আমার স্বামী মাসের প্রথমে তার বেতনের সব টাকা আমার হাতে তুলে দিলেও, তার এক পয়সা খরচ করার অধিকার আমার ছিলো না। কোনো জিনিসের প্রয়োজন হলে নিজেই কিনে এনে দিতো। তবুও আমার হাতে টাকা খরচ করতে দিতো না। মাসের শেষে কড়ায়গণ্ডায় সব হিসাবও বুঝে নিতো। এসব নিয়ে আমার অবশ্য তেমন সমস্যা ছিলো না। সমাজে ভালো নামক তকমাটা পেতে গেলে চোখ থাকতে অন্ধ আর মুখ থাকতেও বোকা সাজতে হয়। কালেভদ্রে নিজের কাছে খারাপ লাগলেও কখনো মুখ ফুটে কারো কাছে কিছুই বলিনি।
গতকাল আমার ভাই কল দিয়ে বললো, ‘ আপু ১০০০ টাকা দিতে পারিস। কলেজে লাগবে, মা আব্বু বাকি সব জোগাড় করতে পারলেও এক হাজার টাকা কারো কাছে পায়নি। শেষ ভরসা হিসাবে তোকে কল দিলাম। “
মধ্যবিত্ত পরিবারে যদি বাবার বয়স বাড়ে, আর কোনো নিদিষ্ট উপার্জনের পথ না থাকে। তখনই অভাব কাকে বলে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ভাইটা সবে সবে কলেজে ভর্তি হবে। কমপক্ষে পাঁচ হাজার টাকা তো লাগবেই। সবই আমি বুঝতে পারি। কিন্তু কিছু করার উপায় নেই। আমার নিজের কাছে পাঁচশ টাকার মতো আছে। বেশ কয়েকমাস ধরেই জমা পড়ে আছে ডাইরির পাতার ভাঁজে। বাকি টাকাটা ও-র কাছে চাওয়া ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই।
সকালে খাওয়ার সময় স্বামীকে বললাম
–” আমাকে পাঁচশ টাকা দিবে?’
–” এতো টাকা দিয়ে তুমি কি করবে?’
–” আসলে ভাইয়ের ভর্তি হতে লাগবে। তুমি দিলে অনেক উপকার হতো। ‘
–” কেন তোমার মা বাপ সব মরে গেছে নাকি? যে তোমার ভাইয়ের কলেজে ভর্তির টাকা আমার দেওয়া লাগবে। মাসের শেষে পাঁচশ টাকা মানে বোঝো তুমি? টাকা রোজগার করতে কেমন লাগে তা তুমি ঘরে বসে বুঝবে কি করে! আমার কাছে কোনো টাকা পয়সা নেই। “
মাসের শেষে যে হাতে টাকা থাকে না এটা আমি বেশ ভালোই বুঝতে পারি। তবে স্বামীর দেওয়া উত্তরটা কেন জানি কানে বেজে চলছে। কলেজে ভর্তি হওয়া যে পাঁচশ টাকায় হয় না তা আমার স্বামীকে আলাদা ভাবে বলে দেওয়ার দরকার হয় না। নিজে থেকেই বুঝতে পারে।
। ফারহানা মানাল।
সেদিনের পর থেকে কখনো স্বামীর কাছে টাকা চাওয়ার প্রয়োজন পড়েনি আমার। খুব বেশি প্রয়োজন হলেও নিজের জন্য বা বাপের বাড়ির কারোর জন্য কিছুই চাইনি। আমার স্বামী অবশ্য সেদিন অফিস থেকে ফেরার পথে কেজি খানেক গরুর গোশত আর পোলাও চাল এনে বলেছিলো বিরিয়ানি রাঁধতে, অনেকদিন খাওয়া হয়নি। তার জন্য রান্না করেছিলাম ঠিকই কিন্তু আমার গলা দিয়ে অমন সুস্বাদু খাবার নামেনি।
পরেরদিন আমার ভাই এসেছিলো অনেক আশা করে, বিয়ের আগে কয়েকটা টিউশনি করাতাম তখন বোনের কাছে কিছু আবদার করলে না পাওয়া হয়নি। সেই ভরসা নিয়েই হয়তো এসেছিলো, বুঝতে পারেনি তার বোন আজ আর অবিবাহিত নেই। তাদের পরিবারের সদস্য নেই। সমাজের মতে বিয়ের পর মেয়েদের স্বামী সন্তানই সব। মা বাবা ভাই বোন নেহাৎ তার বাড়ির আত্মীয় মাত্র। যুগ যুগ ধরে চলে আসা এই নিয়মের বাইরে যাওয়ার অধিকার হয়তো কোনো মেয়েই নেই। কেউ কেউ অতিরিক্ত ভাগ্যবতী বলেই এই নিয়ম তাদের স্পর্শ করতে পারেনি। তাদের ব্যাপার হয়তো আলাদা।
ছোট বেলায় খালামনি একজোড়া রূপার নুপুর বানিয়ে দিয়েছিলো। তেমন পায়ে দেওয়া হয় না। সেই নুপুর জোড়া ভাইয়ের হাতে তুলে দিয়ে বলেছিলাম,
–” মাসের শেষ, তোর দুলাভাইয়ের কাছে টাকা নেই। এই জোড়া বিক্রি করে দে। আমি তো এসব পরি না। “
ভাই হাত পেতে নুপুরজোড়া নিয়ে ছিলো বটে, তবে চোখের পানিটা আড়াল করতে পারেনি। খাওয়ার টেবিল থেকে রাতে বেঁচে যাওয়া অবশিষ্ট বিরিয়ানির সুবাস হয়তো তাকে বুঝিয়ে দিয়েছিলো তার বোনের জীবনের আবছা কিছু অংশ। স্কুল পাশ করা ছেলের বয়স তো খুব একটা কম নয়।
ভাই চলে যাওয়ার পর স্বামী অবশ্য জানতে চেয়েছিলো ভাই কেন এসেছে, বলেছিলাম আমাকে দেখতে এসেছে। আমার কাছে থাকা তার বেতনের অবশিষ্ট টাকাগুলো গুনতে গুনতে বলেছিলো, তা ও-কে খেয়ে যেতে বললে না কেন, শালাবাবুর তো বিরিয়ানি অনেক পছন্দের।
উত্তরে আমি শুধু মুচকি হেসেছিলাম। এসব সামান্য কারণে সংসার ফেলে চলে যাওয়ার মতো মেয়ে আমি নই। একা থাকতে পারার সাহস যোগাতে পারলেও সমাজে তিক্ততা মেনে নেওয়ার সাহস আমার কখনোই হবে না। স্বামী সংসার ছেড়ে যাওয়ার চিন্তা আমার মাথায় আসেনি। শধু মনের কোথাও একটা গভীর ক্ষত হয়েছিলো। যে ক্ষত থেকে ব্যাথা ক্রমশ আমার ভিতরে ছড়িয়ে পড়েছে। কষ্টে চোখের পানি বেরিয়ে এসেছে, বুকে তীব্র ব্যথা অনুভব হয়েছে। পরে আবার ক্ষতটা শুকিয়েও গেছে। আচ্ছা এসব ক্ষত কি কখনো শুকিয়ে যায়?
সমাপ্ত
#জীবনের_কয়েকটা_পাতা
কলমে ঃ- #ফারহানা_কবীর_মানাল