশাল থেকে চট্টগ্রামে চলে আসেন। অতঃপর সবার সম্মতিতে আমার সাথে নিশির বিয়ে হয়।
এসব ভাবতেই ডাইনিং রুমে প্রবেশ করলাম। আমার শ্বশুর স্থিরচিত্তে খাবার টেবিলের একটি চেয়ারে বসে আছেন আর তাঁর পাশের চেয়ারটা আমার জন্য সংরক্ষিত রেখেছেন। এটা সবাই জানে যে আমি যদি শ্বশুর আব্বার পাশে না বসি তবে তাঁর সেই বেলার ভাত হজম হবেনা। তিনি জানেন যে আমার প্রতি তাঁর ভালোবাসার মাত্রাটা বেশি থাকায় অন্য দুই জামাই বেশ হিংসা করে। তবুও তিনি বেশ চালাক চতুর প্রকৃতির হওয়াতে সবকিছু অতি সহজেই সামাল দেন। আমি সাধারণ একটি কোম্পানিতে চাকুরী করলেও নীলা আর মিলার জামাই বেশ বড়মানের ব্যবসায়ী এবং তাঁদের মধ্যে সম্পর্কটাও বেশ বন্ধুত্বপূর্ণ কেননা তাঁরা দুজনেই শেয়ারে ব্যবসা করেন।
.
প্রায় একমাস পরের ঘটনা…
আমি অফিসে কাজ করছিলাম হঠাৎই আমার শাশুরী মায়ের ফোন পেয়ে অফিস থেকে তৎক্ষনাৎ উঠে যাই এবং নিশিকে ফোন দিয়ে বলি,
-তুমি তাড়াতাড়ি রেডি হও এখনি তোমাদের বাড়িতে যেতে হবে।
নিশি আমার কথা শুনে বেশ ভয় পেয়ে কিছু একটা বলার আগেই আমি ফোন রেখে বাসার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম। বাসায় আসতেই নিশি আমাকে বারবার জিজ্ঞেস করছে কী হয়েছে তবুও তাকে কিছু না বলেই ঢাকা থেকে চট্রগ্রামের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেই। কিন্তু শ্বশুর বাড়িতে উপস্থিত হতেই শ্বশুর আব্বাকে সম্পূর্ণ সুস্থ দেখে আমি বেশ অবাক হয়ে যাই কেননা আমার শাশুরী বলেছিলেন তিনি নাকি রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় এ্যাক্সিডেন্ট করেছিলেন। এসব দেখে নিশি বেশ রাগান্বিত স্বরেই আমাকে বললো,
-তোমার সমস্যাটা কী বলোতো? মা কী একটা ফোনে বললো আর ওমনি তুমি আমাকে নিয়ে চলে আসলা? তুমি জানো না যে আমি বাসে চলতে পারিনা আর আমি এতো কিছু জিজ্ঞেস করার পরও কিছু বললা না। কতটা চিন্তা হয়েছিলো আমার জানো?
নিশির কথা শুনে আমি বেশ ইতঃস্তত ভঙ্গিতে বললাম,
-মা তো বললো বাবা নাকি এ্যাক্সিডেন্ট করেছে। আর তোমাকে বললে তুমি পুরো রাস্তায় পাগলের ন্যায় অচেতন হয়ে থাকতে তাই কিছু বলিনি।
নিশি এরপর আমাকে কিছু না বললেও আমার শাশুরীকে বেশ কথা শুনিয়ে দিলো কিন্তু আমার শাশুরী শুধু একটি কথাই বললেন,
-আমি কিছু জানিনা এসব তোর বাবার বুদ্ধি।
আমরা সকালে শ্বশুর বাড়ি পৌঁছালেও বিকালের দিকে নীলা আর মিলা তাঁর হাসবেন্ড সহ শ্বশুর বাড়িতে উপস্থিত হলো। যখন তাঁরাও শ্বশুর মশাইকে সম্পূর্ণ সুস্থ দেখলো তখন স্বভাবতই তাঁরা বেশ রাগান্বিত হলো বিনা কারণে তাঁদেরকে এভাবে মিথ্যা বলে হয়রানি করার জন্য। তবে একটি বিষয় আমার নিকট বেশ অবাক লাগলো আর তা হলো নীলা আর মিলার বাসা যতটুকু দূর আমি থাকি তার থেকেও তিনগুণ দূরে তবুও তাঁরা এতো দেরীতে কেনো আসলো? আমার শ্বশুর যতই হয়রানি করুক না কেন তাঁদের উঁচিত ছিলো আমার বহু আগেই তাঁদের শ্বশুর বাড়িতে উপস্থিত হওয়া। এসব ভাবনা চিন্তার অবসান ঘটতেই আমাদের সবাইকে আমার শ্বশুর বসার রুমে এক করে বললেন,
-তোমাদেরকে বিনা কারণে হয়রানি করার জন্য আমি খুবই দুঃখিত তবে এটার ভিতরেই অনেক তাৎপর্য লুকিয়ে আছে।
সবাই জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে শ্বশুর আব্বার দিকে তাকাতেই তিনি আবার বলে উঠলেন,
-আমি জানি তোমরা সবাই খুব হিংসা করো যে আমি ছোট জামাইকে তোমাদের থেকে কেন এতো বেশি ভালোবাসি? তোমরা হয়তো এও ভাবো যে আমি নিশিকে নিজের পছন্দ করা ছেলের সাথে বিয়ে দেওয়াতেই তাকে বেশি ভালোবাসি। আসলে এসবের কিছুই না, আজকের ঘটনাটাই একবার দেখো। এই যে আমার সামান্য এ্যাক্সিডেন্টের খবর পেয়েই আমার ছোট জামাই চাকরীবাকরী ছেড়ে সুদূর ঢাকা থেকে তোমাদের আগেই চলে আসলো। অথচ তোমরা তাঁর থেকে বহু কাছে থাকা সত্ত্বেও কতটা দেরীতে এসেছো উল্টো তোমাদের উচিৎ ছিলো ওর অনেক আগেই আসা। আমার হয়তো কোনো ছেলে নেই তবুও আমি কখনোই একটি ছেলের শূণ্যতা অনুভব করিনি। কারণ আমার ছোট জামাই আমার যেকোনো বিপদের মুহূর্তে একটি ছেলের ভূমিকায় আমাকে সাহায্য করে। শ্বশুর বাড়িতে শুধু নামিদামী দই রসগোল্লা নিয়ে আসলেই ছেলের ভূমিকা পালন করা যায়না বরং তাঁরা জামাই হয়েই থাকে। এখন তোমরাই বলো ভালোবাসাটা কী শুধু জামাই নামক ব্যক্তিটিই বেশি পাবে নাকি জামাইরূপী ছেলের ভূমিকায় থাকা ব্যক্তিটি বেশি পাবে? প্রশ্নটা তোমাদের নিকট রইলো।
শ্বশুরের এহেন বক্তব্যে পুরো রুমে এক শুনশান নীরবতা বিরাজ করছে। হঠাৎই আমার স্ত্রী নিশি বসা থেকে উঠে অন্যরুমে চলে গেলো। ওর এভাবে উঠে চলে যাওয়া দেখে আমিও ওর পিছুপিছু সেই রুমে উপস্থিত হলাম। নিশিকে উল্টো দিক থেকে আমার সামনে ঘুরাতেই ওর চোখে জল দেখে জিজ্ঞেস করলাম,
-কী হয়েছে তোমার কাঁদছো কেন?
-আচ্ছা তুমি এতো ভালো কেন বলোতো? আমি আগে জানতাম তুমি আমার নিকট পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ স্বামী কিন্তু আজ দেখছি তুমি কেবল স্বামী হিসেবেই শ্রেষ্ঠ নও বরং একজন ছেলে হিসেবেও পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি।
নিশির কথায় আমি কিছুটা মুচকি হেসে বললাম,
-কী করবো বলো? আল্লাহ আমাকে বানিয়েছেনই সবকিছুতে শ্রেষ্ঠ হওয়ার জন্য এতে আমার কী দোষ? প্রভুর নিকটই নাহয় কারণটা জিজ্ঞেস করো তিনি কেনো আমাকে এতো শ্রেষ্ঠ করে বানিয়েছেন?
নিশি আমার কথায় আর কিছু বললো না তবে ওর নীরব হয়ে আমার বুকে লুকিয়ে থাকার মাধ্যমেই জানান দিচ্ছে যে আমার মতো স্বামী পেয়ে সে সত্যিই প্রভুর নিকট কৃতজ্ঞ। আর এটাইতো আমার মতো পুরুষের জীবনের লক্ষ্য।
.
(সমাপ্ত)